বৃষ্টির কাব্য
বৃষ্টির কাব্য
১.
ঘরের ভেতরে একজনের ছায়া পড়ছে। দরজার ওপাশে কেউ যেন দাড়িয়েছিল।
মোবারক সাহেব একবার উকি দিয়ে দেখলেন কে দাড়িয়ে আছে। সামিরা দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার এই এক সমস্যা। গম্ভীর কিছু বলতে চাইলে সে এসে দাড়িয়ে থাকবে মোবারক সাহেবের ঘরের সামনে। তিনি না ডাকা পর্যন্ত ঘরে ঢুকবে না।
মোবারক সাহেব ভেতর থেকে বললেন, " সামিরা মা নাকি?"
সামিরা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, " জ্বী খালু।"
মোবারক সাহেব খবরের কাগজ ভাজ করে বললেন, " কেমন আছ মা?"
সামিরা চিন্তাযুক্ত চেহারা নিয়ে বলল, " ভালো"
মোবারক সাহেব ভারী গলায় জিগ্যেস করলেন,
"কিছু বলবে?"
সামিরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
মোবারক সাহেব বললেন, " যা বলবে বসে বল।"
সামিরা সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। এতক্ষণ তার দৃষ্টি মেঝের দিকে ছিল। এখন সে মোবারক সাহেবের চোখের দিকে তাকাচ্ছে। অর্থাৎ সে এখন তার কথাটা বলার জন্য প্রস্তুত।
"খালু আমি আর পড়ব না। আমি বাড়ি চলে যাব।"
মোবারক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, " কেন মা? তুমি তো মাত্র কলেজ পাশ করেছ।"
সামিরা একেবারে শেষ সিদ্ধান্ত শোনানোর মত করে বলল," আমার পড়তে মন চায়ছে না।"
মোবারক সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন, " বুঝেছি তোমার কী হয়েছে। একঘেয়েমি। আনন্দ ছাড়া পড়ার এই এক শাস্তি। একে বলে Monotonous Life। তুমি এক কাজ কর। কোনো এক জায়গা থেকে ঘুরে আস। তারপর পড়ায় মন বসবে। "
সামিরার চেহারা থেকে চিন্তার ছাপ গেল না। তার মায়াভরা চেহারায় চিন্তার ছাপ একেবারেই মানাচ্ছে না। সে চেয়ার থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মোবারক সাহেবের কাছে মনে হয় মেয়েটা অত্যন্ত গোছানো। ভেবেচিন্তে সব সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার মধ্যে একটা বেচারি ভাব আছে। মোবারক সাহেবের স্ত্রী রেনু সামিরাকে বেড়াতে নিয়ে আসে এই বাড়িতে।কাকতালীয়ভাবে সামিরার মায়ের মৃত্যু হয় সেই দিনে। তার মায়ের মৃত্যুর পর সামিরাকে তার বাবা শহরে তার খালা রেনুর বাসায় পাঠিয়ে দেন। কারণ সামিরা গ্রামে থাকলে তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তার বাবা সেটা চায় না। তাই কোনো উপায় না থাকায় সামিরা উঠেছে মোবারক সাহেবের বাসায়। এখান থেকেই পড়াশোনা করে। মাঝে মাঝে তার বাবা খোঁজ খবর নিতে আসেন। প্রত্যেকবার আসার সময় ভিন্ন ভিন্ন মাছ নিয়ে আসেন। কখনো ইলিশ কখনো আবার বাইন মাছ।
সামিরাকে তিনি নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করেন। কারণ তার কোনো মেয়ে নেই। তার দুটো ছেলে আছে। সাজ্জাদ আর রাকিব। সাজ্জাদ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আর হাসান নবম শ্রেণীতে।
মোবারক সাহেব খাট থেকে নেমে বারান্দার দিকে আগালেন। সেখান থেকে তিনি পুরো ঘরে হাটা শুরু করেন। তার এই একটা অভ্যাস মনে হয় আজীবন থেকে যাবে। হাটতে হাটতে তিনি বিভিন্ন কিছু চিন্তা করতে পারেন। কারণ এই সময়টায় তার সাথে কেউ কথা বলে না।
তিনি সাজ্জাদ আর হাসানের ঘরে ঢুকলেন। সাজ্জাদ মনের সুখে হাত পা গুটিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর হাসান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কী যেন হিসাব করছে। মোবারক সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দেখতেই হাসান হিসাবব করা বন্ধ করে সাজ্জাদকে ঠেলছে আর বলছে," ভাইয়া উঠো অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। ভাইয়া, এই ভাইয়া।"
মোবারক সাহেব হাসানকে ইশারা করে ডাকতে মানা করলেন। সাজ্জাদকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তার খুব ভালো লাগছে। এই ছেলেই ছোটবেলায় মোবারক সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে আরামে ঘুম যেত। আসলে সময় আমাদের থেকে সুন্দর অনেক জিনিস কেড়ে নেয়। যা বারবার স্মৃতি হিসেবে ফেরত দিয়ে যায়।
মোবারক সাহেব নিজ ঘরে ঢুকতেই দেখলেন রেনু চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বসে আছেন। রেনুর চিন্তাকে তিনি তেমন গুরুত্ব দেন না। তার চিন্তা শুধু একটা জিনিসকে কেন্দ্র করে আর সেটা হল সাজ্জাদ আর সামিরার বিয়ে।
রেনু বেগম মোবারক সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দেখতেই ক্ষীণ স্বরে বললেন," সামিরা আর সাজ্জাদকে নিয়ে বড়ই চিন্তায় আছি।"
মোবারক সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন, " সে তো তুমি সবসময়ই থাকো।"
মোবারক সাহেবের কথার কারণে রেনু বেগম আলাপ দীর্ঘ করার সুযোগ পেলেন। তিনি বললেন, " ওদের বিয়ের কথা না। ওরা ইদানিং কিছু বিষয় গোপন করছে বলে মনে হচ্ছে আমার। তাদের মুখ সবসময় গোমরামুখো হয়ে থাকে। সবসময় মন খারাপ ভাব থাকে। একে অপরের সাথে ফিসফিস করে কী যেন আলাপ ও করে।"
মোবারক সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, "আমার মনে হয় সামিরা আর সাজ্জাদের ব্যাপারে তোমার ধারণা ভুল। আর তোমার এসব কথা শোনার জন্য আমার সময় নেই। অফিসের কাজ ফেলে কুল পাই না আর তোমার সব আজেবাজে ধারণা।"
মোবারক সাহেব তোয়ালে হাতে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রেনু বেগমের কাছে মনে হল সময় নেই বলে উড়িয়ে দেয়ার মত কথা এটা না।
আজ সকাল থেকে সাজ্জাদ ঘরেই ছিল। কোথাও যায় নি। রেনু বেগমের কাছে বিষয়টা তেমন সুবিধার লাগছে না। সাজ্জাদ চাপা স্বভাবের ছেলে হলেও সে প্রায় সময়েই থাকে ঘরের বাইরে। কখনো রাস্তায় একা একা হাটে কখনো আবার স্টেশনে কখনো আবার কোনো ব্রীজের উপরে। আজ সে ঘরেই বসে আছে।
রেনু বেগম একবার সাজ্জাদকে দেখে আসবেন ভেবে তার ঘরে ঢুকলেন। সাজ্জাদ খাটের এককোণায় আধশোয়া হয়ে বসেছিল। তার হাতে বন্ধ করা একটা বই। ঘরে উদ্ভট একটা গন্ধ। ঘরটা একেবারে অগোছালো। খাটের একপাশে কাপড়ের স্তূপ। পড়ার টেবিলে বই আর ছেড়া খাতা এলোমেলোভাবে রাখা। সাজ্জাদ এখনো রেনু বেগমকে খেয়াল করে নি। রেনু বেগম সাজ্জাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বললেন," কী অবস্থা করে রেখেছিস ঘরের? আর এই বিশ্রী গন্ধটা কীসের?"
সাজ্জাদ অলসভাবে রেনু বেগমের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রেনু বেগমের খুব ইচ্ছা সাজ্জাদের সাথে সামিরার বিয়ে দিবেন।
এ ব্যাপারে তাকে কিছু বলা যায় না। বললেই সে রেগে যায়। কিন্তু রেনু বেগমের সাজ্জাদের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করা দরকার। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে আলাপ করার মত অবস্থায় আছে। রেনু বেগমের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করার মত একজনই আছে। সে হল সামিরা। রেনু বেগম সাজ্জাদের ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
সামিরা নিজের ঘরে ছিল না। বোধহয় ছাদে গিয়েছে। রেনু বেগম চান এ মেয়েটা যেন তার কাছেই থাকে সবসময়। সামিরা মেয়েটা অতী রুপবতীদের দলে। সাধারণত অতি রুপবতীদের চেহারায় তেমন মায়া থাকে না। তবে এ মেয়েটার চেহারা মায়ায় ভরা। এ মেয়েটাকে সাজ্জাদের পাশে অনেক মানাবে। এ বিষয়ে সামিরার বাবার সাথেও আলাপ করা দরকার।
হাসান স্কুল থেকে এসেছে একেবারে ভেজা কাক হয়ে। হঠাৎ করেই চোখের পলকে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়ে বর্ষার মত বৃষ্টি পড়েছে। হাসানকে দেখে রেনু বেগম তেমন অবাক হলেন না। তার ব্যাগে সবসময় ছাতা থাকে তাও সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই আসবে। তাকে রেনু বেগম ধমক দেওয়ার মত করে বললেন, "কীরে ব্যাগে ছাতা থাকার পরেও ভিজে ভিজে কেন আসিস। শরীর খারাপ করলে কী হবে?"
হাসান ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলল, " বলেছিলাম মা বকা দিবে।"
রেনু বেগম ভ্রুঁ কুচকে জিগ্যেস করলেন, " কী বলিস বিড়বিড় করে?"
হাসান বেজেবেজে বলল," ইয়ে না বলছিলাম ছাতার কথা খেয়াল ছিল না।"
রেনু বেগমের রাগ আরো বেড়ে গেল। তিনি প্রায় চিৎকার করেই বললেন, "যা কাপড় ছেড়ে গোসল করে ফেল।"
হাসান কাধের ব্যাগ হাতে নিয়ে তার ঘরের দিকে গেল। পেছন থেকে রেনু বেগম বলেই যাচ্ছেন, " দেখিস কোথাও বসবি না। সোজা বাথরুমে চলে যা।"
রেনু বেগমের একটা বিষয় খুবই অদ্ভুত লাগে তুমুল ঝড় বৃষ্টিতে ভিজলেও হাসানের কোনো শরীর খারাপ হয় না। হালকা জ্বরও হয়না। একদিন সাজ্জাদ আর হাসান বই কিনে ফিরছিল। তখনই শুরু হলতুমুল বৃষ্টি। হঠাৎ করেই বৃষ্টি পড়েছে বলেই তাদের হাতে কোনো ছাতা ছিল না। দুজনেই একেবারে ভিজে গিয়েছে বাড়িতে আসতে আসতে। সে রাতেই সাজ্জাদের একশ তিন ডিগ্রী জ্বর উঠেছিল। আর হাসান একবারো নাক ঝারেনি। আর রেনু বেগম খেয়াল করেছেন হাসান প্রতিবার বৃষ্টির সময় রাতের বেলা জানালার সামনে বসে বিড়বিড় করে কথা বলে আর খাতায় কী যেন লিখে। একবার তিনি তাকে জিগ্যেস করেছিলেন,"এই হাসান জানালা খুলে বসে আছিস কেন? বৃষ্টি ভেতরে আসঝে তো।"
হাসান একবার তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে খাতাটি বন্ধ করে জানালা কিছুটা বন্ধ করে উঠে পড়ল। হাসানের স্বভাব অতিরিক্ত চাপা। সাজ্জাদের চেয়েও চাপা স্বভাব তার। এ বাড়িতে সবাই চুপচাপ থাকে। শুধু রেনু বেগমেরই বেশি কথা বলতে মন চায়। একসাথে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আড্ডা দিতে চান। তার এই ইচ্ছা বোধহয় পূরণ হওয়ার নয়।
