অনুতাপের আগুনে
অনুতাপের আগুনে
হঠাৎ ভীষণ জোরে জোরে ডানা ঝাপটানোর শব্দে বিমলের তন্দ্রাটা একদম কেটে গেলো। ওর মনে হোলো, যেন একটা বিশাল বড় পাখি ঘর ছেড়ে বেরোনোর জন্য সারা ঘরময় ছুটোছুটি, হুটোপুটি করছে। চোখ মেলে তাকালো বিমল। জানালার কাঁচে প্রথম শীতের মিহি হিমকুচি জমা হয়েছে। রাস্তার ভেপার ল্যাম্প থেকে কেমন ঝাপসা মায়াবী ঢেউয়ের মতো আলো ও জানালার কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকে বিমলের বিছানাটা আলো করে ফেলেছে। নীলচে রাতে হলদে আলো মিশে আবছায়া সবুজ আলো। গোটা ঘরময়। সেই আলোয় বিমল বিরাট সেই পাখিটাকে খুঁজতে লাগলো। কোথায় সে? এই তো ছিলো, ডানা ঝাপটাচ্ছিলো। পাখিটা কোথায় গেলো? বিমল ওপরে চোখ তুলে দেখলো, সিলিঙে, ডাইনে, বাঁয়ে, সবদিকে। উত্তরের বারান্দার দিকের ঘুলঘুলিটা দিয়ে বোধহয় শীতল হিম বাতাস ঢুকছে। সেই বাতাসের দাপটেই কী অনবরত ফরফর করে পাতাগুলো ওড়াচ্ছে বহু বছরের পুরনো সেই ক্যালেন্ডারটা? ক্যালেন্ডারটায় একটা বাচ্চার মুখের ছবি। ছোট্ট বাচ্চা, সামনের দুটো দাঁত কেবল উঁকি দিচ্ছে পাতলা গোলাপী দুই ঠোঁটের হাসির ঠিক মাঝ মধ্যিখানে? ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিমলের মনে হোলো, ওটা তো ববির মুখ! বিমল চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়েই রইলো ছবিটার দিকে, একদৃষ্টে।
ইস্, কী একটা আওয়াজ, খড়খড়, খচমচ, খসখস। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলো বিমল, রান্নাঘরের কোণে একটা ঠোঙা, মুড়ির। হাওয়ায় উল্টেছে ঠোঙাটা। কালো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে সাদা সাদা মুড়ি। আরে, আস্তে আস্তে মুড়িগুলো খই হয়ে গেলো যে। সাদা সাদা খই। সারা মেঝেতে ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে স্তুপাকারে খই, শুধু ধবধবে সাদা খই। রান্নাঘর থেকে বারান্দা, শোবার ঘর, সব সাদা খইয়ে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। আর সেই খইয়ের স্তুপের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে বিমল। খইয়ের ভেতরে ডুবতে ডুবতে বিমল দেখলো পুবের আকাশ, না না, গোটা আকাশ টকটকে লাল, ঠিক আগুনের মতো লাল। কানে এলো ঘন্টাধ্বনি, খুব জোরালো সব আওয়াজ আর "বলো হরি, হরি বোল।" ইস্, বিমলের নাকে চোখে কানে মুখে খই ঢুকে যাচ্ছে, সাদা সাদা খই। যাহ্, সেই বিরাট পাখিটা শেষবার প্রাণপণ ক্লান্ত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
******
বিমলের ঘরের দরজাটা তিনদিন ধরে বন্ধ, দুর্গন্ধ। পাড়ার লোকে পুলিশে খবর দিলো। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেহ উদ্ধার করেছে। হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বা শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে দিন তিনেক আগেই। কয়েক বছর আগে, এই বিমল কী ছিলো!
******
বিমল মিনুর সংসারে নিত্য অশান্তি লেগেই আছে। তুচ্ছ সব বিষয়ে অশান্তিতে সাংসারিক কাজকর্ম, দৈনন্দিনতা মুখ থুবড়ে পড়ে। খুব যে অভাব-অভিযোগ আছে ওদের সংসারে তা কিন্তু নয়। প্রতিবেশীরা ও আত্মীয়রা মিনু-বিমলের অশান্তির কারণ খোঁজায় ব্যর্থ। মিন
ুও কখনো মুখ খোলে নি। বিমলের যুক্তি, মিনু অযথা চেঁচামেচি করে, তাছাড়া সংসারেও মিনুর মতি নেই। তবে সবাই অবশ্য দেখে মিনু উদয়াস্ত সংসার নিয়েই পড়ে আছে। ছোট্ট মেয়ে ববিকে নাওয়ানো খাওয়ানো বেড়ানো পড়ানো, সব মিনু একলাই করে। কাজের লোকবিহীন সংসারে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ মিনু একাহাতেই সামলায়।
আজকাল বিমল মিনুর গায়েও হাত তুলছে। মিনু না বললেও পর্দার ফাঁক দিয়ে কারুর কারুর চোখে পড়ে যায় কখনো কখনো। একবার এই নিয়েই
বিমলকে সাবধানও করা হয় পাড়া কমিটি থেকে। এরপর ক'দিন ঝগড়াঝাটি নেই। মিনুর মুখে যেন সবসময় হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছে। মাঝে একদিন মেয়ে ববিকে নিয়ে দু'জনে ঘুরেও এলো।
এর দিনতিনেক পরে সন্ধ্যায় বিমল রিক্সায় করে মিনু আর মেয়ে ববিকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় পাড়ার লোকজনেরাও জুটে গেলো। মেয়েটা নেতিয়ে পড়েছে, মিনুর অবস্থাও ভালো নয়, মাথা সোজা করে রাখতে পারছে না। হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছনোর আগেই মিনুর চোখের মণি... মেয়ে ববি চিরঘুমে। তিনদিন যমে-ডাক্তারে টানাটানিতে মিনু বেঁচে গেলো ঠিকই, কিন্তু মেয়ের শোকে পাষাণী।
বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। কাজেই পুলিশ এলো। জেরা চললো হাসপাতালেই। মিনু জবানবন্দি দিলো যে, চপে বিষ মিশিয়ে সে নিজেই মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়েছে। সুস্থ হতেই অ্যারেস্ট হোলো মিনু। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে বিমলের দিকে তাকিয়ে মিনু পুলিশ ভ্যানে গিয়ে উঠলো।
বিমল নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠলো, "আমি বুঝি নি, বুঝতে পারি নি যে মেয়েটা মায়ের মুখের ভিতর থেকে চপটা টেনে বার করে খেয়ে ফেলবে। আর মেয়ে নিয়ে অত যে খুঁতখুঁতে মিনু তাতে বাধাও দেবে না, একটুও বাধা দেবে না!"
অ্যারেস্ট হওয়ার রাতেই লক আপেই মিনু মারা গিয়েছিলো। নিজের শাড়ির আঁচল নিজের নাকে মুখে নিজেই গুঁজে দিয়েছিলো। দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলো মিনু।
******
আর তার পর থেকেই বিমল একা একাই বিড়বিড় করে কথা বলতো। ঘুরে ঘুরে বেড়াতো কোথায় কোথায়। মাঝে মাঝে তাকে পাড়াতেও দেখা যেতো। কাজকর্মও সব ছেড়ে ছুড়েই দিয়েছিলো বোধহয়। একা একা দোকান থেকে মুড়ি কিনে খেতো কখনো কখনো। ঘর দোর খোলাই পড়ে থাকতো। চোরও ঢুকতো না ওর বাড়ীতে কখনো। লোকে বলতো বিমল পাগল হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বিমল নিজে জানতো, ও পাগল হয় নি মোটেই। মনেপ্রাণে বিমল চাইতো পাগল হয়ে যেতে, সব ভুলে যেতে, স্মৃতি থেকে সব ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে। তা পারে নি বিমল। প্রতিদিন শুধু অনুতাপের আগুনে তিলতিল করে পুড়েছে। ক্ষমা চাইতেও পারে নি যে মিনু আর ববির কাছে!!
(বিষয় - স্বীকারোক্তি)