Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

বাবলির গরম

বাবলির গরম

6 mins
690


বাবলির গরম

সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

-----------------------------------


আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল বাদে গরমকালের আর যে একটিমাত্র বিষয় বাবলিকে সামান্য উদ্দীপিত করে তা হোলো ঐ মামারবাড়ীর গাছ-গাছালির ছায়াঘেরা পুকুরটা। কী পরিষ্কার আর ঠান্ডা জল সে পুকুরে। গরমকালের পুরোটাই বাবলির থাকতে ইচ্ছে করে মামারবাড়ীতে। কেবলমাত্র ঐ পুকুরের টানে। বাবলি একদম গরম সহ্য করতে পারে না। গরমকাল পড়লেই যে কেউ বাবলিকে দেখেই বুঝবে বাবলি যে কপিকুলের অতি ঘনিষ্ঠ প্রজাতিভুক্তই তা বেজায়রকম সঠিক বটে। যখন তখন যেখানে সেখানে বাবলি চোখ বুজে মুখ বেঁকিয়ে আপাদমস্তক চুলকে নেয় নির্বিকার চিত্তে। বাবা-মা লজ্জিত হতে হতে অবশেষে লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছে।


এহেন বাবলির বাবা এবার বদলি হয়েছে আসানসোলে, সরকারি চাকরি, আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। জানুয়ারীর একেবারে শেষে এক রবিবারের প্রায় সন্ধ্যায় বাবলিরা আসানসোলে এসে পৌঁছোলো। পথশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন বাবলি ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা। সেদিনে আর দেখা হোলো না ওদের কোয়ার্টারের পেছনের উঠোন জুড়ে এলোমেলো বেড়ে ওঠা জামরুল, পেয়ারা, কুল আর ফলসা গাছ। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জানালার ফাঁক দিয়ে বাবলির চোখে পড়লো ছোট বড় মাঝারি সাইজের সব গাছগুলো। বাবলির মাও গরম পছন্দ করে না, আসানসোলে খুব গরম এই খবরে বাবলির মায়েরও অসন্তোষ ছিলো, তবে শেষ শীতের আসানসোলের ঠান্ডায় সে অসন্তোষ কেটে গেলো। গাছপালা আর পাঁচিলে ঘেরা অনেকখানি কম্পাউন্ডওয়ালা কোয়ার্টার ওদের বেশ পছন্দই হয়ে গেলো।


গোটা ফেব্রুয়ারিটা পার হোলো বেশ আরামেই, মার্চের একেবারে গোড়াতেও গরম কোথায়? বাবলির মা বেশ খুশি খুশি, বাবলিও স্কুলে যাচ্ছে আসছে, তবে বাবলির বাবা দুশ্চিন্তায়। মার্চের মাঝামাঝি বাবলির যত্রতত্র সর্বাঙ্গ চুলকানিতে বোঝা গেলো গরম তো এসে গেছে। বাবলি ফাঁক পেলেই আজকাল ইঁদারার ঠান্ডাজল গায়ে মাথায় খানিকটা ঢেলে নিচ্ছে। বাবলির গালে গলায় লাল লাল দগড়া দগড়া দাগ দেখে বাবলির স্কুলে গার্জেন কল হোলো। বাবলির বাবা-মা হেডমিস্ট্রেসকে সমস্যা বুঝিয়ে বলতে, ভদ্রমহিলা সাজেশন দিলেন বাবলিকে এই গরমের সময়টা কোলকাতা সংলগ্ন ওদের শহরতলীর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতে। হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার সিলেবাস ইত্যাদি ক্লাস টিচারের কাছ থেকে জেনে নিয়ে সেই সপ্তাহ শেষেই রবিবারের ভোরের ট্রেনে বাবলিদের তুলে দিয়ে বাবা অফিস নিয়ে আসানসোলেই থেকে গেলো। বাবলিরা গরমের ছুটিতে যেতোই মামারবাড়ীতে, তবে মাসখানেক আগেই গেলো। কম বেশী প্রায় দু-তিন মাস মামারবাড়ীতে থাকবে। বাবলির মাও যেন চোখ নাক মুখ গা হাত পা জ্বলানো এই গরম থেকে মুক্তি চাইছিলো।


মামাদাদু এসে হাওড়া থেকে ট্যাক্সি করে বাবলিদের নিয়ে যাবার সময়ই বাবলি শুনলো মানি আর মাম্নির (বাবলির দুই মাসী.....ছোট্টবেলায় বাবলির উচ্চারণে তারা মানি ও মাম্নি) না কি বিয়ে। বাবলি কলবল করে উঠলো, "কী মজা বিয়ে বাড়ী!" মা আর মামাদাদুর কথোপকথনের মাঝে আবার বাবলি, "মা, বিয়ে কেন হয়?" বাবলির মা উত্তর দেবার আগেই প্রসঙ্গ বদলেছে বাবলি, "মামাদাদু, আইসক্রিম খাবো।" ততক্ষণে সোদপুরে মামারবাড়ী এসে গেছে প্রায়। মিষ্টির দোকান দেখে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ঠান্ডা মিষ্টি দই চুপচাপ খেয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বাবলির আবার বিজ্ঞ উক্তি, "আইসক্রিম খাবো।" ট্যাক্সিওয়ালা আর মামাদাদুর হ্যাহ্যা হাসি আর মায়ের গোল গোল পাকানো চোখ দেখে বাবলি সাময়িকভাবে চুপ করে গেলো।


বাবলির মা সবার বড়। কাজেই ছোট তিন মাসী, দুই মামা আর দিদার আদর কি করে আদায় করতে হয় মামারবাড়ীর আদরের একমাত্র দাবিদার হওয়ার সুবাদে বাবলি তা বিলক্ষণ জানে। মামারবাড়ীতে পা দিয়েই প্রথমে খুঁক খুঁক তারপরে দিদার সস্নেহ আলিঙ্গনে বাবলি বিলাপ সহকারে উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়লো, এবং তার সারমর্ম মামা-মাসীরা উদ্ধার করে ফেললো, "আঁমি আঁইসক্রিঁম খাঁবোঁ।" দাদু ততক্ষণে বাবলিকে কোলে তুলে ফতুয়ার পকেট থেকে টাকা দিয়ে বাবলির 'বোমা'.....বড় মামাকে সাইকেলে চেপে আইসক্রিম আনতে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানি, মাম্নি, বনি.....ছোট মাসী, বাড়ীশুদ্ধু সবার এবং বাবলিরও বনি, 'ছোমা'...ছোটমামা, দিদার কোলে কোলে ঘুরছে তখন বাবলি, এবার বাবলির মোক্ষম ঘোষণা, "গরম লাগে!"


দিদা পাম্প চালিয়ে ঠান্ডা জল তুলে বাবলিকে স্নান করাতে না করাতেই বোমা আইসক্রিম নিয়ে হাজির।


চেটেপুটে আইসক্রিম খেয়ে, কাঠের চামচে যতটুকু উঠলো না ততটুকু আঙুল দিয়ে সাফ করে বাবলি ঘুমলো, মামারবাড়ী জুড়োলো। এভাবেই বেশ মজায় কাটছে বাবলির মামারবাড়ীতে আদরে আহ্লাদে।


এই ক'দিনে দিদার কোলে পিঠে চেপে বাবলি সাঁতারও শিখে ফেলেছে, তবে একা একা পুকুরে নামার উপায় নেই মোটে, কাজের লোকজনসমেত মোট চোদ্দো জোড়া চোখের কড়া নজরদারিতে।

মানি, মাম্নির বিয়ের হুজুগে বাবলির লেখাপড়া মোটামুটি শিকেয় উঠেছে, মা জোর জবরদস্তি বসাচ্ছে মাঝেমধ্যে। তবে তার অধিকাংশ সময়েই মারধোর কান্নাকাটির জেরে বাবলির মা দাদু-দিদার কাছে ঝাড় খাচ্ছে দেখে বাবলির কান্না মাথায়, আর সামনের পোকা ধরা দুই দাঁতে ঝিলিক তুলে দু-গালে টোল ফেলে বাবলির মণি মুক্তো ঝরানো হাসিতে মামারবাড়ী উথালপাথাল।


বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে মা মাসীদেরকে নিয়ে তত দু'বেলাই দোকানে দোকানে ঢুঁ মেরে বেড়াচ্ছে। বাবলি দিদার কাছে যথেচ্ছ আব্দার করে যাচ্ছে আর দিদা হাসিমুখে মেটাচ্ছে সব। যদিও বাবলির আব্দারও খুব বড়সড় নয়..... ঠান্ডা দই, আইসক্রিম আর সাঁতার কেটে স্নান করা বা কারেন্ট অফ থাকার সময়ে হাতপাখায় ননস্টপ হাওয়া। সেসব মেটাতে দিদার কোনও কার্পণ্য নেই।


বাড়ী ভর্তি লোকজন ভিড়ভাট্টায় মাসীদের বিয়ে মিটে গেলো, গরমে কাবু বাবলি আদ্দির টেপজামা পরেই দিব্যি বিয়েবাড়ী পার করে ফেললো। বিয়েবাড়ীর হৈচৈয়ে ছ'বছরের বাবলি মানির কাছে বিশেষ ঘেঁষে নি, মানির খসখসে কাপড়টা বাবলির একদম ভালো লাগে নি, ফটো তোলার জন্য একবার মানির কোলে উঠেই নেমে পড়তে পারলে বাঁচে তখন বাবলি, মানির হামির উত্তরে বাবলি, "ইঃ, গরম", কান-মাথা-গাল-গলা চুলকোতে চুলকোতে। পুকুরঘাটে যাবার দরজাটায় পেল্লায় এক তালা, বাবলিকে বিশ্বাস নেই, গরম লাগছে বলে বৈশাখী বেলায় একাই পুকুর তোলপাড় করতে ছুটতে পারে। বাবলিকে দিদা কয়েকবার ঠান্ডা জলে স্নান করিয়েছে, ঠান্ডা দই দিয়ে ভাত খাইয়েছে, ছোমাকে দিয়ে আইসক্রিম আনিয়ে দিয়েছে। কারেন্ট অফে বিয়ে বাড়ীতে জেনারেটর চলেছে, বাবলি দিদার ঘরে শীতল পাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে অঘোরে।


হঠাৎ বাবলি শাঁখ উলু আর কাঁপা কাঁপা ফোঁসফোঁস আওয়াজে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে, পুরো ব্যাপারটা বুঝতে খানিকটা সময় নিলো। গাঁটছড়া বাঁধা মানি আর মাম্নির পতিগৃহে যাত্রাটা বাবলির বোধগম্য হয় নি, ছ'বছরের জীবনে এ ঘটনা প্রথমবার চাক্ষুষ। বাবলি দিদার শাড়ির আঁচল ধরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন দেখলো, মানি ইনিয়ে বিনিয়ে ছোমা আর বনির গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবলির খোঁজ করছে তখনই বাধলো গোল। এমনিতেই ওই কালো ঢ্যাঙা গুঁফো লোকটাকে বাবলির মোটেই পছন্দ হয় নি, নির্ঘাত ওই লোকটাই জোর করে মানিকে নিয়ে যাচ্ছে, কিছু একটা করতেই হবে, মানি তো বাবলিকেই ডাকছে। যেমনি ভাবা অমনি কাজ, বাবলি মানির বর নামক ব্যক্তিটিকে মাথা দিয়ে ঢূঁশো মেরে মালা ছিঁড়ে পাঞ্জাবি ধরে ঝুলে পড়লো, কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ, "মানিকে ছেড়ে দাও, মানিকে নিয়ে যাবে না, মানিকে চিমটি কেটেছো কেন? মানি কানছে কেন তালে? মাম্নি তো কানছে না, মাম্নিকে নিয়ে যাও। মানি গেলে হাবা কে করবে?" বাবলির তারস্বরে চিৎকারে সবাই হতচকিত। মায়ের হাত উঠতে দেখেই দিদা স্ত্রী-আচারের নিয়ম ভেঙে বাবলিকে আঁকড়ে কোলে নিয়ে সাঁতার কাটতে যাবার লোভ দেখিয়ে কোনক্রমে শান্ত করলো। বাবলির মানি মাম্নি এরপর নির্বিঘ্নেই পতিগৃহে রওনা হোলো।


এই হোলো গরমকাতুরে বাবলির আদরে অধ্যূষিত বাঁদরামিভরা শৈশব। বাবলির বাবা বাবলির এই গরম-গরম বাতিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোলো। অনেক আলাপ আলোচনা সিদ্ধান্তের টানাপোড়েনের পর সে বছরই বাবলিকে পাহাড়ের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হোলো, বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে বাবলিকে বাবা-মা দার্জিলিঙে রেখে নিজেরা চোখের জলে ভেসে ফিরে এলো। পাহাড়ে ন'মাস স্কুল তিনমাস ছুটি, ঐ সময়েও বাবলি বাড়ীতে আসতে চায় না, ওর এক কথা, "গরম লাগে!" অগত্যা বাবলির মা অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে দার্জিলিঙেরই এক স্কুলে ইতিহাস পড়ানোর চাকরি নিয়ে মেয়েকে নিয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে থিতু হোলো বাবলির গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়া পর্যন্ত। আর বাবলির বাবা এই পর্ব পরবর্তী সময়ে মেসে মেসেই বাকি চাকরি জীবন কাটিয়ে দিলো। অবিশ্যি ছুটিছাটায় বাবলিদের কাছে পাহাড়েই গিয়ে থাকতো।


বাবলির মায়ের আর যে ক'বছর চাকরি আছে ততদিন পাহাড়েই থাকার অসুবিধা নেই।

বাবলির বাবার রিটায়ারমেন্টের বছর দুয়েক বাকী থাকতেই বাবা তাদের আদুরে কাতুরে কাঁদুনে বাবলির জন্য সজ্জন পরিবারের সৎপাত্র জোগাড় করে ফেললো। কানাডাপ্রবাসী ব্যবসায়ী পরিবার হলেও পাত্র উচ্চশিক্ষিত এবং ওদেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত চাকরিতে। গরম এড়াতে মাঘ মাসের প্রথম লগ্নেই বাবলির বিয়ে হয়ে গেলো, তাও কোলকাতায় এসে নয়, শিলিগুড়িতে বাড়ী ভাড়া করে। আত্মীয় স্বজনদের শিলিগুড়িতে আনা নেওয়ার দায়িত্ব বাবলির বাবাই নিয়েছিলো বলাই বাহুল্যমাত্র। বিয়ের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বাইশ বছরের চনমনে তরুণী বাবলি বাবা-মাকে চোখের জলে বিদায় জানিয়ে উড়লো কানাডার উদ্দেশ্যে।

বাবলির বিয়ের পরেই বাবলির মা চাকরি ছেড়ে কোলকাতার বাড়ীতে চলে এসেছে, বাবলির বাবাও রিটায়ারমেন্টের ঠিক আগে আগে কোলকাতাতেই পোস্টিং পেয়েছে।


******


বাবলির বেশ ক'বছর বিয়ে হয়েছে, একবারও আসতে পারে নি এখনো দেশে। তবে ফোনে রোজই কথা হয়। সেদিন বাবলি ফোন করেছে যখন, তখন পাড়ার মাইকে উচ্চগ্রামে বাজছে "এসো হে, বৈশাখ, এসো এসো"........ বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বাবলির বাবার কাছে বাবলির গলাটা যেন একটু ধরা ধরা লাগলো, "বাবা, আম লিচু কালোজাম সব এনেছো, না, বাবা বাজার থেকে?" কয়েক মুহূর্তের বিরতির পর আবার কাঁপা গলায় বাবলি, "বাবা, আই মিস্ দ্যাট সামার ডেজ্, সারাবছর এতো ঠান্ডা আর বরফ কানাডায়.......!" লাইনটা মনে হয় কেটে গেলো, বড্ড দূর থেকে ফোন তো!


বাবলির বাবার চোখের কোণটা একটু জ্বালা করে উঠলো, ঘাম গড়িয়েছে কি? গ্রীষ্ম কি এতোই খারাপ?

--------------------------------------------------------------

© সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics