চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো
চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো
(১)
"যা ছিলো স্বপ্নে আশা
আজকে পেল সে ভাষা
এই সুখেরি লগনে
সত্যি হল যে দুজনের ভালোবাসা"
মুখ থেকে পান পাতা দুটো সরাতেই বধু বেশে তনয়ার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি তুলতে অক্ষম হলো উপাখ্যান , টানা দশ বছরের প্রেম ওদের , কতো বাঁধা বিপত্তি এসেছে দুজনের জীবনে তবুও একে অপরের হাত ছাড়েনি কোনোদিন ।
গ্রাডুয়েশন এর পরই একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরীতে জয়েন করে তনয়া আর উপখ্যান চলে যায় মাস্টার্স করতে , রসায়নে পি এইড ডি করে অধ্যাপক হওয়ার শখ তার , বর্তমানে এম ফিল শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে পি এইডি করার সুযোগ পেয়েছে সে , না নেট দিয়ে জে আর এফ পাওয়া হয়নি তাই ছোট্ট খাটো কিছু স্কলারশিপ আর দু একটা টিউশনই এখন তার ভরসা , পারমানেন্টলী সেটেল্ড সে নয় , এই প্রফেশনে সময় লাগে নিশ্চয় তবে লক্ষ্য স্থির থাকলে সফলতা নিশ্চিত , ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চায় উপাখ্যান তাই এই মুহূর্তে পার্ট টাইম জব করাও যে তার পক্ষে সম্ভব নয় , নেট এ যে বসে নি এমনটা নয় ...প্রতিবারি ভাগ্যের ফেরে এক - দু পার্সেনটাইল এর জন্য গেছে ফেঁসে তাই জে আর এফটা আর পাওয়া হয়ে ওঠে নি তার, সত্যি বলতে তথাকথিত সমাজের চোখে বেকার সে , তাই তনয়ার মা বাদে আর কেউ এই বিয়েতে রাজি ছিল না একদম ...
সকলেই প্রায় বলেছিল -- " বেকার ছেলেকে কী বিয়ে করবি রে , যা দেশের অবস্থা ভবিষ্যতেও চাকরী পাবে কিনা কোনো গ্যারান্টি নেই ....." একই কথা প্রতিবেশীরাও শুনিয়ে গেছিল বেশ কয়েকবার , তাতে গা করেনি মোট্টে তনয়া , তার বক্তব্য - 'সে সংসার করবে তার ব্যাক্তিগত বিষয়.. বাকিরা সিন্ধান্ত নেওয়ার কে !! আর কর্মজীবী ছেলে যে ভালো হবে তার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে ?? আর কোনো সমস্যা হলে সে নিজে উপাখ্যানের দায়িত্ব নেবে ...কোন শাস্ত্রে লেখা আছে নারীরা পুরুষের দায়িত্ব নিতে পারে না , আসল দায়িত্ব তো নারীরাই নিয়ে থাকে , সন্তানকে তো গর্ভে ধারণ করে নারীই , তবে নারী হয়ে কেন সে পরনীর্ভশীল হবে ??
সুখে থাকতে চায় তনয়া বিলাসিতায় নয় আর স্বামীর পয়সায় বিলাসিতা দেখানোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই .......'
এর পরে আর সত্যি কিছু বলা চলে না , তনয়ার নিজস্ব জীবন , সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই , আর তাই তার জেদের কাছে হার মেনে এই বিয়েতে মত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ঋদ্ধিমান বাবুও ওরফে তনয়ার বাবা ,সত্যি বলতে তাছাড়া বয়সও তো হচ্ছে , বিয়ে যখন দিতেই হবে তখন নাহয় মনের মানুষের সাথেই হোক ...
"যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব"
পুরোহিত মশায়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করছে দুজনেই , পবিত্র অগ্নিকে সাক্ষী রেখে আমৃত্যু একে অপরের সাথে থাকার অঙ্গীকার করে তারা, সুখে থাক তারা -- উপাখ্যান আর তনয়া ....।
"ইচ্ছে করে একটা ঘরে থাকবো দুজনায়
গড়বো ভিটে খুশির ইটে সঙ্গী হবি আয়.."
(২)
আজ অফিসে এসে থেকে কাজে মন বসাতে পারছে না তনয়া, ভীষণ ছটফট করছে মনটা, কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে দৃষ্টি সরে সরে বারংবার এসে আটকে যাচ্ছে মোবাইল ডিসপ্লেটার উপর , খুব ইচ্ছে করছে কথা বলতে , জানতে ইচ্ছে করছে বড়ো ..কী হলো !
এবার সত্যি ধৈর্য্য এর বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তার , পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন তাঁদের এতো দায় কীসের কে জানে ? সেবার যখন বাবার stroke হয়েছিল কেউ তো সেদিন এগিয়ে এলো না , একমাত্র উপাখ্যানই তো নিজের জীবনের অতো বড়ো সুযোগটিকে হাতছাড়া হতে দেখেও একছুটে চলে এসেছিল তনয়াকে সাহায্য করতে , কই তখন তো কেউ দাঁড়ায় নি পাশে , হ্যাঁ মন্তব্য করতে ছাড়ে নি কেউ... এই যেমন : উপাখ্যান তো বেকার ছেলে ওর পক্ষে যেটা সম্ভব তা কী আর আমরা পারবো .....!
সত্যি বলতে সে মুহূর্তে হয়তো ঋদ্ধিমান বাবু প্রকৃতই বুঝেছিলেন তাঁর মেয়ে তনয়া অন্যায় কিছু করেনি , তনয়া জানে মানুষ চিনতে , তার বিশ্বাস ভরসা কখনো ঠুনকো হতে পারে না ...।
আর কতো জনকে কতো উত্তর দেবে তনয়া !! কেন যে ভগবান মুখ তুলে চাইছে না তাদের দিকে কে জানে...!!
" কী রে তনু ? খাবি না কিছু ? চল খেয়ে আসি মাত্র হাফ আওয়ারের ব্রেক পেয়েছি এখন না খেয়ে নিলে বস কিন্তু পরে আর খেতে দেবে না ..." পূর্বাসার ডাকে সামান্য নড়েচড়ে বসলো সে , তবে তার ভাবগতি'র বিশেষ পরিবর্তন হলো না দেখে পূর্বাসা আবারো বললো -- " কী রে কী হলো যাবি না ....? "
" কিছু হয় নি রে..." কেমন যেন মিনমিনে গলায় বলে উঠলো তনয়া - " আমার ঠিক খিদে নেই তোরা খেয়ে নে....।"
টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসলো পূর্বাসা ; তনয়া কাঁধে আলতো হাত ছুঁইয়ে বললো -- " তনু চিন্তা করিস না সোনা , দেখিস সব ভালো হবে , তোর মতো করে কেউ পারে না রে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে , তোদের জয় হবেই ...."।
স্মিত হাসলো তনয়া-- " জানি না রে কবে সব ঠিক হবে তবে আর পারছি না জানিস , ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি না আমি , ছেলেটা কাঁদতেও পারে না অঝোরে , যে একটু হালকা হয়ে নেবে, আমি বুঝি ওর কষ্টটা কিন্তু কি করে হেল্প করবো ওকে বুঝতেও পারছি না , ও ভিতরে ভিতরে পুরো ভেঙে পড়েছে পূর্বাসা , আমি যে চাই না ও ওর স্বপ্ন গুলো থেকে দূরে সরে যাক....। "
এরপর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল দুজনেই কিন্তু তার আগেই মুঠোফোনের জোরালো শব্দে.. আবদ্ধ শীতল অফিস ফ্লোরের কৃত্রিম নিস্তব্ধতা ভেঙে গেলো ঝনঝন করে ..!!
ডিসপ্লেতে জ্বলজ্বল করছে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির নাম , ক্ষণিক সময়ও যেন নষ্ট করতে পারলো না তনয়া , কলটি রিসিভ করে মুঠোফোনটি কানের সাথে চেপে ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে হলো উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর -- " আমার কাজটা হয়ে গেছে তনয়া, আর কারোর কাছে জবাব দিহি করতে হবে না তোকে , আর কেউ বলবে না তোকে তোর বর বেকার কিছু করে না , কেউ বলতে পারবে না 'ওর তো অনেক সময়' তনয়া আমি পেরেছি.. আমি পেরেছি তনয়া ...."!
" সত্যি ...!!" নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না তনয়া, একপ্রকার লাফিয়েই উঠলো যেন -- " কী বলছিস কী তুই, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো...! "
" একেবারেই না তনয়া একদম সত্যি , চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি ....তবে আপাতত এজ আ গেস্ট লেকচারার জয়েনিং হবে এন্ড নেক্সট উইকে তো গেট(GATE)-এর রেজাল্ট বেরোবে যদি কোয়ালিফাই করে যাই দেন(then) পারফরমেন্স-এর উপর ডিপেন্ড করে ফুল টাইমার হওয়ার চান্সও আছে আর যদি কোয়ালিফাই নাও করতে পারি তাহলেও নো চিন্তা ছমাসের মাথায় আবার ইন্টারভিউ হবে তখন এগেইন ফুল টাইমারের জন্য এপ্লাই করতে পারবো , শুধু আরও একবার ইন্টারভিউতে বসতে হবে এই যা ....(ক্ষনিক থেমে) জানিস তনয়া তখন আমার সেলারিও প্রায় পাঁচিশ হাজারের কাছাকাছি হয়ে যাবে আমিও বাবা মাকে সাহায্য করতে পারবো , আর কেউ বেকার বলবে পারবে না আমায় .... " বলতে বলতে যে উপাখ্যানের গলা ধরে এসেছিল তা শব্দ তরঙ্গের এপ্রান্তে বসেও আন্দাজ করতে যেন কোনো অসুবিধা হলো না তনয়ার ....।
" ছমাস বাদে কেন উপাখ্যান তুই এখনো পারবি ..
না হয় আমরা নুন ভাত খেয়েই থাকবো কিন্তু সম্মান নিয়ে বাঁচবো ; আমি জানি হয়তো তোর স্যালারি একটু কম হবে , তবে তুই তো তোর মনের মতো কাজ করতে পারবি এটাই অনেক আর আমি জানি আমার উপাখ্যান ... তার প্রিয় বিষয় রসায়ন'কে দৈনন্দিন জীবনের রসায়নে পরিণত করতে একদিন না একদিন পারবেই পারবে ...." দু চোখ ভিজে উঠলো তনয়ার ...।
" সে যাই পাও জামাই বাবু প্রথম মাইনেতে কিন্তু আমার এই বন্ধুটিকে কিছু না কিছু দিতেই হবে ..." পাশ থেকে একটু উঁচু স্বরে বলে উঠলো পূর্বাসা -- " ভুলে যেও না নেক্সট মাসে আজকের দিনেই কিন্তু মহালয়া ..."।
" সে আর বলতে , তোমার বন্ধুটি ছাড়া আমি সত্যি কিছু পারতাম না , তোমার বন্ধুটির থেকে জেনে রেখো ওর কি চাই.. আমি তাই দেবো তবে অবশ্যই আমার সার্মথ্যের মধ্যে আর আমি জানি তনয়া কোনোদিন আমাকে ছোট হতে দেবে না , আই লাভ ইউ তনয়া , তুই ছাড়া সত্যি রে আমি অসহায় পুরো , সারাটা জীবন এভাবেই পাশে থাকিস আমার ..." ওপ্রান্ত থেকে বয়ে আসা কন্ঠস্বরে ভর করে দু চার কথা ফুটে উঠলো যেন তনয়ার ঠোঁটের আগায় -- " আর কোনো বাহানা শুনবো না উপাখ্যান, এবার থেকে আমার সব শখ পূরণ করবি তুই , শুকনো কথায় চিরে ভিজবে না আর ...."।
হেসে ফেললো তিনজনেই , এখন সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে তনয়ার , আর মাত্র সাত মিনিট হাতে আছে ; হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে সে বললো -- " শোন না খুব খিদে পেয়েছে বুঝলি , চল টা টা আর তুই বাড়িতে ফোন কর তাড়াতাড়ি .."।
সামান্য "হুম , করছি করছি , চল টা টা " প্রত্যুত্তরের পর 'টুংক টুংক' শব্দে কলটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো আর এদিকে তনয়া এবং পূর্বাসা উৎফুল্ল চিত্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো ক্যান্টিনের দিকে , এবার থেকে যে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করতে হবে , এখনো অনেক'কে অনেক উত্তর দেওয়া বাকি , হয়তো একটু সময় সাপেক্ষ কিন্তু যথাযথ .....।।