বৃষ্টির কাব্য (পর্ব-৩)
বৃষ্টির কাব্য (পর্ব-৩)
৩.
এক সপ্তাহ ধরে রেনু বেগম হাসানের ব্যাপারটা ইনু সাহেবকে বলার চেষ্টা করেও বলতে পারলেন না। কীভাবে বলবেন বুঝে উঠতে পারেন নি। এখন মোটামোটি কথা গুছিয়ে ফেলেছেন।
ইনু সাহেব বসার ঘরে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। রেনু বেগম তা সামনের সোফায় বসে বললেন,"ভাইজান।"
পত্রিকা নামিয়ে ইনু সাহেব বললেন,"হ্যা রেনু বল।"
"ভাইজান হাসানের ব্যাপারে কিছু বলব আপনাকে।"
"হ্যা বল।"
"আচ্ছা আমি বলার আগে আপনি বলুন - আপনি আসার পর কী আপনার হাসানকে অন্যরকম মানে তার উদ্ভট কিছু আপনার চোখে পড়েছে?"
"না তেমন কিছু না। কেন বলছিস?"
রেনু বেগম হতাশ গলায় বললেন,"আমার হাসানকে অন্যরকম লাগছে। সে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলে। সারাদিন একলা থাকে। আর একটা অবাক করার বিষয় হল প্রবল বৃষ্টিতে ভিজলেও তার কোনো অসুখ হয় না। আমার কাছে বিষয়টা তেমন সুবিধার ঠেকছে না।"
ইনু সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন,"দেখ তুই যেমনটা চিন্তা করছিস তেমনটা না।"
বিড়বিড় করে কথা বলা কোনো অসুস্থতা না। এটা অতিরিক্ত চিন্তা করার একটা লক্ষণ। আর বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ না হওয়ার কথা বলেছিস সেটা হল আল্লাহ্ এর রহমতে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব ভালো তাই অসুস্থ হয় না সহজে।"
"ভাইজান সে প্রায় সময়ই একলা থাকে কোনো কথা বলে না। কোথাও যায় না ঘুরতে।"
"আরে ওটা কিছু চাপা স্বভাব তো তাই।"
ইনু সাহেবের মনে হল তিনি "জাহেদ উল্লাহ" এর কথা রেনু বেগমকে না বলে ভালোই করেছেন। সে যদি এসব শুনে সে নিজেই চিন্তা করে করে পাগল হয়ে যাবে।
রেনু বেগম চুপ করে আছেন। ইনু সাহেবের বুঝতে পেরেছেন রেনু বেগমেরর কাছে তার যুক্তিকে খন্ডন করার মত কোনো যুক্তি নেই। কিছু মানুষ মনে করে তাদের আশেপাশে যা ঘটছে সবকিছুর পেছনে রহস্য আছে। তাই স্বাভাবিক বিষয়েও সন্দেহ করে। রেনু বেগম ঐ দলের লোক। কিন্তু হাসানের বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক লাগবে না কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাছে।
রেনু বেগম ইনু সাহেবের দিকে ভীত গলায় বললেন,"ভাইজান আমি চাই না সে যেন আপনার মত কোনো উদ্ভট কাজ করুক যাতে আমাদের শর্মিন্দা হতে হয়।"
ইনু সাহেব মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,"আরে না না। ঔধরনের কিছু করবে না।"
"ভাইজান আপনি মনে কষ্ট নিয়েন না।"
"না। আমি এত ছোট বিষয় নিয়ে কষ্ট পাই না।"
রেনু বেগম উঠে রান্নাঘরের দিকে আগালেন। ইনু সাহেবের মুখে আর হাসি নেই। আসলে অভিনয় ছাড়া জীবন কাটানো কঠিন হয়ে যায়।
সামিরা রান্নাঘরে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিল। রেনু বেগমকে ঢুকতে দেখেই সে জানালার পাশ থেকে সরে পড়ল। রেনু বেগমের কড়া নির্দেশ রান্নাঘরের জানালার সামনে যেন সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকে।
সামিরার বোঝার বাকি রইল না যে রেনু বেগম ইনু মামার সাথে কথা বলে এসেছে। রেনু বেগমের চেহারার মধ্যে অসহায়ত্ব আর হতাশার ছাপ আছে। যতবার তিনি ইনু মামার সাথে কথা বলে এসেছেন ততবারই তার মুখে এধরনের ভাব চলে আসে।
সামিরা তার সামনে বেশিক্ষণ থাকার ঝুঁকি নিল না। সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ইনু সাহেবের কথাবার্তা সামিরার একেবারেই ভালো লাগে না। আজগুবি সব কথা বলেন। তবে কেন জানি কথাগুলো মিলে যায়। গত ২ দিন আগে বিকেল বেলা বসার ঘরে মোবারক সাহেব বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তার অভ্যাসমত সামিরা তাকে কেটলি থেকে কিছুক্ষণ পরপর চা ঢেলেদিচ্ছিল। ঐসময়েই ইনু সাহেব এসে সোফায় বসলেন। বিরস মুখে বললেন,"আজ খুব গরম পড়ছে না ভাই?"
মোবারক সাহেব তার দিকে তাকিয়ে বললেন,"খুব গরম।"
"কিছুক্ষণের জন্য বেরুলেই একেবারে চিকেন ফ্রাই।"
"হু"
কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন,"আচ্ছা আপনি কী মনের কথা জানার বিষয়টা বিশ্বাস করেন।"
"না ওসব ভিত্তিহীন জিনিস আমি বিশ্বাস করি না।"
"আমি জানতাম আপনি বিশ্বাস করেন না।আর আমি এটাও জানি যে আপনি আমাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না।"
মোবারক সাহেব পত্রিকা সরিয়ে তার দিকে তাকালেন। সামিরা কেটলী হাতে সেখান থেকে উঠে চলে এসেছিল। এরপরের কথোপকথন তার একেবারেই শোনার ইচ্ছা ছিল না।
রেনু বেগম চিন্তাযুক্ত চেহারা নিয়ে তার ঘরে বসে ছিলেন। সামিরা রেনু বেগমকে এভাবে বসে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বলল,"খালামণি কিছু নিয়ে টেনশা
ন করছেন?"
হতাশ হয়ে তিনি বললেন,"হু"
"কী নিয়ে?"
"হাসানের অসুস্থতা নিয়ে।"
"কেন ওর কী হল?"
"সে তো স্বাভাবিক আচরণ করছে না। বিড়বিড় করে কথা বলে। কারো সাথে মিশে না। সবসময় দুরে দুরে থাকতে চায়। আমার ভয় করছে সে যেন ইনু ভাইজানের মত কিছু না করে বসে।"
"ইনু মামার মত আবার কী করবে?"
তিনি কিছু বলতে গিয়ে বললেন। তার মুখ সামলে নিয়ে তিনি বললেন,"কিছু না। "
"না কিছু তো অবশ্যই আছে। না থাকলে আপনি এভাবে চিন্তা করতেন না। আমাকে বলেন সত্যিটা।"
রেনু বেগম দীর্ঘশ্বাস নিলেন। এরপর বললেন,"তখন ইনু ভাইজান তোমাদের বয়সী ছিলেন। বেশ হাসিখুশি ছেলে যখন হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে যায় তখন সবার অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কে জানতো এর চেয়ে উদ্ভট কিছু তিনি করতে চলেছেন। একদিন হঠাৎ তিনি আমাকে বললেন, রেনু ছাদে চল আকাশে পুরো চাঁদ দেখা যাচ্ছে। অনেক সুন্দর জোছনা হয়েছে।
আমি মানা করতে পারিনি। আমি আমার ফুফাতো দুই বোন, তাদের একমাত্র ভাই আর ইনু ভাইজান একসাথে ছাদে উঠলাম। সবাই আড্ডা দিচ্ছিল। বেশ সুন্দর পরিবেশ ছিল। কিন্তু ইনু ভাইজান শুধু চাঁদের দিকে তাকিয়েই ছিলেন। তিনি তার জামা খুলে ফেললেন। একপর্যায়ে তিনি তার প্যান্ট খুলে একেবারে নগ্ন হয়ে যান। আমরা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, কীরে ভাইয়া জামা প্যান্ট খুলেছেন কেন?
তিনি চোখ বন্ধ করে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললেন, দেখ না জোছনা কত সুন্দর। আমার শুধু চেহারাতে কেন জোছনা পড়বে। আমার সব অঙ্গ জোছনাতে মেখে যেতে হবে। তাহলেই আমার চাঁদ দেখা স্বার্থক হবে।
আমি সেখানেই কেঁদে দিলাম। আমার ফুফাতো ভাই আর বাবা চাচা মিলে ইনু ভাইজানকে কাপড় ঢাকা দিয়ে নিচে নামালেন।"
সামিরা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল,"উনি পড়ে ঠিক হলেন কীভাবে?"
"অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। মাজারেও গিয়েছি। অনেক কিছু করার পর তিনি সুস্থ হলেন। সুস্থ হওয়ার পর থেকে তিনি যা বলেন তা মিলে যায়। আবার মানুষের মনের কথা কিছুটা পড়তে পারেন। তোমার খালু এসব বিশ্বাস করেনা। তিনি বলেন ইনু ভাইজানের নাকী সিক্সথ সেন্স ভালো। এত কিছু আমি বুঝিনা। আমি বুঝি ইনু ভাইজানের আধ্যাত্বিক ক্ষমতা আছে।"
"বুঝেছি। আপনি চিন্তা করিয়েন না। কিছুই হবে না হাসানের। আমি তাকে বোঝাব।"
রেনু বেগম চুপ করে বসে রইলেন। তার এখন একটু ভাল লাগছে। হাসানের ঘুম ভাঙতে প্রথমেই তার চোখ গেল চেয়ারে বসে থাকা জাহেদ উল্লাহ এর দিকে। জাহেদ উল্লাহ চোখ বন্ধ করে ছিল হাসান উঠে বসল। জাহেদ উল্লাহ গকয়ে এখনই একই শাল। তার চুল আগের চেয়ে বেশি কোঁকড়ানো লাগছে।
হাসানের মনে হল জাহেদ উল্লাহ যদি চোখ খুলত তাহলে সে তাকে কিছু বলতে পারত। সাথে সাথে জাহেদ উল্লাহ বলল," কেমন আছ তুমি? "
" আছি ভালো। আপনি কেমন আছেন?"
" তুমি ভালো থাকলে আমি ভালো।"
" হু। আজকে হঠাৎ আসলেন। আজকে তো বৃষ্টিও পড়ছে না।"
লাজুক মুখে জাহেদ উল্লাহ বললেন, " তুমি তো জান নতুন কবিতা লিখলেই আমি তোমাকে শুনাতে আসি।"
" হ্যা জানি। তো এখন কী কবিতা শুনাবেন।"
জাহেদ উল্লাহ আরো লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, " হ্যা"
" বলে ফেলুন শুনি।"
কিছু বলার আগেই তিনি উধাও হয়ে গেলেন।
রেনু বেগম তার ঘরে ঢুকেছেন তার ময়লা কাপড় নেয়ার জন্য। তাকে খাটে বসে থাকতে দেখে তিনি বললেন," কীরে স্কুল নাই তোর।"
"হ্যা।"
কঠিন গলায় তিনি বললেন," তো এখানে বসে আছিস কেন? রেডি হয়ে স্কুলে যা। "
" আচ্ছা।"
হাসান খাটতে থেকে নেমে ফ্রেশ হতে গেল।
নাস্তা করে সে বাইরে বের হয়ে গেল। তার মাথায় একটা ঘুরঘুর করছে। খাতা কলম থাকলে লিখে ফেলা যেত। না লেখা পর্যন্ত কবিতাটা মাথায় ঘুরতে থাকবে। কবিতা নিজেই নিজেকে আবৃত্তি করছে-
এক অস্বস্ছ কাচঁ দ্বারা আমরা আলাদা
এপাশে আমি তোমায় ছোঁয়ার জন্য উৎসুক
তোমারো কী আমাকে দেখার ইচ্ছে খুব?
ওপাশে গিয়ে পারিনা তোমায় ছুঁতে
তবে তুমি কাঁচে হাত রেখো
আমার উষ্ণতা তোমায় ছুঁয়ে যাবে
আমি জানি চরপাশে আধার ঘন কালো
নিজ অন্তর দিয়ে অনুভব কর
আমার উষ্ণতা তোমায় জানাবে যে তুমিই এখানকার আলো।
জাহেদ উল্লাহ বোধহয় এই কবিতা বলতে চেয়েছিলেন।