Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy

বাকীটা অশ্লীল

বাকীটা অশ্লীল

5 mins
1.3K


অজন্তা আর অর্কপ্রভ প্রায় বছর দশেক চুটিয়ে প্রেম করে অবশেষে দুজনেই চাকরিতে থিতু হয়ে দুবাড়ীর সকলের বিরাটাকার ঘটাপটায় রীতিমতো উৎসব করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো.......সেও প্রায় বছর দশেক গড়াতে চলেছে। সাকুল্যে নয় নয় করেও অজন্তা আর অর্কপ্রভ প্রায় কুড়ি বছর মানে দুযুগ প্রায় বয়ে নিয়ে চলেছে তাদের এই যৌথ প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্কটিকে। একবাক্যে সবাই স্বীকার করে তাদের এই নিটোল সম্পর্কের রসায়ন, বেশ ঈর্ষনীয় জুটি হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক পরিচিতি চেনা মহলে।


এসময়টা বছরের শুরুর দিক, নিজের স্কুলে কাজের তত চাপ না থাকলেও অজন্তার দম ফেলার ফুরসৎ নেই ...... অজন্তা-অর্কর একমাত্র মেয়ে অভীপ্সার স্কুলে অ্যানুয়াল পরীক্ষা একদম সামনে, আইসিএসসি বোর্ডের ক্লাস ফোরের চাপ সামলাতে মেয়ে নিয়ে হিমসিম অবস্থা অজন্তার। অর্ক সকালে মেয়েকে পুলকারে তুলে দেওয়ার অতিরিক্ত মেয়ের লেখাপড়া সংক্রান্ত আর কোনো দায়িত্ব ঠিক বহনের আগ্রহ দেখায় না, সুতরাং সবদিকই অজন্তাকেই সামলাতে হয়। এই কারণেই অজন্তা-অর্ক কয়েক বছর ধরে আর নিজেদের বিবাহবার্ষিকীটা পর্যন্ত ঠিক মতো পালন করতে পারে না, কোনো রকমে দায়সারা ভাবে দুজনে রাতে একটু বাইরে খাওয়া দাওয়া আর উপহার বিনিময়েই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।


এবারে মেয়ের পরীক্ষার রুটিন এমনভাবে পড়েছে যে বাইরে খেতে যাওয়ার সুযোগটুকুও নেই। কদিন ধরে অজন্তা ভীষণ ব্যস্ত মেয়েকে নিয়ে, ভালো করে কোনো দিকেই নজর দিতে পারছে না। নিজে স্কুল থেকে ফিরেই সামান্য চা-জলখাবার খেয়ে মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে পড়াতে বসে পড়ছে, অর্ক অফিস থেকে ফেরার পর কোনো রকমে চা-জলখাবার দিয়ে আবার মেয়েকে পড়াতে বসে পড়ছে। অর্ক কিছুক্ষণ একা একা বসে টিভি দেখে কাগজ পড়ে নীচে নেমে যাচ্ছে ওদের হাউজিংয়ের কমিউনিটি হলে, ওখানে অনেকেই সন্ধ্যেটা তাস ক্যারাম দাবা আর গেটের মুখের সুনীলের স্টল থেকে আনানো ভাঁড়ের চা সহযোগে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেয় রাত সাড়ে নটা দশটা পর্যন্ত। অজন্তাও নিশ্চিন্তে ঘরে বসে মেয়ের পড়াশোনার তদারকি করে।


আজ থেকে অজন্তা ছুটি নিয়েছে... মেয়ের পরীক্ষার জন্য... চাইল্ড কেয়ার লিভ, পনেরোদিনের।


কাল থেকে মেয়ের ওরাল টেস্ট শুরু, আর আজ অজন্তা-অর্কর দশবছরের বিবাহবার্ষিকী। অজন্তা আজ সীমাদিকে রান্না করতে দেয় নি, সীমাদি সাহায্য করেছে আর অজন্তা নিজে হাতে অর্কর পছন্দের মাটনচাঁপ, মিক্সড ফ্রায়েড রাইস, ভেটকি ফিশফ্রাই, ফ্রুট স্যালাড, ফিরনি আর রসগোল্লার পায়েস করেছে, সীমাদিকে দিয়ে চাখিয়েছে আর সীমাদি নিজে দারুন রান্না করে যেহেতু রান্নার সমঝদারও খুব। প্রতিটা পদই অসাধারন এবং সীমাদির স্থির বিশ্বাস দাদাবাবুর(অর্থাৎ অর্কর) খুব ভালো লাগবে।


তার ওপর অজন্তা সারাদিন ধরে অর্কর জন্য এত যত্ন করে সব রান্না করেছে, অর্কর তো ভালো লাগারই কথা অবশ্যই।


সাড়ে ন'টা বাজে, অজন্তা মেয়েকে খাইয়ে দাইয়ে ডেটল দেওয়া গরম জলে হাত পা ভালো করে ধুইয়ে শুতে পাঠালো, মেয়ের স্কুল আছে সকালে, পরীক্ষা আছে, একটু বেশিই ঘুম দরকার। তাছাড়া আজকে এই দিনটিতে অজন্তা অর্কর সাথে একটু আলাদা ভাবে গল্প গুজব করতে করতে আস্তে সুস্থে বসে রাতের খাওয়াটুকু খাবে। মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে আছে আজ, অজন্তা লা-ওপালার ডিনার সেটটাতে সমস্ত কিছু যা যা আজ সারাদিন ধরে অর্কর জন্য রান্না করেছে সব বেড়ে সাজিয়ে রাখলো ডাইনিং টেবিলে। কাশ্মীরি ফ্লাওয়ার ভাসটাতে দশটা লাল গোলাপ সাজিয়ে টেবিলের ঠিক মাঝখানে ক্রিস্টাল ট্রেটার উপর রাখলো, ফ্লাওয়ার ভাসটাকে ঘিরে দশটা রঙীন মোমবাতি জ্বালিয়ে ডাইনিং হলের বড় আলোটা অজন্তা নিভিয়ে দিলো। কম্পমান মোমের শিখা প্রতিবিম্বিত গ্রানাইটের ডাইনিং টেবিল টপে, পুরো ঘরটা কেমন মায়াবী হয়ে উঠেছে মোমের আলোয়, পুরো ফ্ল্যাটের অন্য আলোগুলোও নিভিয়ে দিয়েছে অজন্তা। ওর মনে হচ্ছে স্বপ্নের মতো কি করে দশটা বছর কেটে গেছে, সাজানো গোছানো ছিমছাম আহ্লাদী সুখী সংসারের মালকিন অজন্তা আত্মশ্লাঘায় ভরপুর, অপেক্ষা করছে অর্কর জন্য।



টুং টাং টুং টাং শব্দে বেল বাজার আওয়াজ, অর্ক ফিরেছে, এই এতবছর পরেও অজন্তার হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো, অর্ককে চমকে দেওয়ার আগ্রহে হুড়মুড়িয়ে দরজা খুললো অজন্তা।



ঘরে ঢুকে অর্ক হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিভ দিয়ে টাকড়ায় আওয়াজ তুলে, "ওয়াও, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার!" গর্বে আনন্দে বুকটা ধ্বক ধ্বক করে উঠলো অজন্তার। অর্কর হাত ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে অজন্তা নিজেও বসলো উল্টো দিকের চেয়ারে মুখোমুখি। খুব ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে খাচ্ছে দুজনে, অজন্তার ইচ্ছে করছে তৃতীয়ার চাঁদকে সাক্ষী রেখে অর্কর বুকের সাথে লেপ্টে থাকতে, ইচ্ছে করছে ফিরে যায় সেই কুড়ি বছর আগের সেই প্রথম আলিঙ্গনের সন্ধ্যায়, ইচ্ছে করছে দশ বছর আগের ফুলশয্যার রাতটায়, ইচ্ছে করছে গল্পে আর খুনসুটিতে রাতটা পার করতে।



অর্কর গলার স্বরে অজন্তার যেন ঘোর কাটলো,

"আমি উঠলাম।" অর্কর খাওয়া শেষ হয়েছে, হাত মুখ ধুয়ে অর্ক বাথরুমে ঢুকেছে।



অজন্তা বেঁচে যাওয়া খাবার দাবার গুছিয়ে ফ্রিজে

তুলে রাখলো, বাসনপত্র সিঙ্কে নামালো, টেবিল পরিষ্কার করে সব গোছগাছ করলো, নিজে হাতমুখ ধুয়ে মেয়ের ঘরে গিয়ে মেয়ের ব্যাগে সব ঠিকঠাক গোছানো আছে কিনা চেক করে নিলো। এবার অজন্তা অবাক, এখনও অর্ক বাথরুম থেকে বেরোয় নি। এই কিছুদিন ধরে অর্ক রোজই ডিনারের পরে একই সময়ে বাথরুমে ঢুকছে, এতক্ষণ সময় নেবে তো ছোট বাথরুমটায় ঢুকতে পারে, তা না সেই বড় বাথরুমটাই আটকাবে রোজ।



অজন্তা যতটা পারে রাতেই কাজকর্ম গুছিয়ে রাখতে চেষ্টা করে, সকালে যা যা লাগবে শুতে যাবার আগে অজন্তা সব চেক করে রাখে, খুব অর্গানাইজড স্বভাব অজন্তার। কিন্তু আজ এতো দেরী করছে অর্ক, কাল সকালে আগেই মনে করে দেখে নিতে হবে সব দরকারী জিনিসপত্র... অর্কর শেভিং কিট, ডেটল হ্যান্ডওয়াশ, ডেটল কুলটা মেয়ের খুব প্রিয়... বাথরুমে ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা আছে কিনা।



অর্ক এখনও বাথরুমে, অগত্যা অজন্তা পাশের ছোট বাথরুমেই ঢুকলো, ধাঁই করে এখন অজন্তার মাথায় খেললো... আচ্ছা এতক্ষণ ধরে অর্ক বাথরুমে, অথচ ট্যাপ খোলা বা জল পড়ার কোনো আওয়াজ তো একবারও পায়নি। এমনকি অজন্তা খুব ভালো করে মনে করার চেষ্টা করলো অন্যান্য দিনে জল পড়ার আওয়াজ হয়েছিলো কিনা। অজন্তা নিজে ছোট বাথরুম থেকে বেরোবার সময় বাথরুমের জানালায় চোখ আটকালো, ওদের ঠিক পিছনের ফ্ল্যাট বাড়ীটার বাথরুমটা তো ওদের বাথরুমের একেবারে সোজাসুজি! আর আলো জ্বলছে সে বাথরুমে, জানালার খোলা পাল্লাটা দেখে ভারী অস্বস্তি হোলো অজন্তার।



অজন্তা একী দেখলো সুইচবোর্ডে ছোট বাথরুমের আলো নেভাতে গিয়ে... বড় বাথরুমের আলোর সুইচ অফ, মানে? এতক্ষণ ধরে অর্ক অন্ধকার বাথরুমে কি করছে? অজন্তা যোগসূত্রটা তৈরী করতে পারছে এবার! পিছনের ফ্ল্যাটের আলো জ্বলা জানালার পাল্লা খোলা বাথরুম আর তার ঠিক সোজাসুজি অর্কর অন্ধকার বাথরুম আর জানালার পাল্লা খোলা...... ! গাটা গুলিয়ে উঠলো অজন্তার, বাকীটা ও আর ভাবতেই চাইলো না, বাকীটা তো ওর এই নিটোল ভালোবাসার সংসারে ওর চোখের সামনেই দিনের পর দিন ঘটতে থাকা বড়সড় এক ফাঁকি.....!



ঝাপসা চোখে অজন্তা শোবার ঘরে, ভাবতে চাইছে না আর, তাও সেই বাকীটা ঢুকে পড়ছে বন্ধ দুচোখের বাণভাসি পাতায়... বাকীটা অশ্লীল.... ভারী অশ্লীল সেই বাকীটা!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy