STORYMIRROR

Anishri's Epilogue

Romance Action Thriller

3  

Anishri's Epilogue

Romance Action Thriller

বৃত্তের বাঁধনে (Part 1)

বৃত্তের বাঁধনে (Part 1)

11 mins
211


Seven Star Hospital :

----------------------------------

রাত তখনো ফুরায় নি... হসপিটালের জানলার থেকে বাইরের দিকে তাকায় সমুদ্র, হয়তো অব্যক্ত ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠি পাঠাতে চাইছে ঢেউকে... ওদের গল্পটা হয়তো নতুন করে সাজিয়ে নিতে চেয়েছিল ঢেউ, কিন্তু সেটা মাঝপথেই অসমাপ্ত রয়ে গেল... সমুদ্রের বলা হয় নি ঢেউকে, এক বছর আগেই সে মনে মনে কথা দিয়েছিল ঢেউকে - সুখে দুঃখে সারাজীবন পাশে থাকবে ঢেউ-এর... যাকে আড়াল থেকে প্রাণ দিয়েও আগলে রাখতে চেয়েছিল, আজ তাকেই হারাতে বসেছে সমুদ্র... তার প্রাণের সখী, আত্মার সাথী... ঢেউ-ও কি তার হাত ধরতে চেয়েছিল ভরসা করে, বিশ্বাস করে... ভালোবেসে... বলার সময় পেল না হয়তো... আচ্ছা, মানুষ যা চায় সবসময় আদৌ কি তা পায় !!! ঢেউ পেল !!! সমুদ্র পেল !!! কিছু গল্প শুরু হবার আগেই হারিয়ে যায় - 'অপ্রাপ্তির গল্প' হয়ে.... কিন্তু অসম্পূর্ণ অধ্যায় হলেও স্মৃতিগুলো অবিচ্ছেদ্য হয়ে জুড়ে যায় জীবনে... সময় স্মৃতির ক্ষত মুছতে পারা তো দূর, আবছাও করতে পারে না... হয়তো কোনো একলা দিনে ইচ্ছে হয় হারিয়ে যাওয়া হাতটা ধরতে, আবারও... ঢেউ-এর কেবিনে এখন শুধুই মনিটরের বিপ বিপ শব্দ... সমুদ্র হাত বাড়িয়ে ঢেউ-এর চ্যানেল করা নিস্পন্দ হাতটা ছোঁয়.... যে মেয়েটা কলকলানির জন্য সবসময়ই সমুদ্র-এর কাছে বকা খেত, আজ সেই মেয়েটার মুখের একটা শব্দ শোনার জন্য অধীর হয়ে বসে আছে সমুদ্র....

জলছবি (প্রায় বছর খানেক আগে) :

-----------------------------------------------------

আমাদের গল্পের নায়িকা প্রিষা, বাবার আদরের ঢেউ... তার ঢেউ নাম যেন সার্থকনামা হয়েছে... ঢেউ জন্মের পর প্রথম দশ মাস চুপ করে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছে, তারপর সেই যে মুখ ফুটেছে, তার আর কলকলিয়ে কথা বলার বিরাম নেই... সে আধো আধো বুলিতে কোনোদিন কথা বলে নি, ছোট থেকেই টাস টাস কথার উপর কথার ঢেউ আছড়ে পড়ে... ঝর্ণার মতোই তার প্রাণোচ্ছলতা, নদীর মতোই কলহাসিনী... গ্রীষ্মের গুমোটের গরমের পর কালবৈশাখীর ঝড় যেমন স্বস্তি আনে, তেমনি ঢেউ-এর উপস্থিতি যেন এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া... তবে বাবার সাথে তার অম্ল-মধুর সম্পর্ক... ঢেউ-এর বাবা প্রাঞ্জল রায়চৌধুরী Archeological-র একজন প্রফেসর, অগাধ জ্ঞান... কিন্তু ইতিহাসের জগতেই ডুবে থাকেন বলে ঢেউ-এর মা তাদের ছেড়ে অন্য কারোর সাথে বিলাসিতার জীবন বেছে নিয়েছে... ছোট্ট ঢেউ তার মা-এর এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয় নি, ঠাম্মুর কোলের উষ্ণতা ছেড়ে সে যায় নি.... কিন্তু বাবার এই পড়াশোনার প্রতি Dedication-টাকেও সে ভালো মনে মেনে নিতে পারে নি... পড়াশোনার প্রতি এক তীব্র অনীহা তার...

ছোট থেকেই মাকে না পাওয়ায় ঠাকুমার বড় ন্যাওটা সে, দিনরাত তার সাথে থাকে আর গিন্নিপনা শেখে... ঠাকুমা ছড়ার বই নিয়ে পড়তে বসলে অজস্র প্রশ্ন,

ঢেউ : খোকা যে ক্ষীর নদীর কূলে গেল, ওর ঠাম্মু বকে নি !!! ঠাম্মু, হাটুর নীচে খুকু গোছাভরা চুল কি করে দুলছে গো !!! ও পার্লারে চুল কাটতে যায় না !!! আচ্ছা ঠাম্মু, বাঘ, গরুটাকে চোখের সামনে দেখেও খেল না !!! শুধু একসাথে জল খেল !!!

ঢেউ-এর ঠাকুমা জাহ্নবী দেবী বিরক্ত হয়ে বই ফেলে উঠে যেতেন,

জাহ্নবী দেবী : তোর সাথে এত বকতে পারি না বাপু...

প্রতিবেশী এক মহিলা মেয়ের বিয়ে ঠিক হবার সুখবর জানাতে এসেছিলেন... বড়দের আসরে ছোট্ট তিস্তাও পাকাবুড়ির মতো, দীঘল কালো চোখ বড় বড় করে গালে হাত দিয়ে সব কথা গিলছিল... ভদ্রমহিলা একটু চুপ করতেই তার প্রশ্ন,

ঢেউ : হ্যাঁ গো জ্যেঠিমা, মুনাই দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে এত কিছু চেয়েছে কেন গো !!! তোমার জামাই খুব গরীব !!!! তাহলে বিয়ে দিয়ে কি হবে !!! তোমাদের কাঁধ থেকে তো বোঝা নামল না... Double হয়ে গেল তো...

জ্যেঠিমার মুখ মূহুর্তে কালো হয়ে যায়... ঢেউ-এর ঠাম্মু ঢেউ-এর পিঠে এক কিল বসিয়ে বলেন,

জাহ্নবী দেবী : তোকে সব কথায় কথা কে বলতে বলে !!! যা শিগগির এখান থেকে... পাকা বুড়ি কোথাকার !!! খালি বসে বসে বড়দের কথা গিলবে !!!

ঢেউ স্কুলে ভর্তি হতে প্রাঞ্জল বাবুকে ফি হপ্তায় স্কুলে Parents Call-এ যেতে হতো... বক্তিয়ার খলজি উপাধি প্রাপ্ত ঢেউ-এর পড়াশোনাতে তীব্র অনীহা, তবুও তার মেধার জন্য স্কুলের শিক্ষিকারা তাকে ভালো না বেসেও থাকতে পারেন না... ভূগোল দিদিমণি যখন এশিয়ার ভূবৈচিত্র্য বোঝাচ্ছেন, ঢেউ তখন Atlas-এর আড়ালে মুখ ঢুকিয়ে পামীর পর্বতের দস্যু নিয়ে বন্ধুদের সাথে বক্তৃতায় ব্যস্ত... কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়েও মেয়ের অবিরাম বকুনি...

এবার ঢেউ-এর ঠাম্মু উঠে পড়ে লেগেছেন ঢেউ-এর বিয়ের জন্য... ঢেউ-এর ঠাম্মু ঢেউ-এর জন্য যে পাত্রই পচ্ছন্দ করেন প্রাঞ্জল বাবু এত খুঁত বার করেন যে, ঠাম্মু প্রতিবার দমে যান... তবে ঠাম্মুর সাথে প্রাঞ্জল বাবু একটা ব্যাপারে একমত... ঢেউ বিশ্বভারতীতে গান নিয়ে মাস্টার্স পড়া শেষ করে জীবনের উচ্ছ্বলতাকে, উচ্ছাসকে বেছে নিয়েছে... নাহহহ.. ভুলেও ভাববেন না সে জীবনের স্বেচ্ছাচারিতাকে সে বেছে নিয়েছে... পার্টি, বা বাহ্যিক আড়ম্বরে তার কোনো টান নেই... সে একটি NGO join করে টইটই করে ঘুরে বেড়ায় ভালোবাসা দিয়ে জীবনের সমস্যা সমাধান করতে... তবে প্রাঞ্জল বাবুর চোখে একজন আছে, যার কোনো খুঁত তিনি আপাতত খুঁজে পান নি...


যানজটে ঝঞ্ঝট :

-------------------------

NGO তেই বাবাইয়া-র ফোনটা পেয়েছিল ঢেউ... তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছিল ওর বাবাইয়া.... বেশকিছু কাজ গোছানো বাকি ছিল, তাই অর্ভিকে গাড়িতে তুলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে... কিন্তু গাড়ির জ্যামে ফেঁসে যায়... কোনো কারণবশতঃ ট্রাফিক পুলিশ Signal-এ না থাকায় একটি গাড়ি অপর গাড়িকে টেক্কা দেবার প্রতিযোগিতায় এক ভয়ানক জটের সৃষ্টি করেছে... গাড়িতে বসা অর্ভি রীতিমত বিরক্ত, কিন্তু ঢেউ-এর ঠোঁটে লেগে আছে এক মৃদু হাসির আভাস...

অর্ভি : হাসছিস কেন তুই !!!

ঢেউ : Concert টা বেশ লাগছে...

অর্ভি : এই... তুই এই বিভৎস জ্যামে Concert কোথায় পেলি রে !!! সবকিছুতেই তোর বাড়াবাড়ি...

ঢেউ : আরেএএএ... দেখ, সবক'টা গাড়ি একসাথে হর্ণ বাজাচ্ছে... বেশ Concert-এর মতো লাগছে কিন্তু...

অর্ভি : তুই না ঢেউ সত্যিই !!! এর মধ্যেও গান খুঁজে পেলি !!! দেখ, আজই কাকু আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বললো, আর আজই এই অবস্থা...

ঢেউ : শোন, বাবাইয়া-র ওই 'ভরদি'-তে ঢোকার আমার কোনো তাড়া নেই... কোনোদিন ছিল না, আর কোনোদিন থাকবেও না...

অর্ভি : আহা !!! কাকু কত শখ করে নিজের পড়ার ঘরের ওই নাম রেখেছেন বলতো - 'ভরদি'... তুই জানিস...

ঢেউ : (একটু আনমনা হয়ে) জানিইইইইইই... মা সরস্বতীর নাম, যার অর্থ 'ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসা'... কিন্তু মা সরস্বতীর গুণের বর্ণনায় এই নামটা জ্ঞান এবং বিজ্ঞান-এর সাথে অনুরণিত হয়... বাবাইয়া আমার এই নামটা রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু মায়ের আপত্তি থাকায় রাখতে পারে নি...

অর্ভি : Sorry... ঢেউ... আমি তোকে কষ্ট দিতে চাই নি...

ঢেউ : Don't be Sorry Yaar... ঠিক তুই যেমন আমাকে কষ্ট দিতে চাস না, আমিও তোকে কষ্টে দেখতে পারি না... একটু Wait কর... একটু বসে বসে মহাদেবের নাম নে...

অর্ভি : মানে !! তুই এর মধ্যে কোথায় নামছিস !!!

ঢেউ : শোন, তুই একটু বোস... এখন তো 'উঠিতে সামপ্রিয়, বসিতে সামপ্রিয়, সামপ্রিয় লয়েছে প্রাণ'... তুই বসে বসে সামগান শোন... আমি দেখি, এখানে সাম্য ফেরাতে পারি কি না !!!

অর্ভি : ওই দেখ... এই ঢেউ... ঢেউ... আরে কোথায় চললি গটগট করে...

ভিড়ের মাঝে একজোড়া চোখ দেখে একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা একটি দ্যুতি যেন ভিড় ঠেলে Traffic Signal-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে... মেয়েটির দীঘল আনত চোখ, মেঘের মতো কালো ঢেউ খেলানো চুল, ডানাকাটা পরী না হলেও বেশ সুন্দরী... পরণে সাদা চিকনের সালোয়ার আর আকাশী বাদনীর প্রিন্টের ওড়না, হাল্কা গোলাপী ম্যাট লিপস্টিকে ঠোঁটটা ঠিক যেন গোলাপী পাপড়ির মতোই লাগছে... সবচেয়ে বড় কথা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, তেজদীপ্ত... আজ অব্দি এই এক জোড়া চোখ এত নিখুঁতভাবে কোনো মেয়েকে দেখে নি... তার মনে হতো, মেয়েরা হয় ন্যাকা, নয় বোকা, নয়তো ন্যাকা-বোকা দুটোই... এই বুদ্ধিদীপ্ততা, তেজদীপ্ততা খুব কম মেয়ের মধ্যেই দেখতে পেয়েছে সে, বলা ভালো কারুর মধ্যেই তেমন চোখে পড়ে নি... মেয়েটি সটান Traffic Signal-এর উপর উঠে নিখুঁত দক্ষতায় Traffic Control করতে লেগেছে... সেই একজোড়া চোখ গাড়ি থেকে নেমে Traffic Signal-এর দিকে এগিয়ে যায়....

ঢেউ : এই যে আপনি.... থামুন... থামুন.... হ্যাঁআআআআআ... আপনিইইইইইই... গাড়িটা পেছন.. পেছন... ও বাইক ভাই, অত তাড়াহুড়ো করতে যেও না... এই যেএএএ, Ambulance আপনি যান... যান... এইবারের আপনিইইইইই... হ্যাঁআআআআআ... যাও বাইক ভাই.... ও সাইকেল দাদা, আবার তাড়াহুড়ো করে...

পেছন থেকে একটি জলদগম্ভীর স্বর ভেসে আসে,

নেপথ্যে : আপনারা ওনাকে চেনেন না... উনি কিন্তু সাদা পোশাকের IPS Officer... আপনাদের গাড়ির নম্বর নিয়ে যদি উনি Case ঠুকে দেন, বুঝতে পারছেন তো কি হবে !!! উনি যা বলছেন, তাই করুন... নয়তো...

ঘাড় ঘুরিয়ে ঢেউ দেখে একদম তার বাবাই-এর মতোই এক যুবক দাঁড়িয়ে তার পেছনে.... প্রায় ছয় ফুটের উপর উচ্চতা, সৌম্যদর্শন যুবকটির চেহারায় এমন এক ব্যক্তিত্ব বর্তমান যে তাকানো মাত্রই সম্মান আপনি মনে জায়গা করে নেয়... অনেকটা সবুজ পাহাড়ের নীরব সৌন্দর্যের মতো, স্নিগ্ধ অথচ গম্ভীর, অথচ বুদ্ধিতে শাণিত ছুরির মতো চকচক করা দুই চোখ - যা দেখে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে যায়....

কিন্তু ঢেউ-এর মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়... বাবাইয়া-র প্রতি তার ভালোবাসার উপর নীরব অভিমানের পরত জমতে জমতে পাহাড় প্রমাণ হয়ে গেছে... এতগুলো বছর ধরে মনের কোণে জমাট বেঁধে থাকা অভিমানগুলো ভাঙানোর মতো কেউ ছিল না... যে মানুষটাকে ঘিরে এত অভিমান, সে তার জ্ঞানের জগতে নির্বিকার ছিল... ছোট্ট মা হারানো মেয়েটা যে দিনের পর দিন তার বাবার স্নেহের ওমটুকুর জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা জ্ঞানের জগতে নিবেদিত প্রাণ প্রাঞ্জল বাবুর চোখে পড়ে নি কোনোদিন... ঢেউ ঠিক করে নিয়েছে, জীবনের বিদায় বেলায় নীরবে এই অভিমানগুলো নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চলে যাবে... কিন্তু আজ বাবাইয়া-র মতোই একজনকে দেখে তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়...

 

যুবক : আপনি যান... আমি এইদিকটা সামলে নিচ্ছি...

ঢেউ : Thank You...

অর্ভি : দা... দা... ভা... ই...

ঢেউ নিজের ওড়না টেনে নিঃশব্দে নেমে গাড়িতে ওঠে... অর্ভি উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে,

অর্ভি : জানিস ঢেউ, ওই যে 'যে' তোকে নিস্তার দিল না, ও কে হয় জানিস !!!

ঢেউ : Not Interested ...

অর্ভি : অ্যাঁআআআআআ....

ঢেউ : হ্যাঁ... ঠিকই শুনেছিস... ওই ছেলেটা একদম বাবাইয়া-র মতো... আর এই একটা বিষয়ে আমার কোনো উৎসাহ নেই... Seat Belt-টা লাগা... বাড়ি চল...

অর্ভি : (হতাশ হয়ে) আচ্ছা... ঠিক আছে...

মূহুর্ত :

---------

প্রাঞ্জল বাবু বড় শখ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন 'মূহুর্ত', হয়তো জীবনের সব মূহুর্ত এখানেই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন... কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক... তবে আজ তিনি নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েও একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন... যদি সম্ভব হতো, ঢেউকে আজীবন তিনি নিজের কাছেই রেখে দিতেন... কিন্তু কিছুটা মায়ের চাপে, আর কিছুটা বাস্তবতার কাছে তার স্নেহকে হার মানতে হলো... মায়ের একটা কথা তিনি অস্বীকার করতে পারেন নি... যখন তিনি থাকবেন না, তখন ঢেউকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখার জন্য কাউকে তো একটা দরকার...

তার চোখে একজনই আছে, যার হাতে তিনি ঢেউকে তুলে দিয়ে যেতে পারেন... কিন্তু ঢেউ কি তাকে মেনে নেবে ??? আজ প্রাঞ্জল বাবু আর জাহ্নবী দেবীর সামনে সেই পরীক্ষা....

ঢেউ আর অর্ভি ঠাম্মুর হাতে হাতে সব খাবার বানিয়ে নেয়... এমন সময় তাদের ডাক পড়ে.... খাবার-এর ট্রে হাতে নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকেই চমকে ওঠে ঢেউ আর অর্ভি... অর্ভির মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে...

অর্ভি : দাদাভাই !!! তুই এখানে !!!

প্রাঞ্জল : সে কি অর্ভি !! বেদ তোমার দাদা হয় নাকি !!!

অর্ভি : হ্যাঁআআআআআ কাকু... আমার দাদা হয় তো !!

বেদ : হালুম, স্যার-এর বাড়িতে এত উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করিস না...

অর্ভি : আরে দাদাভাই, স্যার হবে তোর... আমার তো সেই ছোট থেকেই কাকু... কত রাত আমি এই বাড়িতে কাটিয়েছি জানিস !! আর তখন তুই কম ঝগড়া করতিস আমার সাথে !!!

বেদ : আরেএএএ... আমি তখন কি করে জানব, তুই স্যারের বাড়িতে থাকার জন্য জেদ করতিস... উনি তো তখনো আমার স্যার হন নি... আর হালুম, তুই স্যার-এর সামনে এইসব কথা বলছিস কেন !!!

অর্ভি : তুই বা এখানে হালুম হালুম করছিস কেন !! ওটা তো আমার আর তোর একান্তের নাম... জানো কাকু, ছোটবেলায় ও আমাকে হালুম করলেই আমি না কি ফোকলা দাঁতে খিলখিল করে হেসে উঠতাম... কিন্তু আমি তো এখন বড় হয়েছি বলো... এখনো হালুম বলেই ডাকে...

ঢেউ : ভালোই তো... তোর সামগানকে নয় 'হালুউউউম' করা শিখিয়ে দেবেন... তোদের একান্তে সামগান তোকে 'হালুউউউম' করে ডাকবে.... কি রোমান্টিক হবে না, ব্যাপারটা !!!

বেদ : আচ্ছা, আপনিই তো আজকে Traffic Control করছিলেন, তাই না !!!

ঢেউ : আরে আমি তো আপনাকে খেয়ালই করি নি... আপনিই তো তখন এসে আমাকে...

প্রাঞ্জল : সে কি !!! ঢেউ !!! তুই Traffic Control করেছিস নাকি !!!

ঢেউ : (দৃঢ়স্বরে) জীবনের সব জট তো আমি ছাড়াতে পারলাম না বাবাইয়া, 'যান-জট' টাই একটু ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম আর কি !!!

ঢেউ-এর কথা বলার ধরনে বেদ মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হয়... সে প্রাঞ্জল বাবুকে শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ শিখরে বসিয়ে রেখেছে, সেখানে ঢেউ-এর এই স্বরে প্রাঞ্জল বাবুর সাথে কথা বলা তার কানে বেশ লেগেছে...

জাহ্নবী দেবী : ঢেউ মা... বেদ ছেলেটি কিন্তু বেশ বলো... আমার আর তোমার বাবাইয়া-র কিন্তু বেদ-কে বেশ ভালো লেগেছে... তোমার কেমন লেগেছে !!

ঢেউ : বাবাইয়া-র ছাত্রকে আমার কেন কিছু লাগতে যাবে ঠাম্মি !!!

প্রাঞ্জল : ঢেউ বেদ-এর যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, বেদ-এর পরিবার যদি রাজি থাকে- আমি তোমাকে বেদ-এর হাতে সমর্পণ করতে চাই....

ঢেউ : মানে !!! তুমি আজ আমার বিয়ে দেবার জন্য আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে এলে !!!

বেদ : স্যার, আপনিও তো আমাকে আগের থেকে কিছুই আভাস দেন নি...

প্রাঞ্জল : কেন বেদ !!! তোমার কি আপত্তি আছে !!!

বেদ : মানে স্যার... আপত্তি নয়.... আমি এইসব নিয়ে কিছু ভাবিই নি... আমি ভেবেছিলাম, অধ্যয়নেই নিজেকে সমর্পণ করে দেব...

ঢেউ : কিন্তু আমার আপত্তি আছে...

প্রাঞ্জল : কেন রে !! বেদকে তোর পচ্ছন্দ হয় নি !!!

ঢেউ : না বাবাইয়া... প্রত্যেকটা মানুষই তার নিজস্বতায়, তার স্বতন্ত্রতায় সুন্দর হয়... কিন্তু দুটো মানুষের একসাথে পথ চলার পাথেয় তো 'ভালোবাসা'... যার উপর আমি বিশ্বাস নেই, ভরসা নেই... আসলে যে ভালোবাসতে জানে না, তার কাছ থেকে তো জোর করে ভালোবাসা পাওয়া জানে না... কিছু মনে করবেন না বেদ, আমি ভালোবাসার ভাঙন দেখেছি... যখন মা বাবাইয়া-র সাথে ঝগড়া করত, ছোটবেলায় ঠাম্মির কোলে বসে ভয়ে থরথর কাঁপতাম... আমি আর ঠাম্মি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম যাতে বাড়ির এই অশান্তির ঝড় থেমে যায়... আমি তখন একটু বড়, মা আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল... তখন তো আর সেই ছোট্টটি নেই... একটু বড় হয়েছি, অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম... তাই চুপচাপ সবকিছু মেনে নিলাম... মা নিজের সুখ খুঁজে নিল, আর বাবাইয়া নিজের এই... এই অধ্যয়নের জগতেই ডুবে রইলো... একমাত্র ঠাম্মির স্নেহ, ঠাম্মির কোলের উষ্ণতাটুকুই.... আমি আপনাকে ঠকাতে চাই না... আপনি যদি আপনার স্যারের প্রতি শ্রদ্ধার গুরুদক্ষিণাস্বরূপ আমাকে গ্রহণ করেন, তাহলে আপনিই ঠকবেন... আপনার ভাড়ারই চিরকাল ফাঁকা থেকে যাবে... তার উপর আপনি আমার একমাত্র বন্ধু অর্ভির দাদাভাই, আমি অবশ্যই চাইব আপনি জীবনে আপনার প্রাপ্য সবটুকু পান... তাই দয়া করে এই ভুলটা করবেন না... আসছি আমি....

ঢেউ দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, এবং পরক্ষণেই দড়াম করে একটা শব্দ জানান দেয়, সে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছে... অন্য ঘরে তখন অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করছে...

প্রাঞ্জল : বেদ, ঢেউ কথাগুলো ঠিকই বলেছে... ওর জীবনে আমি, ঠাম্মি, আর ওর এই ছোট্টবেলার একমাত্র বন্ধু অর্ভি ছাড়া আর কেউ আসে নি ওর মা চলে যাবার পর... ও ওর সব যন্ত্রণা ওর হাসির পেছনে লুকিয়ে রাখে বাবা... মেয়েটা বাইরে থেকে যতই কঠিন হোক, মনটা বড়ই নরম... কিন্তু ওই যে বললো না- তোমার ভাড়ার শূন্য থাকবে, তা কিন্তু নয়... ও অন্তরে এক বুক ভালোবাসা...

বেদ : কিন্তু ভালোবাসায় সহজাত ভয় একটা ওর...

অর্ভি : কাকু আপনি আমার মা-বাবার সাথে একবার কথা বলুন না... আমি তো ঢেউকে চিনি... ও আমাদের সবাইকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না... ও যদি ভালো নাই বাসতে পারবে, তাহলে NGO-ও এতগুলো বাচ্চাকে কি করে ভালোবাসতে পারে !!! আর আমি আমার দাদাভাইকে আরো ভালো করে চিনি... ওমন মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায় না... ঢেউকে আমাদের সময় দিতে হবে...

প্রাঞ্জল : তাহলে বাবা বেদ আমি কি তোমাদের বাড়ি যাব !!

বেদ : স্যার, আমার মনে হয় ওনার ঘরের দরজাটা এই মূহুর্তে অনেক বেশি জরুরি...

জাহ্নবী দেবী : মেয়েটা আমার বড় অভিমানী... যখন নিজের মনের যন্ত্রণাগুলো আর লুকিয়ে রাখতে পারে না, নিজেকে ঘরবন্দী করে নেয়... আমি ওকে ডাকছি... তুমি কিছু মুখে দাও বাবা... আর তোমাকে জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে না...

বেদ : ঠাম্মি আপনি আগে ওনাকে গিয়ে একটু দেখুন... সিয়া, তুই-ও যা... একবার দেখ...

প্রাঞ্জল : সিয়া !!!

অর্ভি : সিয়া আর সমুদ্র- আমাদের দুই ভাই বোনের ডাক নাম... আমি যাচ্ছি দাদাভাই...

(কেমন হবে সমুদ্র আর ঢেউ-এর এই গল্প !!! সমুদ্র আর ঢেউ কি মেনে নেবে পরস্পরকে !!)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance