Gopa Ghosh

Romance Tragedy Inspirational

3  

Gopa Ghosh

Romance Tragedy Inspirational

বড্ড ভালোবাসা

বড্ড ভালোবাসা

5 mins
215



সেদিন গ্রামে একটা রব উঠলো তুলসী বউ নাকি দু দিন ধরে বাড়ি ফেরে নি। মধ্য বয়স্ক পরান ভানু মাসীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো "কি গো ব্যাপার টা কিছু জানো নাকি? ঘরের বউ দু দিন ধরে বেপাত্তা, কি যুগ পড়ল বলো দিকিন"

ভানু মাসী তো মুখিয়েই ছিল। অমনি শুরু করলো "হক কথা কোয়েছ, সমত্ত বউ একা একা দেখো কার সনে ভেগেছে" চা দোকানি বলু আবার এককাঠি উপরে গিয়ে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো "রাধিকা নাচে রে ও রাধিকা নাচে রে"

ভানু মাসির নজরে পড়ল রবিন ওই রাস্তা দিয়েই হেঁটে আসছে। ভানুমাসি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল "এই রবিন তোর পাশের বাড়ির তুলসী বউয়ের কথা কিছু জানিস"? রবিন ঘাড় নেড়ে অন্য পথ দিয়ে চলে গেল, আর তারপরেই আরম্ভ হল রবিনকে নিয়ে তুলসী বউয়ের নানা মজাদার গল্প।প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার নিরঞ্জন এতক্ষণ মন দিয়ে সব শুনে বলে উঠলো "তোরা ভোলার কথাটা ভুলে যাসনা, একটা পাগল বর নিয়ে তুলসী বেচারি কি করবে এটাও ভেবে দেখা দরকার" সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো পরান "কি বলছেন মাস্টারমশাই, স্বামী যেমনই হোক বউ কি তাকে রেখে কোথাও চলে যাবে?" এর মধ্যেই গ্রামের প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক জড়ো হয়ে গেছে । তুলসী যখন স্বামীর চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে পারছিল না, তখন কারো মাথা ব্যথা ছিল না কিন্তু আজ তুলসী গোটা গ্রামের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।


তুলসীর এই গ্রামে আপনার বলতে একমাত্র তার স্বামী ভোলা। তবে পাশের বাড়ির রবিনের মা বিধু কাকিমা ওর নিজের আত্মীয়ের চেয়েও অনেক বড়। আসলে ভোলা ছোটো থেকে অসুস্থ ছিল না, সৎ মা চারিদিকে বলে বেড়াতো ছেলে পাগল। ভোলার মা দু বছরের ছেলে রেখে দু দিনের জ্বরে মারা যায়। ছেলের দেখাশোনার জন্য বঙ্কিম আবার বিয়ে করলো ঠিকই কিন্তু তাতে ছেলের কোনো যত্ন তো হতই না, উল্টে বাবার অবর্তমানে মায়ের হাতে ছোটখাটো ব্যাপারে বেদম মার খেতে হতো। মাকে যমের মত ভয় পেতো ভোলা। এভাবে সারাক্ষন ঘরের মধ্যে সিঁটিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় নিজের সাথে নিজেই কথা বলতো। পাড়ার লোক বিশ্বাস করে নিল ভোলা পাগল হয়ে গেছে। সৎ মায়ের ইচ্ছা ছিল ভোলাকে পরপারে পাঠিয়ে স্বস্তির শ্বাস নেবে কিন্তু কয়েকদিনের কালা জ্বরে নিজেকেই চলে যেতে হয়েছিল পরপারে। ভোলার বাবা বঙ্কিম ব্রাহ্মণ সন্তান হওয়ার সুবাদে গ্রামের হরি মন্দিরের দেখাশোনা করার ভার পেয়েছিল। তখনকার দিনে ক্লাস এইট অবধি পড়াশুনা করায় রেলের ওয়ার্ক শপে একটা সরকারি চাকরিও জুটে যায় তার। ঘরে মেয়ে না থাকায় বাপ ছেলের খাওয়ার খুব সমস্যা হলো। বঙ্কিম অফিস আর মন্দিরের পুজো নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতো যে ভোলার দেখাশুনা করতে পারছিল না। অফিসের এক বন্ধু তাকে উপায় বাৎলে দিলো, শুধু তাই নয় তার এক প্রতিবেশীর মেয়ের সাথে ভোলার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলো। কিন্তু বঙ্কিম তার ছেলে যে অসুস্থ সে কথা ভেবে প্রথমে রাজি হতে চায় নি। তবে তুলসীর বাবা পাত্র না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে, বঙ্কিম নিমরাজি হয়ে বিয়েটা দিয়েই দিলো। তুলসীর বাবার নুন আনতে পান্তা ফুরোনর মত অবস্থা। ভেবেছিলো মেয়েটা পেট ভরে ডাল ভাতটা তো খেতে পারবে। আর শশুর এর পেনশনের টাকায় জামাই কিছু না করলেও সংসারটা ঠিক চলে যাবে। 


তুলসীর অক্ষর জ্ঞান থাকলেও ক্লাস থ্রী র পর আর স্কুল যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মায়ের সাথে বাড়ি বাড়ি মুড়ি ভাজতে গিয়ে পড়াশুনা টা আর করা হলো না। তুলসী ফর্সা না হলেও গড়ন পেটন আর মুখশ্রী খুবই ভালো। বিয়ের পর গ্রামের কেউ কেউ বলেছিল মেয়েটা তার যোগ্য বর পেল না, ওর আরো ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হতে পারতো। তুলসী এসব কথায় কান দিত না মোটেও। তার মতে ভগবান যা করেন তা ভালোর জন্যই। বেশ কয়েক বছরে তুলসী পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে। বঙ্কিমের মেয়ের অভাব সে সত্যিই পূরণ করতে পেরেছে। ভোলার যত্নে যেনো কোনো ত্রুটি নেই। বঙ্কিমের পেনশনের টাকায় যাহোক করে সংসারটা চলে যাচ্ছিল। ভোলার চিকিৎসা করে যে টাকা হাতে থাকতো তাতেই তুলসী সংসার চালিয়ে নিত। বঙ্কিম আর কিছু দেখতো না। শুধু বার বার বলতো তুলসীকে "মা রে আমার ভোলাকে তুই সুস্থ করে তুলিস, ডাক্তার বলেছে যাহোক করে আর এক বছর চিকিৎসা করলে ও সুস্থ হয়ে যাবে" শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় গলা বুজে যেত বঙ্কিমের। কিন্তু সেই একবছর টা আর পেরোলো না, বঙ্কিম হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলো। গ্রামের লোকেরা প্রথম কয়েকদিন খুব আহা উহু করে আর কোনো খোঁজ রাখলো না, একমাত্র বিধু তার অভাবের মধ্যেও আজ চালটা, কাল ডালটা দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে বলেই তুলসী আর ভোলা বেঁচে আছে। কিন্তু চিকিৎসা আর সম্পূর্ণ হয় না। রবিন ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনে এসেছে আরো কয়েকমাস দামী ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে, আর ভোলাকে প্রায় এক মাস ডাক্তারের নার্সিং হোমে ভর্তি হতে হবে। রবিন শুনেই বুঝে ফেলেছিল তার ভোলা দা আর কোনোদিন সুস্থ হতে পারবে না, কেন না তুলসী বৌদির পক্ষে এত টাকা যোগাড় করা অসম্ভব। তুলসী সেদিন রবিনের মুখে টাকার অঙ্ক টা শুনে চুপ করে থাকলো। তারপর দিন বিধু কে ভোলার দেখাশুনার ভার দিয়ে বাপের বাড়ি যাবো বলে বেরিয়ে গিয়েছিল। আসলে ভোলাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া আসা করে তুলসী এখন অনেক রাস্তা ঘাট চিনে ফেলেছে। আর খুব মিশুকে স্বভাবের বলে কারো সাথে ভাব জমাতে ওর জুড়ি নেই। একদিন ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে বিধুকে গল্প করেছিলো একজন তার শরীরের কিডনি বিক্রি করে সন্তান কে সুস্থ করেছে। বিধু তৎক্ষণাৎ তুলসীর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠেছিল "বালাই সাট, এমন কথা আর কক্ষনো মুখে অনবি না"

মুখে না আনলেও সেদিন কাজে করে দেখিয়ে দিয়েছিল তুলসী। শুধু জানতো রবিন। যদিও রবিনের কোনো আপত্তি ও শোনে নি। রবিনকে দিয়ে মাথার দিব্যি খাইয়ে নিয়েছিল যেনো কোনোভাবেই বিধু না জানতে পারে, কেনো না তুলসী জানতো বিধু কখনোই তাকে এই কাজ করতে দেবে না। রবিন কথা রেখেছিল তবে গ্রামের লোকের এই পবিত্র তুলসীর বৌদির সম্বন্ধে নোংরা কথায় সে আর মাথার ঠিক রাখতে না পেরে বিধুকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়। এরপর গোটা গ্রাম জেনে যায় সত্যি কথাটা। 

তুলসী ফিরলে বিধু জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে "নিজের এত বড় ক্ষতি করার আগে আমাকে একবার জানালি না?" তুলসী খাটে শোয়া ভোলার দিকে সজল চোখে তাকিয়ে শুধু বলে উঠলো "ওকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি কাকিমা"।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance