চায়ের অতিথি
চায়ের অতিথি
গল্পটি শুরু করার আগে দস্তুর অনুযায়ী আমার একটি ছোট্ট পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। আমার নাম সুপ্রসন্ন চৌধুরী। কলকাতার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। স্কুলের চাকরিটা পেয়েছি প্রায় বছর তিনেক। নিজেকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে আবিষ্কার করে, দীর্ঘদিনের লেখালিখির সুপ্ত বাসনাকে ইদানিং একটু প্রশ্রয় দিয়েছি। লেখক বলে আমার কোনো পরিচিতি নেই, ফলে দায়বদ্ধতাহীন লেখার স্বাধীনতাও বেশ উপভোগ করি।
বাবা, নন্দ দুলাল চৌধুরীর চাকরি সূত্রে আমরা কলকাতায় থাকলেও বর্ধমানের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম নখোলায় আমাদের একটি ভিটে বাড়ি আছে। বাবার কাছে শুনেছি প্রথমে নয়টি ব্রাহ্মণ ঘর নিয়ে নাকি সে গ্রামটি গড়ে ওঠে, এবং সেই থেকেই গ্রামটির নাম নখোলা। বর্তমানে গ্রামটির রূপ সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই।
মা বেঁচে থাকা কালিন বাবা নিয়ম করে বছরে একবার গ্রামের বাড়িটিতে যেতেন জমি জায়গার তদারকি করতে। মা গত হয়েছেন দু'বছর আগে। তারপর থেকেই বাবার শারীরিক ও মানসিক উভয় কারনেই সেই বার্ষিক নিয়মে ছেদ পড়েছে। গতবছর বাবা চিন্তিত সুরে আমায় ডেকে বললেন, “আমার তো বয়স কম হলো না। এবার তুমি একটু দায়িত্ব নাও। এবার স্কুলের গরমের ছুটিতে গ্রামের বাড়িটা একবার ঘুরে এসো। সেই তো কোন ছোটবেলায় গিয়েছিলে। নিজের ভবিষ্যতের সম্বলটুকু দেখে বুঝে নেওয়াই উচিত, নচেৎ যেটুকু আছে তাও বেহাত হয়ে যাবে।”
বাবার সে নির্দেশ অপ্রতিবাদে মেনে নিয়েছিলাম। অবশ্য তার পেছনে একটি বিশেষ কারণ ছিল। গ্রামের চিত্রটি আমার কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। আমি যখন শেষবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন আমার বয়স দশ কি বারো। নেহাতই বালক। দুর্বল স্মৃতিতে মনে রাখার মতন অবশিষ্ট যেটুকু আঁকড়ে ছিল তা হল আমাদের ঘরের চৌকাঠ থেকে প্রায় দশ গজ দূরে অবস্থিত একটি মাঝারি মাপের পুকুর, আর তার পাড় জুড়ে আম, জাম ও কাঁঠাল ইত্যাদি সুফলা গাছের ভিড়। আমার লেখার রসদ জোগাতে পারে এমন একটি সম্ভাবনার ওপর ভর করেই আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
স্কুলে গরমের ছুটি শুরু হলে আমি লোটাকম্বল গুটিয়ে সপ্তাহখানেক এর জন্য রওনা দিলাম নখোলা গ্রামের উদ্দেশ্যে। বিদেশ যাত্রা নয়, তাই আয়োজনও ছিল আরম্বর বিহীন। আমাদের গ্রামের বাড়িতে দেখাশোনা করার জন্য এক ব্যক্তিকে মাসোহারায় নিযুক্ত করা হয়েছিল। যাত্রার পূর্বে ডাকযোগে বাবা একটি চিঠি তার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সতর্ক করার মতন বাবা যেটুকু বলেছিল তা হল, “গ্রামে একটিই সমস্যায় তোমায় পড়তে হবে, তার হলো ইলেকট্রিসিটি। কলকাতায় আলো আর ফ্যানের হাওয়ায় বড় হয়েছো বটে, তবে এগুলি ছাড়াও রাত্রিযাপনের এক অনাবিল আনন্দ তুমি সেখানে পাবে। অপূর্ব প্রকৃতি তোমায় মাতিয়ে রাখবে, আর সবচেয়ে বড় কথা গ্রাম্য মানুষগুলির অবিমিশ্র ব্যবহার ও আপ্যায়ন এই যান্ত্রিক শহরে দুর্লভ।”
শিয়ালদহ থেকে বর্ধমান লোকালে যখন চড়লাম তখন সকাল সাড়ে দশটা। ভিড় এড়াতে রবিবারকেই বাছাই করেছিলাম যাত্রার জন্য। তবে আমার সে পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে কামরাটি ভেসে গেল জনজোয়ারে।
ট্রেন যখন বর্ধমান স্টেশনে প্রবেশ করল তখন ঘড়ির কাটায় দুপুর একটা। পেটে খিদের উৎপাতটা ইতিমধ্যেই তীব্র হয়ে উঠেছিল। পথ তখনও অনেকটা। বাবার দেওয়া পথনির্দেশ মেনে প্রথমে বাস ও পরে রিকশায় চেপে নখোলায় পৌঁছতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক লেগে গেল। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে তখন আমি আধখানা। প্রখর সূর্যের তাপ ও গুমোট পরিবেশ আমার ভেতরে উৎসাহগুলিকে ইতিমধ্যেই শোষণ করে নিঃশেষিত করেছিল।
নখালি গ্রামে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। রাস্তাঘাট গুলি ইট পাতা সাপের মতো আঁকাবাঁকা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বিস্তৃত। গ্রামে বাড়িঘরের সংখ্যাই যে শুধু বেড়েছে তাই নয়, তাতে কিছু কিছু আধুনিকতার ছাপও ছিল লক্ষণীয়। তবে বেশিরভাগ বাড়ি গুলিই মাটির দেওয়াল আর টালির চালায় তৈরি। গাছের প্রাচুর্য রাস্তার উপর বিছিয়ে রেখেছে ক্লান্তি নাশক ছায়া।
পথ ধরে খানিকটা এগোতেই একজন পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আমায় দেখা মাত্রই দূর থেকেই হাত উঁচিয়ে এবং দন্ত উন্মোচিত হাসি নিয়ে আমার দিকে এক প্রকার দৌঁড়ে এগিয়ে এলো।
“দাদা বাবু, আসেন। পথে অসুবিধা হয়নাই তো? তা কত্তা বাবু কেমন আছেন?”
এহেন প্রশ্নের বান আমাকে আরো যেন ক্লান্ত করে তুলল। বুঝতে পারলাম উনি আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার। আমার শহুরে পোশাক দেখেই আমাকে চিনতে পেরেছে। আমি এক প্রকার বিরক্ত হয়ে বললাম, “সব ঠিক আছে। বাড়িটা এখান থেকে আর কতদূর।”
“আজ্ঞে, সামান্য দূর। আমারে লক্ষ্য কইরা আসেন। দেন বোঝাটা আমারে দেন”, বলেই আমার হাতর ব্যাগটা সেই প্রৌঢ় নিজের দায়িত্ব নিয়ে নিল। তার সেই সামান্য দূরত্বটুকু পেড়তে আমার বিশ মিনিট লেগে গেল।
বাড়িটায় পৌঁছে কিছু স্মৃতি যেন ধুলো ছেড়ে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ইটের দেয়াল গাঁথা দুটি ঘর বিশিষ্ট বাড়ি। দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় মেরামতির ছাপ স্পষ্ট। দক্ষিণমুখী দরজার ওপারে পুকুরটি অক্ষত, তবে দীর্ঘ অব্যবহারে ফলে, বর্তমানে তাতে ঘন কচুরিপানার আস্তরণ তার রুপ খর্ব করেছে। পুকুর পারের গাছগুলির সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে মনে হলো, তবে এখনো যা আছে কলকাতাবাসীদের কাছে কল্পনাতীত। চারিপাশে যেন এক নিরবচ্ছিন্ন সবুজের মেলা।
“বাবু খাবারের ব্যবস্থা করি?”
প্রশ্নটা শুনে যেন আমার ঘোর ভাঙলো।
“হ্যাঁ, তা তো বটেই। দুপুর থেকে পেটে কিছু পরেনি। আচ্ছা আপনার নামটা তো জানা হলো না।”
“আজ্ঞে, আমার নাম নবীন বারুই। আপনার বাবা, মানে কত্তা মশাই আমায় ননে বলে ডাকে। আপনি বরং একটু জিরিয়ে নেন ততক্ষণ।”
নামটা শুনে মনে মনে একটু হাসলাম। প্রবীণ মানুষটি নামের মধ্যেই নিজের যৌবনকে কেমন ধরে রেখেছেন।
খাবার এলো প্রায় চল্লিশ মিনিট পর। পরিবেশন করে প্রবীণ মানুষটি হাত পাখা নিয়ে সেবায় উদ্যত হলে আমার বেশ অস্বস্তিই হলো। আমার বারংবার প্রতিবাদেও তাকে দমন করা গেলনা। আমার যত্নের ব্যাপারে হয়ত বাবার দেওয়া বিশেষ নির্দেশই তিনি পালন করে চলেছিলেন। যাইহোক, মাছে ভাতে বেশ তৃপ্তিতেই খাওয়া সারলাম। মনে মনে রাঁধুনির গুনের প্রশংসাও করলাম। তারপর তন্দ্রাতুর শরীরটা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। শরীরের অপার ক্লান্তি এবং ক্ষুধা নিবারণের তৃপ্তি অবলিলায় আমায় ঘুমের রাজ্যে টেনে নিয়ে গেল।
কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল আকাশ জুড়ে আমার সে হুঁশ ছিলোনা। ক্রমশ গাছের নিচের অন্ধকার আরো ঘন হয়ে উঠতে লাগলো। ঘুম ভাঙলো নবীনের ডাকে, “দাদা বাবু, আপনার জন্যি চা আনসি। ওঠেন।”
ঘরে একটি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিল নবীন। তাতে আলো আঁধারির এক অপূর্ব রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হলো। শহুরে অভ্যস্ত কোলাহল বর্জিত সে পরিবেশ আমার মনকে আপ্লুত করে তুললো। ইতিমধ্যেই হালকা শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে। হাতে ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে এসেছে নবীন। তার প্রাপ্য ধন্যবাদ তাকে জানালে, সে লজ্জায় মুখ নিচু করে বললো, “কি বলেন বাবু, এ তো আমার কাজ।”
ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা ছিল। নবীন আমি আসার পূর্বেই সেগুলিকে পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হ্যারিকেন আর চায়ের ফ্লাক্সটা টেবিল এর উপর তুলে রাখলাম। আমি বর্তমানে যে ঘরটিতে আছি সেখান থেকে একটি দরজা দিয়ে বিভাজিত দ্বিতীয় ছোট আকারের ঘরটি রান্নাঘর। নবীন সেখান থেকে একটি চায়ের কাপ ও প্লেট ধুয়ে এনে টেবিলের উপরে রাখলো।
“তুমি চা খাবে না?”
“চায়ে আমার রুচি নাই, বাবু।”
তবে কিসে তার রুচি তা যেমন সেও বলার চেষ্টা করল না, আমিও ব্যাপারটা উপেক্ষা করে গেলাম।
“তা আপনি চা খান আমি বরং আপনার রাতের খা
বারের জোগাড়ের জন্য যাই”, বলেই নবীন রওনা হতে উদ্যত হলে আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, “তোমার বাড়ি কত দূর নবীন দা?”
“দুই ঘর পরেই, বাবু। রাইতে তো আমি এখানেই ঘুমাই, ওই বারান্দার চৌকিতে। আপনার কোন অসুবিধা হইবোনা এইখানে। কোন কিছুর প্রয়োজন হইলেই এইখান থেইক্যা একবার নবীন বলে ডাক ছাড়বেন, আমি হাজির হইয়্যা যাইমু।”
আমি একটু মৃদু হেসে বললাম, “তুমি নিশ্চিতে যাও। তবে আমার কিন্তু রাত নয়টায় খাওয়ার অভ্যাস।”
“যে আজ্ঞে বাবু। আমি সময় মতই চইল্যা আসুম”, বলেই সে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল।
আমি ব্যাগ থেকে লেখার সরঞ্জাম অর্থাৎ খাতা ও দুটি কলম বার করে, টেবিলে সাজিয়ে নিয়ে বসলাম। চোখের সামনে খোলা দরজা দিয়ে মসি মাখা পুকুরখানি দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন গ্রাম্য মেয়ের এলানো কেশ। মাঝেমধ্যে জোনাকির আনাগোনা নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারকে বিঘ্নিত করছে। ঝিঁঝিঁ পোকার কলতান বাতাসে এক মেদুর আস্তরণের মতো চেয়ে আছে। এমন পরিবেশ মনকে যতটা কবিতার ছন্দে আচ্ছন্ন করে, ততটা বোধহয় গদ্যের খোরাক যোগায় না।
প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টার পরেও লেখার মতন কোন প্রেক্ষাপট খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম চায়ে চুমুক দিয়েই দেখি যদি কিছু সুফল হয়। ফ্লাক্স খুলে গরম চা কাপে ঢেলে প্রথম চুমুকটি দিতে যাব হঠাৎ এমন সময় দড়জায় এক প্রৌঢ়ের আবির্ভাব।
“আসতে পারি?” ব্যক্তিটি আমার প্রতি কর্কশ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।
অন্ধকারে তার মুখটি স্পষ্ট নয়। তবে বোঝা গেল তার মুখ ভর্তি বর্ধিষ্ণু দাড়ি, পরনে একটি পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। বয়স ষাটের কাছাকাছি হলে অবাক হব না। বাবার মুখে শুনেছিলাম, অতিথি দেখতে গ্রামের মানুষেরা নাকি সকৌতুহলে ভিড় জমায়, তাই আগন্তুকের আগমনে এতটুকুও অবাক হলাম না।
“আসুন না।” আমি ভদ্রতার খাতিরে বললাম।
লোকটি তার মুখের হাসিটি অক্ষত রেখেই টেবিলের ঠিক বিপরীতে রাখা অপর চেয়ারটি টেনে নিয়ে আমার মুখোমুখি বসলেন।
“চা খাচ্ছেন বুঝি?” লোকটি লোভাতুর দৃষ্টি চায়ের কাপটার দিকে নিবদ্ধ করে বলল। দার তামাক সেবনের চিহ্নবাহী দাঁতগুলি মৃদু উন্মোচিত হলো।
“আপনি খাবেন? নিন না, আমার জন্য ফ্লাক্সে আছে।”
আমার মুখের কথাটি ফুরনোর আগেই, প্রৌঢ় চায়ের কাপটি হাতে তুলে নিলেন যেন কত দিনের তৃষ্ণা তার এইবার মিটবে। আমি মনে মনে প্রসন্নই হলাম।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিতেই তার সর্বাঙ্গে যেন এক তৃপ্তির তরঙ্গ বয়ে গেল, আর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “আহ্, কি অপূর্ব। প্রান জুড়িয়ে গেল”, এতদূর বলে পৌঢ় চায়ে পরপর দুটি চুমুক সেড়ে, পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “তা আজই বুঝি আসা হলো?”
“হ্যাঁ। এটা আমার পৈতৃক বাড়ি। শ্রী নন্দ দুলাল চৌধুরী আমার বাবা।”
“সে আমি তোমায় দেখেই বুঝেছি। আমি তো তোমাদের প্রতিবেশী। পুকুরের ওপারে যে কুঁড়ে ঘরটা, ঐটি আমার। তুমি বোধহয় খেয়াল করোনি।”
“না তার আর সময় পেলাম কোথায়।”
“বুঝলাম। আমি কিন্ত তোমায় সন্ধ্যা থেকেই খেয়াল করছি। নবীন চা দিয়ে গেল দেখলাম, তাই আর...” লজ্জিতভাবে বাকিটুকু না বললেও আমার বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে প্রৌঢ় শুধুমাত্র আলাপ জমানোর হেতু উপস্থিত হননি।
“তা তুমি কি বাবা লেখালেখি করো?” বৃদ্ধ টেবিলের উপর রাখা কাগজ ও কলমের আয়োজন দেখে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি একটি সলজ্জ হাসি দিয়ে বললাম, “ওই একটু আধটু চেষ্টা করি মাত্র।”
“তা ভালো। চেষটাতেই তো ফল মেলে। তা এবার কি নতুন গল্প লিখবে?”
জানি না কেন, তবে আমার মুখ থেকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেরিয়ে এলো, “হ্যাঁ ওই ভাবছি একটা ভূত নিয়ে...”
“ভূত?” এক প্রকার বিষম খাওয়ার সুরে প্রৌঢ় আমার কথাটি সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই বলে উঠলেন। তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে গম্ভীর স্বরে বললেন, “তা ভূত কখনো চাক্ষুষ করেছো?”
“নাহ্। কলকাতার মত আলো ঝলমলে শহরে সে সুযোগ নেই বললেই চলে।”
“তবে তো তার আকার, চরিত্র সম্পর্কে তোমার কোন ধারনাই নেই। লিখবে কি করে?” প্রৌঢ় সকৌতুক জিজ্ঞেস করলেন।
এবার আমার বড় বিরক্তি বোধ হল। লোকটা কি আমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছে? আমার আপ্যায়নের এহেন প্রতিদানে আমার মনে রাগের সঞ্চার হল। নিজের আবেগ কে নিয়ন্ত্রিত করে, এবং ক্ষীণ আত্মবিশ্বাসে ভর করে, বললাম, “ভূতেদের কিছু বিধিবদ্ধ রুপ আছে। এই যেমন ধরুন তালগাছের মত লম্বা, ইয়া বড় মূলোর মতো দাত, বিকট ও কুৎসিত রূপ, রক্তাভ চোখ ইত্যাদি। কি ভুল কিছু বললাম?”
পৌঢ় মানুষটি এক বিকট অট্টহাসি দিলেন যেন ভারি কৌতুকের কথা আমি তাকে বলেছি। তবে আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে কৌতুহলী হলাম যে পাঞ্জাবির কলারের উপরে গলার দৃশ্যমান অংশটিতে একটি গাড়ো কালো দাগ আঁকড়ে বসে আছে, ঠিক যেন তীব্র চাবুকের কষাঘাত। অন্তরে জিজ্ঞাসা ঠেলে উঠে আসতে চাইলেও, তাকে অনধিকার পরচর্চার শাষনে দমন করলাম।
অকষ্মাৎ পৌঢ় তার স্মিত হাসি থামিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তারপর একটু মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “ভূত সম্পর্কে তোমার ধারণায় কিছু খামতি আছে। গল্পের ভূত এর সাথে বাস্তবের প্রেতাত্মার যথেষ্ট পার্থক্য আছে। আশা করি খুব শীঘ্রই তোমার ধারণা গুলি শুধরে যাবে। চা খেয়ে মনটা ভরে গেল। এবার তবে আমি আসি।”
আমি তাকে বাঁধা দিয়ে বললাম, “তা আপনার নামটাই তো জানা হলো না।”
পৌঢ় ব্যক্তিটি দড়জায় থমকে দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে বললেন, “অধমের নাম ছিল নীলকান্ত মজুমদার। নমস্কার।”
ব্যক্তিটি অন্ধকারে যেমন অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়েছিল, তেমনি আবার যেন মিলিয়ে গেল। আমার হতভম্বতা কাটলো মুহূর্ত পরেই নবীনের প্রবেশে।
“বাবু চা খেইছেন?”
“আর চা খাওয়া হলো কোথায়। দেখলে না এইমাত্র নীলকান্ত বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার চাটা তাকেই আপ্যায়ন করতে গিয়ে দিতে হলো।”
“বাবু মজা কেন করেন? কি যা তা কন এই ভর সন্ধ্যায়।”
কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে, ঝাঁঝালো কন্ঠে ধমকের সুরে বললাম, “আরে যা তা মানে? আমি কি তোমার সাথে রসিকতা করকরছিঐ যে, পুকুরের ঐ পারেই নাকি ওনার ঘর। বেশ কিছুক্ষণ গল্পোও তো করে গেলেন আমার সাথে, এমন কি ভূতের ব্যাখ্যাও...যাক সে কথা। তবে বুঝলে, একটা অদ্ভুত জিনিস ভদ্রলোকের গলায় খেয়াল করলাম। একটা কালো মোটা দাগ, যেন মোটা দড়ি দিয়ে গলায় শক্ত করে বেঁধে রাখলে যেমন হয় ঠিক তেমন।”
চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখি নবীনের সর্বাঙ্গ জ্বরাক্রান্ত রুগীর মতো কাঁপছে।
“নবীন দা, কি হলো তোমার? এমন করছো কেন?”
সে কম্পমান গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ঐ...ঐ নীলকান্ত বাবু সত্যিই...”
“তোমাকে তো দেখছি বিশ্বাস করানো দায়। কেন সে কি ভূত, যে এখানে আসাটা অসম্ভব!”
প্রত্যুত্তরে নবীন যা বলল তাতে আমার মূর্ছা যাওয়ার যোগাড়।
“আজ থ্যেইকা ছয় মাইস আগে ওই কুঁড়ে ঘরটাতেই নীলকান্ত বাবু গলায় দড়ি দিসিল। চা খাইতে বড় ভালোবাসতো সে। দুই বেলা ভাত না হইলেও, চা সিল তার পরান। আমরা মজা কইরা ওনারে, চা দাদা ডাইকতাম। তবে বাবু...”
নবীনের বাকি কথাগুলি আমার কানে প্রবেশ করেছিল কি না, তা স্মৃতি চারন করে আমি বলতে পারবো না। বাস্তব আর কল্পনার মাঝে তখন আমি বিভ্রান্ত। শীঘ্রই আমি যে জ্ঞান তা পর দিন সকালে নবীনের মুখেই জানতে পারি। এখনো আমার মনের অতল গভীরে সেই চায়ের অতিথির স্মৃতি এক দুঃস্বপ্নের মতো অক্ষত।