বৃষ্টির কাব্য (পর্ব-২)
বৃষ্টির কাব্য (পর্ব-২)
২.
ব্যাগভর্তি সবজি হাতে বাসায় ফিরলেন মোবারক সাহেব। মোবারক সাহেবকে দেখে রেনু বেগম অবাক হলেন। গতকালই তো লোকটা বাজার করে এনেছে। আজ আবার কেন? রেনু বেগম সবজির ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বললেন, " আবার আজকে বাজার করলে যে?"
মোবারক সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি কাল বাজার করেছেন। তবে তার স্ত্রীকে সে এটা বলতে পারেন না যে, " ভুলে গিয়েছি।" তিনি একগাল হেসে বললেন, " আসলে তাজা সবজি দেখে লোভ সামলাতে পারি নাই তাই নিয়ে আসলাম।"
রেনু বেগম স্বাভাবিক ভাবে বাজারের ব্যাগ হাতে করে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
সাজ্জাদ সামনের ঘরে টিভির সামনে চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বসে কী যেন দেখছে। মোবারক সাহেব খেয়াল করেছেন প্রতিদিন এই সময়ে সে টিভির সামনে এসে বসে থাকে। এ সময় দুনিয়া ওলট পালট হলেও তার কোনো খবর হবে না। সাজ্জাদকে কিছুটা অচেনা লাগছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠে মুখ ভর্তি হয়ে গিয়েছে। কখনো চেনা মানুষকে একেবারে অচেনা লাগে আবার কখনো কখনো অচেনা মানুষকে খুব কাছের মনে হয়।
খাবারের পর মোবারক সাহেব নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বসে সিগারেট খান। আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি। তার সিগারেট খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেনু বেগম ঘরে ঢুকেন না। আজ সিগারেট খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই রেনু বেগম ঘরে ঢুকে গেলেন। রেনু বেগমকে দেখা মাত্রই মোবারক সাহেব সিগারেট জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। সিগারেট বাইরে ছুড়ে দেওয়ার পর তিনি নিজেই অবাক হলেন। কারন এর আগে সিগারেট খাওয়া অবস্থায় রেনু বেগম সামনে আসলে কখনো সিগারেট বাইরে ছুড়ে মারেন নি। রেনু বেগমকে দেখে মোবারক সাহেব বুঝে গেলেন যে সে এখন লম্বা গল্প করবে। কারন কাল শুক্রবার। তিনিও মানসিকভাবে "হ্যা, হু" করার জন্য প্রস্তুত হলেন।
রেনু বেগম খাটে বসামাত্রই কাঁথা টেনে শুয়ে পড়লেন আর বললেন,"কাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে ইনু ভাইজান আসবেন।"
মোবারক সাহেব হো হো করে হেসে বললেন," কী বল? এতদিন পর তার আমাদের কথা মনে পড়ল তাহলে।"
রেনু বেগম তার দিকে তাকিয়ে বললেন,"হ্যা। তুমিও শুয়ে পড়।"
মোবারক সাহেব লাইট নিভিয়ে দিলেন। তার মুখে এখন আর হাসি নেই। ইনু সাহেবের সবই কথাবার্তা তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। তার ভালো নাম ইদরিছ আলম। তাকে সবাই ইনু বলেই ডাকে। লোকটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। তবে মোবারক সাহেব তাকে তেমন পছন্দ করেন না। যদিও তার সিক্সথ সেন্স মোবারক সাহেবকে বরাবরই অবাক করেছে। মোবারক সাহেব ঠিক করে রেখেছেন কাল ইনু সাহেব যখন খেতে বসবেন তখন মোবারক সাহেব নিজেই মাছের মাথা তার পাতে তুলে দিবেন। রেনুর বড় ভাই বলে কথা। এতটুকু না করলেও নয়। মাঝে মাঝে অভিনয় করে সত্যকে গোপন রাখতে হয়। কিছু সত্য মানুষের মনে লুকায়িত থেকে যায় যা কখনোই বাইরের কেউ জানে না। জীবনে কিছু রহস্য না থাকলে জীবনের আর মজা কী?
বিরতিহীনভাবে কলিং বেল বেজে যাচ্ছে। কলিং বেলের আওয়াজে সাজ্জাদের ঘুম ভাঙল। এরকম বিশ্রীভাবে ঘুম ভাঙলে একেবারেই ভালো লাগে না তার। সে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করল। বিকট শব্দে কেউ একজন হাসছে। সাজ্জাদ বালিশ কানের চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বিকট শব্দে হাসিটা যেন খুব কাছে চলে এসেছে আর ঘুমোতে দিচ্ছে না। সাজ্জাদ বালিশ সরিয়ে খাটে পা নামিয়ে বসল। সামনের চেয়ারে বসে হাসান গম্ভীরমুখে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। হাসানকে কিছু বলেই সাজ্জাদ তার ঘর থেকে বের হল। সামনের ঘরে তার ইনু মামা আর বাবা মা বসে গল্প করছে। ইনু মামা সে কী বিকট শব্দে হাসছেন। তার পরনে একটা টুকটুকে লাল পাঞ্জাবি। তার হাতে নীল রঙের টুপি। তার পেট আগের চাইতেও বেড়েছে।
রেনু বেগম কথা বলেই যাচ্ছেন। তার কথা বলার মাঝখানে ইনু সাহেব "ওও" "ইশ" "বাহ " "হায় আল্লাহ"- এগুলো বলছেন। এসব কথা না বললে আসর জমে না। আড্ডা দেওয়ার সময় কাউকে না কাউকে এসব শব্দ বলতে হয়।
ইনু সাহেব সাজ্জাদকে দেখা মাত্রই বললেন,"কীরে সাজ্জাদ কেমন আছিস?"
সাজ্জাদ স্বাভাবিক গলায় বলল,"আছি মামা। আপনি কেমন আছেন?"
" আছি ভালো। কীরে তুই এতো অলসভাবে কথা বলিস কেন?"
সাজ্জাদ একটু হেসে বলল,"না মামা ঘুম থেকে উঠলাম মাত্র।"
ইনু সাহেব অবাক হয়ে বললেন,"কেন? এতো দেরী হবে? আরে সকাল সকাল উঠে যাবি। উঠেমাত্র ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে ফেলবি।অলসতা একেবারে চলে যাবে।"
সাজ্জাদকে কাছে এনে ফিসফিস করে বললেন,"জিনিসও সবসময় চাঙ্গা হয়ে থাকবে। কখনো নেতিয়ে পড়বে না।"
সাজ্জাদ আবার হেসে ফেলল। ইনু সাহেবকে সে তার সমস্যার কথা বলবে বলে ঠিক করল। সাজ্জাদের এখনো খুব ঘুম পাচ্ছে। সে তার ঘরে চলে গেল।
তার মনে হল-ইনু মামার মত লোক যদি তাদের বাসায় থাকত তাহলে পরিবেশটাই অন্যরকম হত।সবখানে হাসির শব্দই খালি প্রতিফলিত হত।
হাসান এখনো আগের জায়গায় বসে আছে। এক ইঞ্চিও নড়েনি।সেই আগের মতই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ হাসানকে বলল,"ইনু মামা এসেছেন।"
"জানি"
"দেখা করেছিস?"
"হ্যাঁ। আমি তোমার আগে উঠি ঘুম থেকে তাই তোমার আগেই দেখা হয়েছে।"
সাজ্জাদ একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল,"ইনু মামা যদি সবসময়ের জন্য থেকে যেতেন তাহলে ভালোই হত। কী বলিস?"
"একদমই না। "
সাজ্জাদ অবাক হয়ে বলল,"কেন?"
হাসান এবার সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,"একটা মানুষ সচরাচর যে পরিবেশে থাকে সে সেই পরিবেশের বিপরীত পরিবেশে বেশিদিন থাকতে পারবে না। থাকলে তার বৈশিষ্ট্য পুরোই অন্যরকম হয়ে যাবে। আর ব্যক্তিত্ব হারাবে। তাই ইনু মামাও পারবে না।"
সাজ্জাদের ভাবান্তর হল না। হাসান এধরনের কিছু বলবে বলেই সে আশা করেছিল।সাজ্জাদের হাসানের মত চিন্তা করার সময় নেই। নিজের সমস্যাতেই তার জীবন ভরপুর। আশে পাশে সামিরা থাকলে তার সাথে আলাপ করা যেত। সে ছাদে গিয়েছে কাপড় শুকাতে দিতে। এ বাড়িতে শুধু তার সাথে আলাপ করেই লাভ আছে।
ইনু সাহেব হাসানের দেখা এখনো পেলেন না। হাসানকে দেখার জন্য তার মন আনচান করছে। রেনু বেগম তার সাথে সেই কবে থেকে কথা বলেই যাচ্ছেন। তার কথার কোনো শেষ নেই।
ইনু সাহেবের কাছে মনে হয় হাসান জীবনে অনেক বড় কিছু করে ফেলবে। তার সিক্সথ সেন্স এটাই বলছে। হাসানের সাথে তার কী কিছু মিল আছে? না ঠিক পুরোপুরি মিল নেই। তবে কিছু মিল আছে। বিড়বিড় করে কথা বলা সাদৃশ্যের মধ্যে অন্যতম।
ইনু সাহেব রেনু বেগমের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,"হাসান কোথায় রে?"
"হবে ওর রুমে।"
"কেমন আছে সে?"
চিন্তিত মুখে রেনু বেগম বললেন,"ভাইজান আপনার সাথে ওকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার আছে "
"কী বলবি বল।"
"এখন না। পরে বলব।"
"আচ্ছা। ওর সাথে দেখা করে আসি তাহলে।"
"আরে আমি ডেকে দিচ্ছি।"
"না সমস্যা নাই। আমিই যাচ্ছি।"
ইনু সাহেব হাসানের ঘরেরর দিকে আগাতেইই হাসান বের হল। সে হাসিমুখে বলল,"মামা কোথায় যান?"
"তোর সাথে কথা বলতে।"
"আমি জানতাম আপনি আসবেন।"
"কীভাবে?"
হাসান গলার আওয়াজ নামিয়ে বলল,"জানতাম।"
"আচ্ছা বুঝেছি। এখন বল তোর পড়ালেখার কী অবস্থা?"
"চলছে মামা।"
"হাসান চল আজকে কোথাও ঘুরে আসি।"
"আমার কোনো সমস্যা নেই। কোথায় যাবেন? "
"দেখি কোথায় গিয়ে থামা যায়।"
"বড় ভাইয়া যাবে কী না জানি না।"
"সাজ্জাদ যাবে না।আমি আর তুই শুধু।"
"আচ্ছা মামা।"
রিকশাতে দুজন বেশ চাপাচাপি করে বসেছে। ইনু সাহেবের কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে বসতে। হাসানকে দেখে মনে হচ্ছে না তার বসতে অসুবিধা হয়েছে। হাসানকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। হাসান ইনু সাহেবের দিকে না তাকিয়েই বলল,"মামা এসময় বৃষ্টি পড়লে খুব ভালো হত।"
"কেন বলছিস?"
"রিকশায় চড়ার সময় যেকোনো কিছু চিন্তা করতে খুব ভালো লাগে।"
"তা ঠিক। তবে চিন্তার সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক কী?"
"মামা একেক জনের একেক সময় চিন্তা করতে ভালো লাগে। চিন্তা করার জন্য আলাদা পরিবেশ লাগে। আমার বৃষ্টির সময় চিন্তা করতে খুব ভালো লাগে।"
"বৃষ্টির সময় কী চিন্তা করিস?"
হাসান ভাবলেশহীন মুখে বলল," বৃষ্টির আওয়াজ বোঝার চেষ্টা করি। বৃষ্টির প্রত্যেকটা ফোঁটা আমার কাছে ঐশী চিঠি। একেকজায়গার বৃষ্টির আওয়াজ একেকরকম সাথে বৃষ্টির গন্ধও ভিন্ন। মুলত বৃষ্টি নামক কবিতাটাটা বোঝার চেষ্টা করি।"
ইনু সাহেবের মুখের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। হাসি আড়াল করে তিনি বললেন,"তুই এগুলো একলা বসে বসে চিন্তা করার এত ধৈর্য্য কোথায় পেয়েছিস?"
হাসান অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,"মামা আমি তো একলা চিন্তা করিনা।"
ইনু সাহেব ঠাট্টা করার মত করে বললেন,"অলস সাজ্জাদটাও এসব চিন্তা করে না কি?"
"না মামা। বাসার কেউই এসব ভাবে না।"
ইনু সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,"তাহলে তার সাথে বসে চিন্তা করিস?"
হাসান মাথা নিচু করে বসে আছে। কোনো জবাব দিচ্ছে না।
ইনু সাহেব জবাবের আশায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসান তার মামার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বলল,"মামা আমার কল্পনায় একজন আসে যার সাথে আমি এসব নিয়ে আলাপ করি।"
ইনু সাহেব একটুও চমকালেন না। তার কাছে হাসানকে দেখে মনে হয় সে বাকিদের থেকে আলাদা। তাছাড়া ইনু সাহেবের জীবনে এর চেয়ে অদ্ভুত ঘটনা যে ঘটেছে তা কী হাসান জানে? জানবার কথাও না।
হাসান কিছুক্ষণ পর আবার বলল," তার নাম জাহেদ উল্লাহ।"
ইনু সাহেব বলল, "নাম কি সে বলেছে তোকে।"
"না। আমি ওকে যখন প্রথম দেখি তখন জিগ্যেস করেছিলাম তার নাম কী?
সে বলল, তুমি তো জানই।
আমার মাথায় কেমন জানি জাহেদ উল্লাহ নামটা ঘুরঘুর করছিল। আমি বললাম, জাহেদ উল্লাহ?
সে বলল, হ্যাঁ। চিনতে পেরেছ।"ইনু সাহেব বললেন," কোথায় দেখেছিলি প্রথম আর কখন?"
হাসান এখনো মাথা নিচু করেই বলল," বাসায়। গত বছর থেকে।"
"কীভাবে এসেছিল সে?"
"আমি আমার রুমে ছিলাম। প্রচন্ড জ্বর ছিল তখন আমার। জানালা খোলা ছিল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি বাইরে দেখলাম শাল গায়ে একজন ভিজতে ভিজতে আসছে। জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকল সে। তারপরে আমাদের অনেক কথাবার্তা হয়।"
"তুই কেমনে বুঝলি সে তোর কল্পনা?"
"একসময় মা রুমে এসে আমার জ্বর মাপল। ঔষুধ খাওয়ালো। কিন্তু সামনের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটাকে দেখল না কিছু জিগ্যেস ও করল না ওর ব্যাপারে।"
হঠাৎ রিকশা থামল। রিকশাওয়ালা নেমে পেছন ফিরে ভয়ে ভয়ে বলল,"মামা আর যেতে পারুম না। আমার গাড়ি গ্যারেজে নেওয়া লাগব।"
হাসান কিছু না বলেই রিকশা থেকে নেমে গেল। আর ইনু সাহেবকে বলল,"মামা চলেন। বাকি গল্প হাটতে হাটতে বলব।"
