ব্যথা
ব্যথা
সকাল প্রায় এগারোটা। ঝকঝক করছে রোদের আলো। একটা মাত্র মেয়ে থাকলেও মণিমালার সংসারে লোক একটু বেশি। বুড়ো মা আছে ওর কাছেই। হয়তো তাই অন্যবোনেরা আর কিছু নিকট আত্মীয়ের আনাগোনা লেগেই থাকে বাড়িতে।
নিজে পাঁচ বাড়িতে কাজ করে যেটুকু রোজগার করে তাতে সংসার চলে যায় । কিছুটা পারলে জমায়। মেয়েটার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। তবে কম বয়েসে বিয়ে দেবার ভুলটা আর করবেনা মেয়ের বেলায়। একটু লেখাপড়াও ঝিলিককে শেখানোর ইচ্ছে আছে। আর ভালো করে খোঁজ নিতে হবে জামাই মদ খায় কি না। যদিও মেয়ে বড় হতে এখনো দেরী আছে। কিন্তু নিজের জীবন থেকে এটুকু শিক্ষা ও নিজে নিজেই পেয়ে গেছে। মণিমালার সংসারটা ভাঙার মূল কারণ তো ঐ মদ। মদ খেলেই তো সেই মানুষটা একদম বদলে যেতো।
দরজাটা খোলাই ছিলো। আস্তে করে বাইরের দরজাটা ঠেলে ঢোকে ও বুলান কাকুদের বাড়ি। না এই বাড়িতে ও কাজ করেনা। এমনিই পরিচিত। যেসব বাড়িতে ও কাজ করে, তারা বেশীরভাগ কন্জুস। রেশনের চাল টাল পথেই বিক্রি করে দেয়। আর কেউ বাড়িতে আনলেও পাখিদেরকে খাওয়ায়।
সুতরাং চাওয়ার প্রশ্নই নেই।
কিন্তু ও বুঝতে পারেনি যে কিছু মানুষ আছে যারা মদ না খেয়েও মাতাল। কাকীকে সবে বলেছে, রেশন তুলেছে কি না ওমনি কোত্থেকে বুলানকাকু এসে ওকে তাড়া দেয়, "এই তুই যা তো! তুই যা!"
হ্যাঁ, ওরা গরীব বটে। কিন্তু মানুষ তো, বেড়াল কুকুর নয়। চোর ও নয়! পড়াশোনা জানা শিক্ষিত লোক নাকি এরা। আশ্চর্য! কারোর বাড়ি থেকে কাউকে মানুষ এভাবে তাড়ায়। মনে যে কতটা ব্যাথা লাগে ওরা কি একটুও বোঝেনা ! কাকীও মুখে কুলুপ এঁটে আছে। তার মানে সবাই এটাই চায় যে ও এখন চলে যায় । অতিকষ্টে চোখের জল লুকিয়ে দু একটা অন্য কথা বলে টলে মণিমালা হঠাৎ বলে ওঠে, যাই গো আমি, অনেক কাজ পড়ে আছে। কাকীও বলে,
______হ্যাঁ আয়, আমারও রান্না বাকি । বেশকিছু অবশ্য করবোনা। শুধু খাসীর মাংস আর একটু শুক্তো। তোর দাদা মুরগী খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেছে, তাই।
এবারে আনাজপাতি কুটতে বসে মিলি। বুলানের ছোটো সংসারে তিন জন সদস্য। বুলান, মিলি আর ছেলে পুলক। রেশন থেকে চাল, গম আর আটা পায়।
গমটা মিলে ভাঙিয়ে আটা করে নিজেরাই ব্যবহার করে।
"কি, আছেন নাকি বাড়ি !"
_____হ্যাঁ রে সুশান্ত, আয় আয়।
পেঁয়াজ রসুন কোটা ছেড়ে দৌড়ে এসে দরজাটা খুলে ধরে মিলি। সুশান্ত ঠেলাটা রাস্তার পাশেই রেখে দু তিনটে বস্তা হাতে ঢোকে এসে উঠোনে।
"কিরে চাল এখন কত করে?" জিজ্ঞেস করে মিলি।
_____ষোলো টাকা।
_______ ওমা! আগের বারই তো সতের টাকা করে নিলি। এবার আঠারোই দিবি। আটাও আছে।
______ না নাঃ পারা যাবেনা। আমি অল্পই লাভ করি। আর ঐ চাল হাটেও নিতে চায়না লোকে। যা লাভ করি তা ঐ গমে আর আটায়। চাল রাখতে রাখতে আমার বিছানায় এখন চালের পোকা ঘুরে বেড়ায়। বিক্রিই হতে চায়না। গম, আটাতে আরেকটু ভালো দাম তাও দিতে পারি। চালে পারবোনা।
_____আটা তো আছে নয় কেজি। কিন্তু গমটা দিবনা। আটা করে আমরাই খাই।
বুলান সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। বস্তায় ঢেলে দিতে নেয় চাল গুলো। দেয় ও, কিন্তু হেঁকে ওঠে মিলি,
_______তুমি আবার এখানে কেন?
______ হ্যাঁ ছাড়েন, ছাড়েন। আমিই পারবো।
চলে যায় বুলান।
________কি রে কত হলো?
____দুইশো বিরানব্বুই টাকা। এই নেন।
টাকা ও খুচরো পয়সা হাতে তুলে দেয় মিলির।
______আরে! তিনশো টাকা তো দে এএএএ!
_______চাল রেখে দেন আপনি। পায়েস করে খায়েন। একটু খেজুরের গুড় দিয়েন। দেখবেন কত স্বাদ লাগে!
______হ্যাঁ, চারদিন আর ভাত খাওয়া লাগবেনা।
________ওহো, পায়েস টা কিন্তু টাটকা খায়েননা, বাসি কইরে খায়েন। তাইলে একদম ক্ষীর।
খ্যালখ্যাল করে একাই হাসে সুশান্ত।
_____আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তুই এতগুলা খুচরা দিছিস কেন্? এইগুলা নিয়ে আমাকে একটা দশটাকা দে।
তাই করে সুশান্ত। এবার ঠেলা নিয়ে চলে অন্য বাড়ির খোঁজে। কাল বিকেলে হাটে যেতে হবে। আগে কাজ করতো শিলিগুড়িতে। করোনা এসেছে আর কাজও গেছে। এই লকডউনে শ্বশুর বাড়িতে এসে উঠেছে। ছেলেটাকে এখানকার স্কুলেই ভর্তী করে দেওয়ার কথা ভাবছে। এতো কষ্ট যেন ওকে করতে না হয়। লেখাপড়া শিখলে আরেকটু কম পরিশ্রম করেই পয়সা রোজগার করতে পারবে হয়তো।
ঠেলা গাড়ি টা যখন ভরে যায়, চালাতে চালাতে দশ পাঁচ মাইল হেঁটে যেতে যেতে পায়ে যে কত ব্যাথা হয় বলা হয়না কাউকে । নিজের কাছে নিজেও স্বীকার করতে ইচ্ছে হয় না। সবার খুশী মুখ দেখেই ভুলতে চায় পায়ের ব্যাথা। যতোই লোকে রেশনের মোটা চালকে দূরছাই করুক সুশান্তের কাছে এই চাল ই লক্ষ্মী। প্রতি হাটে অন্ততঃ কুড়ি টাকার উপরে দাম পায় প্রতি কেজিতে। করিতকর্মা জামাই কে পেয়ে বুড়ো শ্বশুরও খুশী। একটাই মেয়ে। মেয়েটা বাড়িতে থাকলে গিন্নিরও একটু সুবিধে হয়। কতদিন আর শরীর চলে। বুড়ো হাড়ে আর কতো সয় !