বাংলা সিনেমা এবং সত্যজিৎ রায়
বাংলা সিনেমা এবং সত্যজিৎ রায়
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ভারতীয় সিনেমার মুক্তিদাতা এই বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার কে ভারতীয় সংস্কৃতির মাইলস্টোন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। চলচ্চিত্র নির্মাণে চিত্রনাট্য - সংলাপ - রূপসজ্জা থেকে শুরু করে সম্পাদনা ও বিজ্ঞাপন প্রচারে সত্যজিৎ রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর অসাধারণ কীর্তির কথা এত সহজে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও যখন লিখতে বসেছি তখন দু চার কথা বর্ণনা করা হলো খুবই অল্প ভাষায়। ইচ্ছা রয়েছে পরবর্তীতে কোনো গবেষণার মাধ্যমে সেটিকে প্রকাশ করার। যাইহোক, শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ভাবনা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আরম্ভ হয়। তবে তার আগে সিনেমা কে এতখানি বাস্তবায়নে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে সিনেমা প্রদর্শন প্রথমে নাটকের মাধ্যমে এবং পরে ক্যামেরা আবিষ্কারের পর চিত্রনাট্য আকারে ফ্রেম বন্দী করা হয়।
যে কোনও চিত্রনাট্যর প্রধান উপলব্ধি হ'ল বিষয়টিকে নতুন আমদানি হস্তান্তর করা। চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকার পুরো বিষয়টির সারমর্ম জানান এবং সংলাপের মাধ্যমে খ্যাতির সারমর্মটি বের করেন। শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা যায় যেখানে তিনি সবাক যুগের কাহিনীকার হিসেবে পরিচিত। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ভাগে যখন নির্বাক চলচ্চিত্রের প্রচলন ছিল তখন চরিত্র বর্ণিত হতো বিভিন্ন ভাব ভঙ্গিমার মাধ্যমে। তখন চরিত্র বর্ণনার আকৃতিগত দিক টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। পরবর্তীতে শব্দ যন্ত্রের আবিষ্কার হবার পর ধীরে ধীরে সিনেমার প্রকৃতির পরিবর্তন হয়। বাংলা সিনেমার প্রকৃতির মাধ্যমে নাট্য ভাবনার মূল রূপের প্রাধান্য পায়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে নাট্য ভাবনার চিন্তনের পরিবর্তন ঘটে।
সিনেমা জগতের অন্যতম পরিচালক শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ভাবনা প্রকৃতপক্ষে বিষয় বস্তুর সরলীকৃত রূপ। মহান পরিচালকের সিনেমার বিষয়বস্তু প্রকাশিত হয়েছে কাহিনীর ব্যক্ত সংলাপের দ্বারা। এখানেই মহান পরিচালকের স্বার্থকতা। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছায়াছবি ' পথের পাঁচালী' মুক্তি পায় 1955 সালে। সমগ্র ছবিটিতে শ্রীমান সত্যজিৎ রায় খুব সহজ - সরল ভাব ভঙ্গিমার দ্বারা একটি গ্রাম্য জীবনের চিত্র বর্ণনা করেছেন। সেই ছায়াছবির সমগ্র চরিত্র বর্ণনার মধ্যে ছিল আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এইরূপ প্রতিটি ছবিতেই আমরা দেখি যে সত্যজিৎ রায়ের পৃথক চিন্তন। তাঁর বিশেষ কয়েকটি ছায়াছবি, যেমন -' তিন কন্যা', ' পোষ্ট মাষ্টার', ' মনিহারা', ' সমাপ্তি', এগুলোতে তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় কিছু গ্রাম্য পরিবেশের মাধ্যমে ভৌতিক অথবা আধিভৌতিক ঘটনার টুকরো টুকরো রূপগুলোকে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য ছায়াছবি যেমন - ' অরণ্যের দিনরাত্রি', ' আগন্তুক', ' নায়ক', এইসব সিনেমার মাধ্যমে তিনি বিশেষ ভাব ভঙ্গিমার দ্বারা নায়ক - নায়িকার চরিত্র বর্ণনা করেছেন। এগুলো বেশ কিছুটা সমাজ জীবনের গল্প, যেগুলোর মাধ্যমে
সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি টি সুস্পষ্ট। এছাড়াও তিনি ছোটোদের জন্য তৈরী করেছিলেন - ভূতের রাজার গল্প। শ্রীমান সত্যজিৎ রায় তাঁর দাদামশাই উপেন্দ্রকিশোর রায়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত করেছিলেন -' গুপি গাইন, বাঘা বাইন ' , ' হীরক রাজার দেশে', ' সোনার কেল্লা', ' গুপি বাঘা ফিরে এলো' প্রভৃতি মজার দেশের বিখ্যাত গল্প। মজার ব্যাপার হলো যে, এইসব গল্প গুলি কাল্পনিক হলেও সিনেমার প্রকৃতির মাধ্যমে একের পর এক গল্পের মাধ্যমে বর্ণিত। সাধারণতঃ এইসব গল্প গুলি কে সিনেমার প্রকৃতির মাধ্যমে ভাবতে গেলে যেসমস্ত উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন হয় শ্রীমান সত্যজিৎ রায় ঠিক সেই ভাবেই সিনেমার চরিত্র গুলিকে বর্ণনা করেছিলেন। শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হিন্দি সিনেমা -' শতরঞ্জ কে খিলাড়ি' সিনেমা জগতে রীতিমতো সারা জাগিয়ে তোলে।
এইভাবে একের পর এক বিভিন্ন ছায়াছবির স্রষ্টা শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় বাংলা সিনেমা জগতে ভাবান্তর ঘটে। বাংলা সিনেমা কল্পনার রূপ ছাড়িয়ে বাস্তবায়নে প্রবেশ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল যে, শ্রীমান সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রতিটি ছায়াছবিতে শুধুমাত্র সিনেমার প্রকৃতি বর্ণনা করেন নি, কিন্তু তিনি সিনেমা তৈরী প্রাক্কালে সিনেমার সিদ্ধান্তের কথাটি কেও চিন্তা করেছিলেন। সিনেমা তৈরীর মূল ভিত্তি হলো একটি যথার্থ কাঠামো তৈরি করা এবং সেই কাঠামো রচিত হয়ে থাকে মূলতঃ নায়ক - নায়িকার অভিনয়ের পারদর্শিতার মাধ্যমে এবং আরও কিছু আনুষঙ্গিক উপাদান যেমন - চরিত্র বর্ণনার মাধ্যমে, দৃশ্য বর্ণনার মাধ্যমে, বর্তমান, ভবিষ্যত ও অতীতের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, এবং সর্বপরি পরিচালকের সুনিপুণ পরিচালনার মাধ্যমে প্রভৃতি। সম্ভবতঃ শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় এসব কিছু ইঙ্গিত যথার্থ ভাবে সুষ্পষ্ট। ছায়াছবিতে সঙ্গীতের প্রয়োগের ব্যাপারটিও বহু প্রাচীন। সঙ্গীতের রাগ মিশ্রণ অদ্ভুত নাট্য রসের মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ ছায়াছবির প্রতিটি ছত্র কে চমৎকার ভাবে প্রকাশ করে। যদিও ছায়াছবিতে সঙ্গীত প্রয়োগের ব্যাপারটা পাশ্চাত্য সিনেমার ধ্যান ধারণা থেকেই গৃহীত। নির্বাক যুগেও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রয়োগের রীতি ছিল এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, হলিউড চরিত্র চার্লি চ্যাপলিনের বহু নির্বাক চলচ্চিত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই সময় বেশ কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিশিয়ান নাম করেন, যেমন - বেটোফেন, মোজার্ট, প্রভৃতি বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞদের দূর্দান্ত সিম্ফনি মন কেড়ে নেবার মতো। শ্রীমান সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত বেশ কিছু ছায়াছবিতে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এসব কিছুই ছিল স্রষ্টার নিজস্ব সৃষ্টি।
শুধুমাত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই নয়, একজন সুদক্ষ সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর সুনাম প্রচুর। গোয়েন্দা গল্প ' ফেলুদা' গল্পের অমর স্রষ্টা হিসেবেও মানুষ তাঁকে চিরকাল মনে রাখবেন। এই বিরল স্রষ্টার মৃত্যু ঘটে 23 rd April, in 1992.