Sandip Das

Classics

5.0  

Sandip Das

Classics

বহুরূপী ভালোবাসা

বহুরূপী ভালোবাসা

11 mins
1.3K


ফিরে আসা দিনরাত্রি 


সোদপুর থেকে শিয়ালদহ লোকাল সেদিন বেশ ভিড়ে ঠাসা , তার মধ্যে জায়গা পেয়ে গেলাম এটা কপাল ছাড়া আর কি বলা যায় আর তাছাড়া রোজ যাতায়াতের সুবাদে কিছু চেনা পরিচিত মুখ তৈরি হয়েই গেছে এতদিনে ।। ট্রেন চলতে শুরু করার প্রায় মিনিট দুয়েক পরেই চোখটা যখন ওর দিকে পড়ল , কেমন যেন মনে হল ।। কোথাও দেখেছি ওকে , কিন্তু মনে করতে পারছি না ।। হা করে তাকিয়ে আছি , ওই প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বয়সি মুখটার দিকে ।। বেশ সুন্দরী চেহারা , মাঝারি গড়ন , গায়ের রং সাদা , গায়ে একটা নীল টপ ও কালো জিন্স ।। 

অবাক হয়ে মিনিট পনেরো তাকিয়ে আছি দেখে , একবার ও আমার দিকে ফিরে তাকাল ।। তারপর আমাকে বেশ খুঁটিয়ে একদুবার দেখে বলে উঠল , " আমায় চিনতে পারলে না !! তুমি সোদপুরের শুভ না ? 

আমি ভাবলাম যে তাহলে তো ঠিক ই ভেবেছি , আস্তে করে বললাম ; " সেটাই তো ভাবছি , কোথায় দেখেছি বলত ?" এবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল , " আমি পায়েল , হাসপাতালে পরিচয় , মনে পড়েছে এবার "?? আমি লজ্জায় জীব কেটে ফেললাম ।। সত্যি চিনতে পারিনি , আমার সেদিনের না পাওয়া ভালবাসাকে ।। এরপর নানা কথা জুড়ে দিল আমার সাথে , কিছু বেশি বলে ফেললাম আর কিছু উত্তর দিলাম না ।। কথায় কথায় বুঝতেই পারিনি ট্রেনটি কখন উল্টোডাঙ্গা পৌঁছে গেল ।। আমি নেমে যাব এখানেই ।। 

ও বললো , ওর গন্তব্য শিয়ালদহ ।। রোজ এই ট্রেনেই ব্যারাকপুর থেকে আসে , এই কোম্পার্টমেন্ট ওর ফিক্সড ।। আবার দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতি বিনিময় করে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে ।। তারপর থেকে রোজ এই আধঘন্টা জমিয়ে আড্ডা চলে ।। বন্ধুত্বটাও বেশ জমছে ধিরে ধিরে , যদিও বছর তিনেক আগেই বন্ধুত্বর হাতেখড়ি হয় ও ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিলাম ।। এই যেমন , ও একটি সরকারি হাসপাতালে নার্স , বাবা ভর্তি ছিল তখন প্রথম আলাপ হয় ।। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে যায় ।। ফেসবুক তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে বের করি ওকে , পায়েল চৌধুরী , নামে ছিল একাউন্টটি ।।

অফিসে বসে বসে এসব নানা পুরোনো কথা মাথায় ঘুরতে থাকে কিছু দিন ধরেই ।।অবশেষে একাউন্টটা আবার একবার সার্চ করতে শুরু করলাম আর মজার কথা হল , এক চান্সে পেয়েও গেলাম ।। ফেসবুক আমাদের ইমোশন কিন্তু বেশ বোঝে ।। তারপর আর কি !! দেরি না করে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম , মিনিটের মধ্যে একসেপ্ট হয়েও গেল ।। এখন আর কোন বাঁধা নেই , দিনে রাতে কথা হবে ।।

অবশ্য এই প্রথম বার রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি না ওকে ।। আগের বারও পাঠিয়েছিলাম , কিছু দিন অপেক্ষা করিয়ে তারপর একসেপ্ট করে সেবার ।। তারপর কথা হত , অনেক জানা অজানা কথা নিজেদের সম্পর্কে আদান প্রদান হত , সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে উঠছিলাম আমরা ।। নানা কথা বার্তার মধ্যে দিয়ে ওর খুবই কাছে চলে আসি আমি ।। এরই মধ্যে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারি নি , একদিন বলেই ফেলেছিলাম পায়েল কে যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি ।। একটাই উত্তর দিল , "নিজেই তো বাবা মা র ওপর নির্ভরশীল , আমাকে চালাবে কি করে " ?? তারপর থেকে আর কোনদিন রিপ্লাই দেয় নি ।। 

সত্যি আমার তখনও কোন চাকরি জোটে নি হাতে , তবে চেষ্টা করছিলাম আর যা কোয়ালিফিকেশন ছিল তাতে বিশ্বাস ছিল , খুব তাড়াতাড়ি জুটেও যাবে ।। সেদিন সে কথা ওকে মেসেঞ্জারে টাইপ করে লিখে পাঠিয়েওছিলাম , হয়ত আর শুনতে চাই নি বা ভাল লাগেনি শুনতে আবার ।। এর পর নিজের জগৎ টা অন্য ভাবে সাজিয়েছি , গেল বছরের প্রথম দিকে একটা চাকরিও জুটেছে ।। মাস গেলে হাতে এখন 30000 টাকা পাই ।। বাবার শরীর আবার খারাপ হলে , তার জন্য চিন্তা করতে হয়েছে , এই সব মিলিয়ে জীবনটা এক অন্য মাত্রায় এনজয় করেছি এতদিন ধরে ।। সে এপিসোডগুলোতে কোন পায়েলের জায়গা ছিল না ।। এত দিন পর ট্রেনে ওর সাথে দেখা হওয়াতে সেই দিন গুলো ফিরে পেলাম তবে একটা ভয় মিশ্রিত আনন্দ মনে থেকেই গেল ।।

তখন রাত বারোটা ।। অফিস থেকে বাড়ি ঢুকতে আজ একটু দেরি হয়ে গেল , মার্চ মাস , তাই প্রচুর কাজের চাপ ।। এই সময়ে একাউন্টেন্টদের যে কি অবস্থা হয় বলে বোঝাতে পারব না ।। বাড়ি ফিরে সেদিন আর শরীর একদম চলছিল না ।। এরই মধ্যে ফেসবুকে হঠাৎ পায়েলকে অনলাইন দেখে নতুন একটা এনার্জি পেলাম মনে হল ।। ছোট্ট করে হায় লিখে পাঠালাম ।। সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাইও দিল ।। এত তাড়াতাড়ি রিপ্লাই পেয়ে একটু অবাক হলাম , আমার মেসেজের জন্যই বসেছিল না তো !! পরক্ষণেই ভাবলাম , তাই আবার হয় নাকি ।। যাই হোক , এভাবে কথা এগোতে শুরু করল ।। সেদিন থেকে রোজ রাতে প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে ওর সাথে চ্যাট করা অভ্যেস হয়ে গেছিল ।। রাতে চ্যাট , অফিসে ফাঁকা সময়ে চ্যাট , দিনে ট্রেনে আড্ডা যেন আমার জগৎটা পাল্টে দিয়েছিল ।। 

অফিসে সায়নী ছিল আমার ফেবারিট কলিগ ।। আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসতে দেখে ও একদিন জিজ্ঞেস করেই বসল যে ব্যাপার কি ।। সব শুনে ও বেশ খুশি হল , বললো , " ভগবান , মুখ তুলে চেয়েছে তোর ওপর "।। আমি আবার নাস্তিক , সবাই জানে সেটা ।। ভগবানের নাম শুনে খুব রেগে গেলাম সায়নির ওপর ।।

সেদিন ছিল শনিবার ।। সকাল থেকে চ্যাট আদানপ্রদান চলছিল ।। হঠাৎ দেখি মেসেঞ্জারে রিং হচ্ছে , পায়েল কলিং ।। ফোনটা দুবার কেটে গেল , শেষ মেস তৃতীয়বার ফোন ধরলাম ।। প্রায় ঘন্টা খানেক কথা হল দুজনের মধ্যে ।। মোবাইল নম্বরও আদানপ্রদান সেরে নিলাম এর মধ্যে ।। ব্যাস আর কি !! এর থেকে ভাল প্রমোশন কারুর জন্য হতে পারেই না ।। প্রায় ফোন করত আমায় ।। খেয়েছি কি না , কি খেয়েছি , কেন খেয়েছি , কখন ঘুমালাম এরকম হাজার ছোট ছোট কথায় ফোন করত ।। প্রথম দিকে সেরাম কল করতাম না আমি , ঐ মাঝে মাঝে কল করতাম , বেশি ফোন তো ওই করত ।। তবে যত সময় যেতে লাগল , আমারও আগ্রহ বেশ বাড়ল ।। 

এখন দিনে অন্তত দশ বারো বার ফোন তো হয়েই যায় পায়েলকে , আর দুদিক মিলিয়ে ধরলে সংখ্যাটা ত্রিশ তো ছাড়াবেই ।। একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারছিলাম এখন যে পায়েল আমার প্রতি বেশ ইন্টারেস্টেড ।। ওর কথা, বার্তা , হাব ,ভাব দেখে স্পষ্ট অনুমান করাই যায় ।। এর মধ্যে একদুবার দেখা করার কথাও বলেছে কিন্তু আমার এত কাজের চাপ যে সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি ।।

সেদিন ২৫শে বৈশাখ , রবীন্দ্র জয়ন্তী ।। দুদিন আগে থেকেই বলে রেখেছিল আজ অফিস ছুটি নিতে , দেখা করতেই হবে , ওর খুব জরুরি কিছু কথা বলার আছে ।। হাজার বুঝিয়েও যখন বোঝাতে পারলাম না , তখন রাজি হওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না ।। বলেই রেখেছিল , সকাল দশটার লোকাল ধরে দমদম , ওখান থেকে মেট্রো ধরে ময়দান ।। তারপর সারাদিন ঘুরবে আমার সাথে ।। ব্যারাকপুরে ট্রেনে চেপেই ফোন করেছিল আমায় ।। জানতে চাইল , আমি বেড়িয়েছি কি না ।। আমি বললাম , বেড়িয়ে গেছি ।। 

ট্রেন এল ঠিক দশটা ।। ট্রেনে চেপে বসলাম ।। সিট রেখে দিয়েছিল তাই অসুবিধা হয় নি ।। পথে নানা কথা বলে চলেছে , নতুন পুরোনো নানা কথা , আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছি আবার কখনো উত্তরও দিচ্ছি ।। কথামত দমদম নেমে বাইরে বেরিয়ে মেট্রো ধরলাম ।। ময়দান যখন নামলাম তখন ঘড়িতে এগারোটা দশ ।। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ভিক্টরিয়া , মনুমেন্ট ঘুরে মাঠে এসে বসলাম ।। 

সকালে সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ওর অনেক কথাই শুনে চলেছি ,কোনটাই সেরাম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল না ।। ভাবছিলাম আমার সাথে সময় কাটাতেই এই মিথ্যা বলেছে হয়ত ।। তবে ওর চোখ , মুখ যেন অন্য কিছু বলতে চাইছিল ।। ঠিক কি ঠাহর করতে পারছিলাম না ।। বিকেল হয়ে এল এদিকে আকাশে কাল মেঘ জমেছে , তাই বললাম , এবার আমাদের বাড়ি ফেরা উচিত ।। ও রাজি হয়ে গেল , বললো , " ঠিক বলেছ "।। এই টুকু বলেই বলে উঠল , " দাড়াও , দরকারি কথাটা তো বলাই হল না " ।। শোনার জন্য দাঁড়ালাম , এদিকে আকাশ কালো করে এসেছে দেখে জলদি বলতে বললাম ।। 

নিজের মধ্যে একটু সাহস জুগিয়ে নিল , তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল , "তুমি কি আমায় এখন ভালবাসতে পারবে ? আমি কিন্তু এখন তোমাকে খুব ভালবাসি ।। দুজনেই চাকরি করি ।। এখন তো আমাদের কোন সমস্যা নেই এক হতে" ।। শুনে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম আর পিছনে পড়ে রইল পায়েল ।। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে একদিকে , অন্যদিকে দুরথেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুর ;

" তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও।

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে

আর কিছু নাহি চায় গো...." ।।


যাত্রা 


মাঝ সমুদ্রের উতলা জলরাশি বারবার ধাক্কা মারছে তাকে । দূর দুরান্তে সব শূন্য । শুধু জল আর জল । ট্রলারটি ডুবে যাওয়ার পর ভাবতে পারে নি শুভ যে এতেও বেঁচে থাকবে সে । জল নেই চারিপাশে পান করার মতো । খিদেতে পেটের ভেতর ইঁদুর ছটফট করছে । তার পর সমস্যা হল যে বাঁশের ভেলায় মৃত্যু যাত্রা শুরু করেছিল সে তার অবস্থা খুবই খারাপ । যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে । 

সমুদ্রের জল আজ তার কাছে মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে বারবার , কিন্তু এই সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে প্রতিদিনের লড়াই শুরু হয় তার । কাক ভোরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে মাঝ সমুদ্রে । সঙ্গে থাকে পান্তা ভাত , লংকা , একটি জাল ও ট্রলার । সে এবং তার ভাই প্রতিদিন মাছের খোঁজে পাড়ি দেয় দূর দুরান্তে । সারা রাত জেগে যে মাছ ধরা পড়ে তা বাজারে কিছুদিন বিক্রি করা হয় । আর এভাবেই যে উপার্জন হয় তাই দিয়ে সংসার চলে । এতো গেল স্বাভাবিক দিনের কথা । এমনও দিন আসে যেদিন কোন মাছ ধরাই পড়ে না । সেই দিন গুলোতে পান্তা কেন , কোন খাবার জোটে না তাদের । 

দুদিন আগে আবহাওয়া দপ্তরের নির্দেশ ছিল সাইক্লোন রিমা ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে আর তাই সমুদ্রে যেন কেউ না যায় । এ সব ভাবতে ভাবতে কত সময় পেরিয়ে গেছে শুভ খেয়াল করেই নি । খেয়াল পড়তেই দেখে আকাশের সূর্যটা লাল হয়ে মাথার ওপর চেপে বসেছে । ভারি অস্থির লাগছিল তার । তপ্ত গরমে মানুষটার আজ মাথা ঢাকার ছাদ পর্যন্ত নেই । ভীষন মনে পড়ছে বাড়ির কথা । এমনই এক গরমের দুপুর ছিল সেদিন । মেয়েটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । বাবুদের ঘরে ঘরে কত সাজ সরঞ্জাম । এসি , পাখা আরো কত কী ! গরিবের ঘরে মাথার ছাদটুকুই সব আর ওই ছাদ টুকু বাঁচিয়ে রাখতে কত লড়াই করতে হয় তা শুধুই ঈশ্বর জানেন । মৃত্যুর সাথে প্রতিদিন পাঞ্জা লড়তে হয় ওদের , একথা কেউ বোঝে না । তাই ঘামের দাম , রক্তের দাম কেউ দেয় না । আজও সে লড়াই করছে সেই ভোর রাত থেকে । কথায় বলে যে লড়াই করে , ঈশ্বর তার জন্য দূত পাঠায় বারবার । " হা ঈশ্বর ! কোথায় তুমি , কোথায় তোমার দূত আজ । দীর্ঘ নয় ঘন্টা ধরে এই মরা স্রোতের মধ্যে দুজনে ..... " , এটুকু বলেই পিছন ফিরে হঠাৎ থেমে গেল সে । ওই ভাঙা বাঁশের ওপর নয় ঘন্টা .... একা একাই পেরিয়ে এসেছে এতটা পথ । হাবু বলে চিৎকার করে ডেকে উঠলো কয়েকবার আর তারপর বাঁশগুলো আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো শুভ । সত্যিটা মেনে নেওয়া তার কাছে ভীষন কষ্টকর । বারবার চিৎকার করলেও ফাঁকা নীল আকাশ , বিশাল সমুদ্র আর নারকীয় সেই সূর্য ছাড়া আজ কেউ নেই এসব দেখার অথবা শোনার । জামার পকেটে পড়ে থাকা শেষ বিড়িটা না জ্বালিয়েই দু টান মারলো আর তারপর ওই অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়লো সাগরের জলে । প্রায় আধ ঘন্টা ধরে কাউকে খুঁজছিল আর তারপর হতাশ হয়ে উঠে এসে হাটু মুড়ে বসলো বাঁশগুলোর ওপরে । " জীবন এভাবেই ভেসে চলার নাম । জীবন এভাবেই জীবনকে জন্ম দেওয়ার নাম । এক জীবনের আগমনে আর এক জীবন শেষ হয় । জীবন মানে বেঁচে থাকা যেমন , তেমনই জীবন মানে মৃত্যু , আজ অনেক কিছুই শিখিয়ে দিলে , হা ঈশ্বর , তোমায় ধন্যবাদ , তোমাকে প্রণাম .... " , নিজের মনেই বিড়বিড় করে আওড়ে চলেছে সে , কতক্ষন তা কেউ জানে না । ওদিকে পিছনের আকাশ লাল হয়ে উঠে , দুপ করে অন্ধকার নেমে এলো চারপাশে । 

ঘন অন্ধকার সামনে দাড়িয়ে আর নিচে জলময় এক পৃথিবী । এখানে জীবন মানেই অনিশ্চয়তা । এখানে জীবন মানেই পদে পদে ভয় । ঝি ঝি পোকার ডাক বাজছে কানের দুপাশে এখন । মরা সমুদ্রে যেখানে জীবনের চিহ্ন নেই লেশমাত্র সেখানে এই ডাক বেশ উৎফুল্ল করে তুলছে তাকে । পরক্ষনেই একটা ছায়া তার সামনে দিয়ে পেড়িয়ে গেল । মুখটা তুলে দুবার ভালো করে চেয়ে দেখল সে । যদিও অন্ধকার তবু সে স্পষ্ট লক্ষ করেছে আজ । মুড়ে রাখা দুপা খুলে বসলো এবার ।মনে হচ্ছে ; হ্যাঁ মনে হচ্ছে জীবন খুব সামনে আর তাই তো এই ঝি ঝি ডাক ; সামনে সুস্থ অবস্থায় দাড়িয়ে তার হাবু । হাত নেড়ে কাছে ডাকল তাকে এবার । তারপর পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বসতে বলল সে । অদ্ভুত কাণ্ড , আজ হাবুও একটুকু মানা করেনি শুভর কোন কথায় । 

“ জানিস । আজ অমাবস্যা ; শুভ বলে চললো ; বাড়িতে বর্ষা মা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে আমাদের " । হাবু চুপ করে বসে সব শুনে যাচ্ছে । এদিকে ভায়ের মুখের এই নিরবতা শুভকে অস্থির করে তুলছে । বারবার প্রশ্ন করে চললো সে ; “ কি রে চুপ কেন ? জেগে আছিস তো রে ? হা ঈশ্বর । তবে কি মৃত্যুর কাছে এগিয়ে চলেছি আমরা ” ? 

রাতের অন্ধকার কেটে সকালের আলো দেখা দিল যখন , তখন আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ । শুভর অবশ্য কোন হুশ নেই এ সমস্ত পার্থিব ঘটনায় । বাঁশের ওপর চুপ করে বসে , মনে হচ্ছে ধ্যান মগ্ন কোন সন্যাসী গভির তপস্যায় নিমগ্ন । ওপরে আকাশের গর্জন আর নীচে শুভর মৌন রূপ , দেখলে মনে হয় একটা কঠিন অভিমান তার । 

বিদ্যুতের ঝলক আর মেঘের গর্জন এর মাঝে সে ওপরে তাকালো একবার । বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে বসে রইল ওই খানেই । তারপর বাঁশগুলোর ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো হঠাৎ , " চুপ । চুপ কর এবার । আর সহ্য হয় না । কিসের এত রাগ তোর ? আমি এখানকার সম্রাট । এ জায়গা আমার । আমি এক চুল নড়ছি না " । এই বলে আবার কিছুক্ষনের জন্য নীরব হলো সে । এদিকে সমুদ্র উত্থাল হয়ে উঠছে । আকাশ থেকে বৃষ্টি ফোঁটা ঝরে পড়তে শুরু করেছে এতক্ষনে । বাঁশের ওই ভেলা এপাশ ওপাশ করে চলেছে । কয়েক মিনিট এভাবেই চললো আর তারপর সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল । শুভ সমুদ্রের জলে সাঁতার কেটে চলেছে ওই অবস্থায়েও । ঘন্টা কয়েকের এই লড়াই থামল যখন তখন একটা ঠান্ডা জমে যাওয়া শরীর অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে একটা ঘরে । চারিপাশে জন সমুদ্র । তাদের মুখে মানুষটাকে ঘিরে প্রবল উৎকন্ঠা । প্রায় হপ্তা খানেক সময় লেগেছিল শরীরে প্রাণ ফিরে পেতে আর এই আড়াই দিনের যাত্রাপথের ভীতি কাটিয়ে সুস্থ মানসিক অবস্থায় ফিরতে লেগেছিল আরও প্রায় এক বছর । এই এক বছর শুভর পৃথিবী বলতে ছিল ওই বাংলাদেশ । তাদের কিছু ট্রলার সেদিন একটা শরীর জলে ভেসে আসতে দেখে এগিয়ে এসেছিল । প্রাণ ছিল তখনও আর তাই তারাই উদ্ধার করে তাকে । সুস্থ হয়ে শুভ যেমন নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশকে তেমনি জেনেছিল তার উদ্ধারের সমস্ত ঘটনা ওই লোকগুলো থেকে । তারা ওকে সাহায্য করেছিল বলেই শুভ আজ ভারতে দাঁড়িয়ে । সীমানার এপারে দাঁড়িয়ে বিদায়ের মুহূর্তে শুভ ধন্যবাদ জানায় নি তাদের । বলেছিল , " এই সীমানা প্রথা ধ্বংস হোক । মিলন হোক মনুষ্যত্বের " ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics