বৃত্তের বাঁধনে (Part 4)
বৃত্তের বাঁধনে (Part 4)
হৃদয় আজ হয়েছে নীরব- অভাব সেথায় তোমার পরশ,
হৃদয় হলো শ্মশানবৎ, নির্জন শূন্যতায় বসত !!!
হাহাকার করা এ বুক, চোখ বুজে দেখি ওই মুখ...
ভরে থাকে মন স্মৃতিতে, ব্যাথা জমে পাহাড় হৃদয়েতে !!!
হারিয়েছো তুমি অজানার মাঝে,
হৃদয় হলো মরুসম তাই..
তোমার স্মৃতির সিঞ্চনতায়, আমি তোমায় দেখতে পাই..
নিমতলা শ্মশান :
--------------------------
প্রাঞ্জল বাবুর মরদেহ নিমতলা মহাশ্মশানে নিয়ে আসা হয়... ঢেউ-এর ঠাম্মিকে শ্মশানে আনা হয় নি... মা হয়ে সন্তানকে ওই সাদা চাদর পরিহিত, ফুলমালা সজ্জিত সাজে তিনি সহ্য করতে পারতেন না... একদিন যে মা সন্তানকে ফুলের সাজে সাজিয়ে নিজের হাতে প্রথম মুখে অন্ন তুলে দেন, আজ সেই মা-ই কি কখনো নিজের প্রাণতুল্য সন্তানকে চন্দন চর্চিত সজ্জা করে স্বর্গের রথের তুলে দিতে পারে... তিনি তো মা, পাষান তো নন... তাছাড়া এই দুঃসংবাদ পাবার পর থেকেই তিনি একপ্রকার সজ্জা নিয়েছেন... তাই সমুদ্রের দনদন, মানে দিদা আর ভালো মা মানে বৈদেহী দেবী ওনার সাথে ঘরে আছে...
দু'চার কদম এগোলেই প্রাচীন নিমতলা শ্মশান, তার সামনে 'রবিঠাকুর'-এর দাহ করার স্থানটি লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা.... ওনার মরদেহের পায়ে টোকেন নম্বর দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে... সামনের সংলগ্ন মাঠে কাঠের চিতা প্রস্তুত করা হচ্ছে অন্তিম সৎকারকার্য সমাধা করার জন্য... সমুদ্র সেই কাজ তত্ত্বাবধান করতে করতে করতে আড় চোখে বারবার ঢেউ-কে দেখতে থাকে.... কাল ওর সাথে কথা বলার সময় ওকে সরল, উচ্ছ্বল মনে হয়েছিল, যা সমুদ্রের মনের অজান্তেই রিনরিন সুর তুলেছিল... কিন্তু আজ ঢেউ একেবারে শান্ত, নিস্তরঙ্গ হয়ে গেছে... একদম নিশ্চুপ... ওকে দেখে মনে হচ্ছে, ওর মুখের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও কেউ শুষে নিয়েছে... একদম নিষ্প্রাণ... জ্ঞান ফেরার পর থেকে একফোটাও চোখের জল ফেলাতে পারে নি কেউ ঢেউ-এর চোখ থেকে... তার কপালে গোটা দশেক Stitch পড়েছে, গায়ে ধুম জ্বর... সমুদ্র অনেকবার চেষ্টা করেছে সব কাজের মাঝেও যদি ঢেউকে কাঁদানো যায়... কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হয়... একদম শব্দ শূন্য হয়ে যাওয়াটাও ঢেউ-এর পক্ষে ক্ষতিকারক সে জানে... কিন্তু কিছু করারও নেই... ঢেউ যেন আজ নিজেই বোবা হয়ে গেছে... একদম বোবা... ঢেউ রজনীগন্ধার মালায় সাজানো শববাহী কাঠের খাটে শোয়া, নাকে তুলো গোজা চোখবন্ধ মুখে চন্দনের ফোঁটা আঁকা চিরঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া সবচেয়ে কাছের মানুষটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে হতশূণ্য হয়ে বসে রয়েছে, যেন যাবার আগে যেটুকু সময় কাছে পাওয়া যায় সেইটুকুও মূহুর্তও সে তার বাবাইয়া-কে চোখের আড়াল করতে চায় না... ছোটো থেকে বড় হওয়া সব স্মৃতি এক লহমায় তার মনে ভিড় করে আসে... বাবাইয়ার আদর, শাসন, অভিমানী ঢেউকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে রাগ ভাঙানো, নিজের যত্নে ওই একরক্তি ছোট্ট মেয়েটাকে পূর্ণাঙ্গ যুবতী হিসেবে হিসেবে বড় করে তোলার দৃশ্যগুলো ঢেউ-এর চোখের সামনে ভেসে ওঠে আজ বারবার... বড় হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা অভিমান, কিছুটা Generation Gap-এর কারনে তৈরি হওয়া দূরত্বের জন্য নিঃশব্দে আজ ঢেউ নিজেকেই দায়ী করে... এই মানুষের হাতের ক্ষণিক সময়, সেইটুকুকেও উপেক্ষা, যন্ত্রণার আঘাতে জর্জরিত না করে মিষ্টি-মধুর সম্পর্কগুলোকে উপভোগ করাই বোধহয় ভালো নিজের মতো করে... বেশি Judgemental হয়ে লাভ কি !!! দিনের শেষে এই একটাই তো জীবন... কতবারই বা অবহেলা করবে নির্দ্বিধায় !!! মানুষ যখন কাছে থাকে, তখন হয়তো কেউ উপলব্ধি করে না তার গুরুত্ব... যখন দূরে চলে যায়, তখন তৈরি হওয়া ওই গভীর শূন্যস্থান পূরণের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না... একদলা কান্না ছাড়া...
হঠাৎ করে ঢেউকে ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে এবার সমুদ্রকে এগিয়ে আসতে হয়... ধীরে ধীরে পেছনে এসে দাঁড়ালেও বোঝে ঢেউ তার অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞাত... সত্যিই আজ ও নিজের মধ্যেই নেই...
সমুদ্র : চলো ঢেউ, সময় হয়ে এলো... এবার যে যেতে হবে... ওঠো...
আবারও প্রাণহীন মূর্তির মতো বসে থাকে ঢেউ... আজ যেন কারুর কন্ঠস্বরই ওর কানে পৌছচ্ছে না... এমন কি সমুদ্রেরও না... অর্ভিরা ওর পাশেই বসেছিল... সমুদ্র পাশে এসে দাঁড়াতেই সামপ্রিয়র চোখের ইশারায় অর্ভি ঢেউকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মৃদু ধাক্কা দেয়....
অর্ভি : ঢেউ উউউউ.... ঢেউ উউউউ....
প্রিয় বন্ধুর হাতের ছোঁয়াতে ঢেউ-এর চমক ভাঙে... সামনের দিকে তাকাতেই দেখে সমুদ্রের চোখে চোখ পড়ে যায়... দেখে সমুদ্র ঢেউ-এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে... ঢেউ কোল ভরা জল নিয়ে চোখ তুলে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ... সমুদ্র এগিয়ে এসে ঢেউ-এর মাথায় হাত রাখলে ঢেউ আর নিতে পারে না... উপস্থিত সকলকে অবাক করে সমুদ্রের হাতটা জড়িয়ে ধরে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে ঢেউ... আজ সমুদ্রের চোখেও জল... প্রাঞ্জলবাবু কর্মক্ষেত্রে তার গুরু হলেও বাস্তবে তার পিতার থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না... সবচেয়ে বড় কথা তাদের অসমবয়সী বন্ধুত্ব... রাজনীতি থেকে অর্থনীতি হয়ে ইতিহাস- কোনো বিষয়েই যে তাদের আড্ডার কমতি ছিল না... পেশায় Archeologist হলেও তাদের সম্পর্কের মিষ্টত্বে কিন্তু কোনো কমতি ছিল না... তাই প্রাঞ্জলবাবুর এইভাবে অস্বাভাবিকভাবে আচমকা চলে যাওয়াটা সে নিজেও এখনো মন থেকে মানতে পারে নি... বলা ভালো, বিশ্বাসই করে উঠতে পারে নি এখনো... মন এখনো বারবার বলছে, এইবার বুঝি গমগমে গলায় ডেকে উঠবেন 'বেদ' বলে...
ঢেউ : (ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে ওঠে) আমি পারব না বেদ... তুমি করো... বাবাইয়া তো তোমাকে আমার থেকে কিছু কম ভালোবাসতো না... আমি পারব না মুখে আগুন দিতে... পারব না.... আমি কাছে থেকেও কিছু করতে পারলাম না বেদ... আমি রক্ষা করতে পারলাম না... আমি চেষ... চেষ্টা করেছিলাম...কিন... কিন্তুউউউ পারলাম না... বেদদদদদ....
ঢেউ-এর আকুল করা কান্নায় চারিদিক যেন হাহাকার করে ওঠে...
সমুদ্র : এইভাবে ভেঙ্গে পড়ো না ঢেউ... শরীর খারাপ করবে... Please ঢেউ, লক্ষ্মীটি কথা শোনো...
ঢেউ : আমায় অনুরোধ করো না বেদ... আমি রাখতে পারব না... আআআ... আমিইই....
সমুদ্র : কিন্তু ঢেউ....
নেপথ্যে : আমি করব মুখাগ্নি...
পেছন থেকে এক জলদগম্ভীর স্বর ভেসে আসায় ঢেউ আর সমুদ্র অবাক হয়ে পেছনে তাকায়... দেখে IPS Officer-এর Uniform পড়া সমুদ্রের বয়সী এক সুদর্শন যুবক... বিস্মিত সমুদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ায়... ঢেউ-ও অর্ভি আর সামপ্রিয়র সাহায্যে উঠে দাঁড়ায়...
সমুদ্র : আপনি !!! আপনাকে তো ঠিক...
পরাগ : আমি IPS Officer পরাগ রায়চৌধুরী, প্রাঞ্জল রায়চৌধুরীর প্রথম সন্তান...
ঢেউ : মা... মানে !!!
হঠাৎ করেই ঢেউ-এর মাথাটা যেন একটা টাল খেয়ে যায়... পাশে দাঁড়ানো সমুদ্রের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে...
পরাগ : Miss Prisha Roychowdhuri, daughter of Priyam Roychowdhuri... Right !!!
ঢেউ : হ্যাঁ.. (একটু থেমে) প্রিয়ম রায়চৌধুরী আমার Biological Mother... কিন্তু আপনি !!!
পরাগ : প্রিষা, আমি আমার বাবার প্রথম সন্তান... নিজের ঔরসজাত... তোমার মতো জারজ নই...
কথাটা শোনামাত্রই তার হাতটা আলগা হয়ে আসে... অজান্তেই কখন যেন সমুদ্রের হাতটা ছেড়ে দেয়.... সমুদ্র বুঝতে পারলেও সবার সামনে কিছু বলে উঠতে পারে না... কিন্তু ভবিষ্যত পরিস্থিতির জটিলতা আঁচ করেই সমুদ্র মূহুর্তেই তার বর্তমান কর্তব্য স্থির করে নেয়... ততক্ষণে পরাগের কথাগুলো ধারালো ছুরির মতো ঢেউ-এর কান ভেদ করে সোজা ওর হৃদয়টাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে... মূহুর্তের জন্য ঢেউ-এর চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়... মাথাটা তার অনেকক্ষণ থেকেই ঘুরছিল... এবার বাক্যবানে জর্জরিত হয়ে টলে পড়ে যেতে গেলেই অর্ভি আর সামপ্রিয় তাকে ধরে ফেলে... সমুদ্র হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে নেয়... অর্ভি আর সাম ঢেউ-এর একদম ছোটোবেলার বন্ধু, কিন্তু সমুদ্র-এর সাথে এখনো ঢেউ সব সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারে নি... কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যদিও ঢেউ নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা উঁচু করে পরাগের দিকে তাকায়...
সমুদ্র : (ঋজু স্বরে) দেখুন, এখানে এই মূহুর্তটায় এইসব কথা বলা...
আচমকাই সমুদ্রকে থামিয়ে দিয়ে ঢেউ বলে ওঠে,
ঢেউ : দাঁড়াও বেদ... ওনাকে বলতে দাও... আজ আমিও শুনতে চাই, যে আর কি কি পাপ আমি করেছি !!! আর দেখতেও চাই যে আমার অতীতে আর কি কি কলঙ্ক আছে, যার সম্পর্কে আমি এখনও জানি না... আপনি বলুন অফিসার, আর কি অভিযোগ আছে আপনার !!! আজ আমি সবটা শুনবো...
পরাগ : আজ না বললে কবে বলব !!! আর অতীত যে সবসময় স্মৃতি মধুর হয়না প্রিষা ম্যাডাম, সেটা এবার আপনারও জানা দরকার.. অনেকদিনই তো হলো... যাই হোক,কাজের কথায় আসি.... যেটা বলছিলাম, আমার বাবা যখন কলেজে প্রথম চাকরি পায়, তখন মায়ের সাথে তার আলাপ... তারা প্রথমে মন্দিরে, পরে Registry করে বিয়ে করে.... এর ঠিক দু'বছরের মাথায় আমি আসি ওদের জীবনে- ওদের ভালোবাসার অঙ্কুর হয়ে... একটা মেয়েকে বাবা-মায়ের শাসন-স্নেহ, ভাই-বোনের সাথে হাজারো খুনসুটি, তার ঘর যেখানে ছোট্ট থেকে তার বেড়ে ওঠা- সবটাই ছেড়ে চলে আসতে হয় অন্যের ঘরে... আবার কেউ কেউ তো খুব বিশ্বাস করেই ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে ঘর ছাড়ে... অবশ্য সব ভালোবাসার মানুষ সেই ভালোবাসা, বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারে না...,
সমুদ্র : কিন্তু ঠাম্মি কেন কিছু জানেন না !!!
পরাগ : দাদুর তখন Cancer... ঠাম্মি ওনাকে নিয়ে তখন ব্যস্ত... ওরা ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল সবাইকে সবকিছু জানানোর জন্য... প্রেমের শুরুতে হাজারো ভালোলাগার অনুভূতিগুলো যেন চারদিক হতে জড়িয়ে ধরে... মনে একরাশ ভালোলাগার রেশ, চোখে মুখে ধরা পড়ে উৎফুল্লতা... চারিদিক থেকে যেন হঠাৎ করেই নিজেকে খুব সুখী সুখী মনে হয়, ওই যাকে বলে 'সুখানুভূতি'... কিন্তু Unpredictable Life-এ হঠাৎ করেই সুখ জড়িয়ে ধরে, আবার হঠাৎ করেই সুখ চলে যায় ফাঁকি দিয়ে... ঠিক এমনটাই হলো আমাদের জীবনে... আমি তখন বছর পাঁচেকের... তখন বাবা University-তে Professor হয়ে গেলেন... কিন্তু ততদিনে মিস প্রিয়মের দৃষ্টি পড়েছে... একদিন সেমিনারে ড্রিংসের সাথে ড্রাগ মিশিয়ে... (কথাটা বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে পরাগের, তাও বলতে থাকে সেইভাবেই) যার পরিণাম এই প্রিষা... সেই ঘটনার পর থেকে প্রিয়ম বাবাকে Blackmail করতে শুরু করে, ওনার কেরিয়ার শেষ করে দেবার... ওই রাতের ঘটনা আমার মায়ের আত্মসম্মানে খুব আঘাত করেছিল... আমার মা অভিমান করে বাবাকে মুক্তি দিয়ে আমাকে নিয়ে অন্য চাকরি নিয়ে সারাজীবনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায়... এটাই আমার মায়ের বাবার কাছে শেষ চাওয়া ছিল... সেইদিনটা ছিল আমার বাবার মায়ের '10th Day of Love'... ভালোবাসা প্রকাশের কোনো নির্দিষ্ট দিন থাকে না, তবুও বিশেষ দিনগুলোতে ভালোবাসার মূহুর্তগুলোকে একটু রঙিন করে সাজিয়ে তোলা... কিন্তু আমাদের রঙিন স্বপ্নগুলো একটু একটু করে ফিকে ধূসর হয়ে গেল শুধুমাত্র ওই প্রিয়মের জন্য... প্রিয়মকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় বাবা শুধুমাত্র এই মেয়েটার আগমন বার্তা পেয়ে... এই মেয়েটা আর ওর মায়ের জন্য আমাদের জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল... আমাদের কি অপরাধ ছিল, বলতে পারেন !!! আমি আর আমার বাবা-মা... আমাদের তিনজনের এই হাসিখুশি সংসারটা ভেঙে গিয়েছিল শুধুমাত্র এই দু'জন মানুষের জন্য... সত্যি বলতে কি, শুধুমাত্র এই মেয়েটার জন্য... সেইদিন যদি ও এই পৃথিবীতে না আসত, তবে আমার বাবা ওই প্রিয়মের বিরুদ্ধে প্রতারণা করার অভিযোগে থানায় অভিযোগ করতো... কিন্তু না... শুধুমাত্র এই প্রিষার মুখের দিকে চেয়ে পারে নি... আর যার ফল ভুগতে আমাকে আর আমার মাকে... আমার মা সারাজীবন একপ্রকার নির্বাসনেই কাটিয়ে দিল... আমার বাবাকে আমার থেকে, আমাদের থেকে দূরে থাকতে হলো... আমি কোনোদিনও পরিবার কাকে জানতেই পারলাম না... দাদু-ঠাম্মি তো জানতেই পারলো না আমাদের অস্তিত্ব... শুধুমাত্র এই প্রিষার জন্য... Just for this Selfish Girl...
ঢেউ যেন আবার পাথর হয়ে গেছে... কথা হারিয়ে গেছে তার... কি বলবে কিছুই জানে না !!! শুধু কানে বাজছে কিছু শব্দ, 'Just for this Selfish Girl' বা ও অনাকাঙ্ক্ষিত এই পৃথিবীতে... ওর জন্য ওর বাবাইয়ার সংসার ভেঙেছিল...
পরাগ : এইবার এই মেয়েটার জীবন আমি তছনছ করে দেব... প্রাঞ্জল রায়চৌধুরীর মৃত্যুরহস্যের তদন্তের ভার আমার উপর এসেছে... ওনার সৎকার্য সমাধা হলেই আমি প্রিষাকে Arrest করব...
সমুদ্র : Just Shutttt Upppp.... I must have to say, just keep your mouth shut Officer... Enoughhhhh is Enoughhhhh.... Everything have some Limit.... but already you have crossed all of your Limit...
সমুদ্রের গলার আওয়াজে হটাৎই চারিদিক মুখরিত হয়ে ওঠে.... মনে মনে প্রমাদ গোনে অর্ভি.... এখানে উপস্থিত আর কেউ না জানলেও সে খুব ভালো করেই জানে যে তার শান্ত দাদাভাই রেগে গেলে ঠিক কি মূর্তি ধারণ করে !!! তাই সে সমুদ্রকে থামানোর চেষ্টা করলে সমুদ্র নিজেই তাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়...
সমুদ্র : অনেকক্ষন ধরে সহ্য করছি আপনার কথা... কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে আপনি যে অভিযোগ করছেন সেগুলো সত্যি?? আমরা তো আপনার মুখের কথা শুনছি শুধু... আপনি যে মিথ্যা বলছেন না তারও তো কোনো প্রমাণ নেই... এবার অন্তত এটা বলবেন না যে পুলিশ এর উর্দি পরলেই সব কথা বেদবাক্য হয়ে যায়... আপনি তখন থেকে একটা মেয়েকে এই অবস্থায় দাড়িয়ে যা নয় তাই বলে অপমান করে যাচ্ছেন... তাকে কটু কথা বলছেন... আপনার উর্দিটা নিশ্চই আপনাকে একজন মহিলাকে অসম্মান করার এক্তিয়ারটা দেয় না, যতটুকু আমি জানি... তাই ভবিষ্যতে কারোর ওপর এমন অভিযোগ আনতে হলে একটু সবদিক চিন্তা ভাবনা করে নেবেন... আইনের রক্ষক হয়ে এইভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভক্ষক হয়ে যাবেন না যেন.... সেটা আপনাকে মানবে না...
সমুদ্রের স্পষ্ট কথায় একটু অবাকই হয়ে যায় পরাগ..পুলিশের সামনে এমন অকুতোভয় খুব কম মানুষই হতে পারে, তাও একজন মহিলার সম্মানের জন্য... তাই কথার ধরনে একটু অবাক হলেও একটা আলাদা সমীহ তৈরি হয় তার সমবয়সী যুবকটির প্রতি... তবে মুখে প্রকাশ না করে কড়া গলায় বলে ওঠে,
পরাগ : উহুউউউ... বেদ ব্যানার্জি, Arrest Warrant আমার সাথেই আছে... প্রাঞ্জল রায়চৌধুরীর অন্তিম সময় একমাত্র এই মেয়েটাই ছিল আমার বাবার কাছে... আর এইরকম একটা জারজ মেয়েকে নিয়ে আপনি আপনার স্যারকে যে কথা দিয়েছিলেন, সেটা রাখবেন কি না সেটা নিয়ে ভাবারও কিন্তু...
আচমকাই কথার মাঝে পরাগকে থামিয়ে দিয়ে সমুদ্র অদ্ভুতভাবে মুচকি হেসে ওঠে, এ যেন এক তাচ্ছিল্যের হাসি....
সমুদ্র : থামুন অফিসার, অনেকটা অতিরিক্ত কথা বলে ফেলেছেন... ভুলে যাবেন না, আপনি এখানে আপনার Duty করতে এসেছেন... কারোর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা করতে নয়... আর কি যেন তখন থেকে তোতা পাখির মতো একটা শব্দ বলে চলেছেন- 'জারজ'... আপনি স্বয়ং এই শব্দটার প্রকৃত অর্থ বোঝেন !! বোধ হয় বোঝেন না... তবে আজ জেনে নিন, সহজ বাংলা ভাষায় জারজ তাদের বলে যাদের এই সমাজে কোনো পিতৃপরিচয় থাকে না বা সমাজ যাদের অবৈধ বলে আখ্যা দেয়... যে সন্তানদের কোনো দায় দায়িত্ব পিতা কখনোই নিজের কাঁধে তুলে নেন না... তবে একটা জিনিষ মনে রাখবেন একজন পুরুষের সাহায্য ছাড়া কিন্তু একজন মহিলার পক্ষে সন্তান জন্ম দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়.... সেটা সেই পুরুষের সম্মতিতেই হোক বা অনিচ্ছায়...
এক্ষেত্রে কিন্তু ব্যতিক্রমটাই ঘটেছে.... আমি যতদূর জানি, আমার স্যার শ্রদ্ধেয় প্রাঞ্জল রায়চৌধুরী নিজেই এই মেয়েটির অর্থাৎ প্রিষা রায়চৌধুরীর সমস্ত দায়িত্ব নিজে হাতে পালন করেছেন এবং তিনি একাধারে যেমন প্রিষার বাবাইয়া, অপরদিকে তার মাও বটে.... কারণ একজন পুরুষ যে চাইলেই মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব দুটোই পালন করতে পারেন সুনিপুণভাবে আমার স্যার তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন... তাই সজ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে তিনিই যে প্রিষার শ্রেষ্ঠ বাবা বা প্রিষা যে তার নিজগুণে প্রাঞ্জল স্যারের শ্রেষ্ঠ কন্যা সেটা আপনি চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেন না... তাই ভবিষ্যতে ওকে জারজ বলার আগে দুবার হলেও ভাববেন, কারণ আপনি হয়তো ভাবছেন অফিসার যে আপনি শুধুমাত্র মেয়েটিকেই অপমান করছেন তা কিন্তু নয়, বাস্তবে আপনি আপনার বাবাকেও অপমান করছেন... আশা করি আমি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি...
সমুদ্রের অকাট্য যুক্তির কাছে আজ পরাগের দীর্ঘদিনের লালিত চিন্তাভাবনার কঠিন প্রাচীরেও ফাটল ধরতে শুরু করে... সত্যিই তো এইভাবে তো কোনোদিনও সে ভেবেই দেখে নি... ছোট থেকেই যা দেখেছে, সহ্য করেছে- তার সাথেই নিজের যুক্তি মিশিয়ে নিজের মতো করেই ভেবেছে... সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনোদিনও তো সে তার বাবার মুখোমুখি দাঁড়ায় নি.... এমনকি তার বাবার অসুস্থতার খবর পেয়েও আসে নি... যদিও তার উপায়ও ছিল না, বাবার অসুস্থতার খবর পাবার পরেই তো পাপড়িকে নিয়ে হসপিটালে ছুটতে হয় তাকে আর মাকে... আর ভোর রাতে তাদের কোল আলো করে আসে এক ছোট্ট কুড়ি- তাদের 'পরশ'... তারপরেই আসে বাবার মৃত্যুর খবর... মা আসতে চাইলো না, পাপড়ির কাছে আছে... তাহলে আজ কিসের ভিত্তিতে এতগুলো কটু কথা শুনিয়ে ফেললো মেয়েটাকে !!! সে যে জানে না বা জানতো না বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন তো নয়... কিন্তু, সে তো এগিয়ে আসে নি তার বাবাকে রক্ষা করতে.... অবশ্য তার যে একটা কারন নেই, এমনটাও নয়... তবে সেসব সময় এলেই প্রকাশ পাবে নতুবা নয়...
তাই মন থেকে দমে গেলেও সর্বসমক্ষে নিজেকে প্রকাশ করে না পরাগ... বরং আরো কঠিন গলায় বলে ওঠে,
পরাগ : আপনি কিন্তু এবার যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছেন বেদ... শুধুমাত্র বাবার প্রিয় ছাত্র বলেই সবসময় রেয়াত করবো এমনটা নাও হতে পারে, সেটা মাথায় রাখবেন...
আজ একদিকে তার স্যারের দেওয়া আদেশ, অন্য দিকে ঢেউ এর প্রতি তার দায়িত্ব তথা বন্ধুত্বের টানাপোড়েনে সমুদ্র নিজেই বিহ্বল... তাই হয়তো আর মাথা ঠিক রাখতে পারছে না... তাই শালীনতা বজায় রেখেই বলে ওঠে,
সমুদ্র : আমি সারাজীবন অন্যায় এর সাথে আপোষ করিনি কখনো... স্যার আমায় সবসময় মাথা উঁচু করে কথা বলতে শিখিয়েছেন... তাই উচিত কথা বলতে কখনই আমার গলা কাঁপে না... এর জন্য যদি কোনো শাস্তি আমার প্রাপ্য হয়, হবে...
সমুদ্রের কথা শেষ হবার আগেই ঢেউ ধীরপায়ে এগিয়ে এসে পরাগের দিকে নিজের দুটো হাত বাড়িয়ে দেয়
ঢেউ : নিন অফিসার, হাতকড়াটা এখনই পরিয়ে দিন... এতদিন জানতাম অন্ততঃ বাবাইয়া আমার আপন.... এখন তো না বাবা আমার আপন, আর মা তো সেই কবেই... (একটা অদ্ভুত হাসি হাসে ঢেউ) আজ নিজেকে ফেলনা বলে মনে হচ্ছে... অস্তিত্বহীন... গোটা পৃথিবীটা এক লহমায় অচেনা হয়ে গেল... সবচেয়ে কাছের মানুষটাকেই চিনতে পারি নি... আর... (কথা বলতে বলতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, দ্রুত একহাত দিয়ে জলটা মুছে নিয়েই বলে ওঠে) বে... বেদ, বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে আমি আপনাকে মুক্ত করলাম... আপনি আমার হয়ে যথেষ্ট লড়াই করলেন এতক্ষণ, তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ... কিন্তু, তাতে কি আমার জীবনের সত্যিটা বদলে যাবে বলুন !!! আর যতই আপনি আপনার স্যারের মতো আধুনিক মনস্ক হোন না কেন, তাতে সমাজ তার মুখটা বন্ধ করবে কি !!! করবে না তো !! তাই আর আপনাদের দয়ার পাত্রী হয়ে বাঁচতে চাই না... এমনিতেই আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন... আমার বাবাইয়া তো আমার জন্য নিজের ভালোবাসার সংসারটাই Sacrifice করে দিল... যদিও নিজের সাথে, আর ওনাদের প্রতি এই অবিচারটা করে উনি একদমই ঠিক করেন নি... তাই জেনে বুঝে আমার মতো মেয়ের সাথে আপনার মতো দেবতুল্য মানুষের জীবন আমি জড়াতে দিতে পারি না... ক্ষমা করবেন... পারলে ভুলে যাবেন আমাদের এই ক্ষণিক পরিচয়টুকুকে... তবে একটাই অন্তিম অনুরোধ রইলো, বাবাইয়া মানে আপনার স্যারের মৃত্যুর কারণটা খুঁজে বার করবেন Please... আপনারা দু'জনই তো ওনার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী... চলুন অফিসার... আপনার তো দেরী হচ্ছে তাই না !!!
ঢেউ-এর সাথে পরিচয় হওয়া থেকে ঢেউ খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সমুদ্রকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করেছিল, কিন্তু হঠাৎই এই 'আপনি' ডাকটা ডেকে যেন ঢেউ সমুদ্রকে ওর জীবন থেকে শত যোজন দূরে ঠেলে দিল...
সমুদ্র : দাঁড়াও ঢেউ... স্যার অন্তিম মূহুর্তে আমাদের দু'জনের হাত এক করে দিয়েছিলেন, সেটা তো তোমার অজানা নয়... তুমি আর আমি তো সেই মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটাকে একপ্রকার নীরব সম্মতিই দিয়েছিলাম... তবে আজ এইসব প্রশ্ন উঠছে কেন !! কতোটা ভরসা, কতোটা বিশ্বাস করে তোমার বাবা তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলো তো !!! আমি নিজেই এইসব ভাবনায় বিশ্বাস করি না... তাই তোমার জন্মের এই সত্যিটা আমার ভাবনার বদল ঘটাবে, তুমি এটা ভাবলে কি করে !! জন্মের উপর কোনো সন্তানেরই হাত থাকে না !!! আর দুটো মানুষের সম্পর্ক তাদের নিজেদের ধ্যানধারণার ওপর নির্ভর করে, বাহ্যিক সত্যের উপর নয়... তুমি হাত ছাড়তে চাইলেও আমি তোমার হাত ছাড়তে চাই কি না, জানতে চাইলে না তো !!!
সামপ্রিয় : এই সিয়া, এইটা তোর দাদাভাই-ই তো !!! শালাবাবুর মনে যে আজ অন্য সুর শুনতে পাচ্ছি !!! তুই-ও কি তাই শুনতে পাচ্ছিস !!!
অর্ভি : বলছিস !!! ব্যাপারটা তো পুরো ঘেটে ঘ হয়ে গেল মনে হচ্ছে...
সামপ্রিয় : আমরা হতে দিলে তো... আমরা আছি কিসের জন্য !!!!
ঢেউ : (শীতল অথচ কঠিন স্বরে) আমার জন্মের সত্যিটা জানার পর সম্ভব হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম বেদ... এখন আমার বেঁচে থাকা প্রতিটা নিঃশ্বাস আমার দমবন্ধ করে দিচ্ছে... আমি শুধু বেঁচে রইলাম, এই মৃত্যুরহস্যের অন্তটুকু জানার জন্য... আর হাত ধরার কোনো প্রশ্নই ওঠে না... আমার জীবনের পঙ্কিলতায় আমি আপনাকে জড়াতে চাই না... শুধু আপনি কেন, অর্ভি আর সামপ্রিয় কারুরই প্রবেশাধিকার রাখব না আমার এই....
'কঠিন', 'শীতলতা' শব্দগুলো সবসময়ই দাপট, গাম্ভীর্য, কিংবা আধিপত্যকে প্রকাশ করে ফেলে... না কি ন্যায়-তেও কঠিনতা থাকে !!! সবসময়ই কি কঠিন পুরুষদেরই হতে হবে !!! কেন, নারীরা কি কঠিন হতে পারে না !!! ন্যায় করতে পারে না !!! আর সেই কঠিন হৃদয়কে বিগলিত করা কি এতটাই সহজ কাজ !!! তবে ভালোবাসা 'অন্তহীন' - ভালোবাসার অন্তহীনতা ঠিক কতটা অন্তহীন তা শেষ সীমায় না এলে বোঝা দুষ্কর... আবার কখনো কখনো অনুরক্তির অনুভূতিরা এতটাই চোরা স্রোতে ডুবে থাকে যে, সেখান থেকে তাদের টেনে তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে...
সমুদ্র ঢেউ-এর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকায়... ওর হাতটা নিজের মুঠোবন্দী করে চোখের অব্যক্ত ভাষায় ওকে বলে,
সমুদ্র : (মনে মনে) ঢেউ, আজ তোমার জীবনের এমন একটা দিন যেখানে মাটি থেকে শিকড়সহ গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে... শিকড় ছেঁড়ার কষ্ট, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হবার যন্ত্রণা আজ তোমার... হয়তো আমি তোমার সব যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারছি না, কিন্তু এই মূহুর্তে আমি তোমার হাত কিছুতেই ছাড়তে পারব না... তুমি চাইলেও না... তুমি পরিস্থিতির শিকার ঢেউ... আমি তোমাকে সম্মান করি তোমার আত্মসম্মানবোধ, সততা, আর আলাদা ব্যক্তিত্বের জন্য.... NGO-তে তুমি জীবনে পরাজিত মানুষগুলোকে জীবনে ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনযুদ্ধে জেতার স্বপ্ন দেখাও... সবাইকে শেখাও- 'জীবন মানে একা বাঁচা নয়, সকলকে নিয়ে আনন্দে বাঁচা... আমরা যেখানেই থাকব, সকলকে নিয়ে একসাথে চলব'... এইটাই 'ঢেউ'... আমার 'ঢেউ'... আমাদের 'ঢেউ'... মামাই আর ভালোমার আর্শীবাদ নিয়ে আজ বিকেলে যাব তোমার কাছে... কথা দিলাম...
একটা ক্লান্তির হাসি হেসে সবাইকে পেছনে ফেলে ঢেউ যন্ত্রমানবের মতো এগিয়ে যায় পুলিশ ভ্যানের দিকে... গাড়িতে ওঠার আগে একবার ঢেউ ফিরে তাকায় পরাগ-এর দিকে... ভালোবাসা আর ঘৃণার দ্বৈধতা ছুঁয়ে থাকা এই দুই সহোদর-সহোদরা- যারা সমাজ, রীতি, ন্যায় সবদিক থেকেই মানসিক এবং চারিত্রিক দিক থেকে আলাদা... তাদের দুই পৃথিবী পরস্পরের বিপরীতে- দু'জনের সমাজ দু'রকম, জীবনধারা আলাদা... রয়েছে দু'জনেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ, দৃষ্টিভঙ্গি... একজনের জন্ম অপরাধের অন্ধকারে হলেও সে ভালোবাসায় দীপ্তিশীল... অন্যজন ভালোবাসার অঙ্কুর হয়েও, বৈধ জন্মের আলোকবৃত্তে থেকেও ভালোবাসার উজ্জ্বলতা থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে... সে শুধুই অপরাধকে ঘৃণা করে.... শুধুই ঘৃণা... এই দুই সহোদর-সহোদরা কি কখনো নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এক সীমানায় আনতে পারবে !!! হতে পারবে তারা সমমনস্কতার !!! তাদের পিতার মৃত্যু রহস্যের সমাধানের অন্তিমে শুধুমাত্র হৃদয়ের দুর্বলতা কি এদের রক্তের বন্ধনে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে, আত্মার বন্ধনে বাঁধতে পারবে !!!
পরাগ চিতায় আগুন দেয়.... দূর থেকে Prison Van-এর ভেতর থেকে জলভরা চোখে তাকিয়ে থাকে ঢেউ... মনে মনে উচ্চারণ করে এক অমোঘ সংস্কৃত শ্লোক,
ঢেউ : 'দিব্যান লোকান স্ব গচ্ছতু'... আমি পারলাম না বাবাইয়া তোমার কাছে যেতে... ওরা যাই বলুক, আমি জানি তুমি ওপর থেকে সব দেখতে পাচ্ছো... তুমি তো জানো বলো, তোমার ঢেউ মা নির্দোষ... আমার জন্য তুমি সবকিছু হারিয়েছো একদিন... আজ আমি তোমায় কথা দিচ্ছি সুযোগ পেলে আমার মায়ের করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি নিজেই করবো দেখো !!! আর তোমার বেদকে সামলে রেখো... আমি তো আর থাকতে পারলাম না ওর জন্য... দূর থেকে হলেও তুমি দেখো ওকে, সামলে রেখো ওকে বাবাইয়া... (ঢেউ-এর চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে শুরু করে) বে... বেদদদদ...
তাই তো না চাইতেও সমুদ্রের আকুলতা ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে ঢেউ-এর অবাধ্য চোখ চলে যায় সমুদ্রের দিকে... ঝরে পড়ে কয়েকফোটা মুক্তোদানা... এই যুগলের সবকিছুর উত্তর লুকিয়ে আছে 'অন্তহীন'-এর অন্তরে... সমুদ্রের চোখের অব্যক্ত আশ্বাসবাণী পড়তে এতটুকু অসুবিধা হয় না ঢেউ-এর... সেই আশ্বাস-এ ছিল, ভালোবাসা আর ছায়াঘেরা অন্ধকারবৃত্তে থাকবে না, থাকবে ছায়াঘেরা আলোকবৃত্তে... ভালোবাসার জন্য সমাজের তথাকথিত নিয়ম-নীতি, চিরাচরিত বদ্ধমূল ধারণা, অচলায়তন ও অন্ধকারবৃত্তের বাইরে এসে নিজেকে নিরপেক্ষ করে গড়ে তোলা... যেখানে থাকবে ভালোবাসার বিপরীতে থাকা মানুষটাকে সমাজের আঘাত থেকে রক্ষা করার অসীম প্রচেষ্টা... এক স্নিগ্ধ সম্পর্কের জন্য প্রেমের উন্মাদনা, ভালোবাসার আকুলতা... কিন্তু ভালোবাসা কি এত সহজে পাওয়া যায় !!!
শত বিবিধতা থাকা সত্ত্বেও পরাগ, সমুদ্র আর ঢেউ-এর জীবন একটা সূক্ষ্ম সুতোয় বাধা পড়ে গেছে- সেই সুতোর নাম 'প্রাঞ্জল রায়চৌধুরী'... তারা নিজের দ্বৈধতার উর্ধ্বে উঠে পারবে কি একযোগে এই মৃত্যুরহস্যের সমাধান করতে !!! ওদিকে পরাগের দিকে তাকিয়ে থাকে এক কঠোর দৃষ্টি... মনে মনে শপথ গ্রহণ করে নিজের দায়িত্ব কঠোরভাবে পালন করার... আর বলে ওঠে,
পরাগ রায়চৌধুরী, এমন একদিন আসবে যেদিন তুমি নিজেই এই অন্যের পাপের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া মেয়েটার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে... Just Wait and Watch...
নীরব অপরাহ্ন, চলে গেছে অনেক সময়...
অনেক ভাবনা, ফিসফিস করে কথা কয়...
ও কি !!! নদীর পাড়ে জ্বলছে কার চিতা !!!
পুড়ছে মানুষের দেহলতা, পুড়ছে অহংকার
পুড়ছে সুখ-দুখ, দহনে জীবন শুদ্ধ....
এরপর নাভি ভাসান শীতল জলে....
(কবিতা সৌজন্য : শ্মশান, রচয়িতা : তপতী চ্যাটার্জি)

