Ananya Podder

Classics

4  

Ananya Podder

Classics

বন্ধু আবার কাছে আয়

বন্ধু আবার কাছে আয়

14 mins
530


বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে | এমন বৃষ্টিতে বিছানায় অলস গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে বরাবরই ভালো লাগে অদিতির | আজ স্কুলে বিশেষ সেরকম কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসও নেই, আর এত বৃষ্টিতে কজনই বা স্কুলে আসবে ভেবে স্কুলটা আজকের মতো ডুব দেওয়ার কথাই ভাবলো অদিতি | ঠিক এই সময়েই সেই বাজখাই গলা, "কিরে অদি, উঠলি?? আর কত ঘুমোবি রে?? স্কুলে যাবি তো?? "


সকাল দশটায় স্কুলে যাওয়ার থাকলে ঠিক নটার মধ্যেই উপস্থিত হতে হবে জয়কে | স্নানটা সেরে স্কুল ইউনিফর্মটা কোনো রকমে গায়ে গলিয়ে সোজা অদিতির বাড়িতে চলে আসা জয়ের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ | অদিতির মা অলোকা একসাথে ভাত মেখে দুই বন্ধুকে খাইয়ে দেয় | দিনের তিন বেলার ভাতের মধ্যে দুবেলার ভাতই লেখা থাকে অদিতির বাড়িতে অদিতির মায়ের হাতে রান্না করা |


জয় ওরফে জয়স্মিতা অদিতির অনেক দিনের বন্ধু | সেই যে ক্লাস সিক্সে পড়তে বন্ধুত্ব শুরু হোলো, সেই বন্ধুত্ব আত্মীয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো | অদিতির মা নিজেও বলেন, "আমার একটা না, দুটো মেয়ে - অদিতি আর জয়স্মিতা | "


জয়স্মিতার মা নেই | সেই কোন ছোটবেলায় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় জয়স্মিতার মা | জয়স্মিতার বাবার নারীসঙ্গ সম্পর্কেও প্রচুর খবর ছিল জয়স্মিতার কাছে | ফলে, অসুস্থকর পরিবেশ ওর লেখাপড়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ালো |


ক্লাস সিক্সে পড়তেই দামী ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া জয়স্মিতা ফেল করে বসলো | ফলে নামী দামী স্কুল থেকে বের হয়ে আসতে হোলো তাকে | এর মধ্যেই জয়স্মিতার বাবা আবার বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে আসলেন ঘরে | তখন জয়স্মিতা ওর বাবাকে বলল, "আমি তোমার সঙ্গে আর থাকবো না | আমাকে দাদু দিদার কাছে পাঠিয়ে দাও আর ওখানেই একটা যে কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও | ব্যস, আমার প্রতি তোমার আর কোনো দায়িত্ব থাকলো না | "


জয়স্মিতার বাবা আর নতুন মা যেন স্বস্তি পেলেন মেয়ের এমন সিদ্ধান্তে | তিনি তড়িঘড়ি করে মেয়েকে তার দাদু দিদার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন |


দাদু দিদার কাছে এসে জয়স্মিতা মলিনীবালা বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হোলো | ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া জয়স্মিতা বাকিদের থেকে বাংলায় ছিল কাঁচা |তার শব্দ ভাণ্ডারে বিশেষ কোনো সঞ্চয় ছিল না | অথচ অন্য বিষয়গুলোতে সে বেশ ভালোই ছিল | দাদু দিদা গরীব হলেও তাঁদের স্নেহে আর সুস্থ পরিবেশে জয়স্মিতা আবার নতুন করে লেখাপড়ায় মন দিলো | সব বিষয়কে আয়ত্ত করতে পারলেও বাংলা বিষয়টাকে সে কিছুতেই নিজের আয়ত্তে আনতে পারছিলো না | তখন অদিতিকে বাংলার শিক্ষিকা বলেন, জয়স্মিতাকে একটু সাহায্য করে দিতে |


সেই থেকে শুরু | গল্প সূত্রে জানা গেলো দুজনের বাড়ির দূরত্ব মাত্র দশ মিনিটের | জয়স্মিতার গল্প মায়ের কাছে করতেই অদিতির মা অলকা মেয়েকে বললেন, "আহা রে, মা মরা মেয়ে!! এইটুকু বয়সেই জীবন কত কিছুই না দেখিয়ে দিলো মেয়েটাকে !! এক কাজ করিস মনা, জয়স্মিতাকে একদিন নিয়ে আসিস আমাদের বাড়িতে | "


মায়ের কথায় অদিতি জয়স্মিতাকে বাড়িতে নিয়ে আসতেই সেই যে অলকার আপন হয়ে উঠল সে , সেই থেকেই অদিতির উপরে জয়স্মিতার দাবী গেলো বেড়ে, সাথে অযাচিত অত্যাচার | জয়স্মিতা অদিতির বন্ধু রইল কম, বোন হয়ে গেলো বেশি | দিনের বেশিরভাগ সময়টাই জয়স্মিতার অদিতির বাড়িতে কাটে | এই কবছরে জয়স্মিতা অদিতির জয় আর জয়স্মিতার কাছে অদিতি অদি হয়ে উঠেছে |


আজও জয় এই আকাশ ভাঙা বৃষ্টি নিয়ে এসেছে অদিতিদের বাড়িতে | জয়ের গলাটা পেতেই অদিতি বলল, "তুই মায়ের কাছে যা | মা আজ খিচুড়ি রান্না করছে, যা গিয়ে খিচুড়ি খা | আমি আজ স্কুলে যাবো না | "


অদিতির কথা জয়স্মিতা শুনলে তো!! সে বলল, "শুধু শুধু স্কুল কামাই করবি, তা আবার হয় নাকি?? ওঠ, ওঠ, উঠে স্নানে যা | মায়ের হাতের গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে স্কুল যাই চল | "


অদিতি আর্টস ডিপার্টমেন্টে পড়ে, আর জয়স্মিতা সাইন্স বিভাগে | ফলে দুজনের রুটিন অনুযায়ী ক্লাসের হেরফেরও থাকে অনেক | কিন্তু দুজনে একসাথে স্কুল যাবে, একসাথেই স্কুল থেকে ফিরবে | আজকের রুটিন অনুযায়ী অদিতির সেরকম ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও অগত্যা স্কুলে তাকে যেতেই হোলো, কারণ, জয়স্মিতার আজ ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি দুটোরই প্রাকটিক্যাল ক্লাস আছে |


রাগে গজর গজর করতে করতে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় অদিতি বলল, "তোর মতো বন্ধু থাকার চেয়ে শত্রু থাকা অনেক ভালো | আমার উপরে তোর এতো দাবী কিসের রে?? একদিন তোর এই জুলুমের জন্যই দেখবি, তোর কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যাবো আমি | "


জয়স্মিতা হাসতে হাসতে বলল, "সেদিনটা কোনোদিন আসবে না | তোকে পালাতে দিলে তবে না পালাবি তুই আমার থেকে??"


অলোকা ঠাকুরের উদ্দেশ্যে বলতেন, "ভগবান, ওদের বন্ধুত্বে যেন কারোর নজর না লাগে | "


কিন্তু ভগবান অলকার কথা শোনেননি | হরিহর আত্মা দুই বন্ধুর মাঝে সত্যিই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় প্রেম |


স্কুলগন্ডী পেরিয়ে জয়স্মিতা আর অদিতির কলেজ আলাদা হয়ে যায় | জয়স্মিতা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢোকে, আর অদিতি বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়া শুরু করে | সেই সময়েই অদিতির জীবনে আসে প্লাবন | প্লাবন অদিতির চেয়ে তিন বছরের বড়ো | একাউন্টেন্সি নিয়ে একই কলেজে পড়ে সে | দুজনের মধ্যে আলাপের পরে প্রেম হতে খুব বেশি সময় লাগেনি |


জয়স্মিতাকে প্রথমে প্লাবনের কথা জানাতেই ভয় পেয়েছিলো অদিতি | কি জানি, প্লাবনকে পছন্দ না হলে হয়তো বলেই বসবে, "ওর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবি না তুই | "


কিন্তু জয়স্মিতা তা করেনি | অদিতির হাবভাব দেখে সে বুঝেছিল, অদিতির জীবনে বন্ধু ছাড়াও বিশেষ কেউ আছে, যার সান্নিধ্য অদিতি অনেক বেশি করে চায় | তাই টিউশনের নাম করে মাঝেমধ্যেই পালিয়ে বেড়ায় অদিতি |


একদিন জয়স্মিতা হাতেনাতে ধরে ফেলে ওদের দুজনকে | প্লাবনকে অদিতির সাথে দেখে বলে, "তুমি তো বেশ জাদুকর, যে, আমার এতদিনের বন্ধুটাকে আমার কাছেই মিথ্যে বলা শিখিয়ে দিলে!! তা বেশ করেছো, তবে না বুঝবে তুমি আমার অদি তোমাকে কতটা ভালোবাসে !! "


প্লাবনও হাসতে হাসতে বলেছিল, "অদিতিকে এখন থেকে তোমার বলা বন্ধ করো জয়স্মিতা | অদিতি এখন আমার | "


জয়স্মিতা বলেছিল, "বেশ তো তুমি নিয়ে নাও আমার অদিকে | আমার তাতে একটুকুও দুঃখ নেই | একদিন তো আমার বন্ধুকে কারোর না কারোর হতেই হত | সেই মানুষটা না হয় তুমিই হলে | কিন্তু একটা কথা তোমায় বলে রাখি, অদিকে কখনো কাঁদিও না যেন | অদির মাকে আমি মা বলে ডাকি | আমার সেই মা যেন তার মেয়ের দুঃখ দেখে কখনো দুঃখ না পায়, সে খেয়ালটুকু রেখো | "


প্লাবন কলেজ, ইউনিভার্সিটি শেষ করে পৈতৃক ব্যবসায় ঢুকে গেলো | অদিতি তখন এম.এ পড়ছে, আর জয়স্মিতা সোজা কলেজ কাউন্সেলিং - এই চাকরি পেয়ে গেলো | জয়স্মিতার দাদু জয়স্মিতা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়েই মারা যান | জয়স্মিতা চাকরি পাবার মাস ছয়েকের মধ্যে ওর দিদাও মারা গেলে পিছুটান বলে জয়স্মিতার আর কিছু থাকলো না |


অলকা জয়স্মিতাকে বললেন, " আর ও বাড়িতে থেকে তুই কি করবি?? বরং এ বাড়িতেই পাকাপাকি থেকে যা | ওই বাড়িটা বিক্রি করে যা পাবি, নিজের ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখ | সারাদিন তো অফিসেই কাটাস, রাতটুকু না হয় আমাদের সাথেই থাকলি | "


জয়স্মিতা আপত্তি করেনি আর | অলকা তার কাছে মায়ের চেয়ে কিছু কম নয় | এই মানুষটার স্নেহের পরশ পেয়েছে বলেই নিজের জীবনের সব দুঃখকে ভুলে যেতে পেরেছে সে | আর প্লাবনদার সাথে অদির বিয়ে হয়ে গেলে বাবা মাকে দেখাশোনার জন্য না হয় সেই থেকে যাবে | দুই পিপাশার্ত একে অপরের কাছে থেকে একে অপরকে ভালোবাসা আর স্নেহে ভরিয়ে রেখে দেবে |


দিনগুলো ভালোই কাটছিলো | তবে ছুটির দিনগুলোতে অদিকে এখন অনেক কম পাওয়া যায় | সে প্লাবনের সাথে ছুটির দিনের বিকেলটা কাটায়, কখনো সিনেমা দেখে, কখনো শপিং করে, আবার কখনো কোনো দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে |


বেশিরভাগ দিনই অনেক রাতে বাড়ি ফেরে জয়স্মিতা | তার কাজটাই যে এমন,, যাওয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও বাড়ি ফেরার কোনো নির্ধারিত সময় নেই | তবুও যদি কোনোদিন আগে চলে এসেছে, বিছানায় শুয়ে অদির সাথে গল্প করা তার হয়নি | কারণ অদিতি তখন প্লাবনের সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত | বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় ক্লান্ত জয়স্মিতা ঘুমিয়ে পড়তো |


তাও কোনো অভিমান ছিল না জয়স্মিতার | সে বুঝতো তার বন্ধুর মনের অবস্থা | প্লাবনদা যে অদির জীবনের অনেকটাই জুড়ে আছে, সে অনুভবটুকুও ছিল জয়স্মিতার | তাই আস্তে আস্তে দূরত্ব তৈরী করছিলো সে তার প্রানপ্রিয় বন্ধুর থেকে |


কিন্তু এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে গেলো | প্লাবনের মা এলেন অদিতির বাড়িতে বিয়ের পাকা কথা বলতে | সেদিন জয়স্মিতার অফিসে পার্টি ছিল | তবুও বন্ধুর বিয়ের পাকা কথা হবে বলে সে পার্টি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে | কিন্তু তার এই তাড়াতাড়ি ফিরে আসাটাই কাল হোলো |


সেদিন পার্টিতে জয়স্মিতা সামান্য স্কচ খেয়েছিলো | পরিমাণটা খুব সামান্য হলেও তার মুখের গন্ধ প্লাবনের মায়ের নাককে এড়িয়ে যেতে পারেনি | প্লাবনের মা অনিতাদেবী বেজায় চটে গেলেন জয়স্মিতার এমন মদ্যপানে |


তিনি অদিতিকে পরিষ্কার জানালেন, "আমাদের পরিবার খুবই রক্ষণশীল পরিবার | আমাদের পরিবারে এই সব নেশা ভাঙ করা প্রশয় পায় না | তোমার এই বন্ধুটি একটি মেয়ে হয়ে মদ্যপান করে, আর তোমরা ওর সেই বিশৃঙ্খল জীবনকে আস্কারা দাও, এটা মোটেই ভালো লাগলো না আমার | তুমি যদি তোমার এই বন্ধুটির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারো, তবেই আমার প্লাবনের বৌ হতে পারবে তুমি, নচেৎ নয় | "


প্লাবনের মায়ের কথায় প্রতিবাদ করে ওঠেন অলকা, "আপনি বোধহয় জানেন না, জয়স্মিতা শুধুমাত্র অদিতির বন্ধুই না, সে আমার আরেক সন্তান | এই বাড়িতে, এই পরিবারে অদিতির যতটা অধিকার আছে, ঠিক ততটাই অধিকার জয়স্মিতারও | আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো শর্ত মানতে পারবো না আমি | "


অদিতি ভয়ে কেঁপে ওঠে!! তাহলে কি তার এতদিনের ভালোবাসা হারিয়ে যাবে তার জীবন থেকে !! সে তার মাকে বলে ওঠে, "তুমি চুপ করো না মা | উনি তো ঠিক কথাই বলেছেন | জয় হঠাৎ করে ওসব ছাইপাশ খেতে গেলো কেন?? "


জয়স্মিতা বুঝলো, পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়েছে | সে প্লাবনের মায়ের হাত ধরে বলল, "আমার ভুল হয়ে গেছে আন্টি | আমার জন্য আপনি আমার বন্ধুকে যেন কোনো শাস্তি দেবেন না | "


প্লাবনের মা এক ঝটকায় জয়স্মিতার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িযে নিয়ে বলেন, "দূর হও আমার কাছ থেকে | তোমার এতো বড়ো সাহস হয় কোত্থেকে যে তুমি আমার হাত ধরো | মদ খেয়ে মাতলামি করার আর জায়গা পাওনি তুমি !! অসভ্য মেয়ে কোথাকার !! "


অলকা তীব্র প্রতিবাদের সুরে বললেন, "আপনিও বোধহয় আপনার সীমা অতিক্রম করে কথা বলছেন দিদি | "


অলকাকে হাতের ইশারায় থামলে বলল জয়স্মিতা | তারপর প্লাবনের মাকে বলল, "আপনার আপত্তিটা কোথায় বলুন তো আন্টি ?? আমার মদ খাওয়ায়, নাকি আমার মেয়ে হয়ে মদ খাওয়ায় ?? "


"দুটোই "... হুঙ্কার ছাড়লেন অনিতা |


"তাহলে প্লাবনদা যেদিন বন্ধুদের সাথে বারে বসে মদ খেয়ে বাড়ি ঢোকে, সেদিন আপনি কি করেন আন্টি ??"... জয়স্মিতার এমন প্রত্তুতরে তৈরী ছিল না কেউই | ঘরের মধ্যে তৈরী হওয়া ক্ষনিকের নিস্তব্ধতা কাটিয়া প্লাবন বলে ওঠে, "না মা, জয়স্মিতা মিথ্যে কথা বলছে | আমি কোনোদিন ওসব মুখেও তুলে দেখিনি | "


জয়স্মিতা একটু হেসে বলল, "প্লাবনদা মাকে ভয় পেয়ে মিথ্যে বলছো ঠিক আছে | কিন্তু আমি তোমাকে বহুবার চায়না টাউনে দেখেছি, বন্ধুদের সাথে গ্লাস হাতে বসে আছো | আমি কোনোদিন অদিকে কিছু বলিনি, কারণ আমার মনে হয়েছে, এটা তোমার ব্যক্তিস্বাধীনতা | কাউকে বিব্রত না করে সাময়িক ভাবে নিজের পছন্দমতো জীবন কাটাতে চাইলে দোষের কিছু করছো না | আর যখন সিগারেট খেতে পারো, তখন একটু আধটু মদও হয়তো খেতেই পারো | হয়তো অদিকে বলেওছো কথাটা, আবার হয়তো বলোনি | সিগারেট আর মদ দুটোই তো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক | অদি যখন তোমার সিগারেট খাওয়ায় আপত্তি তোলেনি, তখন হয়তো এইটুকু মদ্যপানেও আপত্তি তুলবে না | সে যাই হোক, সেটা সম্পূর্ণ অদির ব্যাপার | আজও হয়তো কথাটা বলতাম না, যদি না তোমার মা এভাবে অপমান করতেন !! কিন্তু এক দু পেগ মদ খেলে যদি আমি অসভ্য হয়ে যাই, তাহলে তুমিও তো সেই অসভ্যদের দলেই পড়ো,, তাই না?? "


প্লাবন বেগতিক দেখে মাকে বলল, "মা, চলো এখান থেকে | জয়স্মিতার মাথা খারাপ হয়ে গেছে | "


সেদিনের সেই ঘটনার পরে প্লাবন অদিতির কাছে আবদার করে বসলো, "অদিতি, তোমাকে জীবনে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে,, হয় প্রেম, না হয় বন্ধুত্ব | সিদ্ধান্ত তোমার নিজের, আমি কিছু বলবো না | জয়স্মিতার মতো উগ্র নারীবাদী মেয়ে তোমার জীবনে থাকলে আমাদের দাম্পত্য জীবন কোনোদিনই সুখের হতে পারবে না | "


অদিতি পড়লো ফ্যাসাদে | সে কোনদিকে যায় এখন !! একদিকে তার এতদিনের গভীর বন্ধুত্ব, অন্যদিকে তার প্রেম!! কোথায় যায় সে ??


তাই সে অগত্যা বন্ধুত্বের হাত ছেড়ে প্রেমের হাত ধরলো | অদিতি বন্ধুর কাছে দাবী করেছিল, "তুই আমায় কথা দে, তুই কোনোদিন মদ ছুঁবি না | "


জয়স্মিতা বলেছিল, "প্লাবনদার কাছ থেকে এমন কথা নিয়ে আসতে পারবি তো তুই অদি??... দেখ, বিষয়টা আমার মদ খাওয়া বা ছাড়ার নয় | বিষয়টা তোর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা | আমি যদি তোর কথা মেনে জীবনে মদ স্পর্শ না করি , তবে তুই আমাকে আস্বস্ত করতে পারবি তো, যে, প্লাবনদা বা ওর মা আর কোনো বিষয়ে তোর উপরে দাবী খাটাবে না ?? আজ একবার ওদের ডিমান্ডের সামনে মাথা নুইয়ে দিলে ওরা আবার তোর কাছে নতুন কিছু দাবী করবে না?? এভাবে নিজের স্বাধীনতাকে ওদের সামনে বিকিয়ে দিস না অদি | ভালো যখন দুজনেই বেসেছিস, তখন একে অপরের ইচ্ছে অনিচ্ছে দুজনকেই তো দেখতে বল !! প্রেম সারাজীবন থাকে না, একটা সম্পর্কে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা রাখাটাই আসল কথা | "


জয়স্মিতার সব কথা শুনে অদিতি বলেছিল, "তুই আমাদের জীবন থেকে চলে যা জয় | তুই তোর বাবা মায়ের সুস্থ দাম্পত্য জীবন দেখিসনি, তাই এতো সব কথা তোর মনের মধ্যে আসে | কিন্তু দাম্পত্য জীবনে অ্যাডজাস্টমেন্ট একটা বড়ো শব্দ, আর সেটা মেয়েদেরই বেশি করতে হয় | তোকে বোঝাতে পারবো না আমি এসব কথা | তার চেয়ে ভালো তুই আমাদের জীবন থেকে চলে যা | তুই তোর নারীবাদীত্ব নিয়ে থাক, আর আমি আমার ভালোবাসা, সংসার নিয়ে ভালো থাকি | "


অদিতির কথায় অলকা কেঁপে উঠেছিলেন, " এতটা স্বার্থপর হোস না মনা | জয় শুধু তোর জীবনের সাথেই জড়িয়ে নেই, জয় জড়িয়ে আছে আমার জীবনেও | তোর বন্ধু হওয়া ছাড়াও জয় আমার আরেক সন্তান | ভুলে যাস না, আমি ওরও মা |"


মায়ের কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে অদিতি, "তোমার কাছে নিজের মেয়ের থেকে অন্যের মেয়ে বেশি হোলো বুঝি ?? জয় থাকুক নারীবাদী হয়ে | আমি ওর জন্য সব কিছু হারাতে পারবো না | "


জয়স্মিতা বুঝলো, ওর জন্য ওদের মা মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়ে যাচ্ছে | সে অলকাকে বলল, "তুমি অদিকে কিছু বোলো না মা | সত্যিই তো, আমার জন্য অদি কেন নিজের জীবন নষ্ট করবে | "


তারপর অদিতিকে সে বলল, " তুই যখন চাইছিস অদি, তখন আমি চলেই যাবো তোর জীবন থেকে | তবে নিজের স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকলে যদি তোরা আমায় নারীবাদী বলিস, তাহলে আমি সত্যিই নারীবাদী | এতো কিছুর পরেও আমি আবারও বলবো, নিজের স্বাধীনতা, নিজের সত্ত্বা, নিজের ইচ্ছে এভাবে কারোর হাতে তুলে দিস না | অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে আজ ভালো লাগলেও একদিন সত্যিই কিন্তু হাঁপিয়ে উঠবি |"


সেদিনের সেই ঘটনার দিন পনেরোর মধ্যেই জয়স্মিতা চাকরির বদলি নিয়ে চলে গেলো | কোথায় গেলো, কেউ জানলো না | অলকা অনেক করে অনুরোধ করেছিলেন, "আমায় বলে যা জয়, কোথায় যাচ্ছিস?? "


জয়স্মিতা বলেছিল, "না মা, জানতে চেওনা কোথায় যাচ্ছি | আমি আমার প্রিয় বন্ধুর মাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইনা | তবে তোমার কাছ থেকে দূরে গেলেও তুমি আমার চোখের নজরে ঠিকই থাকবে | ভগবান না করুক, যদি কোনোদিন তোমার কঠিন সময় আসে কখনো, তাহলে তোমার পাশে অদি না থাকলেও আমি ঠিক থাকবো, চিন্তা কোরো না |"


প্লাবন আর ওর মায়ের শর্ত পূরণ হওয়াতে অদিতির সাথে প্লাবনের বিয়েটা হয়ে গেলো নির্বিঘ্নে | সংসারে ঢুকে অদিতি আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলো, অ্যাডজাস্টমেন্টের সংজ্ঞা | খুব ভালো গান গাওয়া সত্ত্বেও অদিতির গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো | চাকরি করার ইচ্ছে তো মুখেই আনা গেলো না | প্লাবনের মায়ের সোজা কথা, "আমাদের বাড়ির বৌ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে রোজগার করতে যায় না |"


শুধু তাই নয়, অ্যাডজাস্টমেন্টের নামে নিজের পছন্দ মতো জামাকাপড় পরা, নিজের পছন্দ মতো খাবার খাওয়া, নিজের ইচ্ছেমতো বা প্রয়োজন পড়লেও বাপের বাড়ি আসা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো অদিতির | অদিতির জীবন সংসারের চার দেওয়াল, আর ছেলে মানুষ করার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেলো | শ্বশুরবাড়ির বড়লোকিআনায় এখন আর আভিজাত্য খুঁজে পায় না অদিতি | তবুও অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই হবে তাকে | কারণ, তার ধারণা, সংসারে মেয়েদেরকেই অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয় বেশি |


কিন্তু সেই অ্যাডজাস্টমেন্টটাই অদিতির জন্য চূড়ান্ত বোঝা হয়ে গেলো, যখন প্লাবনকে সে তারই এক সেলস গার্ল- এর সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখলো | মনে পড়লো জয়ের কথা, "সম্পর্কটা প্রেমের উপর টিকে থাকে না, টিকে থাকে শ্রদ্ধার উপরে |"


এরপরও জীবন অদিতিকে অনেক কিছু দেখালো | যে রক্ষণশীলতার দোহাই দিয়ে অনিতা দেবী জয়স্মিতাকে অদিতির জীবন থেকে দূর করে দিয়েছিলেন, সেই রক্ষণশীলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্লাবন এখন পারমাতাল হয়ে উঠেছে | সন্ধ্যের পরে মদের বোতল এবং গ্লাস তার রোজকার সঙ্গী | গলা অব্দি মদ না খেলে নাকি তার ঘুম আসে না | আর নেশায় চুর হয়ে গেলে অদিতির সাথে শুরু হয় চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার | এখন অনিতাদেবী নিজের কপাল চাপড়ান, কিন্তু তার কিছুই করার নেই | তিনি শুধু অদিতিকেই পাঠ পড়িয়ে যান, "ঘরের কথা ঘরেই রেখো অদিতি | নাহলে মান সম্মান শুধু আমাদেরই নষ্ট হবে না, তোমার বাবা মায়েরও নষ্ট হবে | তোমার ছেলেকে কেউ পাতে তুলতে চাইবে না | সবাই ওকে মাতালের ছেলে বলে জানবে | তার চাইতে চুপ করে থাকো | তোমার শ্বশুর আর আমি যা রেখে যাবো, তোমার কখনো অর্থের অভাব হবে না | সবার স্বামীসুখ ভাগ্যে লেখা থাকে না, ধরে নাও, তুমিও তাদের মধ্যেই একজন | "


অদিতিও চুপচাপ মেনে নিয়েছে শাশুড়ির কথা | সে চাইলে বেরিয়ে আসতেই পারে শ্বশুরবাড়ি থেকে | তার বাবা মাকে সবটা জানালে তারা কোনোদিনই তাকে ফেলে দেবেন না | কিন্তু অদিতি ইচ্ছে করেই এই অভিশপ্ত জীবনের শাস্তি ভোগ করছে | কারণ, সে বুঝেছে, সে তার প্রিয়তম বন্ধুকে আঘাত দিয়ে যে দীর্ঘশ্বাস কুড়িয়েছে, তার বর্তমান জীবন সেই দীর্ঘশ্বাসেরই ফল |


জয়স্মিতা হয়তো ক্ষমা করে দিয়েছে তাকে, কিন্তু প্রকৃতি, সে বদলা নিয়েই থাকে, সে কাউকে ক্ষমা করে না | প্রত্যেক মানুষের কর্মফল তাকে যে ভোগ করতেই হয় | তাই প্রকৃতির নিয়মেই আজ রোজ একজন মদ্যপ মানুষকে তার সামলাতে হয় |


এখন প্রতি মুহূর্তে অদিতি অভাব বোধ করে জয়স্মিতার | ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার সব জায়গায় একাউন্ট খুলেছে শুধু তার জয়কে যদি খুঁজে পাওয়া যায় কোথাও | কিন্তু না, জয়ের কোথাও দেখা নেই | নিজের মনে মনে প্রতি মুহূর্তে অদিতি জয়স্মিতার কাছে ক্ষমা চায়, আর মনে মনে বলে, "বন্ধু আবার কাছে আয় | আমি যে বড্ড একা রে | তোর মতো বন্ধুর একটা হাত যে আজ ভীষণ ভাবে পেতে ইচ্ছে করে | ফিরে আয় বন্ধু, ফিরে আয় |"


কিন্তু জয়স্মিতা ফেরে না | পৃথিবীর কোনো এক কোণে বসে বোধহয় সেও তার অদির জন্য কষ্ট পায় | হয়তো সে ভালো আছে এই ভেবে যে, তার অদি প্লাবনদার সাথে সুখেই আছে | হয়তো বন্ধুর সুখের জন্যই তার এই নীরব গোপন জীবন কাটানো |


জানা নেই কারোরই কারোর মনের কষ্ট | দুজনেই দুজনকে ভালোবেসে যাচ্ছে, দুজনেই চাইছে একে অপরের কাছে পৌঁছতে | কিন্তু প্রকৃতি এখনও যে অনুমতি দেয়নি | সে অদিতিকে আরেকটু বোঝাতে চায়, অনেক ভাগ্য করে পাওয়া বন্ধুকে দূরে যেতে দিতে হয় না | নাহলে সারাজীবন নিঃশব্দে কামনা করেই যেতে হয়, "বন্ধু আবার কাছে আয়, বন্ধু এবার তো কাছে আয় |"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics