Sangita Duary

Classics

4  

Sangita Duary

Classics

বৃত্ত

বৃত্ত

18 mins
264



''কুঁড়ি, কোথায় গেলি মা? এদিকে আয়, কে এসেছে দেখ...!"


ছাদের রেলিং ধরে একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কুঁড়ি, কত্ত ঘুড়ি উড়ছে, ছোট বড়ো, কি সুন্দর সুন্দর রং ওদের! মা বলেছে সব ঘুড়িদের আলাদা আলাদা নাম আছে, কিন্তু সবাইকে তো একইরকম দেখতে। হোক গে, কুঁড়ি দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আকাশে। ঠিক এমনি সময়েই মায়ের ডাক। কুঁড়ির এখন একদম যেতে ইচ্ছে করছে না, চলে গেলেই যদি ঘুড়িগুলো ভ্যানিশ হয়ে যায়!


কুঁড়ি আবার শুনলো, এবার বাবা ডাকছে। এবার যেতেই হবে। নাহলে বাবা রাগ করে, কথা না শুনলে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে থাকে কুঁড়ির দিকে। খুব ভয় করে বাবাকে তখন। বাবা যখন মাকে বকে তখনও খুব ভয় হয় কুঁড়ির। কুঁড়ি তো বাচ্চা মানুষ তাই বাবা মার সব কথা ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু মা যখন কাঁদে, কুঁড়ি বুঝতে পারে বাবা মাকে বকেছে বলেই মা কাঁদছে, মায়ের কষ্ট হচ্ছে, কুঁড়ি মায়ের কাছে গিয়ে ছোট্ট হাতে মায়ের চোখ মুছিয়ে দেয়, মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, গালে হামি দেয়। মাও শক্ত করে কুঁড়িকে জড়িয়ে ধরে।


ছোট্ট ছোট্ট পায়ে কুঁড়ি দৌড়ে ছাদ থেকে ঘরে ঢোকে। ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির কোণায় হোঁচট খায়, হাঁটুটা ছোড়ে গেছে। খুব ব্যাথা লেগেছে কুঁড়ির। ডাগর চোখে জল টলমল করে ওঠে। কুঁড়ি মুছে নেয়। সে জানে কাঁদলে বাবা বকবে। ছাদে আর তার ওঠা হবেনা।


নিচে নেমেই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কুঁড়ি। ছোটমামা এসেছে! সঙ্গে এত্ত এত্ত চকোলেট, মামার বাড়ির বাগানের আম! দৌড়ে গিয়ে কুঁড়ি মামার কোলে উঠতে যেতেই বাবা ধমক দিলো, "মামা বাইরে থেকে এসেছেন মামনি, আগে মামাকে ফ্রেস হয়ে নিতে দাও, তারপর...!"


কুঁড়ি মাথা নেড়ে হ্যা বলে বাবাকে।


ব্যাগ কাঁধে বাবা অফিসে বেরিয়ে যায়। এইবার খুব মজা করতে আর বাঁধা নেই কুঁড়ির। মামার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, "এতদিন আসোনি কেন? তোমার স্যার তোমায় ছুটি দেয়নি?"


ছোটমামা চকোলেটের মোড়ক খুলে দিতে দিতে বললো, "দেয়নিই তো, তারপর আমি যেই স্যারকে বললাম, আমার কুঁড়ি মা ডাকছে, অমনি স্যার ভয় পেয়ে আমায় ছুটি দিয়ে দিল। আর আমি দৌড়ে অমনি আমার কুঁড়ি মার কাছে চলে এলাম।"


হি হি হাসছে কুঁড়ি।


*************


খুব আনন্দ হচ্ছে কুঁড়ির। ছোটমামার সঙ্গে মামারবাড়ি এসেছে সে। কি মজা!


কটাদিন পড়তে বসতে হবেনা, অবশ্য পড়তে কুঁড়ির কষ্ট হয়না, তবে একটু আধটু স্পেলিং মিসটেক করলেও যে বাবা চোখ বড় বড় করে তাকায়, কুঁড়ি কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারেনা, নতুন করে আবার মুখস্থ করতে থাকে, যাতে আর ভুল না হয়!


এখানে সেই ভয় নেই। কুঁড়ি দৌড়ে অরিন দাদার কাছে যায়, অরিন কুঁড়ির রাঙা মামার ছেলে, বয়স পনের বছর, কুঁড়ির থেকে দশ বছরের বড়। অরিন দাদার কতো বই, তাতে কত সুন্দর ছবি! মামারবাড়ি এলেই কুঁড়ি অরিন দাদার কাছে খুব আসে, অরিন দাদা কত গল্প পড়ে শোনায়, কত সুন্দর ছবি দেখায়, রঙিন চক-পেন্সিল দেয়!


এবারে অরিন দাদার বাবা মা নাকি বাড়ি নেই, হরিদ্বার না কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। নিশ্চয় অরিন দাদারও খুব মজা, মামিমা পিট্টি দিচ্ছেনা, মামু গাট্টা দিচ্ছেনা। চুপিচুপি অরিন দাদাদের বাড়িতে যেতেই কুঁড়ি দেখলো অরিন দাদা একমনে টিভি দেখছে, কুঁড়িকে দেখেই টিভি বন্ধ করে দিলো। বললো, "কবে এলি?"


তার পর কুঁড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, "একটা খেলা খেলবি? টিভিতে ওরা যেমন খেলছিল, তেমন?"


অরিনদাদা কুঁড়ির ফ্রকটা তুলতে যেতেই কুঁড়ি বললো, "ওটা তো পানিশমেন্ট, আমি জানি, যেদিন বাবা মাকে বকে, আর মা কাঁদে, সেদিন রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়লে, বাবাও মাকে ঐরকম পানিশমেন্ট দেয়, মায়ের ব্যাথা লাগে, আমি জানি, মা শাউট করে। তাই তো বাবা বকলে আমি কাঁদি না, যদিও আমাকেও বাবা...!"


অরিন কুঁড়ির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে, "ধুর বোকা, ওটা পানিশমেন্ট না, ওটাকে আদর করা বলে, আয় আমিও তোকে আদর করি। খবরদার! কাউকে বলবি না, তাহলে কিন্তু এটা পানিশমেন্ট হয়ে যাবে আর তোর ব্যাথা লাগবে। আর যদি কাউকে না বলিস তাহলে দেখবি নেক্সট টাইম তোর খুব ভালো লাগছে, বুঝলি?"


কুঁড়ির ব্যাথা লাগে। চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়, মা বাবার কথাটা তো সে অরিন দাদাকে বলে দিয়েছে তাই হয়ত অরিন দাদার আদর ওর নিজের কাছে পানিশমেন্ট লাগছে। না, আজকের কথাটা কুঁড়ি কাউকে বলবেনা।


************


আজ কুঁড়ির স্কুলমেট ঐন্দ্রীর জন্মদিন।


ওয়ার্ডরোব খুলে লাল টুকটুকে মিনিটা হাঙ্গার থেকে খুলতে গিয়েও তুলে রাখলো, বাবা যে এই সব ছোটখাটো ড্রেস একদম পছন্দ করেনা!


ব্রাউন রঙের লম্বা গাউনটা গলিয়ে কুঁড়ি হালকা লিপস্টিক ঠোঁটে বুলিয়ে নিলো।


বেরোনোর আগে বাবাকে বলতে যেতেই বাবার সেই চিরন্তন সাবধানবাণী, "বেশি দেরি করোনা !"


ঐন্দ্রীর বাড়িতে ঢুকতেই শ্রিয়া, পর্ণা, রণিত হৈহৈ করে বেরিয়ে এলো, " অ্যাজ ইউজ‍্যুয়াল, ইন্দ্রাক্ষী তুই এখানেও লেট? হোপফুলি তাড়াতাড়ি কেটে পড়বি না?"


কুঁড়ি সহপাঠিনীদের নজরকাড়া আধুনিক পোশাকগুলোর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে, "কেন? ঐন্দ্রী পার্টিটা লাঞ্চ টু ডিনার পর্যন্ত এক্সটেন্ড করলো নাকি?"


"কেন? ডিনার পার্টিতে তোর বাবার পারমিশন আছে বুঝি?"


শ্রিয়ার বরাবরই একটু ঠুকে কথা বলার অভ্যেস।পর্ণা ইতিমধ্যেই একটা স্প্রাইটের বোতল নিয়ে এসেছে, মুখের কাছে হাতের উল্টো পিঠ এনে আড়াল করার ভঙ্গিতে কুঁড়ির কানে কানে বলে, "দারুন একটা প্রোগ্রাম সেট করেছি এক্ষুনি, রণিতের বাড়িটা আজ একদম এম্পটি, শ্যাম রণিত কয়েকটা ভদ্গা অ্যারেঞ্জ করেছে, হেব্বি মস্তি হবে, যাবি?


কুঁড়ির তো চোখ কপালে, "কি বলছিস? শেষে কি থেকে কি হয়ে যায়!"


-" কি হবে? আর কতদিন সেরেল্যাক খাবি? উই আর গ্রোন আপস, আর চার বছর পর কলেজে ঢুকবো, একটু টেস্ট না করলে ভিকটিম অফ র‍্যাগিং ইজ এ মাস্ট।"


কুঁড়ির বুক ধুক পুক করে, না, বাবা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। নাহলে....!


***********


কি হচ্ছে এখানে! নানান রঙের বেলুন, কি সুন্দর হাওয়া লেগে উড়ছে, কুঁড়ির খুব ইচ্ছে করছে সবকটা বেলুন কিনে নিতে। বাবা নিশ্চয় না করবে, বলবে ,এতো বড় হয়ে গেছিস, সামনের বছর মাধ্যমিক দিবি, এই বয়সের কেউ বেলুন নিয়ে খেলে?


তো কি? খেলার, ভালোলাগার আবার বয়স হয় নাকি? বাবা যখন টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখে আর ধোনি সেঞ্চুরি করলে দমাদ্দম লাফায়, সেটা ছেলেমানুষি না?


কুঁড়ি এগিয়ে যায়, খালি গা, সাদা ধুতিটা প্যান্টের মতন এঁটে পিছনে বাঁধা, কোমরে লাল ফেটি, কপালেও কাপড়ের লাল ব্যান্ড, ওটা কি বাজাচ্ছে লোকটা? সেদিন টিভিতে দেখেছিল কুঁড়ি, সাপকে হিপ্নোটাইজ করতে লাগে, কি যেন নাম বাঁশিটার? হ্যাঁ, বীণ! বাহ! সাপটা বেশ ফনা দুলিয়ে নাচছে তো? এটাকেই কি সাপখেলা বলে? একটু দেখি!


নিশ্চয়, অবশ্যই বাবা বারণ করবে, বলবে...


আচ্ছা, আজ টিউশনিতেই তো কুঁড়ি দ্য লস্ট চাইল্ড পড়ছিল, সেই মেলা, সেই বেলুন, সাপখেলা সব কেন তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে?


এরপর, হ্যা, এরপর কুঁড়ি নিশ্চই সেই মিষ্টির দোকানটা দেখবে, যেখানে বরফি বিক্রি হচ্ছিল, ওই বাচ্চা ছেলেটার মতো কুঁড়িরও খুব খেতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু বাবা বকার ভয়ে...!


ওই তো সেই সর্ষের হলুদ ক্ষেত, আল বরাবর একটা ছাগলছানা লাফিয়ে চলছে, কুঁড়ির খুব ইচ্ছে করছে ছোট কঞ্চি দিয়ে ওটাকে খোঁচাতে। কিন্তু সে জানে ,বাবা বারণ করবে।


ওই তো নাগরদোলা, এবার ঠিক সেই বই এ পড়া বাচ্চাটির মতোই কুঁড়ির প্রবল ইচ্ছে হবে ওটাতে চড়ে। দুচোখ বুজে সর্বশক্তি সাহস প্রয়োগ করে বাবাকে বলবে, "আই ওয়ান্ট টু রাইড, ফর ওয়ান্স, প্লিজ বাবা..."!


কুঁড়ি জানে এইবার সে হারিয়ে যাবে, চোখ খুললেই দেখবে আশেপাশে বাবা মা কেউ নেই!


সত্যিই কুঁড়ি হারিয়ে গেল! মা........!


বিছানাতে বসে ঘামছে কুঁড়ি।


পাশের টেবিলে কাঁচের গ্লাসে চাপা দেওয়া জল। মা বলে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে জল খেতে। কুঁড়ি ঢকঢক শেষ করে ফেলে গ্লাসখানা।


*************


মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েগেছে কয়েকদিন। কুঁড়ি মায়ের সঙ্গে মামারবাড়ি এসেছে। ছোট্টবেলার মতো আর এদিকওদিক দৌড়োয়না, মায়ের সাথেই লেপ্টে থাকে সবসময়, আর অরিনদাদার কাছেও যায়না, ভাল্লাগেনা। কথা বলতেও ইচ্ছে করেনা। আগে না বুঝলেও কুঁড়ি এখন বোঝে তখন অরিনদাদা তাকে নিয়ে কি করতো।


গরমকালে মামারবাড়ি দারুন আরামের। চারিদিকে সবুজ বাগান, দুপা গেলেই সজল নদী, কুঁড়ির খুব ইচ্ছে করে সারাদিন নদীর পাড়ে বসে থাকে।


হঠাৎ বৃষ্টি এলে তো আরও মজা, বাগানের সমস্ত গাছ চান করে টাটকা স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে, কুঁড়ির নিজেকেই যেন তখন একটা গাছ মনে হয়, বৃস্টিতে ভিজে নতুন, তরতাজা।


কুঁড়ির মামার মেয়ে, কুঁড়ির চেয়ে ছ মাসের ছোট। বৃষ্টি এলেই স্টিরিওতে ফুলভল‍্যুমে হানি সিং চালিয়ে হাতপা ছোড়ে। কুঁড়িকেও জোর করে। কোনো নিষেধ নেই , এখানে তো আর বাবা নেই, তাহলে আপত্তি কি?


না, নিজের মর্জির বিরুদ্ধে বাবার পছন্দ মত চলতে চলতে কুঁড়ি কখন যে বাবার পছন্দটাকে নিজের পছন্দ বানিয়ে নিয়েছে, কুঁড়ি জানলোইনা!


বৃষ্টি এলে কুঁড়ির রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ইচ্ছে করে বাবার মতো। অথবা কোন কিছু না করে নিস্পলক গাছেদের স্নান দেখতে ইচ্ছে করে, বাবার মতো। বৃষ্টি এলেই না একা হওয়া যায়! নিজের সাথে কথা বলা যায়!


কুঁড়ির খুব ইচ্ছা ছিল, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার। বাবা বললেন, "সাইন্সএ সুযোগ বেশি, তাছাড়া, তুমি সাইন্সে খারাপ নও!"


****************


কুঁড়ি এখন কানাডায়। পোস্ট ডক্টর‍্যাল রিসার্চার।


বাবা মাকে ছেড়ে ,নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের ছোট্ট পড়ার ঘর ছেড়ে সে আজ অনেক দূরে। একা, স্বাধীন। এখানে কেউ পাশে থাকার নেই। ছঘন্টা ল্যাব সেরে নিজের রুমে ফিরলে কেউ বলার নেই, "তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে, কচুরি ভাজছি, গরম গরম খেয়ে নিবি", কিংবা এখানে একটু ওয়েস্টার্ন পরলে কেউ বলার নেই, "মামনি, নিজের লাবণ্য জোর করে কাউকে দেখিও না, নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো যাতে তোমার গুণের ছটায় সবাই আলোকিত হতে পারে!"


ছুটির দিনগুলোতে কিংবা রিফ্রেশিং টাইমে ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রীজে, কিংবা এডমন্টন বেড়াতে গেলে ব্যাচমেটরা অনেক সময় বন্ধু জুটিয়ে ফেলে, তাদের সঙ্গে মজাও করে দেদার। কুঁড়ি নীল আকাশের পেঁজা তুলোয় কিংবা নুড়ি বিছানো রাস্তার ফাঁকে তার ছেলেবেলা খুঁজে বেড়ায়, আরও একজনকে আজকাল কুঁড়ির মন খোঁজে। প্রতীককে।


**************


যাদবপুর কলেজ। গেটের সামনে লম্বা মিছিল। অধ্যাপকের সাসপেনশন চাই!


বারবার নোটিস দেওয়া সত্বেও কলেজের বাইরে চড়া দামে টিউশনির নামে নোট বিক্রির প্রতিবাদ।


ফার্স্ট ইয়ারের প্রত্যেককেই বাধ্য করা হয়েছিল মিছিলে সামিল হতে। কুঁড়ির ওসব ভালো লাগেনা, বেকার বেকার কলেজের সামনে খানিক হল্লাগোল্লা ,তারপর যেই কে সেই। তার চেয়ে সময়টা লাইব্রেরীতে কাটালে ভালো। ইলেক্ট্রোডাইনামিক এর একটা থরো রিডিং চাই। নেক্সট উইকে ক্লাস টেস্ট আছে।


দুপা এগুতেই সামনে প্রতীক, "কি ব্যাপার! ব্যানারের হোডিংগুলো কি খুব ছোট হয়ে গেছে?"


কুঁড়ি অচেনা ছেলের সাথে কথা বলায় অভ্যস্ত নয়, ড্যাবড্যাব চেয়েই রয়েছে আগন্তুকের দিকে।


দুচোখ সরু করে কুঁড়িকে জরিপ করলো প্রত্যয় দত্ত।


"শুরুটা কি সিবিএসসি দিয়ে? বাংলা পড়তে অসুবিধে হচ্ছে?"


-" আমি বাঙালি, সিবিএসসি বোর্ড হলেও বাংলা পড়তে না পারাটা, বাঙালির লজ্জা!"


-"যাক, কথাটা বলতে বেশ ভালোই পারো দেখছি, এই সুরেশ, এই বল্তি মামনির হাতে একটা প্ল্যাকার্ড দে!"


- "সরি, আমার লাইব্রেরীতে কাজ আছে, তাছাড়া ফালতু সময় নষ্ট করতে আমি কলেজ আসিনা!"


পলকে প্রত্যয়ের চোখদুটি জ্বলে উঠলো যেন, "কি সাবজেক্ট তোমার? এইচএসে কত পার্সেন্টেজ ছিল?" হঠাৎ কুঁড়ির বামকব্জি ধরে টানতে টানতে ইউনিয়ন রুমে, " দ্যাখো, এ হলো তমাল, নাইনটি টু পার্সেন্ট হোল্ডার। ফার্স্ট সেমিস্টারে ফেল। কেন জানো? ও কোনো চামার প্রফেসরের কাছ থেকে নোট কেনেনি।


আর এই যে, এ হলো বৃষ্টি। পাশ কোর্সের ক্লাসও মিস করেনা, তা সত্বেও, প্রজেক্টে জিরো। কি করে? অ্যা? কি করে? আরো দেখবে? এসো। ওই যে দেখছো, গেটের বাইরে বুকষ্টল, এক্ষুনি যাও, প্রত্যেকটা স্টলে গিয়ে টিউশন খোঁজো, প্রত্যেকে গ্যারান্টি সহ ফার্স্ট ক্লাস পাইয়ে দেওয়া প্রফেসরের হদিস দিয়ে দেবে। এই, বাই দ্য ওয়ে, তুমি কার কাছে পড়, তিনি কত নেন, লাইব্রেরীতে কি করতে যাচ্ছো, আরে দামি টিউশনি নিয়েছ, নম্বর এমনিই চলে আসবে, ফালতু পড়ে কি লাভ? যাও সিনেমা দেখো পার্টি করো।


আর এই সব ছেলেমেয়েরা যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে চোখে অগাধ স্বপ্ন নিয়ে, তারা তলিয়ে যাক!"


সেই প্রথম কোনো পুরুষ দেখেছিল কুঁড়ি। উস্কোখুস্কো চুল, ঘামে ভেজা, ঠোঁটে নিকোটিন, কি ভীষণ আকর্ষণ ওই চোখ দুটোতে। ক্লাসে এসে তিন্নিকে জিগ্যেস করে কুঁড়ি জেনেছিল ছেলেটির পরিচয়, প্রত্যয় দত্ত, ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট, ইউনিয়ন করে, যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে আগুপিছু না ভেবেই ঝপাং ঝাঁপ।


তারপর, দিন কেটে গেলো, ফাইনাল ইয়ার শেষে প্রত্যয়ের অবির্ভাবও লীন হয়ে গেল কলেজ করিডোরে। কুঁড়ির দিনগুলোও বাঁধা হয়েগেল নিজের ছন্দে। তবে বছর তিনেক আগে বাড়ি গিয়ে কলেজ স্কয়ারে আবার দেখা প্রত্যয়ের সঙ্গে। কড়া রোদ গায়েব হয়ে হঠাৎ বৃষ্টি। দোকানের একটা শেডের নীচে কুঁড়ি গুটিসুটি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা পিরিচিত গলা। "আরে বলতি ম্যাডাম!,এখানে?" কুঁড়ির সামনে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে। ভিজে ফর্মাল প্যান্ট শার্ট, কাঁধে অফিসব্যাগ।


-" হ্যা, এখানে একটু কাজ ছিল, হঠাৎ বৃষ্টি!"


-" ভারী অন্যায়! বৃষ্টির বোঝা উচিত ছিল, আপনি অকাজ কিছুই করেননা, আর আপনাকেই কিনা কোনো পরোয়ানা ছাড়াই ভিজিয়ে দেওয়া ,এতো ভারী অন্যায়!"


কুঁড়ি রাগতে গিয়েও হো হো হেসে ফেলেছিল দেখে প্রত্যয়ের বক্তব্য ছিল, "বাপরে, আপনি হাসতেও জানেন?"


-" কেন হাসিটা কি অকাজ যে আমার সাজেনা?"


-" কি বলছেন ম্যাডাম, এ জগতে মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে বড় কিছু আছে নাকি? যাক, এখানে এভাবে আপনার মত ভেজার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। সামনে একটি কফি শপ আছে, যদি আপনার সময় হয়, চলুন, একটু আড্ডা দেওয়া যাক!"


পুরোনো ভালোলাগায় ফিরছিল কুঁড়ি। ভালোলাগার অধ্যায় শেষ হয়েও আবার যখন শুরু হয়, তখন সে অধ্যায়কে খুব সহজে শেষ হয়ে দিতে দেওয়া যায়না।


কফির কাপে চুমুক দিয়ে কুঁড়ি বলেছিল, "কলেজ পাশ করে কি করছেন? এখন কিন্তু কলেজগুলোর আপনাকে খুব প্রয়োজন। যেভাবে ভর্তির নাম করে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে, গ্রামের ছেলেরা তো চাষবাস ছেড়ে আর পড়াশোনাই শিখতে চাইবেনা।"


-" তাইতো কলেজ শেষে আমিও আর কিছু শিখতে চাইলামনা, কি দরকার, বেশি শিখে ফেললে, সেই শেখার উপযুক্ত বিনিময় না পাই যদি?"


-" মানে বুঝলামনা।"


-" মানে, গ্রাজুয়েশন ডিগ্রিটাকে আর টপকে গেলামনা। দিন দিন দেশে শিক্ষিত বেকার যে হারে বাড়ছে, চাকরি জোটানো চাপের ব্যাপার। নয় কি?"


-" তাহলে কি করেন এখন"?


-"একটা প্রাইভেট ফার্মে আছি, সেলসে।"


-" আর আপনার সমাজ সেবা?"


-" সেটাও আছে, একটা হোমের সঙ্গে যুক্ত আছি, ছুটির দিনগুলোতে পড়িয়ে আসি, আড্ডা দিয়ে আসি!''-


-" বাহ! দারুন ব্যাপার তো, ইস, আমার কালই রিটার্ন নাহলে...!"


- "রিটার্ন? কোথায়?"


-" ও, আপনাকে তো বলাই হয়নি, আমি এখন কানাডায় আছি, লাইজারে পোস্ট ডক্তরাল রিসার্চ করছি।"


-" মাই গুডনেস, তারমানে আমি সেদিন ভবিষ্যৎ প্রফেসরকে প্রভোক করছিলাম, ইয়ে মানে, ভবিষ্যতে দেশে ফিরবেন তো?"


-" অফকোর্স। দেশ গড়বো বলেই না সাময়িকভাবে বিদেশ পাড়ি দিলাম!"-


-" এটা দারুন বললেন তো, ওই ডাক্তার হওয়ার আগে শপথ নেওয়ার মতো, ..রোগ এবং রুগীই আমার একমাত্র প্রাইওরিটি....এন্ড অল...!"


-" তার মানে বলতে চান আমিও ওইসব সোকোল্ড ডাক্তারদের মতন হবো রুগীর আগেও রুটি এবং রুজির পিছনে ছুটব?"


-"হবেন না বলছেন, তারমানে সেদিন আপনাকে দিয়ে ব্যানার লেখানোটা আমার সার্থক হয়েছে! ইস! আগে যদি আপনার সঙ্গে দেখা হতো, আমার হোমের বাচ্চাদের অন্তত একটা মিসিং লিংক দেখাতে পারতাম!"


-" বেশ, নেক্সট বার , কথা দিলাম,"


কথাটা জিগ্যেস করতে বেশ বাঁধছে কুঁড়ির। হুট করে কাউকে জিগ্যেস করা যায় নাকি সে বিবাহিত কিনা? ধুর, যা ভাবে ভাবুক, খানিক দোনামনা করে বলেই ফেললো কুঁড়ি, "বিয়ে করেছেন?"


- "উমমম, হুম,!"


তিরতির করে জ্বলা প্রদীপটা নিভে গেল যেন। মুখ নামিয়ে নিলো কুঁড়ি।


প্রত্যয় বলেই চলেছে, "আপনার মত কপাল কজন নিয়ে জন্মায় ম্যাডাম? বি এ পাশ করেই চাকরি খোঁজ, চাকরি পেলে কি, ঘরে বউ আনো, এইতো আমাদের জীবন, একটা ফ্রি উপদেশ দিই?" প্রত্যয় ফিসফিস করার ভঙ্গিতে কুঁড়ির খুব কাছে এগিয়ে এলো, "যতদিন একা আছেন, ভাবুন এই একবিংশ শতকেই আছেন, দোকা হলেন কি স্ট্রেট টাইম মেশিনে চড়ে সেই পরাধীন ভারতে, ব্রিটিশ রাজ, রক্ত ঘাম সব ঝরিয়ে দিন, স্বাধীনতা পাবেন না!"


নিভে যাওয়া প্রদীপের শেষ ফুলকির মতোই ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ফুটলো কুঁড়ির ।


**********


কুঁড়ি দেশে ফিরেছে মাস ছয়েক হলো। হাওড়া স্টেশনের লাগোয়া একটি কলেজেই আপাতত ওর কাজের ঠিকানা।


কলেজ, বাড়ি, বাবা, মা, বইপাড়া এইসবের মধ্যে কুঁড়ি বেশ আছে।


বাবা মার বয়স হচ্ছে, মামাতো, খুড়তুতো, পিসতুতো, মাসতুতো সমস্ত ভাই বোনরা একে একে জীবিত নাম ঘুচিয়ে বিবাহিত হয়ে গেল। একমাত্র কুঁড়িই ওদের বংশে এখনো প্রতিদিন আইবুড়ো ভাত খেয়ে চলেছে। বাড়িতে থাকলেই মায়ের ঘ্যানঘ্যান, অমুক পিসি একটা সম্বন্ধ এনেছে, তমুক মাসি একজন ছেলের কথা বলেছে। ধুর! বাড়িতে থাকতেই ইচ্ছে করেনা কুঁড়ির। বিয়ে নামক প্রহসন তো কম দেখলোনা এতদিন বিদেশে থেকে, শুধু বিদেশ কেন, এদেশও বা কম কি? ভালো তো লেগেছিল একজনকে, কিন্তু সেও তো...!


তাছাড়া আজকাল বিয়ের কথা শুনলেই ছোট্টবেলাকার কয়েকটা ছবি ভেসে আসে মনে, অরিনদাদা কুঁড়ির ফ্রকটা খুলে দিয়ে বলছে, "চল বর-বউ খেলি!"


হাসি পেয়ে যায় কুঁড়ির, তখন অরিনদাদা মতো একটা ছোটছেলেও বুঝতো, বৈবাহিক সম্পর্কে শরীরটাই প্রায়োরিটি। হাঃ!


তাছাড়া স্টাফরুমেও তো রোজ ঘ্যানঘ্যান, যতই যুগ বদলাক, মানবচরিত্র অপরিবর্তনশীল। যতই পুরুষ নারী যোগ্যতায় সমান চলুক, দায়িত্ব কর্তব্যে নারীকেই দশ হাত বের করতে হয়।


বিয়ের পাঁচবছর পর যদি একটু টেন্ডারনেসের জন্য বর ভুলে অন্য পুরুষে মজতে হয়, দরকার নেই সেই বিয়ের। গটগটিয়ে বেরিয়ে যায় কুঁড়ি।


ডাকনামটা তো বেশ চটকদার রেখেছিল বাবা মা, তবে কুঁড়িকেই চটপট বুড়ি সাজাতে এরকম চটরপটর কেন বাপু!


***************


ছুটির পর মাঝে মাঝেই গঙ্গার ধারে যায় কুঁড়ি। ভালো লাগে, বাড়ির স্টিরিও থেকে যতটা দূরে থাকা যায়!


নদীর শান্ত ঢেউ সব ভুলিয়ে দেয়, নতুন দিন শুরু করার অক্সিজেন দেয়।


নদীর বুকে সন্ধ্যে নামলে কুঁড়ি উঠে বসে, ট্যাক্সি থামায়। আজ একটাও ট্যাক্সি নেই, উল্টো দিকে থেকে একটা অটো, কুঁড়ি হাত দেখাতে গিয়েও থেমে যায়, পাশ দিয়ে কে চলে গেল? প্রত্যয়!


কুঁড়ি অনেক ডাকলো। ভুতে পাওয়া মানুষের মত দিকবিদিক ভুলে হেঁটে চলেছে প্রত্যয়। কুঁড়ি দৌড়ে এলো, "এতবার ডাকছি, শুনতে পাচ্ছেন না?" বলেই চমকেছে কুঁড়ি, একি চেহারা হয়েছে? কোঠরে বসা চোখ, হার ঝিরঝিরে দেহ, গালে প্রায় দিন পনেরোর না কাটা দাড়ি!, "প্রত্যয় বাবু!"- কুঁড়ি চিৎকার করে।


এইবার যেন শুনতে পেল ছয়ফুটের দেহটা, কুঁড়িকে দেখেই জ্বলে উঠলো চোখ, "আরে আপনি? কবে এলেন?"


-" সেসব পরে, আপনি বলুন, আপনার এই অবস্থা কেন?"


গভীর দৃষ্টি নিয়ে কুঁড়িকে দেখছে প্রত্যয়, "কি বলি বলুন তো? আর আপনি শুনেও বা করবেন কি?"


কুঁড়ি জোর করে প্রত্যয়কে গঙ্গার পাড়ের বেদিতে বসিয়ে দেয়, "সে ভাবনা আমার। আপনি বলুন!"


-" আমার একে একে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রাক্ষী!"


এই প্রথম কুঁড়ির নাম ধরে ডাকলো প্রত্যয়। হোক না পরপুরুষ, কিন্তু কুঁড়ির জীবনে সেইই তো প্রথম পুরুষ!


প্রথম পুরুষের কণ্ঠে নিজের নাম শোনাটাও বড়ো ভালোলাগার।


প্রত্যয় বলে চলেছে," ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছি। মা অনেক কষ্টে বড় করেছিলেন আমায়। তাই কলেজ পেরিয়ে মায়ের কষ্ট লাঘব করতেই চাকরি খোঁজা। মায়ের জোরেই চাকরি পাওয়ার একবছর পরেই বিয়েটা করে ফেলি। বেশ সুখেই ছিলাম, জানেন, হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আমার স্ত্রী চলে গেল। বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার সময়। মায়ের বয়স হয়েছে, ওইটুকু দুধের শিশুকে নিয়ে মা...


মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, জানেন, আমারও যদি একটা কিছু হয়ে যায়, তাহলে...."


কুঁড়ি চকিতে চেপে ধরেছে প্রত্যয়ের মুখ, "ছি:! ও কথা বলতে নেই, আপনাকে বাঁচতেই হবে, আপনার সন্তানের জন্য!"


বুকটা হালকা লাগছে কুঁড়ির। কি যেন একটা প্রাপ্তির অনুভূতি, একটা আশ্বাসবানী, আশ্চর্য! একটা শিশু জন্মেই মাকে হারালো, একটা স্বামী তার স্ত্রীকে হারালো, এমতাবস্থায় কুঁড়ির তো কষ্ট পাওয়ার কথা, কিন্তু তার এতটা ভালো লাগছে কেন? তবে কি কুঁড়ি স্বার্থপর হয়ে গেল, পছন্দের মানুষটাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে মানবিকতা ভুলে গেল? ছি!"


*****


*****


পুরোনো রোজকার রুটিনের মাঝেও আরও একটি কর্তব্য যোগ হয়েছে কুঁড়ির। কলেজ ছুটির পর রোজ একবার করে প্রত্যয়ের বাড়ি ঢুঁ মারা। প্রথমদিন প্রত্যয়ের সঙ্গেই এসেছিল সবার সঙ্গে আলাপ করতে, এখন নিজেই চলে আসে। ছোট্ট বাবুইকে চোটকে আদর করে, প্রত্যয়ের মার সাথে গল্প করে, তারপর প্রত্যয় ফেরার আগেই চলে আসে। তার এই নিত্য যাতায়াতের কথা প্রত্যয় জানেনা। কিন্তু কুঁড়ি বুঝতে পারছে, ওই পরিবারের সঙ্গে সে জড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে মাসিমার স্নেহ, বাবুইএর ছোট নরম ছোঁয়া, কুঁড়ি ওটাকেই নিজের সংসার ভাবতে শুরু করেছে ধীরেধীরে। মাসিমা আপত্তি করবেননা, বরং খুশিই হবেন কুঁড়িকে বৌমা হিসেবে পেয়ে, শুধু প্রত্যয়ের মত চাই। না করবেনা নিশ্চয়!


তাইতো আজ কলেজ বেরোনোর আগে মাকে বলেছে কুঁড়ি, "বিয়ের ভাবনা আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমি নিজেই পছন্দ করে নেব!"


মা খুশি হয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলো, "এই তো, এতোদিনে মেয়ের বিয়ের সাধ হলো!"


আজ খুব খুশি কুঁড়ি, সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে, মাসিমা বলেছেন প্রত্যয় পায়েস পছন্দ করে, ওবাড়িতে কুঁড়ি নিজের হাতে বানাবে, প্রত্যয় ফেরার আগেই। তারপর....


কুঁড়ি ব্লাশ করছে।


দরজা খুলতেই সামনে প্রত্যয়! আজ বেরোয়নি নাকি? চোখ দুটো ফোলা ফোলা, কি হয়েছে?


-" ভেতরে আসুন" বলে সরে দাঁড়ালো প্রত্যয়।


একি! এত চুপচাপ! কোথায় সব?


প্রত্যয় বললো, "আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল, তাই মাকে বাবুইকে নিয়ে একটু বাইরে পাঠিয়েছি"


কুঁড়ি লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো, " বাইরে পাঠানোর কি দরকার, মাসিমা তো সবই..."


কুঁড়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রত্যয় বললো, "আমি আগে জানতামনা, আপনি রোজ এখানে আসেন, জানলে আমি অ্যালাও করতামনা। দেখুন মিস রায়, আমি আমার স্ত্রীকে এখনও ভালোবাসি, ওর জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারবোনা। আপনি শিক্ষিতা, সুন্দরী, আমার জন্য নিজের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করবেননা। কাল থেকে এবাড়িতে আর না এলেই আমি খুশি হব, নমস্কার!"


কুঁড়ি স্থানুবৎ! এরকম আচরণ পাবে, কোনোদিন কল্পনাই করেনি। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো অজান্তেই।


চৌকাঠ ডিঙোনোর আগেই মোবাইলে ঝংকার। বাবা! অপ্রান্তে বাবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, "মামনি, তোমার মা...!


কুঁড়ি হাউহাউ করে উঠলো, "কি হয়েছে মার?"


- "টিভি দেখতে দেখতেই মাথা ঘুরে পরে গেল। তুমি শিগগির এসো.."


-" আমি এক্ষুনি আসছি, বাবা..."


ওদিকে প্রত্যয়ের গলা, "কি হয়েছে?"


কুঁড়ি ভয় পেয়েছে খুব, " মা মা...!"


-" চলুন, আমিও যাচ্ছি..!''


হঠাৎ সেলিব্রাল অ্যাটাকে মারা গেলেন কুঁড়ির মা। ফাঁকা বাড়িতে।এখন কুঁড়ি আর বাবা। কেমন যেন থমকে গেছে সবকিছু। প্রত্যয়ের প্রত্যাখ্যান, মার চলে যাওয়া, পরিস্থিতি বোবা করে দিয়েছে কুঁড়িকে।


বাবাকে কোনোদিন খুব কাছের মানুষ মনে হয়নি কোনোদিন, তুলনায় মা ছিল কুঁড়ি বন্ধু, প্রিয় সখী, সব কথা বলার আগেই বুঝে ফেলতো মা। মায়ের বুকে মাথা রেখেও এতো সুখ!


এখন কার কাছে আশ্রয় চায়বে কুঁড়ি? কত অব্যক্ত ব্যাথা জমে আছে বুকে, কে লাঘব করবে? কে বুঝবে তাকে?


ছোটবেলায় তবু বাবার ধমক রোজকার সঙ্গী ছিল, এখন সেই বাবাকেই অভিভাবকত্ব দেখাতে হয় কুঁড়িকে। তাদের তিনজনের এই ছোট্ট পরিধিতে মা সম্পূর্ণ বৃত্ত হয়ে ছিল, আজ সেই নিরাপদ কক্ষপথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাবা, মেয়ে, একাকিত্বে, মনেমনে।


সেদিন কুঁড়ির সঙ্গে প্রত্যয় ছিল অনেক্ষন। হাসপাতালে যাওয়া থেকে মায়ের বডি সৎকার হওয়া অব্দি, তারপর কুঁড়িই জোর করে বাড়ি পাঠিয়েছে প্ৰত্যয়কে। যার ওপর কোনো অধিকার নেই, তার কাছে প্রত্যাশাও রাখাটা ঠিক নয়। হ্যা, সেই সময় অবচেতনবশত হয়তো অনেকটাই পাশে পেয়েছিল প্রত্যয়কে, কিন্তু অধিক পাওয়া তো কাম্য নয়।


মায়ের কাজে ওবাড়িতে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। মাসিমা এসেছিলেন, একা। প্রত্যয় নিজে থেকে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। দরকারই বা কি? এই বেশ আছে কুঁড়ি।


কলেজ শেষে সোজা বাড়ি ফেরে। গঙ্গার ঘাট আর ভালো লাগেনা। অবাধ্য জলের ঢেউ যেন মার স্পর্শ মুছিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কুঁড়ি পরমাণু সেকেন্ডও মায়ের অস্তিত্ব আগলে রাখতে চায়, মায়ের স্মৃতি একটু গায়েব হলে যে আর একজনের কথা মনে এসে যায়, যে কিনা স্বার্থপরের মত ফিরিয়ে দিয়েছি কুঁড়িকে, তিলতিল করে গড়া স্বপ্ন ভাঙতে বাধ্য করেছে! চারদিকে কেবল অপ্রাপ্তি, প্রিয়মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা, কুঁড়ি আর সহ্য করতে পারছেনা। এইসময় মায়ের কোল টা খুব দরকার ছিল কুঁড়ির!


দরজার আড়াল দিয়ে বাবাকে একঝলক দেখে নিলো কুঁড়ি। এখন বেশিরভাগ সময়ই বাবা বই পড়েন। ভালো, নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেয়ে, ভুলিয়ে রাখার চেয়ে ভালো কিছু হয়না।


আজ ছুটি। কুঁড়ি রান্নাঘরে টুকটাক কাজ সারছিলো।


দরজায় বেল।


কুঁড়ি আলগোছে দরজা খুলে দেয়।


প্রত্যয়। কি ব্যাপার!


বসার ঘরে দুজন মুখোমুখি বসে। কুঁড়িই প্রথম জিগ্যেস করে, "বাবুই কেমন আছে? মাসিমা? অনেকদিন ওদের দেখিনা, সঙ্গে আনলে তো পারতেন, আমার নাহয় যাওয়ার অসুবিধে আছে, ওনাদের তো নেই!"


কিছুক্ষনের নীরবতা, তারপর, প্রত্যয়, "আমি একজন ক্যান্সার পেশেন্ট। মা জানেনা। পৃথা জানতো, পৃথা কনসিভ করার ছয়মাস পর ধরা পড়ে। ট্রিটমেন্টও চলছে। আমারই তো আগে যাওয়ার কথা ছিল, ও চলে গেল। আপনাকেও বিড়ম্বনায় ফেলতে চাইনি, তাছাড়া আপনার পরিবার আছে, অপবার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ...সব ছেড়ে...


তাই সেদিন ওভাবে...!" প্রত্যয়ের চোখে আকুতি, "আমায় ভুল বুঝবেননা, আপনার এই কষ্টের জন্য আমি তো কিছুটা হলেও দায়ী, তাই...!"


-" তাই ক্ষমা চেয়ে দায় মুক্ত হতে চায়ছেন?


দায় তো আপনার আজকের নয়, প্রথম যেদিন আমায় দিয়ে জোর করে ব্যানার লিখিয়েছিলেন, দায় তো সেদিনই শুরু হয়েছিল। নাহলে একেকবার দেখা হওয়ার পর আপনাকে ভুলে যাওয়ার ঠিক পরমুহূর্তেই কেন হাজির হতেন আমার সামনে বারবার?


জানেন সেদিন, মাকে আপনার কথা বলায় মা শেষ বারের মতন আমার কপালে, এই এইখানটায় চুমু খেয়েছিল, আপনি এখন দায়মুক্ত হতে চায়ছেন?"


কেঁদে ফেলে কুঁড়ি, "হ্যা, আমার কষ্টের জন্য আপনি দায়ী, স্বার্থপর আপনি ,তাই ক্ষমা চেয়ে দায়মুক্ত হতে চায়ছেন। ভবিষ্যতে কি হবে? আপনি মারা যাবেন, আমার মাও মারা গেছেন, মারা গেছেন আপনার স্ত্রীও। কিন্তু ওদের সঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মরে গেছে কি? যায়নি। আমিও নাহয় বাবুইকে আঁকড়ে ধরে ওই মুহূর্ত গুলো নিয়েই বাঁচতাম, এতো স্বার্থপর আপনি, নিজেকে মহৎ প্রমান করার উদ্দেশ্যে আমায় এইটুকু ঋণমুক্তিও দিলেন না?


আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ? ওই দেখুন আমার বাবা, নির্জীব বসে আছেন বই খুলে, এটাই আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ? ওই দেখুন আমার মা, আমার সব থেকে কাছের মানুষ, দেওয়ালে ছবি হয়ে গেছে, ওটাই আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ? এটাই দেখতে চেয়েছিলেন তো আপনি?


জানেন, ছোটবেলায় বাবাকে খুব ভয় পেতাম, বাবার ইচ্ছে মত কাজ করতাম তাতে নিজে আনন্দ পেতামনা কিন্তু। করতাম, এই ভেবে, একদিন আমিও বড় হবো, স্বাবলম্বী হবো, স্ব-অধীন হবো। তখন আর বাবার আধিপত্য খাটবেনা, আরো এটা ভেবে বাবার কথা শুনতাম, বাবা তো আমায় ভালোবাসেন, যা বলেন আমার ভালোর জন্যই।


আসলে সবাই আমার ভালোই চায়, তাই সবাই আমায় একা করে চলে যায়, আচ্ছা, একা থাকলেই কি ভালো থাকা যায়? বলুন না!


আপনিও তো সেদিন আমার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যই আমায় দূরে করে দিয়েছিলেন তাই না?


সি, এখন আমি একদম নিজের মালিক, যা ইচ্ছে তাই করতে পারি, বাবা আর আমাকে কিছুতেই বকেননা, আর মা, খুব কষ্ট পেলেও কোনোদিন জড়িয়ে ধরতে আসবে না , আমার তো খুশি হওয়ার কথা, ভালো থাকার কথা, কেন পারছিনা বলুন তো?"


কুঁড়ি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে, "দেখুন তো কি কান্ড, কিভাবে আপনাকে বিব্রত করছি!


চা খাবেন? বসুন!"


কুঁড়ি উঠতে যেতেই ওর হাতটা টেনে ধরে প্রত্যয়, " পারবেন, আমাকে আপনার অধীনে রাখতে? আমিও যে বড্ড একা, তার চেয়েও বোধয় বেশি শুন্যতা আপনার মধ্যে। সেদিন বুঝিনি, তাই নিজের নিঃস্ব জীবন আপনাকে উপহার দিতে চায়নি। তাই আজ উল্টো হাওয়া বইয়ে আপনার দরজায় এসে দাঁড়ালাম, আপনার সমস্ত শুন্যতা শুষে নিতে।


পারবেননা একা একটা বাবুইকে নিয়ে, একা আমার মাকে নিয়ে, আপনার বাবাকে নিয়ে আর একা একটা প্রত্যয়কে নিয়ে নিজের শুন্যতায় পরিপূর্ণতা ভরে সবাইকে ভরিয়ে দিতে?"


প্রত্যয়ের বুকে ডুকরে কেঁদে ফেললো কুঁড়ি।


প্রত্যয়ও জড়িয়ে ধরেছে কুঁড়িকে, " আজ আবার বাঁচতে ভীষণ ভাবে ইচ্ছে করছে," ,কুঁড়ির মুখটা দুই হাতে ধরে প্রত্যয় বললো, "চেয়ে দেখো, তোমার বাবা, তুমি, আমার মা, আমি, বাবুই আমরা সবাই কিন্তু একা, নিজের নিজের জগতে এক একজন পরাজিত সেনা।পারবেনা, তোমার কক্ষপথে দিকভ্রষ্ট আমাদের নিয়ে নতুন বৃত্ত তৈরি করতে, ঠিক তোমার মায়ের মত, আমার মায়ের মত?"


কান্না মুছে বরাভয় দেয় কুঁড়ি, "পারবো!"


দেওয়াল জুড়ে মায়ের মালা ঝোলানো ছবি, উজ্জ্বল, আশীর্বাদ মাখা চোখে যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics