Rima Goswami

Romance Tragedy Inspirational

2.7  

Rima Goswami

Romance Tragedy Inspirational

বধূ যখন বেশ্যা পর্ব দুই

বধূ যখন বেশ্যা পর্ব দুই

14 mins
2.9K


ক্ষিধেয় পিত্ত জ্বলছে বৌমা, তাড়াতাড়ি ডিনার বেড়ে ফেলো দেখি । আর ওই অলক্ষুনে মেয়ের জন্য ডাক্তার ডাক্তার বাই করতে হবে না । উর্যা আর সহ্য করতে পারছে না , মেয়েটা হেঁচকি তুলছে । গা পুড়ে যাচ্ছে , উর্যার মাথাটা যেন আর কাজ করছে না । শশুরের কোন হাঁকডাকই উর্যার কানে যাচ্ছে না । ওই দুধের শিশুকে ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই বাধ্য হয়ে উর্যা বিছানায় শুইয়ে ভিজানো গামছা দিয়ে শরীরটা মুছিয়ে দিল। যদি জ্বরটা নামে ? তার পরে হলঘরে উঁকি দিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। নিজের বেডরুমে এগিয়ে গেল পা টিপে টিপে । এখন অবশ্য ওই বেডরুমে আর উর্যার স্থান নেই । লুকিয়ে লুকিয়ে আলমারি খুলে নিজের গয়না বের করে নীচে নেমে এলো । বাচ্চাকে কোলে তুলে একটা ছাতা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এলো সে । তার পর রীতিমতো যুদ্ধ করে গয়না বেচে বাচ্চাকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে স্থির হলো । ডাক্তার গুনগুনকে ইঞ্জেকশন দিলেন তবেই ওর জ্বরটা একটু নামে । উর্যা এখন ঘায়েল বাঘিনী যার সন্তানের জন্য সে সব লড়াই লড়তে পারে । বাড়ি ফিরে এসেই মেয়েকে ব্রেস্টফিড করে , ঘুম পাড়িয়ে উর্যা এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে ।সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম , বাচ্চার শরীর অসুস্থ এইসব মিলিয়ে পেটে কিছুই পড়েনি । রান্নাঘরে নানান ধরনের পদ রান্না হয় তবে উর্যার জন্য বরাদ্দ দুপুরে ডাল ভাত , রাতে দুটো শুকনো রুটি ।পাঁচ পদের রান্না কতদিন খাওয়া হয়না তাঁর । প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল সে । কত দিন ওর খাবার খেলো পরম তৃপ্তি করে। ভিতর থেকে উগলিয়ে আসা দুঃখ চোখের জল হয়ে অনবরত নামছে । জলে ভরা দু চোখ বার বার মুছাতে গিয়ে বুকের ভেতরটা শুন্য মনে হল নিজেরই । আজ তার কি অপরাধ ? গুনগুনকে জন্ম দেওয়া ? যায় জন্য রাতারাতি সে এবাড়ির বউ থেকে কাজের লোক হয়েছে , কুকুরের থেকেও অধম খাদ্য তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে , নিজের স্বামীর সঙ্গে এক ঘরে থাকার অধিকার হারিয়ে সিঁড়ির তলায় একটা অন্ধকূপের মতো ছোট ঘরে রাত কাটাতে হচ্ছে ।


অথচ ঠাকুমার ওকে শাসন করার কারণে পৃথিবীতে সব থেকে খারাপ মানুষ উর্যার নিজের ঠাম্মিকেই মনে হতো । আজ বুঝতে পারছে উর্যা ঠাম্মি বেঁচে থাকলে এরা এভাবে অত্যাচার করতে পারত না ওকে । এসব ভাবতে ভাবতে চোখটা একটু লেগেই ছিলো অমনি একটা জোর আঘাত আর উর্যা দুম করে মাটিতে আছড়ে পড়ে । আচমকা আঘাতে হতভম্ব উর্যা সোজা হয়ে দাঁড়ায় । সামনে দাঁড়িয়ে ঋষি আর ওর বাবা মা । ঋষির বাবার হাতে একটা নাইলনের দড়ি । শাশুড়ি অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তি খেউর করতে করতে বললেন , হতভাগী চুরি করে মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়েছে । আজ ঋষি ওকে আর ওই আপদটাকে শেষ করে দে । আমি তোর আবার বিয়ে দেবো তুই কিছু ভাবিস না । ঋষি উর্যার চুলের মুঠি টেনে ধরে আর হিসহিস করে বলে ওঠে - কথা কানে ঢোকেনি তখন ? গয়না বিক্রি করে মেয়েকে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে ? আমার বন্ধুর দোকান তাই জানতে পারলাম । ও আমাকে ফোন করে বললো , না হলে তো বুঝতেই পারিনি কি চলছে তলে তলে । চ , আজ তোর শেষ দিন । তবে তোকে মারার আগে তোর মেয়েকে শেষ করে দেবো । এই বলে ঋষি ঘুমন্ত গুনগুনের দিকে এগিয়ে যায় । উর্যা বুঝে গেছে কথায় কাজ হবে না । তাই কোন কথা না বলে চৌকির পাশে পরে থাকা একটা হামলা দিস্তার লোহার দিস্তা তুলে পিছন থেকে জোড়ে মেরে দেয় ঋষির মাথায় । এত জোরে আঘাতে ঋষির মাথা ফেটে চৌচির হয়ে ঘিলু রক্ত ছিটে আসে উর্যার মুখে । ঋষি মুখে আওয়াজ ও করতে পারেনা । লুটিয়ে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে আর শেষ হয়ে যায় ধরফর করে । ঋষির বাবা মা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো , অনেক্সপেক্টেড এই ঘটনায় তারা যেন বোবা হয়ে গেছে । রক্ত ঘিলু মাখা উর্যাকে দেখে মনে হচ্ছে অসুরদলনী দেবী দুর্গার মত । সন্তানের চোখের সামনে মৃত্যু দেখে ভয়ে ঋষির মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । পরিস্থিতি দেখে ওর শশুর এগিয়ে আসতে গেলে হাতের ওই লোহার ভারী দিস্তাটা উর্যা ছুড়ে মারে ওই শয়তানকে । দিস্তাটা লোকটার পায়ে গিয়ে আঘাত করে আর হয়ত পায়ের হাড় সুদ্ধু ভেঙে যায় । ব্যাথায় চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায় ঋষির বাবা । উর্যা জানে এখানে আর থাকা উচিত নয় । পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলে ওর দিকটা আর শুনবে না ।


খুনের মামলায় ওকে জড়িয়ে সারাজীবনের জন্য জেলে ভরে দেবে । ওর জেল যেতে ভয় নেই কিন্তু মেয়েটার কি হবে ? এই ভেবে পালিয়ে যাওয়াটাই সঠিক মনে হলো তখন । আর হাতে সময়ও বেশি নেই , বুড়ো যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে আর বুড়ি অজ্ঞান । তবে বুড়ির জ্ঞান ফিরে এলেই পুলিশ ডাকবে । মেয়েকে কোলে তুলে উর্যা আবার ওপরের ঘরে যায় । আলমারি খুলে হাতের কাছে টাকা , গয়না যা পায় তুলে একটা লেডিস ব্যাগে ভরে নেয় । আবার নীচে এসে ঋষির মাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে যায় । ঋষির বাবা যন্ত্রনাতে কাতরাচ্ছে আর চিৎকার করছে পুলিশ পুলিশ । উর্যার ওসব দেখার বা শোনার জন্য এতটুকু সময় নেই । মেয়ের কটা ছোট জামা কাপড় , ওষুধ আর বার্থ সার্টিফিকেটটা নিয়ে নেয় সে । নিজের মুখে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে মুছে ফেলে তার পর শাড়িটা পাল্টে নেয় দ্রুত । আর মেয়েকে কাঁথাতে মুড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে । যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি পালাতে হবে সম্বলপুর থেকে না হলে ধরা পড়ে যাবে । কিন্তু যাবেটা কোথায় ? ওদের শশুরবাড়ী রেল স্টেশনের কাছেই । টলতে টলতে স্টেশন পর্যন্ত এসে দেখলো একটা কলকাতাগামী ট্রেন জাস্ট সিগন্যাল দিয়ে ধীরে ধীরেএগোচ্ছে স্টেশন ছেড়ে । আর সাতপাঁচ ভাবার সময় নেই ,কোনমতে ছুটে একটা বগিতে চেপে পরে সে । ওটা জেনারেল চেয়ার কার । সবটাই প্রায় ভর্তি , বাথরুমের কাছে ফাঁকা প্যাসেজটাতে বসে যায় মেয়েকে নিয়ে । রাত প্রায় দেড়টা , গুনগুন খিদেতে কেঁদে ওঠে । বুকের দুধ খাইয়ে দেয় ওকে তারপর ড্রপারে করে প্যারাসিটামল এর ডোজ দেয় । ঘুমিয়ে পড়ে গুনগুন , কিন্তু উর্যার তো ঘুমালে চলবে না ? ওকে তো এখন আর একটা লড়াই লড়তে হবে । স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার লড়াই । বাবার বন্ধ পড়ে থাকা বাড়িতে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না । ওখানেই আগে যাবে পুলিশ , ওকে খুঁজতে । আর তো সাধারণ মানুষের পর্যায়ে পড়েনা । এখন ও একজন খুনি তাই সমাজে ওকে এমন ভাবে থাকতে হবে যাতে ও ধরা না পড়ে ।


উর্যার শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন কিছুই নেই যেটা দিয়ে একটা ভালো চাকরি পাওয়া যাবে আর থাকলেও চাকরি করা সম্ভব হত না । তাকে পরিচয় গোপন করে লুকিয়ে বাঁচতে হবে । কার কাছে যাওয়া যায় ? মায়ের বাড়ি ? মানে মামাবাড়ি ? যদিও জন্মের পর মায়ের মৃত্যু হয়েছে বলে মামারা কেউ উর্যাকে মেনে নেয়নি কোনদিন । দিদুন ভালোবাসত , মাঝে মাঝে আসত ওকে দেখে যেত । এখন তো দিদুন ও নেই । ছোটবেলায় দুদুনকে জড়িয়ে মায়ের গন্ধ পাবার চেষ্টা করত উর্যা । ভীষণ ভাব ছিল , দিদা আর নাতনির । মামাবাড়ি গেলে মামারা ওকে মেনে নেবে ? আর সময় তো কারো জন্য যেমন থেমে থাকেনা, সম্পর্ক গুলোই যেন শুকনো কাঠের মতো হয়ে যায়। এই যে ঋষি , ওকে চোখে হারাত একসময় । আর তারপর কি হলো ? এত অত্যাচার করলো উর্যাকে যে শেষপর্যন্ত ঋষিকে উর্যার হাতেই মরতে হলো । যতই হোক , তবু যাকে একদিন ভালোবেসেছিল উর্যা তাকে নিজের হাতে শেষ করে ভিতরে ভিতরে গুমরে মরে যাচ্ছিল ।


রাত , দিন , দুপুর পার করে ট্রেনটা শিয়ালদহ ঢুকছে ।এনাউন্সমেন্টা শোনার পরেই গুনগুনকে নিয়ে উর্যা গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। উড়িষ্যা পেরোনোর আগেই টিটি এসে মোটা টাকা ফাইন করেছে উর্যাকে । হাতে গোটা তিন হাজার ক্যাশ টাকা ছিল , ফাইন দিয়ে মাত্র এক হাজার টাকা পড়ে আছে । ভয় ও করছিল , টিটি ওকে পুলিশে দেবে না তো ? ওর আর ধৈর্য ধরছেনা , স্টেশনে নেমেই আবার ট্রেন ধরতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। গোপালমাঠ যেতে হবে মামারবাড়ি । দেখাই যাক ওরা কি বলে ? স্টেশনে নেমে ভেন্ডরদের কাছে দুটো পাউরুটি আর ঘুগনি খেলো উর্যা । আগের রাত থেকে খাওয়া নেই , সারা রাস্তা বেসিনের কলের জল খেয়ে এসেছে সে । তার পরেও খাবার মুখে দিয়েই গাটা গুলিয়ে উঠলো তার । কেমন রক্ত ঘিলু এসবের গন্ধ নাকে আসছে । তবু মন কে শক্ত করে বোঝালো আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা তারপরেই মামাবাড়ি , খাবারটা জোর করে খেয়ে একটা লোকাল ট্রেনে টিকিট কেটে চড়ে গেল সে । দীর্ঘ কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে দিদুন নেই , কোন যোগাযোগ নেই মামাদের সাথে । আজন্ম তাদের দেখেনি উর্যা । সত্যি বলতে প্রয়োজন ও হয়নি কোনদিন ! মা গত হয়েছেন সেই জন্মের বেলাতেই তখন তো মা কথাটা পর্যন্ত বলতে সেখেনি ও তাই হয়ত মামা বলাও হয়নি কোনদিন । মাকে যতটুকু জেনেছে তা ওই বাবার মুখের কথা শুনে, তারপর বাবাও একদিন চলে গেল এই সেদিন । আত্মীয়স্বজন নেই তেমন তাই সহানুভূতি দেখিয়ে পাশে আছি কথা টুকু বলার ও কেউ তো নেই । মেয়ের জন্ম দেবার অপরাধে শশুর বাড়ীর সবাই দূরে সরে গিয়েছিলো। অনেক কষ্ট করে সে আজ শেষে অপরাধী হয়েছে ।


মেয়ের জ্বর ও কমে গেছে , ট্রেনে চড়ে একটা ফাঁকা সিতে বসলো উর্যা । পাশে কেউ নেই তাই মেয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যাগটা আর টাকা গয়নার হ্যান্ড ব্যাগটা পাশেই রেখে দিলো । ঝিমুনি এসে যাচ্ছে ট্রেনের হওয়ায় ।

এতক্ষণ নিশ্চই পুলিশ খুঁজতে শুরু করেছে ওকে ।


ট্রেনটা বর্ধমান ঢোকার পর কোলাহল , যাত্রী ওঠা নামার মধ্যেই কে যেন উর্যার ব্যাগটা চোখের নিমেষে সিট থেকে তুলে ছুটে পালাতে লাগলো । উর্যা অত টুকু অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে ছুটে ওই চোরটাকে ধরতে গেলেও ততক্ষণে ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে । চলন্ত ট্রেনটা থেকে নামতে যাওয়া মানে জীবন শেষ । উর্যা বুঝলো এই মুহূর্তে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে । তার কাছে একটা কানা কড়িও নেই । এই অবস্থায় তাকে পৌঁছতে হবে গোপালপাঠ । ব্যাগটাতে নয় করে লাখ টাকার গয়না ছিলো , মামারা আশ্রয় না দিলেও উর্যা দুম করে জলে পড়ে যেত না । একটা ব্যবস্থা হতো নিশ্চই । কিন্তু ভাগ্যদেবী সেদিন উর্যার জন্য কি ভেবে রেখেছিল সেটা বুঝতে উর্যার আর বেশি সময় লাগেনি । স্টেশনে নেমে এদিক ওদিক খোঁজ নিয়ে উর্যা জানতে পারলো গোপালমাঠ বেশিদূর নয় । তাই হাতে টাকা পয়সা না থাকায় কর্পদশুন্য উর্যা মামার নাম করে করে লোকের কাছে রাস্তা জেনে জেনে প্রায় এক ঘন্টা খানেক ঘুরে শেষে মামার বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছে যায় । সেখানে পৌঁছে পাঁচিলের বাইরে থেকেই নিজের মা বাবার নাম ও একটা চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পায় । বাবা মায়ের নাম শুনতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে যায় সে । পুরো কোন্দোলটা বাইরে থেকে শুনে উর্যা এটাই বোঝে যে ওর ঋষিকে খুন তারপর পালিয়ে আসা এসব এদের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে । হয়ত মামাদের মধ্যে এই নিয়েই একটা জোর বচসা চলছে । পুলিশ উর্যার খোঁজে তার বাবার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে । এবং ওর আত্মীয়স্বজনের একটা লিস্ট বানিয়ে সকলের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বলছে উর্যা যদি তাদের বাড়ি আসে , তারা যেন সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে । বাবার এক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ মামাবাড়ি পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে । মানে উর্যা এখানে ঢুকে নিজের পরিচয় দেওয়া মাত্র এরা উর্যাকে লোকাল পুলিশের হাতে তুলে দেবে আর লোকাল পুলিশ উড়িষ্যা পুলিশের হাতে । উর্যা দিকবিদিক শুন্য হয়ে হাঁটা শুরু করে । সে এটুকু জানে তাকে এখানে কেউ চেনে না , মামারাও পরিচয় না দিলে চিনতে পারবে না । ব্যাপারটা অন্য রাজ্যের তাই পরিচয় গোপন করে থাকতে পারলে সে বেঁচে যাবে । কিন্তু বাঁচাবে কিসের জোরে ? এত টুকু মেয়েকে নিয়ে টাকাপয়সা ছাড়া কোথায় ঘুরে মরবে ? হাঁটতে হাঁটতে উর্যা দেখে ও এসে পড়ছে কোন বস্তি এলাকায় । ঘিঞ্জি বস্তি , চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন মহিলা । ওকে ওভাবে অবিন্যস্ত ভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে একজন মোটা মতন মহিলা এসে জিজ্ঞাসা করে , বেটি এখানে কি করছিস ? কাউকে খুঁজছিস ?

মহিলাকে জরিপ করে উর্যা ... বেশ মোটাসোটা আধ বয়সী মহিলা কিন্তু অদ্ভুত তার সাজগোজ ! পরনে চুমকির কাজ করা গোলাপি ক্যাটক্যাটে শাড়ি , মাথায় জুঁই ফুলের মালা আর সাড়া গায়ে ইমিটিসনের গয়না ।

কচকচ করে পান চিবোতে চিবোতে আবার ওই মহিলা বলে কি রে বেটি বল ?

উর্যা বলে ,আমার নাম উর্যা আমার মেয়েকে নিয়ে একটা থাকার জায়গা খুঁজছিলাম । আমাদের কেউ নেই , এখানে কি কোথাও কাজ আর মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবো মা ?

মা শব্দটা শুনে মনে হয় মহিলা একটু ইমোশনাল হয়ে গেল ? উনি বললেন এটা একটা বেশ্যাপট্টি । এখানকার মাসি হলো বিজলি মানে উনি নিজে । উর্যাকে এখানে থাকার জন্য ঘর , কাজ সব উনি দিতে পারেন তবে এই কাজ কি উর্যা করতে পারবে ? উর্যা বেশ্যাপট্টি কথাটা শুনে ভয়ে শিউরে ওঠে । যেদিক থেকে এসেছিল , কোন বাক্যব্যায় না করে সেদিকেই ঘুরে ছুটতে শুরু করে ও । পিছনে ওই মহিলার গলা শুনতে পায় উনি বলেন , বেটি তোর ভয় নেই । রেপ এখানে হয়না , হয় ভদ্র সমাজে । আমাদের এখানে টাকা ফেলো তামাশা দেখো । কেউ তোমার সাথে টাকা আর অনুমতি ভিন্ন জবরদস্তি করবে না। যদি দরকার হয় এ বস্তিতে এসে বিজলীর নাম করিস তুই আশ্রয় পাবি ।


উর্যার কানে আসছে কথা গুলো কিন্তু ও ছুটছে প্রানপন মেয়েকে নিয়ে । মনে মনে কেউ যেন বলছে পালা এখান থেকে পালা । কিছুদূর গিয়ে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে মেয়েকে নিয়ে বসে গেল উর্যা একটা গাছের তলায় । জায়গাটাতে কোন মন্দির আছে । হরিনাম সংকীর্তন করছে আটচালাতে বসে কিছু বয়স্ক মানুষ । তেষ্টা , খিদেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে উর্যার । হাতে না আছে টাকা , না কোন জামাকাপড় । মেয়েটা বুকের দুধ খেয়ে পড়ে আছে কিন্তু ওই এক জামাতে আর কতক্ষণ রাখবে ওকে ? হিসু করে ফেলেছে বেশ কয়েকবার এরই মধ্যে । আশায় বুক বেঁধে উর্যা মেয়েকে কোলে নিয়ে ওই বয়স্কদের কাছে এগিয়ে গেল । যদি কোন সাহায্য পাওয়া যায় এই আশায় । কিছুটা গিয়ে আবার থেমে যেতে হলো ওকে । ওরা কি একটা আলোচনা করছে । কীর্তন শেষ , বেশ তর্ক বিতর্ক শুরু হয়েছে ওদের মধ্যে । আর তর্কের বিষয় আর কেউ না উর্যা নিজে । এক বয়স্ক উর্যার মায়ের নাম করে বলছে , সীমা তো অকালে মরলে ওই হতভাগ্য মেয়েটার জন্ম দিতে গিয়ে । মামারা তো ওই জন্যই মেনে নিতে পারলো না ভাগ্নিকে । শুনছি উড়িষ্যাতে বিয়ে হয়েছিল , তা ওনার সাধ দিতে গিয়ে ঠাকুমা আর বাপটাও মরলো একসিডেন্ট করে । শশুর বাড়ীতে কি জানি কি হয়েছিল ? স্বামীটাকে নিজের হাতে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলে আবার শশুড়টাকে ও আধমরা করে এসেছে । পুলিশ ওর মামা শান্তনুকে ফোনে বলেছে ভাগ্নি যদি আসে , যেন পুলিশকে খবর দেয় ওরা । মেয়েটাকে তো চেনেও না শান্তনু , ওর মা যেত শুনেছি নাতনিকে দেখতে । তবে সে যেখানেই যাক পুলিশ তাকে ধরবে ঠিকই । এক যদি পরিচয় লুকিয়ে কোন ঝুপড়ি বস্তিতে লুকোতে পারে তবে হয়ত কিছু সময় পর পুলিশ ওকে খুঁজে না পেয়ে কেস বন্ধ করে দেবে ।


আর একজন বিচ্ছিরি হেসে উঠলো , আর বললো ... উড়িষ্যাতেও নিশ্চয়ই কাদারোডের মত রেন্ডিখানা আছে ? তা ওসব জায়গায় লুকালে তো পুলিশ খুঁজে পাবেনা ?


উর্যার মাথা টোলছে , খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র । পুলিশের থেকে বাঁচা অত সহজ হবে না ওর । না আর ভদ্র সমাজ হয়ত ওর জন্য নয় । ওকে মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে । বিয়ের নামে তো কত অত্যাচার , ধর্ষণ সইলো ! এবার না হয় বাঁচতে উর্যা শরীর বিক্রি করবে ? টাকার বিনিময়ে একটা জীবন তো বাঁচবে ? সভ্য সমাজের নামে কত কলুষিত চেহারাই তো দেখলো সে । এই যে এক পা চিতায় রেখে নাম সংকীর্তনের নাম করে বুড়ো গুলো নিন্দা চর্চা করছে তাদের থেকে অনেক ভালো ওই মহিলা । হোক সে বেশ্যা ? তবু অচেনা উর্যাকে বাঁচতে সাহায্য করতে তো চেয়েছে ? এখন যেখানেই যাবে পুলিশের চক্করে পরে যাবে তার থেকে ভালো মামারা জানবে ভাগ্নি তাদের দুয়োরে কোনদিন আসেইনি । সারাজীবন যারা উর্যাকে অপয়া ভেবে মুখ দেখেই নি তারা কি উর্যাকে সাহায্য করত ? উর্যার ওদের কাছে আসাটাই ভুল হয়েছিল ভাগ্য ভালো সামনাসামনি দেখা হয়নি । বেঁচে থাকতে অনেক যুদ্ধ করতে হয় । ওরাও তো দুবেলা যুদ্ধ করে বাঁচে ! ওদের সমাজ ঘেন্না করে তবুও তো রাতের অন্ধকারে ওদের কাছেই আসতে হয় নিজেদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে ?


উর্যার সেই দিন ফিরে আসা বিজলী মাসির কাছে । এক সাধারণ বাড়ির মেয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে রাতারাতি হয়ে যায় বেশ্যা । নিজের বাপের দেওয়া নামটা আর কিছুতেই ফেলতে না পারায় এই জগতেও তার নাম উর্যাই রয়ে যায় । বিজলি মাসির কাছে ফিরে এলে সেদিন মাসি ওকে খাবার , আশ্রয় সব দিয়েছিল । একবার ও জিজ্ঞাসা করেনি কেন উর্যা এখানে এসেছে ? কি তার পরিচয় ? শুধু বলেছিল ওর যত দিন সময় দরকার এই পেশায় নিজেকে টেনে আনার জন্য ততদিন ও মাসির কাছে বেফিকর থাকুক কোন চাপ নেই । দু একদিন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল উর্যা । মনে ভগবানকে হাজার দোষ দিয়েছিল সে , তার জন্যই কি ভগবান এত বিষাদ লিখে রেখেছিল ? তার পর ও বুঝেছিল সময় যেমন কারোর জন্য থমকে থাকে না তেমনই পেট ও কোন দুঃখ নামক বিলাসিতার ধার ধারেনা । এই যে এক দেহপসারিনী নারী বিজলী তার মধ্য যে আবেগ আছে যে মমত্ব আছে কৈ উর্যার শাশুড়ি মায়ের মধ্যে তো তা ছিলো না ? বিজলী মাসি তাকে তো একবারও জোর করেনি ? শুধু সমাজের নগ্নতাটুকু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো । আজ প্রায় চার বছর হতে চললো উর্যা এখানে আছে । আর পাঁচটা দেহপসারিনীর মতোই আছে । বিজলি মাসি ও তাকে ছেড়ে চলে গেছে গত বছর এক মনখারাপ করা দুপুরে । মাসির চলে যাবার পর জন্ম থেকে মাতৃহীন উর্যা যেন আরোও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে ... পৃথিবীতে মা শব্দ একটাই । মা শুধু সম্পর্ক নয় মা তো অনুভূতি । আশ্রয়ের নাম মা , শান্তির নাম মা , স্নেহের নাম মা , ভালোবাসার নাম মা , মৃত্যুর নাম মা ।


আর উর্যার মধ্যে কোন অচ্ছুত ভাব আসেনা । কারণ সে তো মা ! তার পরিচয় সে গুনগুনের মা । ঋষির কাছে ও থাকলে গুনগুনকে মরতেই হতো , হয়ত সেইদিনই ? যেমন ভাবেই বাঁচুক না কেন গুনগুন বেঁচে তো আছে ? বাবা বলত আত্মাটা খাঁচা ছেড়ে উড়ে যাবার পর দেহখানি যে রাজা বাদশারই হোকনা কেন মূল্যহীন । গুনগুন বা উর্যা যদি সে রাতে মরেই যেত কে দেখতে আসতো , উর্যার সতিত্ব ?


মথুরা বাবুর বাড়িতে তোলপাড় চলছে খুব , ছেলের বিয়ে মনে হয় পন্ড হয়েই গেল । জন্ম সূত্রে পাঞ্জাবের মেয়ে মাহি । জানা গেছে সে নাকি গোপালমাঠ এলাকার কোন এন জি ও তে কাজ করে । আর কি ভাবে তার কাছে খবর আছে মথুরা বাবুর ওই যৌনপল্লী যাওয়া আসার কথা । মাহি মেয়েটা এমনিতে ভালো , সেদিন মথুরা বাবুর ছেলে মার্কণ্ডেয়র সাথে টুকটাক কথা কাটাকাটিতেই ব্যাপারটা এক্সপোজ হয় । মার্কণ্ডেয় রাগে মাহিকে বলে ছিল তুমি তো আধা বেশ্যা হয়ে গেছ যতই হোক দুবেলা আসা যাওয়া করো ওখানে । আর রাগে হুস খুইয়ে মাহিও ও বলে ফেলে , আমি তো কাজ করতে যাই , মানুষের উপকার করতে যাই । তোমার বাবা তো আমার বয়সের একটা মেয়ের সাথে সেক্স করতে যায় মার্কণ্ডেয় ! ছেলে কথাটা শুনে রাগে দিকবিদিক শুন্য হয়ে গায়ে হাত তোলে মাহির । তার পর মার্কণ্ডেয় এসে ব্যাপারটা নিজের মা সতিকে বলে । সতীর কিছু আসে যায়না স্বামী কখন কার সাথে শুচ্ছে শুধূ একটাই অভিযোগ তা বলে এসকর্ট সার্ভিস না নিয়ে লোকাল যৌনপল্লীতে ? মথুরা বাবুকে সবটা জানানো হয়েছে কিন্তু সোজাসুজি অভিযোগ মা ছেলে কেউ করতে পারেনি , যতই হোক সব ফুটানি ওই মানুষটার রোজগারে । বলা তো যায় না কখন আবার কাকে এনে ঘর ঢুকিয়ে বলবে সতী তুমি তোমার জায়গাটা এর জন্য ভ্যাকেন্ট করে দাও । এখন সমস্যা একটাই বিয়েটা তো দিতে হবে মাহির সাথে । যতই হোক সে মার্কণ্ডেয়র পছন্দ !



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance