বাবা
বাবা
আঠারো বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেল অলক।বড় কষ্ট লাগছিল এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে।মনে হচ্ছিল এইবার তাকে সত্যি সত্যিই সাজা দেওয়া হল । চোখের কোনে এতদিন বাদে জল এল ।
একটা খুন করেছিল অলক । ইচ্ছে ছিল দুটো করার । জেলে এসে একটা দুঃখ ওকে খুব কষ্ট দিত। বউটাকে খুন করার আগেই ধরা পড়ে গেল।
বউটা পাড়ার একটা অল্প বয়েসি ছেলে চঞ্চলের সঙ্গে শুচ্ছিল রোজ দুপুরে।একটা উড়ো ফোন ওকে খবরটা দিয়েছিল ।তারপর দশদিন ধরে রোজ দুপুরে ওত পেতে ও দেখেছিল চঞ্চল রোজ একটায় ওর বাড়িতে আসছে আর ঠিক চারটেয় বেরিয়ে যাচ্ছে ।রাগ সামলাতে পারেনি অলক। অন্ধকারে একটা লোহার রড নিয়ে ও চঞ্চলের জন্যে দাঁড়িয়েছিল ।সর্বশক্তি দিয়ে মাথায় রডটা মেরে দেহটাকে নিথর করে দিয়েছিল ।বাড়িতে এসে ওই লোহার রডটা দিয়েই বউটাকে শেষ করার ইচ্ছে ছিল। তার আগে পাড়ায় হৈ হৈ ,লোকজনের চেঁচামেচিতে ও দ্বিতীয় খুনটার জন্যে সময় নিয়েছিল ।
-অলকদা চঞ্চলের ভাই চন্দনকে কেউ খুন করে দিয়েছে। একজন এসে জানিয়ে ছিল। ছি! ছি! চঞ্চলের বদলে ওর যমজ ভাই চন্দনকে মেরে ফেলল। তাড়াতাড়ি দীপাকে খুন করতে ও এগিয়ে এসেছিল ।হাতে রক্তমাখা লোহার রডটা দেখে দীপা অর্ককে কোলে নিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল । ধরা পড়ে গিয়েছিল অলক।
আঠারো বছর পর অলক বাড়ি ফিরছে।এর মধ্যে একদিনও দীপা ওর সঙ্গে দেখা করতে আসে নি।আঠারো বছরে পুরো পৃথিবীটা পাল্টে গেছে।রাস্তার চেহারা, ঘর বাড়ি দোকান । পাড়ার নামটা ঠিক আছে তো? মাঝ রাস্তায় একটা পার্ক পড়ল। একটা গাছের তলায় বসে পড়ল অলক ।খুব খিদে পেয়েছে । মুখে একগাল পাকা দাঁড়ি , মাথার চুলগুলোও সব পেকে গেছে ।পুরোনো কোঁচকানো পোশাক ।ওকে এখন খুব পরিচিত কেউ দেখলেও চিনতে পারবে না।ওর বাড়িটা ও চিনতে পারবে তো !
হাঁটতে লাগল অলক। অবশেষে একটা বাড়ির সামনে ও দাঁড়িয়ে পড়ল ।একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে গেটে। বাড়িটায় একটা সাদা প্যান্ডেল । শ্রাদ্ধ বাড়িই মনে হচ্ছে । ছেলেটা যেন ওর যৌবনের ছবি।
- কি, চাইছেন? ছেলেটা ওকে প্রশ্ন করল ।
অলক বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকল । এইটাই সেই বাড়ি? একটা ভাঙা একতলা বাড়ি বেমালুম পাল্টে গিয়ে সুন্দর তিনতলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখল অলক ।
-খাবে? এবার ছেলেটা ‘তুমি’ বলল ।প্যান্ডেলের ভেতর অনেক লোক ছোটাছুটি করছে ।দিনের বেলায় ভেতরে অনেক আলো জ্বলছে । দুপুরের খাবার পরিবেশন চলছে ।
-কি হল, অর্ক। পেছন থেকে মা ডাকল ।মার চুলে সাদা রঙ ।চোখে চশমা ।
-খেতে চাইছে। অর্ক বলল।
মা এগিয়ে এল ।এক ঝলক দেখল অলককে ।
-কিছু বলবে? খাবে?
অলক চুপ করে থাকল । দেখতে থাকল দীপাকে ।
-কাউকে খুঁজছো?
-হ্যা।
-কাকে?
-আমাকে ।আমি এখানে ছিলাম তো।হাসল অলক ।
অর্ক এগিয়ে এল ।
-এই যে বাবা, খাবে খাও। নাহলে এসো । খাবে ? খাও না , এসো, এসো বাবা ।
অলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি সত্যিই তোমার বাবা’।
-জানিতো ।অর্ক হাসল । বলল, ‘বস, বস। আমি নিজে তোমায় পরিবেশন করে খাওয়াবো’।
অলক কাঁদতে থাকল। অনেকক্ষণ ধরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । সবাই খুব কষ্ট পেল। আহা, দেখ মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে । দীপা তাকিয়েছিল ।একটা ভয় বুকের ভেতর শব্দ করছে।
অর্ক ইশারা করল মাকে চলে যেতে। কী হবে পাগলেরর কান্ড দেখে!বাবার বাৎসরিকে একটা দুঃখি মানুষ খাক না । কিন্তু লোকটা খাচ্ছে না ,চোখ ভর্তি জল নিয়ে তাকিয়ে আছে অর্কের দিকে ।