Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

3  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

অন্তরালে (পর্ব ৮)

অন্তরালে (পর্ব ৮)

17 mins
214


(সমাপ্তি থেকে যেখানে ভালোবাসার সূচনা)

(শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)


অজং শাশ্বতং কারণং কারণানাং

শিবং কেবলং ভাসকং ভাসকানাম্।

তুরীয়ং তমঃপারমাদ্যন্তহীনং

প্রপদ্যে পরং পাবনং দ্বৈতহীনম্।


অর্থাৎ যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না; দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না; সৎ ছিল না, অসৎ-ও ছিল না... তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন... তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ; তিনি স্ব-স্বরূপে বর্তমান, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি; তিনি তুরীয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন...

শ্রদ্ধা আদর্শকে মাঠে দৌড়তে দেখলে হয়তো এই কথাগুলোই ভাবতো, ঠিক যেন স্বয়ং মহাদেব মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছে... কিন্তু BMW থেকে নামা একজোড়া চোখে কিন্তু আদর্শের এই রূপ ধরা পড়লো না... তার চোখ সেই যক্ষপুরীর অপ্সরাদের মতো মেঘদূতকে দেখে ভাবে- মেঘ বোধহয় হরণ করে নিল গিরিশৃঙ্গ... মেঘ যেন এমনই দেহধারী, এমনই বলবীর... সেই জোড়া চোখ সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর কোর্ট পরিহিতা, লম্বা Straight করা চুল ঝুটি করে বাধা, Black Sunglass চোখে, এক হাতে বন্দুক নিয়ে শার্টের হাতা Fold করতে করতে দূর থেকে আদর্শকে দেখে ক্রুর স্বরে বলে ওঠে,


আগন্তুক : HANDSOME HUNK.... I wondered !! I wondered !! I wondered !! How Handsome you are, Officer Meghdoot Banerjee !! Do you know how long time, you race with me !! I am fascinated by your Physique... Wow !!! and also your Experiment, your Knowledge and your Attitude... Why Not !! I know, you are such a Brilliant Officer... Shroddha doesn't deserve You... You are mine... only Mine.... 'Love is an endless mystery, for it has nothing else to explain it....'

এমনসময়ই আদর্শের ফোন বেজে ওঠে, পকেট থেকে ফোন বার করে আদর্শ দেখে ইনায়েৎ-এর ফোন...


আদর্শ : হ্যালো ইনায়েৎ, তুমি কেমন আছো !!

ইনায়ৎ : আমি ভালো আছি... তুমি আর ভাবিজান কেমন আছো !!! তোমার পরিবার কেমন আছে !!

আদর্শ : ভালো আছে... সবাই ভালো আছে...

ইনায়ৎ : আর তোমার ভালোবাসা !!! ভাবিজানকে বলেছো তোমার মনের কথা !!!

আদর্শ : তোমার ভাবিজানকে কিছু বলার দরকার পড়ে না... ও না বলতেই খোলা বই-এর মতো আমার সব মনের কথা পড়ে নিতে পারে...

ইনায়ৎ : তো ভাবিজানকে তোমার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দাও... তোমাদের তো কাল 'প্রেমের দিবস'... ভালোবাসার দিন... কাল ভাবিজানকে আদরে, সোহাগে ভরিয়ে দাও...

আদর্শ : হয়ে গেছে !!! না আরো কিছু আছে !!!

ইনায়ৎ : নাহহহ ভাই... আসলে কি বলো তো !! মানুষের জীবন তো !!! তাছাড়া ভাবিজানের উপর কুনজর পড়েছে...

আদর্শ : কার !!!

ইনায়েৎ : ইনি দেশের Top Young Gangstar-দের মধ্যে অন্যতমা- যার না কি রূপের কোনো তুলনা হয় না, দেখলে মনে হয়, কোনো শাপভ্রষ্টা কিন্নরী বা অপ্সরা... ঐশ্বরিকা ... বাবার একমাত্র মেয়ে যে বাবা প্রফেশনেই এগিয়ে যাচ্ছে... ইনি জাতে মেয়ে হলেও কাজকর্ম আর চালচলনের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ছেলেদের মতো... নারীদের মন নাকি ভারি নরম হয়, কিন্তু এর ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ আলাদা... মনের ভেতরে দয়ামায়া নেই বললেই চলে... নিজেকে এমনভাবে গড়েছে, যার কোনো দূর্বলতা নেই... কথায় কথায় খুন করে, যার টার্গেট কখনো Miss হয় না... যাকে বলে Cold Blooded Murderer... অপরাধ যাই হোক, তার আদালতে অপরাধী একটাই শাস্তি পায়... আর সেটা হলো মৃত্যুদন্ড... ঐশ্বরিকাকে কেউ কখনো দেখে নি... মাফিয়া জগৎ বলো আর সাধারণ মানুষ বলো- সব জায়গাতেই 'ঐশ্বরিকা' শুধুমাত্র একটা নাম... কিন্তু এই নামের মানুষটা 'কে'- সেটা কেউ জানে না...

আদর্শ : কিন্তু শ্রদ্ধার ওর কি ক্ষতি করেছে !!!

আগন্তুক : তুমি আমার জন্মশত্রু মেঘদূত... আমি চিরকাল তোমাকে শেষ করতে চেয়েছি... আজ আমি এসেছিলাম, তোমাকে নিজের হাতে শেষ করতে... কিন্তু তোমাকে দেখার পর মনে হলো, তুমিই সেই... তুমিই আমার সেই চিরকাঙ্খিত পুরুষ... আমাকে তো যে সে পেতে পারে না !!! Right !!! তেমনি তোমাকেও সবাই পেতে পারে না... বিশেষ করে ওই শ্রদ্ধা তো নয়ই... তোমার বাবার জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি... তোমার বাবা নিজের পরিবারকে বাঁচিয়ে নিজের সাথে আমার বাবাকেও শেষ করে দিয়েছিল... আমার... আমার মাথার উপর থেকে অভিভাবকের আশ্রয়টা হারিয়ে গেল... এর দাম তো তোমাকে দিতে হবে... তোমাকে তোমার শ্রদ্ধাকে হারাতেই হবে... ব্যাস... ওইটুকুই কষ্টই তোমাকে দেব আমি... তোমার শ্রদ্ধার চিতার উপরেই সজ্জিত হবে আমাদের বাসর...

আদর্শ : কি হলো !! বললে না তো ইনায়ৎ - কি দোষ আমার শ্রদ্ধার !!

ইনায়ৎ : She wants Revenge on You, Officer Meghdoot Banerjee... ওরা তোমাকে RAW Officer, সাত্ত্বিক ব্যানার্জির সন্তান হিসেবে ভাবছে, যে 1990 সালের দিল্লীর বিস্ফোরণের তদন্তের মূল দায়িত্বে ছিলেন... যার গোটা পরিবার এক আত্মঘাতী বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গিয়েছিল... কিন্তু নিজের মৃত্যুর আগেই সাত্ত্বিক সেই বিস্ফোরণের মূল মাথাতেও শেষ করেই শহীদ হয়েছিলেন... ওই বিস্ফোরণে শুধু সাত্ত্বিক ব্যানার্জি এবং ওনার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল... কিন্তু ওনার সন্তানের দেহ পাওয়া যায় নি... ওনার স্ত্রীর মৃত্যুও কিন্তু ওই বিস্ফোরণে হয় নি... কোনো একটা অজানা শক্তি ওনার স্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয় নি... আর সেটাই ওদের সন্দেহের কারণ... ওদের সন্দেহ, হয়তো সেই শক্তি ওনার সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে গেছে... আর...

আদর্শ : আর !!!

ইনায়ৎ : আর তুমিই সেই সন্তান... নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি... আর তুমিও তো অনাথ মেঘদূত... তোমার যশোদা মায়ের পালিত সন্তান...

আদর্শ : শ্রদ্ধা এখানে কোথা থেকে এলো !!!

ইনায়ৎ : তোমার ভালোবাসা... তোমাকে ভাঙ্গার অস্ত্র...

আদর্শ : কেউ যদি আমার রাহীর দিকে চোখ তুলেও খারাপ নজরে তাকায়, আমি তার চোখদুটো খুবলে নেবো... মেঘদূত ভালোর ভালো, আর খারাপের....


জলজোছনা :

-------------------

সংস্কার : দেখো দাভাই কিন্তু ভালোর ভালো, আর খারাপের খুব খারাপ... আম... আমরা যে প্রাণ হাতে নিয়ে এইসব পরিকল্পনা করছি... মানে ঠাম্মি, তুমি Sure- এই মদন-রতির পরিকল্পনাটা কাজ করবে !!!

ঠাম্মি : আরে, করবে... করবে... আমি রাহীকে পাঠালাম মেনকা হয়ে বিশ্বামিত্র-র ধ্যানভঙ্গ করতে... আর রাহী ওখানে গিয়ে মীরা হয়ে গেল... এই মেয়েটার দ্বারা আদর, সোহাগ কিছু হবে না দেখছি... আমাকেই ওকে মীরা থেকে মেনকা বানাতে হবে... যাহ, শ্রী দিদিভাই দেখতো, রাহী দিদিভাই স্নানে ঢুকলো কি না !!!!

শ্রেষ্ঠা : হ্যাঁ, ঢুকেছে... আর আমি আমার কাজটাও সেরে দিয়ে এসেছি...

ঠাম্মি : দাদুভাই, এবার তুই যা...

সংস্কার : সীমান্তে !!! ওরে বাবা রে !!! ও... ওই তো দাভাই আসছে Jogging সেরে... আমি আর যাব না...

ঠাম্মি : এসে গেছে !!! হে গোপাল, এদের জীবনে একটু সোহাগের ছোঁয়া দাও...





আদর্শের ঘর :

~~~~~~~~~

শ্রদ্ধার তখন সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে... সে তো বুঝতেই পারছে না তার সাধারন ব্লাউজ বদলে কিভাবে Boat Neck Blouse হয়ে গেল... বহু চেষ্টাতেও সে সব বোতাম লাগাতে পারলো না... এমনসময় দরজায় নক করে কেউ...

আদর্শ : রাহী !!! এই রাহী !!! দরজা খোলো...

শ্রদ্ধা : (আৎকে উঠে) এ কি !! ও তো চলে এলো... এবার আমি কি করব !!!

আদর্শ : (একটু উদ্বিগ্ন স্বরে) এই রাহীইইইই !!! দরজা খোলো... ঠিক আছো তুমিই !!!

শ্রদ্ধা কোনোরকমে গায়ে আঁচড়টুকু টেনে পিঠটা ঢেকে দৌড়ে দরজা খুলে জোর করে একটা ক্যাবলার মতো হাসি হাসে... আদর্শ তার হাসি দেখেই বোঝে, শ্রদ্ধা কোনো সমস্যায় আছে...

আদর্শ : Any Problem !!

শ্রদ্ধা : নাহহহ... আম... আমি যাই... গিয়ে জজ... জলখাবারটা নিয়ে আসি তোমার...

আদর্শ : ঠিক আছে, আমাকে ঘরে ঢুকতে তো দাও...

শ্রদ্ধা : অ্যাঁ... হ্যাঁ... হ্যাঁ... দিভাই, ছুটকি এদের দেখছো গো !!

আদর্শ : (শ্রদ্ধার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে মনে মনে) আচ্ছা রাহী, দিভাই ছুটকি এদের সাথে সমস্যা ভাগ করা যায়... আমাকে বলা যায় না, তাই না !!! আমি এতটাই দূরের !!! এতটাই পর !! কালিদাস বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন, 'মানুষেরা এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, পরষ্পরের মধ্যে অপরিমেয় অশ্রুলবনাক্ত সমুদ্র'... আচ্ছা, আমি আর তুমিও কি বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপ, আমাদের দুজনের মধ্যে কেবল অপরিমেয় অশ্রুলবনাক্ত সমুদ্র !!!

"মেঘমন্দ্র শ্লোক

বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

রাখিয়াছে আপন স্তরে স্তরে

সঘন সঙ্গীত মাঝে পুঞ্জিভূত করে..."

শ্রদ্ধা : জানো !!

শ্রদ্ধার প্রশ্নে চিন্তার ঘোর কাটে আদর্শের...

আদর্শ : নাহহহ... কাউকেই দেখি নি...

শ্রদ্ধা : ওহহহ...

কথাগুলো বলতে বলতে আদর্শ নিজের T-shirt টা খুলে শুধু Vest Shirt-টা পড়ে খাটে একটু বসে থিতানোর জন্য... চুপ করে দেখতে থাকে শ্রদ্ধা ঘরের বারান্দাতে নিজের ভিজে খোলা চুল পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে তোয়ালে শুকাতে দিয়ে ঘরে আয়নার সামনে এসে আদর্শের নামের সিঁদুরে নিজের সিঁথি রাঙাচ্ছে... ঠিক যেন 'যক্ষের অলকা' ফুলের মৃদু হৃদয়ের রমনী, যে কি না বেঁচে থাকে শুধু তারই প্রতিক্ষার দিন গুনে ... শ্রদ্ধার এই সদ্যস্নাত স্নিগ্ধ কোমল রূপের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে আদর্শ... বসন্তের আগমনেও যেন বর্ষার কাদম্বরী মেঘ আদর্শের অজান্তেই তার মনে প্রেমের উদ্রেক করে... সেই প্রেম কেবল আদর্শের হৃদয়কে সিক্ত করে এমন নয়, চেতন-অচেতন জ্ঞানরহিত আদর্শের শরীরও যেন কল্পিত পুষ্পার্ঘ্যে তার প্রিয়াকে আহ্বান করতে চায়... হঠাৎই অসাবধানতাবশতঃ শ্রদ্ধার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে তার আঁচল খসে পড়ে...

আদর্শ মোহাবিষ্টের মতো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে শ্রদ্ধার কাছে, ঠিক যেন গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে শ্রদ্ধার স্খলিত আঁচল আদর্শকে আমের বনের ছায়া দিয়ে দীর্ঘপথ একাকী ভ্রমণের শ্রান্তির বিদুরণ ঘটাবে... একে একে শ্রদ্ধার পিঠের সব বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলে আদর্শ...

'চুম্বন মাগিব যবে ঈষৎ হাসিয়া,

বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,

উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ মুখ,

রেখো ওষ্ঠাধর পুটে....'           (কবিগুরু, 'মানসসুন্দরী')

এরপর আদর্শ শ্রদ্ধাকে নিজের ঘর্মাক্ত পুরুষালী বুকে টেনে নেয়... শ্রদ্ধার ঠোঁটখানি কেঁপে ওঠে, আয়নাতে উৎসুক আঁখিজোড়া ক্ষণিকের জন্য আদর্শের অন্তরে যেন সেই প্রেমের দূতস্বরূপ কাদম্বরী মেঘের সন্ধান করে... দেখে আদর্শের চোখে ধ্বনিত হচ্ছে অতলস্পর্শী এক বিরহ যা শ্রদ্ধার চোখ থেকেও অশ্রুধারা বর্ষিত করতে থাকে... আজ ঠিক যেন শ্রদ্ধার মন্দিরের দেবদাসীদের মতো বিরহ শ্রান্ত দেহতনু আদর্শের প্রেমের বর্ষাবারির সস্নেহ চুম্বন লাভের অপেক্ষায়, ঠিক যেমন বিরহখিন্না শীর্ণ অগভীর জলধারাগুলো বর্ষার মেঘের পথ চেয়ে থাকে... আদর্শ এক হাতে শ্রদ্ধার উন্মুক্ত জঠর আবৃত করে অন্য নরম হাতে শ্রদ্ধার শিথিল কেশরাশি সরিয়ে তার বিরহিনী প্রিয়ার কেশের জলধারায় সিক্ত গ্রীবায় গহীন অধরস্পর্শ করে... শ্রদ্ধা প্রেমাসিক্তা হয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে... আদর্শ শ্রদ্ধাকে তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়, ঠিক যেন উভয়ে উভয়ের সমাহারে প্রদীপ্ত, প্রাণবন্ত - পৃথিবীর মর্ত্যধামে স্বর্গের বিন্দুখানিক এসে পড়ে তাদের ভালোবাসার, তাদের পরস্পরের সমর্পণের মূহুর্ত রূপে... আদর্শের হাত তরঙ্গের ন্যায় ক্রমে উঠে এসে স্পর্শ করে শ্রদ্ধার স্তনতট, ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন বিদ্যুত ক্ষরিত হয়... আদর্শ নিজেকে সংযত করে শ্রদ্ধার থেকে একটু সরে আসে... তারপর শ্রদ্ধাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর অলক-কুমকুমে আবার অধর স্পর্শ করে... এরপর আদর্শের অধর ধীরে ধীরে শ্রদ্ধার কপাল, আঁখিপল্লব, কপোল পেয়ে শ্রদ্ধার অধরের কাছে এসে থেমে যায়... ধীরে ধীরে চোখ খোলে আদর্শ... ক্ষণিক দুই হাতের অঞ্জলিতে শ্রদ্ধার মুখখানি তুলে ধরে প্রেম-পিয়াসী নয়নে শ্রদ্ধার কম্পিত অধরের সুধা পান করে... তারপর শ্রদ্ধার কানে কানে বলে,

আদর্শ :

'গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা,

তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সঙ্গম,

দুইটি তরঙ্গ উঠে প্রেমের নিয়মে,

ভাঙ্গিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে'     (কবিগুরু, 'চুম্বন')

শ্রদ্ধা :

'উদ্ভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত বারংবার,

তুমি এসো স্নিগ্ধ অশ্রুপাতে দগ্ধ বেদনা 'পরে'

                                  (কবিগুরু, চিত্রা 'জ্যোৎস্নারাত')

আদর্শ :

'ধীরে ধীরে হৃদয়ের গ্রন্থি তব খুলিব প্রেমের গৌরবে'

এবার শ্রদ্ধা বড় বড় করে চোখ মেলে তাকায়... এত দিনের চেনা আদর্শকেই বড় অচেনা বলে মনে হয়... আদর্শ মানেই সংযম, আদর্শ মানেই কঠোরতা... তাই আজ চিরচেনা মানুষটাকেই গণ্ডির বাইরে ঈষৎ লাগামছাড়া হতে দেখে অবাকই লাগে শ্রদ্ধার... কি হলো হটাৎ আজ !!! যোগী মানুষ নিজেকে সংসারের লক্ষণ রেখায় বাঁধতে চাইছে !! তবে কি যে সময়টার জন্য ওর এতদিনের প্রতীক্ষা তা আসতে চলেছে ?? নিষ্পত্তি হতে চলেছে এই অনন্ত অপেক্ষার !! জানা নেই শ্রদ্ধার... তাই একটু দ্বিধাগ্রস্থ অবাক গলায় আদর্শের বুকের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে বলে ওঠে,

শ্রদ্ধা : চিত্রাঙ্গদা !!! কি হয়েছে আজ তো !!!

আদর্শের আঙুল এসে শ্রদ্ধার ঠোঁটের উপর নামে, চোখের ইশারায় কথা বলতে বারণ করে... আজ যে এক অশান্ত ঢেউ উঠেছে আদর্শের বুকের ভিতরেও... তার এতদিনের নিয়ম, সংযমের বেড়াজাল যে এবার ছিন্ন হতে চলেছে, বলাবাহুল্য সে নিজেই এই জাল ছিন্ন করতে চাইছে... শুধু যে নিজের কারণে তা নয়, শ্রদ্ধার কারণেও... মেয়েটাও যে বড্ড কষ্ট,উপেক্ষা পেয়েছে আদর্শের কাছ থেকে, যা বোধ হয় ওর পাওয়ার কথা ছিল না.. তাই তো আজ এই আত্মসমর্পণ... প্রেমিকের সুরে তাই বলে ওঠে,

আদর্শ : আজ স্থির করেছি, তোমার থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নেব...

শ্রদ্ধা কথা বলতে চায়, কিন্তু পারে না.. বন্দিদশার জন্য... অবাক চোখে চেয়ে থাকে শুধু, চোখের পাতা পড়ে না..

শ্রদ্ধা : উম.. ম..ম... উমমমম...

আদর্শ : নাহহহ... আজ যে আমার দিন রাহী... নগ্ন পায়ে এতটা পথ একা হেঁটে এসেছি রাহী... প্রতি রাতে যার ভেজা চুলের গা হতে ভেসে আমার প্রশ্বাস বায়ু নিয়ে আজো প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে যাই তার উপস্থিতিময় গোধুলিবর্ণ স্বপ্নগুলো দেখব বলে, অথচ তার ভালোবাসার স্বপ্নগুলো আমারই অবহেলার সর্বোচ্চ মুকুট পরিধান করে শুষ্ক, রুক্ষ্ম হয়ে পড়ে আছে... আজ তোমার কাছে ভিক্ষে চাইতে এসেছি রাহী, 'তোমার অন্তরে ঠাঁই দাও'...

হতভম্ব শ্রদ্ধা অপলকে কিছুক্ষণ আদর্শের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপরেই ঠুকরে কেঁদে উঠে আদর্শের বুকে মুখ গুঁজে দেয়... আদর্শ তার প্রাণভ্রোমরাকে নিজের হৃদমাঝারে আঁকড়ে ধরে বলে,

That I want thee, only thee

let my Heart repeat without End...

All Desires that distracts me, Day and Night...

Are False and Empty to the Core....

                         

                             (Only Thee, Gitanjali, Kobiguru)


জলজোছনা :

--------------------

শ্রদ্ধার কান্না থামিয়ে আদর্শ শ্রদ্ধার চোখ মুছিয়ে দিতেই দরজার খুট করে একটা ছোট্ট শব্দ হয়... শ্রদ্ধার কানে সেই আওয়াজ না গেলেও আদর্শ তা ঠিকই শুনতে পায়... শ্রদ্ধাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে খুব সন্তর্পনে গিয়ে অকস্মাৎ দরজা খুলতেই সংস্কার, শ্রেষ্ঠা আর সম্প্রীতি হুড়মুড়িয়ে এসে আদর্শের গায়ে এসে পড়ে... আদর্শ কঠিন মুখে তার ভাই-বোনকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে ধমকের সুরে বলে ওঠে,

আদর্শ : কোনো কাজকর্ম নেই না তোদের !! সকাল সকাল দরজায় আড়ি পাতছিস...

শ্রদ্ধা চোখের জল মুছতে মুছতে ফিক করে হেসে ফেলে... এই দলের সদস্যা হবার দৌলতে সে খুব ভালো করেই জানে, যার আঙ্গুলিহেলনে এই কার্যটি হচ্ছিল- তিনি এখানে উপস্থিতই নেই...

সংস্কার : আ... আ... আ... আড়ি !!! আড়ি কেন পাততে যাব দাভাই... আমরা তো তোদের দু'জনকে খেতে ডাকতে এলাম...

আদর্শ : খেতে ডাকতে !!! মানে আমাদের দু'জনকে খেতে ডাকতে তোরা তিনজনে এলি !!! আমাকে কি তোদের মতো গর্দভ পেয়েছিস !!!

শ্রেষ্ঠা : দাভাই !!! তুমি আমাদের গাধা বললে !!!

শ্রেষ্ঠা ঠোঁট ফুলিয়ে কথাগুলো বলে...

আদর্শ : নাটক করবি না শ্রী... একদম নাটক করবি না... সব ক'টার কানগুলো ধরে কষিয়ে মুলে দিতে ইচ্ছে করছে... (ধমকে) দেবো ??

আদর্শের বকুনিতে সবাই একবার চমকে উঠলো... ছুটকি ঠোঁট ফোলায় বাচ্চাদের মত...

সম্প্রীতি : দাদভাই.. ই.. ই.. This is not Fair.. তুই শুধুই আমাদের বকিস... কি করেছি আমরা ?? কি করেছি ?? হ্যাঁ.. তুই সবসময়ই এমন শেয়াল পণ্ডিত সেজে থাকিস কেন রে !! আমরা কোথায় তোর ছোট্ট ছোট্ট কতগুলো ভাইবোন !! হুমম !!! আর তো... তোকে কে বললো যে, আমরা তোদের শুধু ডাকতে এসেছি !! আমরা আমাদের দাবী জানাতে এসেছি... আমাদের দাবী কিন্তু মানতে হবে...

সংস্কার : (মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে নাড়তে নাড়তে) হ্যাঁ, মানতে হবে... মানতে হবে... আমাদের দাবী মানতে হবে... ছুটকি, Feeling "ভোট ভোট"... By the Way, দাবিটা কি !!

আদর্শ : ছুটকি !!! বড্ড পাকা পাকা কথা হয়েছে আজ কাল... আর ভাই, এত নাটক তোরা করতে পারিস যে কি বলবো !! আর শ্রেষ্ঠা, তোর কি ব্যাপার !! তুইও আজকাল এদের দলে যোগ দিয়েছিস !! নাহ্, তোদের সব ক'টাকে থিয়েটারে ভর্তি করে দিলে একেক জন নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রী হতিস কিন্তু..

একটা মুচকি হাসি দেয় আদর্শ...

সম্প্রীতি : শোন, বাজে কথা বলা বন্ধ করে কাজের কথাটা কি কেউ শুনবি Please ?? আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাচ্ছি..

ছুটকির এই আদুরে রেগে যাওয়া দেখে শ্রেষ্ঠা আর শ্রদ্ধা দুজনেই দুপাশ থেকে ছুটকিকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে...

সংস্কার : ওরে বাবা রে !!! দাভাই.. ই.. ই আমি কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছি... বাঘিনী ক্ষেপেছে আর রক্ষে নেই... এবার সবার ঘাড় মটকালো বলে...আমি বরং লুকোই তোর পেছনে !!

ভাই বোনের কাণ্ডকারখানা দেখে আদর্শ এবার সকলের সাথে জোরেই হেসে ফেলে কারন সে খুব ভালো করেই জানে এদের সবার এখানে একত্রিত হবার আসল কারন...

সম্প্রীতি : কর !! কর !! এই সবই কর... আসল কথাটা আর কারোরই মনে নেই.. তা থাকবে কেন !! আমি কে হই তোদের !! একটুও ভালবাসিস না আমায় তোরা.. হূহঃ !! আচ্ছা, দাভাই আমার কুড়ি বছর বয়স হবে এই জন্মদিনে... তোদের কারোর মনে আছে সেটা !! জন্মদিনে আদরের ছোট বোনটাকে কিছু দিতে হয় জানিস !!!দাভাই, বলতো তুই আমায় কি Gift দিবি ?? বল... বল !!

আদর্শ সংস্কারকে ছেড়ে দুই হাতে তার আদরের বোনকে নিজের বুকে আগলে টেনে নিয়ে স্নেহভরা নরম গলায় বলে,

আদর্শ : কি উপহার চাস বল !!! তোকে অদেয় তোর এই দাভাই-এর কিছুই নেই...

সম্প্রীতি : সত্যি বলছিস !! ভেবে বলছিস তো !!

সংস্কার : এই দাভাই, আব্দার কিন্তু বিপদসীমা লঙ্ঘন করছে, খুব সাবধান... এই তোর দাবীটা কি রে !!!

সম্প্রীতি : এই ছোড়দাভাই, তুই তোর নিরেট মাথাটা একটু কম ব্যবহার কর, Please...

সংস্কার : I... N... S... U... L... T... অপমান !!!

শ্রেষ্ঠা : এই তুমি চুপ করো না !!! ছুটকি, তুই আগে দাবীটা জানা তো !!!

সম্প্রীতি : দেখ দাভাই, আমি আর কতদিন বাড়ির সবথেকে ছোট থাকবো বল তো !! এবার একটা Twinkle Twinkle Little Star তো আসুক...

কথাটা বলেই ছোড়দাভাই-এর দিকে তাকিয়ে চোখ মারে ছুটকি... ওপাশ থেকে উত্তর আসে Thumps Up-এর মাধ্যমে, মানে ওদের এখানে আসার পরিকল্পনা সফল...

আদর্শ : মানে !!! এ আবার কেমন দাবী !!!

আদর্শ হঠাৎই দেখে শ্রদ্ধার গোটা মুখ লজ্জায় রাঙিয়ে গেছে, আর উপস্থিত সকলে মুখ টিপে হাসছে... এ যেন ভারী আনন্দের কথা... কিন্তু ধুররর... সে তো তখনো এই কথার অর্থ অনুধাবন করে উঠতে পারে নি....

নেপথ্যে : হবে তো ছুটকি, তোমার ইচ্ছে অবশ্যই পূর্ণ হবে... এই বংশের প্রথম বংশধর অবশ্যই আসবে, এই বংশের বড় ছেলের হাত ধরে, আমার শ্রী-র কোল জুড়ে...

সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখে শ্রদ্ধার মামীমা লতিকা এসেছে... আদর্শ আড়চোখে দেখে, আদর্শের অপমানের যন্ত্রণাতে শ্রদ্ধার মুখের রঙ মূহুর্তেই বদলে কালো হয়ে গেল... কিন্তু আদর্শ যথেষ্ট স্থিতধী... সবচেয়ে বড় কথা, সে চায় না তাদের জীবনের নব প্রত্যুষে যে ভোরাই-এর সুর বেজেছে, তার তাল কেটে ছন্দপতন ঘটুক... তাছাড়া ডাক্তাররা বারবার বলে দিয়েছে, শ্রদ্ধাকে ভীষন যত্নে রাখতে, কারণ শ্রদ্ধার আঘাত Heart-এর খুব কাছেই লেগেছে... শ্রদ্ধা এখন ভালো থাকলেও যে কোনো ছোট থেকে ছোট আঘাত তার ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হতে পারে...

আদর্শ : আপনি !!! শ্রী, রাহী- তোমরা গিয়ে সবার জলখাবারের ব্যবস্থা করো... আর বাবিন আর ছুটকি- তোরা গিয়ে ঠাম্মির কাছ থেকে পুজোতে কি কি লাগবে সব কিছু জেনে নে... জলখাবার খেয়েই আমরা পাঁচজনে বাজারটা করে নিয়ে আসব...

লতিকা : পাঁচজনে !!! না না... রাহী গেলে কি করে হবে !!

শ্রেষ্ঠা : কেন !! রাহীর যেতে অসুবিধাটা কোথায় !!!

লতিকা : ও মা !!! বেয়ানকে হাতে হাতে এগিয়ে কে দেবে !!! তুই আর জামাই বরং ঘুরে আয়... কাল সরস্বতী পুজো... কেমন কেমন প্রেম প্রেম ভাব চারিদিকে... তোরা একটু আনন্দ করবি না !!! এই তো আনন্দ করার বয়স রে...

শ্রেষ্ঠা : মা, তুমি কেন ভুলে যাও বলো তো- আজ পিপির জন্যই আমি আর তুমি বেঁচে আছি... যেদিন আমি হলাম, পিপি এক মূহুর্তের জন্যও নিজের কথা, নিজের গর্ভের সন্তানের কথা না ভেবে তোমার পাশে ছিল... সেই ঝড়ের রাতে কোনো দাই পাওয়া যায় নি মা... শুধু পিপি নিজের পরিশ্রমে আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল... যার দাম পিপিকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল... আমার এই বোনটা এক মূহুর্তের জন্যও মায়ের বুকের ওমটুকুও পায় নি, এই শুধু আমি এই পৃথিবীতে আসব বলে...

শ্রদ্ধা : থাম না দিভাই... এইসব কথা বলে কেন আমায় অপরাধী করিস !!! আজ আমার মা থাকলেও হয়তো এমনটাই ভাবতো... সে যখন নেই...

শ্রেষ্ঠা : পিপি না থাকলেও তোর দিভাই তো আছে... আমরা একসাথে জন্মেছি, একসাথে বড় হয়েছি... আমার জীবনের একটা মূহুর্ত নেই, যেখানে তুই জড়িয়ে নেই... আর যদি আজ আমার আর বোনের মধ্যে কোনো একজনকে ঘরে থাকতে হয়, তাহলে আজ আমি কাম্মার সাথে ঘরে থাকব... কিন্তু বোন আজ দাভাই-এর সাথে যাবে...

আদর্শ : (ঋজুস্বরে) শ্রী.... আমি যখন বলেছি আমরা সবাই যাব, তখন সবাই মিলেই যাব... ছুটকি, তুমি আর রাহী গিয়ে রান্নাগুলো তাড়াতাড়ি সামলে নাও... আর আজ দুপুরে আমরা পাঁচজনে বাইরে খাব... তারপর Airport-এ আমার এক বন্ধুকে আনতে যাব- 'আয়ান'... ও আমাদের সরস্বতী পুজো দেখবে বলে কাশ্মীর থেকে আসছে... কথা বাড়িও না... কথায় কিছু বাজে কথা বাড়ে... আর আনন্দের মূহুর্তগুলো নষ্ট হয়... যাও...


প্রিন্সেপ ও বাগবাজার ঘাট :

------------------------------------------

একে একে সব কেনাকাটা সেরে আদর্শরা Airport থেকে আয়ানকে নিয়ে গঙ্গার প্রিন্সেপ ঘাটে যায়... সুন্দর বাঁধানো ঘাট, বিকেল বেলা দ্বিতীয় হুগলি সেতুর পাশ দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে সত্যিই সুন্দর লাগে... আদর্শ তারপর আজানকে দেখায় জেমস প্রিন্সেপ মনুমেন্ট- এই মনুমেন্টের থামগুলো এমনভাবে দাড়িয়ে থাকে যেন তারা অনেক না বলা গল্প জানে...

সূর্যাস্ত দেখার পর তারা যায় বাগবাজার ঘাটে... শ্রেষ্ঠার কাছ থেকে আদর্শ শুনেছে শ্রদ্ধার সমুদ্র বড় প্রিয়... এই মূহুর্তে সাগর দেখানো সম্ভব নয় বলেই আদর্শ শ্রদ্ধাকে গঙ্গার ঘাটে ঘুরতে নিয়ে এসেছে... মেঘলা আকাশ, হালকা হাওয়াতে শ্রদ্ধার খোলা চুলগুলো অল্প অল্প উড়ছে... সবাইকে এগিয়ে যেতে দিয়ে আদর্শ তার একটা আঙুল দিয়ে শ্রদ্ধার একটা আঙুল জড়িয়ে ধীর পায়ে হাটতে থাকে... কিছু মানুষ হাঁটতে বেরিয়েছে- তারা এই শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরিহিত যুগলের স্নিগ্ধ মূর্তি দেখে নিজেদের চঞ্চল মনকে শান্ত করছে... দূরে কিছু নৌকা দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যেবেলায় পাখিরা তাদের ছোট্ট নীড়ে ফিরছে... একটা মাছরাঙা পাখি ক্ষণিক এই যুগলকে দেখে আবার মাছের সন্ধানে লেগে পড়লো... চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু জলের ছপাত ছপাত আওয়াজ হচ্ছে... গঙ্গায় তখন জোয়ার এসেছে, কচুরিপানার দল ভিড়েছে ঘাটে, সিঁড়িগুলোও তখন জলে ডুবে গেছে... শ্রদ্ধা আস্তে করে সিঁড়ির কাছে একটা হাতে গঙ্গার জল ছোঁয়... কারণ, তার অপর হাত আদর্শের বলিষ্ঠ, শক্ত হাতের মুঠোবন্দী... শ্রদ্ধা আর আদর্শ ক্ষণিক যোগ দেয় ঘাটগুলোর বহু না বলা গল্পের দলে... এমনসময় বাকিরা এসে যোগ দেয় ওদের সাথে...

আদর্শ : জানো আজান, এই নদীটা আসলে গঙ্গার শাখা নদী হুগলি... মূল ধারা পদ্মা নামে বাংলাদেশে বয়ে গেছে... কিন্তু আমরা একে হুগলি নদী বলি না, আমরা তার 'গঙ্গা' নামটা বলতেই বেশি পচ্ছন্দ করি... এই নদী ইংরেজদের বড় বড় জাহাজ, নৌকা থেকে বর্তমানের লঞ্চ, পুলিশ Speedboat সব দেখছে... সেই সঙ্গে কলকাতার সব গঙ্গার ঘাট তার অসংখ্য না বলা গল্পের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে... তাদের নিজেদের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তারা কি সেইসব গল্প কখনো ভুলতে পেরেছে !!! ঠিক আমাদের জীবনের মতো, তাই না আজান !!! নদী তো আমাদের জীবনের কথাই বলে...

আজান : কি জানি বড়ভাই, হয়তো দেড়শ বছর আগেও এই দেশ স্বাধীন করার জন্য এই গঙ্গার ঘাটেই বসে কত পরিকল্পনা করেছি... কে বলতে পারে বলো !! জানো বড়ভাই, অভয়াঙ্কর স্যারের একটা মেয়ে আছে...

আদর্শ : কি বলছো ইনায়ৎ !!!

আজান : হ্যাঁ... আমি সেদিন স্যারের ঘরে গিয়েছিলাম ওই ঐশ্বরিকার Case-টা নিয়ে... স্যার কেন জানি সেদিন খুব Drink করেছিলেন !! আমাকে বললেন, উনার পাপ ওনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়... উনি চেয়েছিলেন, ওনার তোমার মতো পুত্রসন্তান হোক, যে কি না তার শৌর্য্যের ধ্বজা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে... তাই উনি তোমাকে আমাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন... কিন্তু, এতে তার পাপস্খলন তো হয় না, তাই না !!! তার স্ত্রী তার কন্যাসন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান... স্যার ওনার স্ত্রীকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন... তাই যার আগমনে তাকে তার স্ত্রীকে হারাতে হয়েছিল, তিনি তার মুখ দেখতে চান নি... তার মনে হয়েছিল, তার সন্তান 'অপয়া, অলক্ষ্মী, রাক্ষসী'... একে জন্মের সময়ই তার মাকে হারায়, তার উপর কন্যাসন্তান হবার অপরাধে তিনি সেই নবজাতককে ত্যাগ করেন... আজ লজ্জায়, পাপবোধে চাইলেও সেই সন্তানের মুখোমুখি তিনি দাঁড়াতে পারেন না... কিন্তু বয়সের ভারে তার বড্ড সাধ হয়- একবার তার Princess-এর মুখে 'বাবা' ডাক-টা শোনার জন্য... কিন্তু, তার কোনো অধিকার নেই তার সন্তানের জীবনে পদার্পণ করার... তিনি নিজ দোষে সব হারিয়েছেন...

আদর্শ : কি বলছো ইনায়ৎ !! আমি তো ভাবতেই পারছি না...

আজান : ভাবিজানের বিপদ হতে পারে শুনে কেমন পাগল পাগল করতে লাগলেন !!! এত স্থিতধী আমাদের স্যার, কিন্তু এই খবরটা শুনে কেমন যেন তার সব আত্মসংযম হারিয়ে ফেললেন... তার কোনো অনুভূতিই যেন তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না...

আদর্শ : হ্যাঁ, শ্রদ্ধার প্রতি ওনাদের স্নেহসুধাটা আমিও অনুভব করি... হয়তো শ্রদ্ধার মধ্যে উনি নিজের সন্তানের ছায়া দেখতে পান... ওনার মধ্যে বরাবরই দেশপ্রেমের মতো পিতৃত্ববোধটাও অত্যন্ত প্রখর- সে আমি হই, তুমি হও কি শ্রদ্ধা !!!

সম্প্রীতি : এই কি রে দাভাই !! যেই বন্ধুকে পেলি, ওমনি আমাদের ভুলে গেলে বল... খালি বন্ধুর সাথেই কথা বলে যাচ্ছিস... এই রাহী, একটা গান ধর তো...

শ্রদ্ধা : আমি !!

সম্প্রীতি : হ্যাঁ... তুই... আর এমনভাবে ধর যাতে দাভাই-ও গান ধরতে বাধ্য হয়...

আদর্শ সবার অলক্ষ্যেই ধীরে ধীরে শ্রদ্ধার অঞ্জলির উপর নিজের অঞ্জলি রেখে একটু মৃদু উষ্ণতা সঞ্চারিত করে...

শ্রদ্ধা :

তোমার দেবালয়ে কি সুখে কি জানি

দু’লে দু’লে ওঠে আমার দেহখানি

আরতি-নৃত্যের ভঙ্গীতে, সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।

অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে

প্রদীপ-শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম

তোমায় হে সুন্দর, বন্দিতে সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।

আদর্শ :


পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল

গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।

 

তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত

লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো

তোমার পদতলে রঞ্জিতে, সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance