STORYMIRROR

Avijit Roy

Classics

4.6  

Avijit Roy

Classics

শেষ চিঠি

শেষ চিঠি

5 mins
797


মুখবন্ধ:

রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি বাঙালির বড় আপন। লেখক এর কাছে তিনি চিরকালের প্রেরণা। আমার এই গল্পটি রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প পোস্টমাস্টার কে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। গল্পটি পড়ে, তার অসম্পূর্ণ তায় আমার দীর্ঘদিনের যে একটি আক্ষেপ ছিল তা আমি এখানে পূরণ করার সুযোগ পেয়েছি। গল্পের ভাষাও রবীন্দ্রনাথের থেকে অনুপ্রাণিত। তার গল্পে আমি একটি যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছি জানি এটি আমার ধৃষ্টতা, তবুও এই কাজটি করে আমি মনে তৃপ্তি পেয়েছি।


          




শেষ চিঠি


বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আসিয়া অখ্যাত উলাপুর গ্রামের রূপ চেনা দায়। তাহাকে অজপাড়াগাঁ বলিলে তাহার অহংকারে যে আঘাত হানা হইবে, এবং তাহার বৈদ্যুতিক বাতি, পিচঢালা রাস্তা এবং ইট গড়া বাড়ি গুলির গর্বকে খর্ব করা হইবে তাহা ভাবিয়া আমি নিজেকে সংযত করিলাম। স্বীকার করি, উলাপুর এখন একটি মফস্বল।

গ্রামের একমাত্র পোস্ট অফিসটিও তাহার জরাজীর্ণ রূপ ঝাড়িয়া ফেলিয়া, আধুনিক বলিষ্ঠ গঠনে গড়িয়া উঠিয়াছে। আমার পিতা, নিহার রঞ্জন চক্রবর্তী আজ হইতে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে এই গ্রামে প্রথম পোস্টমাস্টার হইয়া আসিয়াছিল। সেকথা বোধকরি এই গ্রামটি তাহার স্মৃতির পট হইতে মুছিয়া ফেলিয়াছে, তথাপি আমার পিতার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একটি প্রাণী এখনো সযত্নে তাহা পরিচর্যা করিয়া চলিয়াছে। 

 সুদূর কলিকাতা হইতে যে মানুষটি এই গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশে হাবুডুবু খাইয়া, অবশেষে চাকরিতে জবাব দিয়া, বঙ্গসন্তানের স্বগৃহের প্রতি মোহকে অক্ষুন্ন রাখিয়া, কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়াছিল তাহারও অন্তঃস্থলে যে ক্ষত সেইদিন হইয়াছিল, তাহা বোধ করি একমাত্র একজন অন্তরীক্ষ হইতে নিরীক্ষণ করিয়া ছিল। বহুকাল পরে আমি তাহা জানিয়াছি। 

এক বৎসর পূর্বে আমার পিতা গত হইয়াছেন। মৃত্যুর পূর্বে পিতা যেমন বহু যত্নে সংরক্ষিত গুপ্তধনের অনুসন্ধান তাহার পুত্রের হাতে তুলিয়া দিয়া নিশ্চিন্তি বোধ করেন, অনুরূপ প্রশান্তি আমার পিতা অনুভব করলেন আমার উদ্দেশ্যে এই কথাগুলি বলিয়া—

“আমি বেশ বুঝিতে পারছি আমার আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে। আমার মৃত্যুর পর, উলাপুর গ্রামে গিয়ে রতন নামে এক নারীর খোঁজ করবে। সে এখন চল্লিশোর্ধ হবে। আমার একটি চিঠি তার হাতে তুলে দেবে। মনে রেখো এটি আমার শেষ ইচ্ছা, তাই অন্যথা হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না।”

পিতার শেষ ইচ্ছা রক্ষা এবং এক প্রকার কৌতুহল বশেই এই গ্রামে উপস্থিত হইয়াছি। চারিপাশের সবুজ রুপ গোগ্রাসে গিলতেছি। পোস্ট অফিসের অনতিদূরে একটি পুকুর আছে। পিতার মুখে তাহার কদর্য রূপের কথা শুনিয়া ছিলাম, তবে বর্তমানে দেখিলাম তাহারও রূপ ফিরিয়াছে। 

বর্তমান পোস্ট মাস্টার সুনিল বিশ্বাস মহাশয়ের সহিত পরিচয় হইয়াছে। তাহার একটি স্বল্প বয়স্ক সহকারীও জুটিয়াছে। অফিসের ঘর হইতে অনর্গল সিলমোহরের শব্দ কানে বাসা বাঁধিয়াছে। 

“তা মশাই, হঠাৎ এই গ্রামে?” পোস্টমাস্টার মহাশয় আমায় জিজ্ঞেস করলেন।

আমি তাহাকে রতন নামক রমনির কথা পাড়িলাম। ইহাও জানাইলাম যে কিভাবে আমার পিতার কঠিন ব্যাধি তার সেবায় সারাইয়া উঠিয়াছিল। পোস্টমাস্টার মহাশয় আদ্যপ্রান্ত মনযোগ সহকারে শুনিয়া, অবশেষে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “কিন্তু এমন কোন মানুষের সঙ্গে তো আমার পরিচয় হয়নি। অবশ্য আমি এখানে আছি বছর দুয়েক। আপনি বরং প্রতিবেশীদের একবার জিজ্ঞেসাবাদ করে দেখুন। খবর অবশ্যই পাবেন, যদি না তিনি...” 

পোস্টমাস্টার মহাশয় কথাটি সম্পূর্ণ না করিলেও তাহার ইঙ্গিত আমার বুঝিতে ভুল হইলোনা। আমার অন্তরাত্মা মোচড় দিয়া উঠিলো। আমার পিতা এই বাস্তব সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া, শুধুমাত্র বিশ্বাসের বলে যে গুরু দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করিয়া পৃথিবী হইতে নিশ্চিন্তে বিদায় লহিয়াছেন, তাহার ব্যর্থতার সকল উৎসগুলিকেই আমার মন নস্যাৎ করিতে চাহিল। আমি উঠিয়া পড়িলাম।

আশপাশের দুই চারটি বাড়িতে অনুসন্ধান করিয়া সুরাহা হইল। এক বৃদ্ধা রতন নামটি শোনা মাত্রই চিনিলেন। আমার মনে আশার আলো উদয় হইল।

“পাশের গ্রাম মুকুন্দপুরের শেষ প্রান্তে রতনের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর নাম অঘোরকান্তি রায়। তা বাবা, তুমি কি ওর জ্ঞাতি?” বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করিলেন।

“আজ্ঞে হ্যাঁ, একপ্রকার তাই।”

বৃদ্ধার বিস্ময়ের অন্ত রহিলনা, কারণ তিনি জানিতেন রতন অনাথা, এবং কোনোকালেই কেহ তাহার খোঁজ করেনাই। তাহার থেকে ঠিকানা জোগাড় করি

য়া রওনা হইলাম। একটি হোটেলে দুপুরের আহার সারিয়া যখন মুকুন্দপুর পৌছাইলাম তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অদৃশ্য হইয়াছে এবং রক্তাভ আকাশ যেন ব্যর্থ প্রেমিকের মতো তাহার অবশিষ্ট আভাটুকু আঁকড়াইয়া ধরিবার প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে।

অঘোরকান্তি বাবুর বাড়ি প্রকৃত অর্থে গ্রামের শেষ প্রান্তে। রাস্তার বৈদ্যুতিক আলো জ্বলিয়া উঠিয়া ছিল। চারিপাশের রূপ তখন কালিমাবৃত। বাড়িটি ঠিক পর্ণকুটির নহে, আংশিক ইটে গাঁথা ও অংশীক দর্মার বেড়া আবৃত। বাঁশের বেড়া ঘেড়া প্রশস্ত উঠোন। উঠোনের মাঝখানে তুলসি তলায় প্রদীপ হাতে দাঁড়াইয়া ঘোমটা টানা এক নারী।

“অমলকান্তি বাবু বাড়ি আছেন?”

আমার এই রূপ অকষ্মাৎ প্রশ্নে সে নারী চমকাইয়া ফিরিলো। হয়তো ঘোমটার আড়ালে হইতেই তিনি বাক্যালাপ করিতেন যদিনা আমার বয়স তাহাকে আত্মবিশ্বাস যোগাইতো।

“উনি তো এখনও হাট থেকে ফেরে নি। তা, তুমি কে, ভাই?”

আমি সমস্ত সংকোচ দূরে ঠেলিয়া দিয়া বলিলাম, “আমার নাম অমল। আমি কলকাতা থেকে আসছি। আপনি বোধ করি রতন পিসি?”

কলিকাতার সহিত এ নারীর যে কোন এক সুদূর সংযোগ এখনো রহিয়া গিয়াছে তাহা তার ফ্যাকাশে মুখ দেখিয়া বুঝিলাম। তাহার হৃদয় উদ্বেল করিয়া যে স্মৃতি ঠেলিয়া উঠিতে চাহিল আমি তাহার বাহন হইলাম মাত্র।

“আমার পিতা নিহার রঞ্জন চক্রবর্তী এই গ্রামে প্রথম পোস্টমাস্টার হয়ে এসে ছিলেন।”

আমার কথা শুনিয়া তিনি যেন টলিয়া গেলেন, ঠিক যেমন ঝড়ের দাপটে শীর্ণ কান্ডাধারী গাছ সমূলে দুলিয়া ওঠে। পরমুহূর্তে বাড়ির দাওয়ায় আমার ঠাই হইল। অনাড়ম্বর আপ্যায়নে যে ভালোবাসার স্পর্শ আমি পাইয়াছিলাম তাহা যান্ত্রিক কলিকাতা শহরে কখনো অনুভব করি নাই। রতন পিসির চুলে পাক ধরিয়াছে। বয়সের ভার তাহার শরীরে দেখা দিয়াছে, অথচ শৈশবের স্মৃতি গুলি যেন এখনো চিরযৌবনের সুধা পান করিয়া অমরত্ব লাভ করিয়াছে।

পিতার মৃত্যু সংবাদ ও অনেক ঘটনার স্মৃতিচারণের পর অবশেষে সেই দীর্ঘ চিঠিখানি কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ হইতে বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলাম। তিনি অবাক হইলেন। আমি বিস্তারিত ভাবে বুঝাইয়া বলিলাম।

“তুমিই পড়ে শোনাও”, রতন পিসি চোখ মুছতে মুছতে বলিলেন।

আমি শুরু করিলাম—

“স্নেহের রতন,

  এই চিঠি আশা করি তুমি নিজেই পড়িতে পারিবে। তোমাকে যে শিক্ষা দানের কর্ম শুরু করিয়াছিলাম তাহা সম্পূর্ণ করিতে পারি নাই বলিয়া আমার আক্ষেপ রহিয়া গিয়াছে। তুমি আমাকে ভুলিয়া গিয়াছো এ আমার বিশ্বাস নহে। কলিকাতায় ফিরিয়া আমার মনের আক্ষেপ বাড়িয়াছে। বিদায় বেলায় তোমাকে যে কষ্ট আমি দিয়াছিলাম তাহা তোমার চোখের জলে স্পষ্ট হইয়াছিল। আমি চাকরি হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া একপ্রকার প্রাণে বাঁচিয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু আমি যে কি রত্ন হারাইয়াছি তাহা বুঝিতে আমার খুব বিলম্ব হয় নাই। তুমি আমাকে দাদাবাবু ডাকিয়া, আমাকে কেন্দ্র করিয়া স্নেহের যে মায়াজাল বুনিয়া ছিলে, আমি তাহা নির্মম হস্তে ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া আসিয়াছিলাম। তার পর বহুবার ভাবিয়াছি ফিরিয়া গিয়া তোমারে সঙ্গে লইয়া আসি, কিন্তু সাহসে কুলায় নাই। নিজেকে সান্তনা দিয়া ছিলাম এই ভাবিয়া যে, নতুন পোস্টমাস্টার নিশ্চিত তোমার যত্ন নেবেন। তুমিও ক্রমে আমারে ভুলিয়া যাইবে। তবুও নিজের মনকে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট করিতে পারিনাই, তাই তোমার খবর লইবার জন্য পোস্টঅফিসের উদ্দেশ্যে একখানি পত্রও লিখিয়া ছিলাম, কিন্ত তাহার কোন উত্তর আমি পাইনাই। আমার চিন্তা কয়েক গুণ বাড়িয়া ছিল মাত্র। আমি প্রকৃতই দোষী। তাই জীবিতাবস্থায় তোমার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারবনা জানিয়াই এই চিঠিখানির আশ্রয় লইতে হইলো। অমল তোমার উদ্দেশ্যেও একখানি কথা...” চিঠিতে নিজের নাম পড়িয়া স্তব্ধ হইলাম। 

“থামলে কেন পড়”, রতন পিসি কহিল। 

আমি পুনরায় শুরু করিলাম, “রতনকে আমি সকলের অলক্ষ্যে স্নেহের স্থান দিয়াছি, তুমি তার যথাযথ মান রাখিও। রক্ত অপেক্ষাও বৃহত্তর সম্পর্ক এই পৃথিবীতে আছে বলিয়াই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর। 

  রতন, তোমার এই দাদাবাবুকে ক্ষমা করিয়া দিও।

        আশীষান্তে

         দাদাবাবু

চিঠি খানি ভাঁজ করিয়া রাখিয়া দেখিলাম রতন পিসির চোক্ষু দিয়া অবিরাম অশ্রুধারা বহিতেছে। তাহাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজিয়া পাইলামনা। শুধু বুঝিলাম পিতার আত্মা আজ প্রকৃতই শান্তি লাভ করিলো। মানুষ অনেক কিছু হারাইয়াও বাঁচিতে পারে, কিন্ত স্নেহ ও ভালবাসা ব্যতীত সে প্রকৃতই কাঙাল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics