বৃত্তের বাঁধনে (Part 3)
বৃত্তের বাঁধনে (Part 3)
'ভাসানের সুরে বোধনের গান'
Seven Star Hospital :
-----------------------------------
প্রাঞ্জলের কেবিনের দরজা ঠেলে ঢেউ আর সমুদ্র প্রাঞ্জল বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়... ওষুধের প্রভাবে ঘোরের মধ্যে থাকলেও ঘরে কারুর উপস্থিতি ঠিকই টের পান উনি... আসলে নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষ তো... একজন তার আত্মজা, নিজের সন্তান... আরেকজন সন্তান তুল্য, নিজের সুযোগ্য শিষ্য... তার ঢেউ আর সমুদ্র... কিন্তু উপস্থিতি বুঝলেও তিনি সাড়া দিয়ে উঠতে পারেন না... বলা বাহুল্য, উনি চান না... জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত কখনো আসে, যখন একজন মানুষ চুপ করে যান... বলাবাহুল্য তার কাছে কোনো উত্তরই অবশিষ্ট থাকে না... শুধুই নিজের কাছের মানুষগুলোর সান্নিধ্যটা উপভোগ করতে চান... নীরবে, নিঃশব্দে... প্রাঞ্জলবাবুও তার ব্যতিক্রম নন... তিনি জানেন, তার সময় ফুরিয়ে আসছে... তাই তো তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে তিনি আর বিলম্ব করতে চান না... ওদিকে আপাতগম্ভীর, স্বল্পবাক, বই-এর জগতে সর্বদা নিমগ্ন বাবাকে ওইভাবে নিঃসারে শুয়ে থাকতে দেখে ঢেউ আর নিজেকে সামলাতে পারে না... একপ্রকার ছুটে গিয়েই প্রাঞ্জলবাবুকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথা রাখে... গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটা কোনোমতে গিলে কাঁপা কন্ঠে ডেকে ওঠে,
বাবাইয়া
ঢেউ-এর চোখের জলে প্রাঞ্জল বাবুর বুকের কাছটা ভিজে যায়... আজ যে প্রাণপ্রিয় কন্যার চোখের জলের প্রতিটা কণা একজন অসহায় পিতার ভারাক্রান্ত হৃদয়কেও ছুঁয়ে যাচ্ছে... কন্যা মাত্রই রূপ, বর্ণ, শিক্ষা নির্বিশেষে পিতার আদরের রাজকন্যা হয়, তাদের মন ও মনণের একমাত্র অধিশ্বরী... সে পিতা গরীব হোক বা ধনপতি... পিতা-পুত্রীর সম্পর্কে মনের টানটাই যে আসল... আর বাকি সব কিছুই বাহ্যিক, সর্বোপরি তুচ্ছ... তাই প্রবল যন্ত্রণা স্বত্ত্বেও নলবিদ্ধ হাতটা ধীরে ধীরে ঢেউ-এর মাথায় রাখেন প্রাঞ্জলবাবু... মুখে একটাই শব্দ উচ্চারণ করেন, 'ঢেউ মা'
প্রত্যেক কন্যার কাছেই বাবার মুখ থেকে শোনা এই 'মা' ডাকটার একটা আলাদাই তাৎপর্য থাকে, বলা যায় এর থেকে মধুর সম্বোধন বোধহয় আর কিছুই হয় না... ঢেউ-ও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়... এই 'মা' সম্বোধনটা যে তার বড্ড প্রিয়... তাই তো বাবার বুকেই মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে... ঈষৎ জড়ানো স্বরে অভিমানী কন্যাকে জড়িয়ে ধরেই প্রাঞ্জলবাবু বলে ওঠেন,
প্রাঞ্জল : কি হয়েছে ঢেউ !! তুমি কাঁদছ কেন !! আমার ছোট্ট মেয়েটা কি ছোট্টই রয়ে যাবে !!! এতটুকুও বড় হবে না !! দেখো তো, এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদেই যাচ্ছে... তাকিয়ে দেখ, আমি... আমি ঠিইই.... ঠিক আছি... চিন্তার কিছু নেই... এমন কারো না মা... তুমি আমার ঢেউ বুড়ি যে...
বাবা মেয়ের এমন মধুর সম্পর্কের সমীকরণের সাক্ষী থেকে যায় এই হসপিটালের ঘর, ঘরের দেওয়াল-পর্দা, প্রত্যেকটা ওষুধের পাতা, অজস্র ছোট বড় যান্ত্রিক শব্দ করে নিরন্তর চলা যন্ত্রগুলো... অবশ্য আরো একজন আছে, পিতা-পুত্রীর অভিমান-মানভঞ্জন পর্ব দেখে যার মনের গোপন কুঠুরি থেকে আজ বেরিয়ে আসছে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস...মনে করিয়ে দিচ্ছে অতি সযত্নে লুকিয়ে ঢেকে রাখা এক ক্ষতস্থানকে... যদিও মুখের রেখাগুলো সেই ভাব প্রকাশে অনিচ্ছুক... তার অন্তরে যতই রক্তক্ষরণ হোক, সামনের ঘটে যাওয়া দৃশ্যের বহিঃপ্রকাশ রূপে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে তার অন্তরে... যাইহোক, দীর্ঘদিনের এক ঠান্ডা যুদ্ধের সাময়িক অবসান তো ঘটলো... সমুদ্র তাতেই খুশি... হঠাৎ করেই, মেয়েকে আগলানো অবস্থাতেই সমুদ্রের দিকে চোখ পড়ে যায় প্রাঞ্জলবাবুর... ধীর স্বরে ডেকে ওঠে, 'বেদ'...
স্যারের গলার আওয়াজে সাময়িক চিন্তার জাল ছিন্ন হয় সমুদ্রের... সামনের দিকে এগিয়ে যায় ধীর পায়ে...
সমুদ্র : হ্যাঁ স্যার বলুন... জল খাবেন !! আপনার গলার স্বরটা জড়িয়ে যাচ্ছে... কষ্ট হচ্ছে কোথাও !! আমি এক্ষুনি ডক্টরকে ডেকে আনছি....
সমুদ্র বাইরের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে প্রাঞ্জল বাবু বলে উঠেন,
প্রাঞ্জল : দাঁড়াও... কাউকে ডাকতে হবে না... আমি ঠিক আছি... কিন্তু তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে... বলা ভালো তোমাদের দু'জনের সাথেই... আমার যে তোমাদের দু'জনকেই এখন আমার পাশে বড্ড প্রয়োজন...
বাবাইয়ার এহেন কথার ধরনে ঢেউ ততক্ষণে উঠে বসেছে... সমুদ্রের সাথে চোখাচোখি হতেই বোঝে তাদের দু'জনের অবস্থা বর্তমান অবস্থান এক... দু'জনের কাছেই প্রাঞ্জলবাবুর কথাগুলো অনেকটাই ধোঁয়াশার মতোই লাগছে, কারন দু'জনের কাছেই তা অজ্ঞাত... একরাশ প্রশ্ন নিয়ে দু'জনেই প্রাঞ্জলবাবুর মুখের দিকে তাকায়...
যদিও মনে মনে স্থিতধী সমুদ্র ঠিকই বোঝে সেই মহেন্দ্র ক্ষণটি উপস্থিত !!! প্রাঞ্জলবাবুকে সমুদ্র নিজের বাবার মতো শুধুই শ্রদ্ধাই করে না, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে এখন তাদের মধ্যে এক নিবিড় আত্মীয়তা, বন্ধুত্বের সম্পর্ক... তারা পরস্পরকে চেনে, জানে, অনুভব করতে তাদের সমস্ত বলা বা না-বলা সব কথাই... আসলে প্রাঞ্জলবাবু নিজের হাতে, নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন সমুদ্রকে... ওর আধুনিক মানসিকতা অথচ পুরনোকে ধরে রাখার, তাকে নিজের মতো করে সম্মান করার চিন্তাকে প্রাঞ্জলবাবু নিজেও সম্মান করেন... সে যতই সমুদ্র তার ছাত্র হোক... বয়েসে ছোট হলেও মানুষ ভাবনায় বড় হয়... এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি... যতই রক্তের সম্পর্ক না থাকুক- ওনার ভাবনা, চিন্তা, ধ্যানধারণার একজন উত্তরসূরী রেখে যেতে চান এই পৃথিবীর বুকে, যে তার মনণশীলতার ধ্বজা বহন করে নিয়ে সামনের পথে হাটতে পারবে ঠিক তার মতো... তাই তো সমুদ্রের হাতেই তিনি সঁপে দিতে চান এক গুরুদায়িত্ব- তার জীবনের দুই পরম সম্পদকে... কারন সমুদ্র যে যোগ্য... 'তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি'... তাই তো প্রাঞ্জলবাবু আর সমুদ্র এই কলিকালের দ্রোণাচার্য ও একলব্যের শ্রেষ্ঠ নির্দশন... আর সেইজন্যই সমুদ্র অনুভব করতে পারে, প্রাঞ্জলবাবু কি বলতে চাইছেন, কিন্তু ঢেউ-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে শুধুমাত্র পরিস্থিতির চাপে তাকে কোনোকিছুতেই বাধ্য করতে সমুদ্রের অন্তর সায় দিচ্ছে না... কারণ জোর করে তৈরি হওয়া সম্পর্কের ভিতটা ভীষণ দুর্বল হয়... সামান্য আঘাতেও সেটা যে কোনো সময় টলে যেতে পারে... কিন্তু ঢেউ-এর বিপদ আসন্ন জেনেও ওকে একলা পথে হাঁটতে দিতে ভরসা হয় না তার... শুধু ঢেউ কেন !!! সে কি নিজেও কারুর 'Target' নয় !!! তাই ঢেউ-এর পাশে থাকাটাও এখন ততটাই প্রয়োজনীয়...
শিষ্য এবং কন্যার মনোভাব সহজেই অনুমান করতে পারেন প্রাঞ্জলবাবু... তাই অযথা তাদের কৌতুহলের পরীক্ষা না নিয়েই প্রাঞ্জল বাবু মৃদু হেসে দু'জনের হাত চেয়ে নেয়... দু'জনেই প্রথমটায় ইতস্ততঃবোধ করে, যতই হোক, এখনো অপরের কাছে অপরিচিতই... হয়তো কিছু ভাবনা মিলেছে, হয়তো কিছু ভাবনা মেলে নি... তাই বলে তারা একে অপরকে চিনে ফেলেছে, সেটা বলা চলে না... তবে কিছু একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি যে তৈরি হয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য নয়... দু'জনেই সেটা জানেও... তাছাড়া কোথাও যেন প্রাঞ্জল বাবুর প্রতি অবিচ্ছেদ্য টানটাই তাদের দু'জনকে বেঁধে রাখছে... একজন যদি তার বাবাইয়ার প্রতি ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়, তবে অপরজন গুরুর জন্য নিজের প্রাণটুকু দিয়ে দিতেও প্রস্তুত... তাই কেউই একেবারে 'না' করতে পারে না...অস্বস্তি হলেও তারা দু'জনে হাতদুটো বাড়িয়েই দেয়... প্রাঞ্জলবাবু অবাক চোখে বিষয়টা দেখলেও মনে মনে খুশিই হোন... কারনটা যে 'তিনি' নিজে জেনেও দু'জনের হাত নিয়ে একসাথে করে পরম মমতায় নিজের বুকে জড়িয়ে নেন... ঢেউ আরো একবার অস্ফুটে ফুঁপিয়ে উঠলে সমুদ্র ঢেউকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে কাঁদতে বারন করে... এবার গলা ঝেড়ে সরাসরি উনি বলে ওঠেন,
প্রাঞ্জল : আমি... আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের দু'জনের চার হাত এক করে দিতে চাই, বেদ... পারলে... পারলে আজই...
ঘরে একটা পিন পড়লেও তখন শব্দ শোনা যাবে, এমনই এক অখন্ড নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে তাদের তিনজনের মধ্যে... নীরবতা ভেঙ্গে উত্তরের প্রত্যাশা না করেই আবার বলতে শুরু করেন প্রাঞ্জলবাবু...
প্রাঞ্জল : বেদ, তুমি তো সবই জানো, তাই তোমাকে আবার নতুন করে বলার কিছুই নেই... আমি জানি, এবার যাবার জন্য ডাক... ডাক এসেছে বেদ... প্রদীপের তলার তেল খুব তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে... তাই একেবারে নিভে যাবার আগে আমার শেষ ইচ্ছে আমি পূরণ করে দিতে চাই, শেষ কর্তব্যটা সম্পন্ন করে যেতে চাই... আমি আমার ঢেউ মাকে তোমার হাতে সমর্পণ করে যেতে চাই... আমি জানি বেদ ও তোমার কাছেই সবচেয়ে ভালো থাকবে... তুমিই ওর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়... আমার অবর্তমানে তুমিই ওর যথার্থ খেয়াল রাখতে পারবে, সম্মান দেবে ওর স্বতন্ত্রতার... তাই তো কালবিলম্ব না করেই আজই আমি তোমাদের এক করে দিতে চাই... চিরকালের মতো... আশা করি, তোমরা আমার কথা রাখবে !!! কি !! রাখবে তো !!! ঢেউ !! বেদ !!
ঢেউ আর সমুদ্রের নিস্তব্ধতায় ভেতর ভেতর চিন্তিত হয়ে পড়েন প্রাঞ্জলবাবু... তবে কোনো তাড়াহুড়ো করে ফেললেন না তো !!! জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন না তো ছেলে, মেয়েদুটোর উপর... কিন্তু তারও তো কিছু করার নেই... অভিভাবক হয়ে সন্তানদের সুরক্ষার দিকটা ভাবার দায়িত্ব অবশ্যই তার... এতে তো কোনো দোষ নেই... তিনি তো একজনের বাবা, একজনের শিক্ষক, সর্বোপরি উভয়েরই অভিভাবক... তাই সন্তানরাই তার First Priority... সেই যতই তিনি সংসারের প্রতি নির্লিপ্ত থাকুন না কেন !! টান তো তাতে কিছুমাত্র কমে না... প্রাঞ্জলবাবুর এই সিদ্ধান্ত জানানোর অকস্মাৎ প্রকাশে ঢেউ এবং সমুদ্র দু'জনেই চুপ করে যায়... এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে কি বলা উচিত, কি উত্তর প্রত্যাশিত- সেটাই তারা বুঝে উঠতে পারে না....
ঢেউ : বাবাইয়া !!!! তুমি... তুমি এইসব কি বলছো !!! যা বলছো, ভেবে বলছো তো !!! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না... কি হয়েছেটা কি তোমার !!! এত উতলা কেন হচ্ছো তুমি !!! তুমি আমাকে... ঠাম... ঠাম্মুকে একা করে কোথায় যাবে !!! আম... আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না... তুমি আর ঠাম্মি ছাড়া আমার যে কেউ নেই, সেটা কি তুমি ভুলে গেছো !! মা, সে তো কবেই চলে গেছে আমার জীবন থেকে... একবারের জন্যও পিছন ফিরে আমার দিকে তাকায় নি... হয়তো তার মনেই ছিল না, তার 'সন্তান' বলে কোনো ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব আছে.... তুমি সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে আমায় কোলে পিঠে করে বড় করেছো, সম্পূর্ণ একাই... আমায় মা-এর অভাবটাই বুঝতে দাও নি... তুমিই আমার বাবাইয়া ছিলে, আবার আমার মা-ও... তাহলে আজ কেন এতো 'পালাই পালাই' করছো ?? তোমরা দু'জনের কেউ-ই না আমার কথা ভাবলে না... স্বার্থপর মতো আত্মসুখের সন্ধানে একজন তো চলেই গেলো... আর আজ যেন তুমিও যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছো... মাঝখান থেকে আমিই বড্ড একা হয়ে রয়ে গেলাম... সাথে বোকাও...
অভিমানী মেয়ে বাবার থেকে মুখ ফেরালেও প্রাঞ্জলবাবুর চোখে পড়ে একজোড়া আকুল চোখের দৃষ্টি ঢেউ-এর দিকে পরম আশ্বাসের নীরব ভাষা নিয়ে চেনে আছে, মুখ ফিরিয়ে থাকায় ঢেউ তা অনুভব করতে পারছে না... প্রাঞ্জলবাবু ম্লান হেসে অভিমানিনী মেয়ের অভিমান ভাঙ্গাতে চেষ্টা করেন... তিনি জানেন, আজ তিনি যাই বলবেন, ঢেউ-এর কাছে তাই অজুহাত মনে হবে... এই কারনে তিনি নিজের মায়ের সাথে দেখা করতে চান নি, পাছে মাতা-পুত্রের মুখোমুখি সাক্ষাতে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন... তিনি যে নিজের অন্তিম সময়ের প্রত্যাশায় প্রত্যেকটা মিনিট, প্রত্যেকটা সেকেন্ড অতিবাহিত করছেন- সেটা তিনি নিজেই প্রকাশ্য দিবালোকে আনতে চান না... তাই নরম গলায় বলে ওঠেন,
প্রাঞ্জল : এবার যে তোমাকে বড় হতে হবে মা... অনেক বড়... শুধু বয়সে নয় মা- মনে, মানসিকতায়... ধরি... ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা হতে হবে.... ঠান্ডা মাথায় হাসিমুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাটা নিজের আয়ত্তে আনতে হবে... হবেইইই... আমি জানি তুমি পারবে... এই ভরসাটুকু তোমার উপর আমার আছে... আমার 'ভরদি'... আমার বেদ... আমার সবকিছুকে... যে... যে তোমাকে সামলাতে হবে...
ঢেউ : আমাকেএএএ !!! সবসময়েই আমিই কেননন!!!
প্রাঞ্জল : কারণ তুমিই আমার পূর্ণতা, ঢেউ.... মনে পড়ে ঢেউ, আমাদের মূহুর্তের বারান্দার ধার বরাবর বাঁশ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট বাগানে রঙিন ফুলের গাছ সাজাতিস তুই আর মা... উঠোনে একপাশে একটা মাঝারি উচ্চতার শিউলি গাছ ছিল... রোজ... রোজ University বেরনোর আগে ওই শিউলি গাছের নীচে আমার চোখ দুটো আটকে যেত... একরাশ শিউলি ফুলের মাঝে বসে থাকত একটা ফুটফুটে মেয়ে... ঠিক যেন 'উমা' রূপে 'মা দূর্গা'... কি অপূর্ব সুন্দর নিষ্পাপ নিটোল মুখখানি... আমার... আমার জীবনের সব মলিনতা মুছে দিয়ে মনটা আমার জুড়িয়ে দিত... আমাকে দেখেই সেই ছোট্ট মেয়েটা ফুল কুড়ানো বন্ধ করে কচি কচি হাতে দু'চারটে ফুল তুলে আমার দিকে টলমল পায়ে ছুটে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুল... ফুলগুলো আমার হাতে দিয়ে আদরে আদরে আমাকে ভরিয়ে দিত....
তাই আজ কথা বলে যেতে ইচ্ছে করে তার... নিরন্তর... বলা যায় না, যদি আর সুযোগ না পান... তাই জীবনের যে মূহুর্তটুকু তার হাতে আছে, সেটুকু তিনি প্রাণ ভরে 'বেঁচে' নিতে চান... তাই তো ধরা গলায় আবার বলতে শুরু করেন,
প্রাঞ্জল : জানো বেদ, আমি যখন সারাদিন পর University থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরতে বাড়ি ফিরতাম... আমার ছোট্ট মেয়েটা ওই ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিত... আর বলতো, 'বাবাইয়া, তোমাল কত্ত হট্টে !!' যখন Thesis-এর কাজ নিয়ে রাতের পর রাত জাগতাম, পা টিপে টিপে আমার চেয়ারের পেছন দিক দিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরতো... আমি দেখতে পেয়ে কোলে তুলে নিলে আদো আদো গলায় বলতো, 'আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, আমার বাবাইয়া-র কপালে টিপ দিয়ে যা'....
কথাগুলো বলতে বলতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন আনচান করে ওঠে, বুকের মধ্যে অকাল শ্রাবণ নামে প্রাঞ্জলবাবুর... ঢেউ আর সমুদ্র-এর চোখ বেয়েও নেমে আসছে আজ শ্রাবণের বারিধারা... কোথায় গিয়ে যেন আজ তিনজনেই এক হয়ে গেছে... কারুর অতীত আজ সন্তানদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তো কারুর অতীত স্মৃতি আজ পুরাতন স্মৃতি মনে করিয়ে মানুষটাকে আগলে রাখতে চাইছে... সম্পর্কের টান-ই হোক বা নাড়ির টান, তা ছিন্ন করা কি এতই সহজ !!! কান্নাভেজা গলায় ঢেউ বলে,
ঢেউ : আর তুমি বেদকে আমাকে কেন সামলাতে বলছো !!! তুমি ওর জীবনটা কেন নষ্ট করতে চাইছো !!! তুমি তো বেদকে ওর নিজের থেকেও বেশি ভালো করে চেনো, জানো... ও আত্মনির্ভরশীল স্বতন্ত্রতার একজন মানুষ... ওর মূল্যবোধকে আমি নিজেই শ্রদ্ধা করি... আর তাই তুমি সবটা জেনেও বেদের এতদিনের নিস্তরঙ্গ স্থিতিশীল জীবনে কেন ঢেউ আছড়ে ফেলে ওর অভ্যস্ততার এতদিনের বালিঘরটাকে ভেঙ্গে ফেলতে চাইছো বাবাইয়া !!! এটা তো ওর সাথে অন্যায় করা হবে... আর নিজেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব না নিয়ে অন্য কারুর উপর নিজেকে চাপিয়ে দেওয়াটাকে কাপুরুষতা বলে... আমি নারী বলে কোমল হতে পারি, তাই বলে দুর্বল নয়... মনে রেখো- ঝড়ের মুখে কোমল তৃণই কিন্তু টিকে থাকে, মহীরুহরা কিন্তু আছড়ে পড়ে ভেঙ্গে যায়... তাই, নিজের আত্মসম্মান বোধ বিসর্জন দিয়ে আমি কারুর জীবনের বোঝা হয়ে বাঁচতে পারব না কখনো... তুমি এইভাবে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারো না... আমি প্রথমবার তোমার এই চাওয়াটা পূরণ করতে পারলাম না, বাবাইয়া... আমাকে ক্ষমা করো...
যদিও সমুদ্র জানে ঢেউ স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করেই বলে, এবং বলতে ভালোও বাসে... আর সমুদ্র ঢেউ-এর স্পষ্টবাদীতাকে ভীষন সম্মানও করে... কিন্তু কেন জানি, আজ শেষের কথাটা কোথাও গিয়ে সমুদ্র-এর মনের কোন গোপনে আঘাত করলো... সমুদ্র চিরকালই মনের দিক থেকে নিজের কাছে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ... কিন্তু হঠাৎই আজ মনে হলো, কোথাও কি তবে সুর কেটেছে !!! সে কি সত্যিই নিজেকে এতটাই ভালো চিনতে পারছে এখনো !!! না কি সবটাই মনের ভুল !!
তাই অন্তর্মুখী সমুদ্রের এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই বেরলো না মুখ থেকে... ঘর সাময়িকভাবে স্তব্ধ হলেও প্রাঞ্জলবাবুর পিতার মন অনেককিছুই পরে ফেলতে পারে নিঃশব্দে... তোর চোখের অগোচরেই যে দুটো মন আজ বিপরীত স্রোতে বইছে, তা তিনি মুখে না বললেও যথেষ্টই বুঝতে বুঝতে পারেন... একজনের আত্মমর্যাদার বিপরীতে অপরজনের তীব্র অভিমান... প্রাঞ্জলবাবু নিজের মনেই মুচকি হেসে ওঠেন... ভাবেন, এইভাবেই যদি দিন কেটে যায়- যাক না !! এই রাগ যে কখন অনুরাগে পরিণত হয়ে যাবে, সেটা সময়ই বলে দেবে... তিনি তো নিমিত্ত মাত্র... তাই কন্যার কথায় বিন্দুমাত্র দৃকপাত না করে নির্লিপ্ত কন্ঠে তিনি আবার বলতে শুরু করেন,
প্রাঞ্জল : জানিস ঢেউ, তোর মা আমাকে প্রথম দেখাতেই নাকি আমার প্রেমে পড়েছিল.... হয়তো এই প্রথম দর্শনেই প্রেম বলে পরে আর সম্পর্ক তার কোনো দাম রইলো না ওর কাছে... সব ভালোবাসার ঝুড়িটুকু একেবারেই উপুড় না করে যদি একটু কৃপনতা দেখাতো, তাহলে আজ বোধহয় তোর জীবনটা অন্ততঃ অন্যরকম হতো.... তাই একটু একটু করে ভালোবাসার গুরুত্বই আলাদা... অনেক গভীর হয় সেই ভালোবাসা... নদীর বুকের ঢেউ সবাই দেখতে পায় রে মা... উত্তাল বুকের ঢেউ কেউ দেখতে পারে না... নদীর ঢেউ তো আপন সুখে নাচে... কিন্তু উত্তাল বুকের ঢেউ-এ কেবল নীরবে অশ্রু ঝরে... আমার বেদ-এর চোখে যেন কোনোদিন জল না আসে, খেয়াল রাখিস...
ঢেউ : আজ তোমার কি হয়েছে বাবাইয়া !!! তুমি আমাকে বারবার কেন বেদকে সামলাতে বলছো !!! বলো...
প্রাঞ্জল : সমুদ্র সৈকতে বালির উপর পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছে জীবন... আকস্মিক একটা ঢেউ এসে সেই ছাপ মুছে দিয়ে চলে যায়... তবুও এগিয়ে যেতে হয় আবার পায়ের ছাপ ফেলে... জীবনটা তো এমনি আবহমান... কারোর জন্য কোনো কিছুই তো থেমে থাকে না মা... তার গতিতে সে বয়ে চলে... তবে মাঝে মাঝে এমনি এক একটা ঢেউ এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়... তবুও থেমে থাকলে তো চলবে না তোমাদের... এগিয়ে যেতেই হবে তোমাদের... আর বেদ-এর কথা বলছিস !!! আমার 'বেদ' নিজেই ঋকবেদ-এর মতোই, খানিকটা যেন পৃষ্ঠা খোলা একটা বই... কিন্তু চাইলেই যে কেউ পড়ে ফেলতে পারবে না... আর যদি কেউ যদি পাঠোদ্ধার করতেও পারে, মর্মোদ্ধার করা কিন্তু ওতো সহজ নয়... আমার বেদ, আমারই বেদ....
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে যাবার পর এবার প্রাঞ্জলবাবু একটু হাঁপাতে থাকেন... ক্লান্ত লাগে হঠাৎই... তাই কথা বলতে বলতেই চুপ করে যান... যদিও তা সমুদ্র-এর চোখ এড়ায় না... সমুদ্র অনেকক্ষণ ধরেই থামানোর চেষ্টা করলেও একটা সময় বুঝতে পেরেছিল আজ আর তার স্যারকে থামানো এতটাও সহজ হবে না... তিনি যে আজ কথা বলেই হাল্কা হতে চান... বলা যায় না, সত্যিই এরপরের ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে !!! তাও চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠে,
সমুদ্র : স্যার, আপনার এতো কথা বলা উচিত হচ্ছে না... আপনি একটু বিশ্রাম করুন... ঠাম্মি আর ঢেউ-এর জন্য ভাববেন না... আমি থাকতে ওদের কোনো বিপদ আঁচড় কাটতে পারবে না, যে যতই ঢেউ না চাক... আমি ঢেউ-এর যুক্তিকে সম্মান করি, ওর মন ও মানসিক চিন্তাধারাকেও... তবে সবসময়ই স্বামী হয়েই একজন নারীকে আগলে রাখার যায়, তা আমি নিজেই বিশ্বাস করি না... 'বন্ধুত্ব'-এর দাবীতেও পাশে থাকা যায়... আর সেই সম্পর্কটাকে কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে ক
খাঁটি হওয়ারও সম্ভাবনা থেকে যায়... তাই আপনি ভাববেন না, স্যার... ঢেউ না চাইলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাব- ওকে আগলে রাখার, ওকে ভালো রাখার.... ওকে... ওকে খুশি রাখার দায়িত্ব....
প্রাঞ্জল : বেদ বাবা, আমার ঢেউ-এর মনটা তুলোর মতো নরম... ভিজে গেলে ভীষণ ভারি, আর শুকিয়ে গেলে খুবই হালকা... আর এই হালকা হয়ে যাবার পর মানে অভিমান ভরা ভেজা ভারি মন থেকে অভিমান মিলিয়ে যাবার পর মনের মেঘলা আকাশে দেখা যায় এক টুকরো আলো, সবার মনে বকুল ফুলের সুবাস ছড়ায়... (একটু থেমে, একটু দম নিয়ে)
জানো বেদ বাবা, কথা বলা হয় না বলে সত্যিই কত সমীকরণ অচিরেই বদলে যায়... তাই অভিমান আর অভিযোগ ভুলে আবেগ প্রকাশ মানুষের জীবনে ভীষণই প্রয়োজন... তাতে অনেক কুয়াশা মুছে যায়, দেখা যায় শুভ্র দিগন্ত...
সমুদ্র : স্যার... আপনি Please এত কথা বলবেন না... এত কথা বলা ঠিক হচ্ছে না আপনার...
প্রাঞ্জল : জীবনের স্রোত যখন যেদিকে যায়, সেদিকেই চলতে শিখতে হয়... আজ আমাকে বলতে দাও বেদ... হয়তো আর বলা হবে না...
সমুদ্র : কি বলছেন স্যার !!!
প্রাঞ্জল : (ঢেউ-এর হাতটা আঁকড়ে ধরে) অনেক মানুষ অভিমান জমিয়ে পাহাড় জমাতে বেশ পারদর্শী... কিন্তু সেই পাহাড় কাটার দুঃসাধ্য তো সকলের থাকে না... গুটি কতক পটু মানুষ সেই কাজে সক্ষম.... তবে পাহাড় কাটার যে অভাবনীয় পরিশ্রম আর ক্লান্তি আছে, তা সেই মূহুর্তে যে অভিমান করেছে, তার পক্ষে বোঝা পাহাড় কাটার থেকেও কঠিন... তুমি পারবে তো বেদ, আমার ঢেউ-এর অভিমানের পাহাড় কাটিয়ে ওর অন্তরটা....
ঢেউ : (আর্তনাদ করে উঠে) Pleaseeeee বাবাইয়া.... এবার থামো তুমি.... থা.... মো....
কথাটা শেষ না করেই ছিটকে দূরে সরে যায় ঢেউ... ওর শরীরটা কাঁপছে... চোখ দুটো জলে টলটল করছে... হাটু মুড়ে বসে পড়ে মাটিতে... চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে ঢেউ-এর... যেন মেঝেতে মিশে যেতে পারলে বাঁচে সে... এ যেন এক অসহায় আত্মসমর্পণ... বিব্রত দেখায় সমুদ্রকে, ঢেউকে দেবার মতো শান্তনার ভাষা হাতড়ে বেড়াচ্ছে... হঠাৎই দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যায় ঢেউ-এর কাছে.... শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঢেউ-এর কাঁধ... সমুদ্রের হাতের স্পর্শে ঢেউ সারা শরীরে এক অজানা স্বর্গীয় অনুভূতির পরশ পায়, তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঢেউ-এর সর্বাঙ্গ... সম্মোহিতের মতো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে ঢেউ... খালি বোঝে না যে, তার এতদিনের একাকীত্বের অভিশাপটা থেকে মুক্ত হবার সময় বোধহয় এসে গেছে, তাকে বোঝার মানুষটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে... সমুদ্র মাটি থেকে ধরে ওঠায় ঢেউকে... ধরে নিয়ে আসে প্রাঞ্জল বাবুর কাছে... প্রাঞ্জল বাবু ওদের চার হাত এক করে নিজের চ্যানেল করা হাতটা ওদের হাতের উপর রেখে বলে ওঠেন,
প্রাঞ্জল : ঢেউ মা, তুমি বলো ভালোবাসা কি তুমি জানো না !!! ভালোবাসার আরেক নাম ত্যাগ... ভালোবাসা যে শুধু নিজের সুখ খোঁজার নাম নয়, সেটা যে অন্যকে সুখে রাখারও আরেক নাম... আজ আর দ্বিধাবোধ করো না মা... বেদ-কে তোমার সারাজীবনের সঙ্গী হিসেবে পূর্ণতা দাও... এখনই নাই বা দিলে সম্পর্কটার কোনো পরিচয়, তাতে সম্পর্কটার কোনো গরিমাটা কখনো কমবে না বইকি বাড়বে... যেদিন নিজেরা উপলব্ধি করবে, তোমরা দু'জনে দু'জনের কাছে কতটা অমূল্য... সেদিন... সেদিন না হয় সামাজিক নামে পরিচিত হয়ো, কেমন !!!! আজ আমার কর্তব্য শেষ হলো বেদ... আমি তোমার হাতে আমার ঢেউকে সম্প্রদান করে গেলাম.... আজ যে আমার কি পরম পরম শান্তির দিন... ভীষণ নিশ্চিন্ত লাগছে নিজেকে... মনে হচ্ছে আমি আমার এই শ্রেষ্ঠ সম্পদকে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দামী সুযোগ্য ব্যক্তির হাতে দিয়ে গেলাম... আমি শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও জানবে আমার আর্শীবাদ সবসময়ই আছে তোমাদের সাথে... দু'টিতে ভালোবাসায় ভরে থেকে ভালো থেকো, সুখে থেকো....
সমুদ্র : কথা দিলাম স্যার, প্রাণ দিয়ে হলেও আমি ঢেউ আর ঠাম্মুকে আগলে রাখবো... আর আপনার দেওয়া গুরুদায়িত্ব যা আমার জীবনেরও মূল লক্ষ্য- তা আপনার মতো করে আপনার পথে চলেই আমি পূরণ করবো... শুধু আপনি আমার পাশে থাকবেন স্যার, কথা দিন... সবসময়, প্রত্যেকটা মূহুর্তে... তাই আপনাকে সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে খুব তাড়াতাড়ি, আমাদের অসম্পূর্ণ লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে...
প্রাঞ্জল : জানো বেদ, প্রজাপতি দক্ষের পাপের শাস্তি কিন্তু মহাদেব কখনো দেবী সতীকে দেন নি... কিন্তু অভিমানিনী সতীর পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি... তুমি কথা দিলে কিন্তু বেদ, তুমি আমার ঢেউকে আগলে রাখবে... আমার পাপের আগুনের দহন থেকে তুমি আমার ঢেউকে রক্ষা করবে... আমি আমার সাথে আমার সব পাপ নিয়ে যাচ্ছি, আমার পাপের কথা ও কিছু জানে না... আমার নিষ্পাপ ঢেউ বড় অভিমানিনী... তুমি ওকে একা হতে দিও না কখনো... ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়....
ঢেউ এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে চেপে রেখেছিলো... এবার সে নিজের বাবাইয়ার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে বাবাকে আঁকড়ে ধরলো... এখন আর তার অশ্রুধারা মানলো না কোনো বাঁধা... প্রাঞ্জল বাবুর চোখের জল মুছে দিলেও ঢেউ-এর চোখে এক পশলা বৃষ্টি নামে,
ঢেউ : বাবাইয়া, আমাকে ক্ষমা করে দাও... অনেক ভুল করেছি আমি, তীব্র অভিমানে বছরের পর বছর তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছি... আমি তোমায় খুব ভালোবাসতাম... খুব ভালোবাসতাম... প্রতি রাতে তোমার বুকের একটু স্নেহের ওমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকতাম... কিন্তু কখন যে অপেক্ষা অভিমানের রূপ নিয়ে নিল !!! আমার কেন জানি না মনে হতো, তুমি কাজের অছিলায় আমায় এড়িয়ে যেতে চাও... কিছু বলতে চেয়েও পারো না... তাই তো তোমার ওই ব্যস্ততাভরা ব্যবহারটাকেই আমার 'উপেক্ষা' বলে মনে হতো...
ঢেউ-এর কথা শুনে প্রাঞ্জলবাবু হাল্কা কেঁপে ওঠেন... কেবিনের AC-র ঠান্ডাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়... কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন না, ঢেউ না বুঝলেও তার একলব্যটি এক তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকেই অপলকে তাকিয়ে আছে, শুধু কিছু হিসেব মেলাতে পারছে না এই যা... ওদিকে ঢেউ যেন আজ সেই ছোট্ট মেয়েটা হয়ে গেছে... ও নালিশ, অনুযোগের ঝুলি খুলে বসেছে... হঠাৎই তার কি মনে হওয়ায় বলে ওঠে,
ঢেউ : ক্ষমা করো গো আমায়... কি পাপ !! কোন পাপের কথা তুমি তখন থেকে বলে যাচ্ছো !!!
প্রাঞ্জল : সন্তানকে কখনো ক্ষমা না করে থাকা যায় রে বাবা... কিন্তু তোর কোনো দোষ ছিল না রে মা... তোর মা তোকে ছেড়ে চলে যাবার পর তুই আমাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলিস... কিন্তু আমার পাপের ঘড়া ততদিনে ভরে গেছে... তাই নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়ে আমি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিতাম... যদি কোনোদিন আমার অতীত তোমাদের সামনে চলে আসে, তোমরা পারবে তো আমাকে ক্ষমা করতে !!! আমাকে ঘৃণা করবে না তো !! যদি দূরে সরে যেতে বলো, তাও সই... কিন্তু তোমাদের চোখের ওই ঘৃণাভরা উপেক্ষাটা আমি কিছুতেই মানতে পারব না... পারলে তোমরা দু'জনেই আমায় ক্ষমা করে দিও... জানবে আমিও পরিস্থিতির স্বীকারই ছিলাম, কোনো বৃহৎ কিছু পাবার সিঁড়ি মাত্র... তাই বেদ-এর কাছে আমার অন্তিম অনুরোধ- আমার ঢেউ-এর হাত কখনো ছেড়ে দিও না... আমার মেয়েটা বড় একা হয়ে যাবে সব সত্যি সামনে এলে... ওকে... ওকে বুক দিয়ে আগলে রেখো বাবা...
ঢেউ দেখে তার বাবাইয়ার চোখে তার এতদিনের উপেক্ষার জন্য কোনো অভিমান নেই, আছে শুধু তার কান্নার জন্য দুঃখ... ঢেউ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে মানসিকভাবে... তার বাবাইয়াকে জড়িয়ে ধরে সে অনেকক্ষণ কাঁদে... কেউ সেদিন তাকে থামাতে পারে না... সমুদ্র-এর চোখের কোলে জল থাকলেও মুখে মৃদু হেসে একবার ঢেউ-এর মাথায় হাত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়... বাবা আর মেয়ে কিছুক্ষণ একান্তে থাকতে দিয়ে সে কেবিন থেকে বেরিয়ে ডক্টরের সাথে জরুরী কথাবার্তা বলে Pharmacy-তে যায় কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার জন্য....
ফার্মেসীতে পা দেওয়া মাত্রই তীক্ষ্ণ 'ক্রিং ক্রিং' শব্দে গোটা হসপিটাল করিডোর, Pharmacy Area, Administrative Department মুখরিত হয়ে ওঠে... Emergency Bell... হসপিটালের কোনো একটা কেবিন থেকে ভেসে আসছে... কিন্তু সেটা যে কোথায়, সমুদ্র এক লহমায় ঠাউর করে উঠতে পারে না... হঠাৎই একটা ঠান্ডা, শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া বরাবর নেমে যায়...
সমুদ্র : (স্বগতোক্তি করে) স্যার ঠিক আছেন তো !!! ঢেউ !!!
কথাটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেই একপ্রকার লাফ দিয়েই ফার্মেসী থেকে বেরিয়ে আসে সে... দৌড়ে দিকভ্রষ্টের মতো কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়ায়... সামনের দিকে তাকিয়েই বোঝে সব শেষ... ধপ করে দরজাতেই বসে পড়ে... ততক্ষণে সমুদ্র-এর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে হসপিটালের ডক্টর এবং নার্সরা... সামনের দিকে তাকাতেই শিউরে ওঠে তারা... দেখে মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢেউ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে.... আর বেডে গুলিবিদ্ধ প্রাঞ্জল বাবুর নিথর দেহ....
(অতঃপর...)

