STORYMIRROR

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy

2  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy

অপত্যস্নেহ

অপত্যস্নেহ

4 mins
891


সকাল হতে না হতেই নিধু বিধুর মায়ের চিল চিৎকারে আশপাশের লোকজনের বিরক্তির সীমা নেই। নিত্য নৈমিত্তিক এই ঘটনায় সবাই যদিও খুবই বিরক্ত তথাপি গা সওয়াও হয়ে গেছে, এই নিয়ে কেউ কখনো কোনো কথাও বলে না বুড়ির সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে। দেড় বছরের যমজ দুই ছেলে নিধু বিধুকে নিয়ে বিধবা হয়ে আজ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নানান দুঃখ বেদনায় জর্জরিত হয়ে দিনাতিপাত করে বয়স সত্তর পার করে পাড়ার ছেলেছোকরাদের দেওয়া খিটখিটে বুড়ি উপাধি অর্জন করেছে। তবে এতে বুড়ি মোটেই রাগে না, বরং ফোকলা দাঁতে হাসে। উল্টে পালাপার্বণে ছেলেপুলেদের মোয়াটা নাড়ুটা যত্ন করে খাওয়ায়। পাড়ার বৌমেয়েদের সাংসারিক কাজে কর্মে ঠেকা-বেঠাকায় হাসিমুখে সাহায্য করে। কারুর বাচ্চা হওয়ার সময় বা রোগেভোগে কারুর আটকালে ও দরকার পড়লে বুড়ি হাসপাতালে গিয়ে রাত জেগে অবধি প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ায়।


নিধু বিধুর মায়ের একটা নিজস্ব নামও আছে, নয়নতারা। পাড়াতুতো সম্পর্কে সবায়েরই নয়নপিসি। বিয়ের বহুকাল বাদে জন্মানো এই যমজ ছেলেরা মাত্র দেড়বছর বয়সে পিতৃহারা হোলো। এরপর শ্বশুরবাড়িতে টিকে থাকা নয়নপিসির পক্ষে আর বেশীদিন সম্ভব হোলো না, পেট ভরানোর সংস্থান স্বামীর সাথেই বিদায় নিয়েছিলো, সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাপের ভিটেয় ফিরে এসেছিলো। আর মেয়ের এই দুঃসময়ে নয়নপিসির বাবা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নয়নপিসির নামে কয়েক কাঠা জমি দানপত্র করে দিয়েছিলেন। শত অভাবেও সে জমি বিক্রির কথা নয়নপিসি কখনো মনেও আনে নি।



কালের নিয়মে নয়নপিসির বাপ-মা চোখ বু‌ঝলেন আর তারপর থেকে ভাই ভাইয়ের বৌয়ের বিস্তর মুখ ঝামটা হেনস্থা সহ্য করে গোবর কুড়িয়ে, ঘুঁটে দিয়ে, মুড়ি খই চিঁড়ে ভেজে, গোটা কয়েক মুরগির ডিম আর সামান্য সম্বল গয়নাগাঁটিটুকু পর্যন্ত বিক্রি করে করে নিধু বিধুকে বড় করেছে, লেখাপড়া শিখিয়ে উপযুক্ত করেছে। তারপর ছেলেরা রোজগেরে হলে তাদের বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দিয়েও নয়নপিসির ছুটি মিললো না। সুখের মুখও দেখা হোলো না।

নিধু বিধুর বৌ ঘরে আসার পর ধীরেধীরে নয়নপিসির গুরুত্ব আর আধিপত্য সংসারে কমতে কমতে একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। আস্তে আস্তে বৌয়েরা গিন্নী বান্নী হয়ে উঠেছে, সংসার বড় হয়েছে। আর কেবল গিন্নীপনাটা বাদে গেরস্থালির বাকী সব কাজের চাপে অর্ধাহারে নয়নপিসি কঙ্কালসার খিটখিটে বুড়িতে পরিণত হয়েছে।



নিধু বিধুর মা প্রথম প্রথম ছেলেদের কাছে অনুরোধ অভিযোগ জানাতো। তারপর কেঁদে কেটে অনুনয় বিনয়ও করেছে অনেক, কিন্তু ছেলেদের তাতে খুব বিশেষ হেলদোল দেখা যায় নি। সর্বস্বান্ত নিঃস্ব বুড়ির কথা ছেলেরা কানে তোলে নি। ফলস্বরূপ শাশুড়ির উপর দুই ছেলের বৌয়ের ব্যবহারই দুর্ব্যবহার থেকে অত্যাচারে পরিণত হয়েছে। বুড়ির চিৎকারেও আজকাল কেউ আর তেমন কান দেয় না। কান্নাকাটি, বিলাপ শেষপর্যন্ত শাপশাপান্তে রূপান্তরিত হয়। তবে এই শীতে বুড়ির চেঁচামেচি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কিছু একটা বিহিত করতেই হবে স্থির করলো পাড়ার ছেলেছোকরারা এবং তা বয়োজ্যেষ্ঠদেরও জানালো। আগামী রবিবারেই নিধু বিধুর অর্থাৎ নয়নপিসির ছেলেদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করা হবে জানানো হোলো তাদের। অরাজী হবার সাহস নিধু বিধু দেখায় নি।



রবিবারে পাড়ার গণ্যমান্য পাঁচজন আর

পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সামনে নয়নপিসির কাছে জানতে চাওয়া হয় চেঁচামেচির কারণ, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বুড়ি ছেলেদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে বোবাদৃষ্টিতে খানিকক্ষণের জন্য চেয়ে থেকে বললো, তার ছেলেরা বৌমারা খুবই ভালো, তাকে খুব ভালো করেই যত্নআত্তি করে, বুড়ো বয়সে তারই ভীমরতি, মরা স্বামী বাপ মায়ের কথা মনে করে সে অমন কান্নাকাটি করে, ছেলেদের বৌমাদের কোনো দোষ নেই। পাঁচজনের সামনে বুড়ির এই কবুলে সবাই হতভম্ব, এমনকি নিধু বিধুও হতবাক, আর নিধু বিধুর বৌ তো বেবাক অবাক, বুড়ির হোলোটা কি? পাড়ার লোকজন সবাই বিদায় নিলে বুড়িও ছেলেদের পাশ কাটিয়ে লাঠি ঠুকঠুক করে নিজের ঘরে ঢুকে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে চাটাইয়ের ওপর পাতা শতচ্ছিন্ন তেলচিটে ময়লা বিছানাটার ওপর দুই হাঁটু এককরে জড়সড় হয়ে বসে রইলো। ছেলেরা বুঝে উঠতে পারল না মাকে কিছু বলা উচিত কিনা। তবে ছেলের বৌদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো... "যাক বাবা বুড়ি তবু বাইরের লোকের কাছে মুখ খুলে আসল কথা কিছু বলে নি।"



এর পরদিন থেকে আশ্চর্যজনকভাবে নয়নপিসির চিৎকার চেঁচামেচিও শোনা যায় নি।

এখন পাড়ার লোকজনের কাছে এইটাই লাখটাকার প্রশ্ন হয়ে ঘুরতে লাগলো নয়নপিসি সবায়ের কাছে ছেলে বৌদের দোষ ঢাকলো কেন? কোনো রকম অভিযোগই বা জানালো না কেন? তাহলে এতদিন ধরে চিৎকার চেঁচামেচি শাপশাপান্তই বা কেন করতো? বুড়ি আজকাল বাড়ির বাইরেও বেরোয় না, বুড়ির সেদিনকার ব্যবহার নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করারও সুযোগ পায় না। আস্তে আস্তে পাড়ার লোকেদের কৌতূহলেও ভাঁটা পড়তে শুরু করলো। নয়নপিসির গলার আওয়াজ আর শোনা যায় না। তাই ধীরেধীরে নয়নপিসিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যেতে থাকলো।

হঠাৎ একদিন সকালে পাড়ার লোকেরা দেখলো নিধু হনহনিয়ে একটা সাইকেলভ্যান ডেকে নিয়ে এলো। আর তারপর নিধু বিধু ধরাধরি করে কাউকে কিছু না জানিয়ে নয়নপিসিকে ভ্যানে চাপিয়ে তড়িঘড়ি হাসপাতালের দিকে নিয়ে চললো। হঠাৎ করেই নয়নপিসি আবার তপ্ত আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠলো।



তারপর আকস্মিকভাবে পরপর অনেকগুলি ঘটনা ঘটে গেলো। নয়নপিসির বাড়িতে পুলিশ এলো, থানায় আটক নিধু বিধু। কোমরে দড়ি দিয়ে মহিলা পুলিশেরা নিধু বিধুর বৌকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো, ওদের বাচ্চাগুলোও পিছন পিছন হাপুস কাঁদতে কাঁদতে চললো। ভারী হৃদয়বিদারক দৃশ্য!



এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতটা এবার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। হাসপাতাল ও থানা থেকে জানা গেলো যে, নয়নপিসিকে খুন করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে নয়নপিসিকে নাকি ঘাড় মটকে ভেঙ্গে মেরে ফেলা হয়েছে। পাড়ার লোকজন বড় দুঃখ পেলো, আফশোষ করতে থাকলো, চেষ্টা করেও নয়নপিসিকে বাঁচাতে পারলো না, পিসিরই অসহযোগিতার কারণে। অপত্যস্নেহে অন্ধ নয়নপিসিকে তাই এমন বেঘোরে প্রাণ দিতে হোলো।



পাড়ার লোকজন পুলিশের সাথে আলোচনা করে নির্বিবাদী সদালাপী দুঃখিনী পিসির সৎকারের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিলো। ছোট বড় নির্বিশেষে নয়নপিসির এই মর্মান্তিক পরিণতিতে সবিশেষ মর্মাহত।



শ্মশানঘাটের ক্রিয়াকর্মের সময় দেখা গেলো পিসির বাঁহাতের বুড়ো আঙ্গুলে নীলরঙ্গের স্ট্যাম্পের কালি স্পষ্ট লেগে রয়েছে, নয়নপিসির অন্ধ অপত্যস্নেহের নির্মম সাক্ষ্যরূপে সম্পর্কের মাহাত্ম্যকে বিশ্রী ভেঙচি কেটে।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy