বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
মধুজা এলে এই ভাবেই আসে, ঠিক যেন একটা দমকা বাতাস । উড়িয়ে নিয়ে যায় সমস্ত মন খারাপের আস্তরণ । মেঘাকে কতভাবে যে চমকে দেয় সে তার ইয়াত্তা নেই । আজও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি ।
হলুদ ওড়নার আড়াল করে একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজ এনেছে মধুজা । তাঁর ঠোঁটে এখন খেলে যাচ্ছে এক দুষ্টু স্মিত হাসি । গুপ্তধনের মতো খবরের কাগজটা বার করতে করতে মধুজা বলল, “এটা কি তোমার দেওয়া বিজ্ঞাপন, মেঘাদি ? আমি কিন্তু শেষের ঐ ফোন নম্বরটা দেখা মাত্রই বুঝে গেছি ।”
মেঘা স্টোভের উপর ভাতের হাঁড়িটা চড়াচ্ছিল । খবরের কাগজটার দিকে চোখ ফিরিয়েই তাঁর বুকটা ধরাস করে উঠল । হৃদস্পন্দন যেন কানে সশব্দে বাজছে । আজ যে রবিবার ! বিজ্ঞাপনটা আজই বেরোনোর কথা । ইস্, সে একদম ভুলেই গিয়েছিল ! সকালে যে বাজার থেকে একটা খবরের কাগজ কিনে আনবে তাও বেমালুম ভুলে গেছে !
খবরের কাগজটা মধুজার হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিল মেঘা । পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতাটা খুলেই এনেছে মধুজা । তাঁর খবরটার চারপাশে গাঢ় নীল কালিতে একটা গোল দাগ করা । নিশ্চয়ই মধুজার কান্ড !
“কায়স্থ, ৪১/৫’-১”, বি.এ পাশ কন্যার জন্য পাত্র চাই ।” মনে মনে পড়ল মেঘা । একবার না, কয়েক বার । কোনো কিছু ভুল ছাপা হয়নি তো ! না, তা হয়নি । একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মেঘা ।
“বিয়ে করবে ভালো কথা । কিন্তু তোমার কোনো ডিমান্ড নেই মেঘাদি ? এই যেমন সুপাত্র, সরকারি চাকরী...”
“ছাড় তো ও সব কথা । এই বয়সে আবার ডিমান্ড”, মধুজাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে মেঘা বলল । “বিজ্ঞাপনের এক একটা শব্দের জন্য খরচ কত জানিস ? আট টাকা ! ভাবতে পারিস ? এখন চুরান্ত কম্পিটিশনের বাজার । ভালো করে দেখ, এই পুরো পাতাটা জুড়ে কত মেয়ে লাইন দিয়ে আছে জাস্ট উৎরে যাওয়ার জন্যে ! তুই বলছিস ডিমান্ড !”
“এখন দেখছি তোমার সম্পর্কে পলাশ দা একদম ঠিক কথাই বলে ।” একটা অদ্ভুত সুর করে মধুজা কথাটা বলল ।
“পলাশ ? মানে ঐ বিধানকাকুর ছেলে ? যাদের বাড়ি উত্তর পাড়ায় ?”
মধুজা বেশ করে মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলল ।
“তা কী বলে তোর পলাশ দা ? ভালো কিছু যে বলে না সে আমি বেশ জানি ।”
“কী করে সুনাম করবে বলো ?”
“তবু বল কী বলে সে ?”
“কী আবার ! ঐ তোমার কোনো স্টাইল নেই, মেকাপ করোনা, কোমর দুলিয়ে হাঁটতে পারোনা । মোদ্দা কথা মর্ডান ট্রেন্ডের সাথে তুমি একদম খাপ খাওনা । সাথিদিকে দেখেছো ? তোমার থেকে তো মাত্র কয়েক বছরের ছোটো । ও যখন হাঁটে মনে হয় রাস্তায় না, রেম্পে হাঁটছে । কতো সিটি পড়ে জানো ? পলাশ দা বলে তুমি নাকি গাছের মত, ঐ প্রাণটুকুই যা আছে কিন্তু কোনো হেলদোল নেই । অথচ তুমি সাজলে নাকি তোমায় দারুণ লাগবে” কথাগুলি থ্রু-ট্রেনের মতো গড়গড় করে বলে গেল মধুজা । মেয়েটা এরকমই । মুখে কিচ্ছু আটকায় না । মেঘা রাগ করে না । রাগ করে কী হবে ? কথাগুলো তো আর মিথ্যে নয় । কিন্তু ওসব যে তাঁরও ইচ্ছে করে সেই গোপন খবরটা মধুজা জানবে কেন ! মেঘা জ্বলন্ত স্টোভের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখে হাঁড়িতে ফ্যান উথলে উঠছে । হাঁড়ির ঢাকনাটা আলগা করে দেয় মেঘা ।
মধুজা চলে গেছে অনেক্ষণ । এখন ভর দুপুর । ঘড়িতে দুটো বেজে পনেরো মিনিট । মেঘা এসে দাঁড়ায় ওঁর ঘরের একমাত্র আদ্যিকালের পুরনো আয়নাটার সামনে । ওঁর কোমর অব্দি ধরা আছে ঐ অস্বচ্ছ কাঁচের উপর । শাড
়ি এবং ব্লাউজের ফাঁক ফোকর দিয়ে শরীরের যতটুকু অংশ দেখা যায় তাতে যেন মেঘ লেপে দেওয়া হয়েছে । না, শরৎ-এর শুভ্র পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ নয় । বরং শ্রাবনের শ্যামলা মেঘ । ওঁর সমস্ত শরীর জুড়ে জল টলমল মেঘের আনাগোনা । সেই জল দুচোখ দিয়ে বেআক্কেলের মতো ঝড়ে পড়ে যখন তখন । ঠিক যেমন এখন তাঁর দুই চোখ ভিজে একসা । তবে মেঘা জানে এই জল একদিন ঠিক শুকিয়ে আসবে । একটা রোদ ঝলমলে দিনের অপেক্ষায় সে ।
একবার কোমর দুলিয়ে হেঁটে দেখল মেঘা, ঠিক যেমন সাথী হাঁটে, যেমন করে পলাশরা দেখতে চায়, সিটি মারতে চায় । কিন্তু কই তেমনটা তো হলো না ! ওঁর কোমর সত্যিই যেন রুক্ষ গাছের গুঁড়ির মত । এতটুকুও যেন দুলতে চায় না ! নিজের উপর খুব রাগ হয় মেঘার ।
এ সবই সপ্তাহ খানেক আগের কথা । আজ শ্রাবণের বাইশ । মেঘার জীবনে এক কঠিন পরীক্ষার দিন । এক পাত্রপক্ষ যাচাই করতে আসবে তাকে । দুপুরে মধুজা এসেছিল । মেঘা তখন মাত্র ভাতের প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতে যাচ্ছে । পাত্রপক্ষ আসার খবরটা মেঘাই ওঁকে দিয়েছিল । একপ্রকার জোর করে একটা লাল লিপস্টিক, আর একটা গোলাপী শাড়ি গছিয়ে দিয়ে গেছে মেঘার হাতে । যাওয়ার আগে বলে গেছে “ ডিসেম্বরে আমার ফাইনাল সেমিস্টার আছে । তাই বিয়ের ডেট যেন কিছুতেই জানুয়ারির আগে ফেলবে না ।” কথাটা শুনে বেশ লজ্জা পেয়েছিল মেঘা । গালদুটোও হয়ত একটু লাল হয়েছিল !
আজ বিকেল থেকেই বৃষ্টি, যাকে বলে শ্রাবণের ধারা । এটা তো হওয়ারই ছিল, যাকে বলে ভবিতব্য । মা বেঁচে থাকতে একদিন বলেছিল, “তোর জন্মের সময় সে কী টানা বৃষ্টি ! হাসপাতাল থেকে আমাদের বাড়িতে আনতেই তোর বাবা হিমসিম খেয়ে গিয়েছিল । দেখবি তোর বিয়েতে বৃষ্টি না হয়ে যায় না । বৃষ্টি লগ্নে তোর জন্ম কিনা !” কথাটা ঠিক এখন মনে পড়ল মেঘার এবং সাথেসাথে তাঁর ভ্রু বিরক্তিতে কুঁচকে গেল । সে স্থির করেছে বিয়ে সে শীতেই করবে । মায়ের কথাটা কিছুতেই ফলতে দেবে না সে । সবসময় সেই কেন হারবে ?
এখন ঘড়িতে রাত ন'টা । পত্র পক্ষের আসার কথা ছিল ছ'টার মধ্যে । ফিরবে সেই টালিগঞ্জ ! এই ব্যারাকপুর থেকে টালিগঞ্জের দূরত্বটা তো নেহাত কম নয় ! মধুজা কয়েকবার এসে খবর নিয়ে গেছে । বৃষ্টি থেমে গেছে প্রায় ঘন্টা খানেক । আরো আধ ঘন্টা কাটতেই মেঘার হৃদস্পন্দন বেড়ে উঠল । স্মৃতিতে বেজে উঠল মোবাইলের একটা রিংটোন । আননোন নম্বর । ওপারে একটি ভারী পুরুষ কন্ঠ ।
“খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করছি । আপনি কি মেয়ের মা ?”
“না, আমি মেঘা সোম । বিজ্ঞাপনটা আমার নিজের জন্যই দিয়েছিলাম”, মেঘা সলজ্জ গলায় বলেছিল ।
কয়েক মূহুর্তের নিস্তব্দতা ভেদ করে জবাব এসেছিল, “তোমাকে তবে তুমি করেই বলছি । বাবা, মা কেউ কি কাছাকাছি আছেন ? থাকলে তাঁদের কাউকে ফোনটা দাও ।”
“না । মা, বাবা মারা গেছেন । এক দাদা আছেন বটে । তবে সে আলাদা থাকে । আমার সাথে সম্পর্ক রাখে না । আপনি যা বলার আমাকেই সরাসরি বলতে পারেন ।”
“ও, ঠিক আছে । আগামী রবিবার সন্ধ্যায় না হয় সামনাসামনিই কথা হবে । তোমার ঠিকানাটা...”
মনের কথার কী বিজ্ঞাপন হয় ! কিন্তু, মেঘার এখন মনে হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের শেষে জুড়ে দেওয়া উচিত ছিল, আমি অনাথ । আমার এক দাদা এই বাড়িটা বন্দক দিয়ে, টাকাকড়ি নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে । আমার বড় দাদা আগামী মাসে শ্বশুর বাড়িতে শিফ্ট করবে । আমি কিন্তু বাঁচতে চাই । একটা ছাদ চাই, একটা নিশ্চিত আশ্রয় । এই আমার শেষ সুযোগ । আমাকে কেউ বাঁচান ।
মনের ভেতর ওঠা হঠাৎ এতো আলোড়নে মেঘা হাঁপিয়ে উঠল । বিছানায় পড়ে থাকা স্তব্ধ, মৃতবৎ মোবাইলটার দিকে একবার তাকালো সে এবং তাঁর হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে এল এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ।