অন্তরালে (পর্ব ৭)
অন্তরালে (পর্ব ৭)
(সমাপ্তি থেকে যেখানে ভালোবাসার সূচনা)
জলজোছনা :
---------------------
দীর্ঘদিনের অভিযানের ক্লান্তি থেকে আদর্শ পরেরদিন আর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে পারে নি... সকালে তার ঘুম ভাঙে শ্রদ্ধার হাতের নরম স্পর্শে... আদর্শ ঘুমিয়ে আছে ভেবে শ্রদ্ধা পরম মমতায় তার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে... আদর্শের বড্ড ইচ্ছে করছে নরম চোখে শ্রদ্ধাকে দেখতে, শ্রদ্ধার হাতটা নিজের বুকে আঁকড়ে একটু শুয়ে থাকতে... কিন্তু চোখ খুললেই যে তার অভিমানিনী ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেবে... তাই আর চোখ খোলা হয় না আদর্শের... ওষুধের প্রভাবেই শ্রদ্ধা বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না, ধীরে ধীরে তার চোখ মুদে আসে আর হাত লুটিয়ে বিছানাতে পড়ার আগেই আদর্শ তার নরম হাতটা নিজের মুঠোবন্ধ করে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে... শ্রদ্ধা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন... এখনো শ্রদ্ধার চোখের নীচে জলের ধারা তার চিহ্ন রেখে গেছে...
যে আদর্শ একদিন তার এই জীবনের সাথে শ্রদ্ধাকে জড়াতেই চাইত না, আজ সেই আদর্শ শ্রদ্ধা তাকে ছেড়ে চলে যাবে- সেই ভাবনাটাই এক মূহুর্তও ভাবতে পারে না... একমাত্র ভালোবাসাই পারে মানুষকে নতুন পথের হদিস দিতে... এইভাবেই জীবনের অন্ধকারগুলো আলোর হদিস পায় স্নেহের স্পর্শে, ভালোবাসার স্পর্শে... শুধু দরকার লাগে একটা ভালোবাসার হাতের, তাহলেই একজন মানুষ জীবনের সব প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হতে পারে... হয়তো এইভাবেই হয় আত্মার পরিবর্তন... এইভাবেই রত্নাকররা যুগে যুগে বাল্মীকি হয়...
ঠাম্মির জেদাজেদিতে বহুদিন পর শ্রদ্ধা আদর্শের সাথে সরস্বতী পুজোর কেনাকাটা করতে বেরতে রাজি হয়েছে... হয়তো আদর্শের সান্নিধ্যের উষ্ণতা আর ঠাম্মির সেবা, পরিচর্যা ও ভালোবাসায় ধীরে ধীরে অভিমানের মেঘ সরিয়ে আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরেছে নিষ্প্রাণ, জড়বৎ পাথরের প্রতিমায়... সন্ধ্যেবেলায় Fresh হয়ে বেরিয়ে আদর্শ দেখে শ্রদ্ধা নিজের ঘরে নেই... খুঁজতে খুঁজতে দেখে ঠাম্মির ঘরে ঠাম্মির কোলে শুয়ে আছে শ্রদ্ধা...
শ্রদ্ধা : বলো ঠাম্মি, এই List মিলিয়ে সব কিনে আনলেই হবে তো !! আর কিছু লাগবে !!!
ঠাম্মি : গোটা রাস্তা দুটিতে মিলে ঝগড়া করো না যেন !!!
শ্রদ্ধা : আমি ওনার সাথে ঝগড়া করার কে হই, বলো তো !!!
ঠাম্মি : আজ তোকে আদির সম্পর্কে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, দিদিভাই !!
শ্রদ্ধা : বলো !!!
ঠাম্মি : আদি মাঝে মাঝেই কোথায় চলে যায়, কিছু বলে তোকে !!!
শ্রদ্ধা : না ঠাম্মি... কিছুই বলে না...
ঠাম্মি : (একটু যেন আনমনেই) দিদিভাই, ভালোবাসিস আমার দাদুভাইকে !!
শ্রদ্ধার চোখ থেকে দু'ফোটা বৃষ্টি ঝরে পড়ে...
শ্রদ্ধা : ঠাম্মি, উনি কোনোদিনই চান নি যে ওনার জীবনের সাথে আমাকে জড়াতে... তাও দয়া করে আমাকে... সেখানে এইসব অনুভূতি অবান্তর, ঠাম্মি... আর যদি আসেও, সেটাও এক তরফাই হবে...
ঠাম্মি : না রে দিদিভাই... জানিস কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “প্রেম হল ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন”... আদি একদম ওর বাবার মতো...
ঠাম্মির মুখ থেকে নিঃসারিত শব্দগুচ্ছ শুনে আদর্শ আর শ্রদ্ধা একসাথে চমকে ওঠে... আদর্শ একটু টলে যায়, কোনোরকমে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়... বোঝে, আজ তার পরীক্ষার দিন... শ্রদ্ধা ঠাম্মির কোল থেকে উঠে ঠাম্মির মুখোমুখি হয় আদর্শের জীবনের সত্যের সম্মুখীন হবার জন্য... বাইরে যতই দূরত্ব থাক, তাদের অন্তর যে একসূত্রেই বাঁধা...
শ্রদ্ধা : ঠাম... ঠাম্মি !!! তুমি আদির পরিচয় জানো !!! তাহলে এতদিন ওকে 'আশ্রিত'-র পরিচয়ে অবহেলিত হতে কেন দিলে !!!
ঠাম্মি : আদির জন্য... আদির সুরক্ষার জন্য... তুই আর আদি যে এক আত্মা, এক প্রাণ দিদিভাই... ওর সবটা জানার অধিকার শুধুমাত্র তোর... এই কথাটা ভুলেও আর কোথাও উন্মোচিত করবি না... কখনো... কোনোদিনও... নিজের প্রাণের, নিজের সর্বস্ব দিয়ে হলেও আদিকে তুই সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করবি... তোর ভালোবাসার শক্তি, আঁচলের ওমের থেকে যেন আদিকে কখনো সরিয়ে দিবি না... কথা দে দিদিভাই... আগে এই বুড়ি ঠাম্মিকে কথা দে...
শ্রদ্ধা : (কান্নাভেজা গলায়) ঠাম্মি, আমি তোমার আদিকে Divorce দেবার কথা হয়তো বলেছিলাম... কিন্তু সেটা শুধুই ওর মুক্তির কথা ভেবে... Divorce হয়ে গেলে হয়তো আমি নিজেকে শেষ...
আর বলতে না পেরে ঠাম্মিকে জড়িয়ে তাকে নিজের বাঁধভাঙা আঁখিধারায় প্লাবিত করে দেয়... এই মূহুর্তটা ছিল আদর্শের জন্য আরেকবার চমকে ওঠার মূহুর্ত, কি ভয়ানক চিন্তন নিজের মনের ভেতর বপন করছিল এই মেয়েটা.... ঠাম্মির আদরে শ্রদ্ধার কান্নাটা একটু কমলে শ্রদ্ধা তার দুই হাতের মধ্যে ঠাম্মির মুখটা তুলে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলে,
শ্রদ্ধা : ও ঠাম্মি, কিন্তু তুমি কেন বলছো যে আদির সুরক্ষার জন্যই সব গোপন করতে হয় !!! বলো না, ঠাম্মি !!! আদির কি কোনো বিপদ আছে !!!
ঠাম্মি : শোন রাহী দিদিভাই, জন্ম থেকেই তোরা দু'জনেই বড় অভাগা রে... অভিশাপ যেন তোদের প্রতিপদে পথরোধ করে দাঁড়ায়... তবে তোদের ভালোবাসার জোরকে এতটাই মজবুত করতে হবে, যাতে তোদের ভালোবাসার জোরের কাছে অভিশাপের জোর হেরে যায়...
শ্রদ্ধা : পারব ঠাম্মি... আদির জন্য সব পারব আমি... পারতে আমাকে হবেই...
ঠাম্মি : আদি অনাথ নয়, বরং এই বংশেরই প্রথম বংশধর দিদিভাই... আমার প্রথম সন্তান দিগম্বরের শেষ চিহ্ন আমার আদি... আদর্শ ব্যানার্জি..
ঠাম্মির কথায় চমকে ওঠে আদর্শ... অজানা সত্যের ধাক্কায় কেঁপে ওঠে আদর্শ... মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করা মেঘনাদ-রূপী মেঘদূত-ও আজ সত্য-মিথ্যের অসম লড়াই-এ ভারসাম্য হারায়... পড়ে যেতে গেলে বারান্দায় থাকা আলমারির গায়ে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়...
আদর্শ : (মনে মনে) এইসব কি বলছে ঠাম্মি !! কি বলছে !! আমি অনাথ নই !! এই... এই ব্যানার্জি পরিবারের সন্তান !! সত্যিই কি এই পরিবারেরই রক্ত বইছে আমার শরীরে !! তবে সবাই যে বলে আমি নাকি অনাথ !!! আড়ালে হয়তো অবৈধ-ও... এইগুলো তাহলে সব মিথ্যে !!! সব... ব... ব...
ঠাম্মি যে কখনো এমন কিছু বলতে পারে তা স্বপ্নেও এক মূহুর্তের জন্যও ভাবে নি আদর্শ আর শ্রদ্ধা... আদর্শ যে সবার থেকে আলাদা সেটা ও ছোট্টবেলা থেকেই বুঝতো শ্রদ্ধা... অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করা, কারোর সমস্যায় নিজের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া আদর্শ খানিকটা ওই রবিনহুডের মতো... সাধারন মানুষদের কাছে ভগবানের মতো আর অসাধুদের কাছে যমরাজ... তাই আজ অবর্ণনীয় সত্যিটা জানার পর সে নিজেই দোলাচলে... নাহ !! আদর্শের পরিচয়ের সত্য-মিথ্যার ঘটনা প্রবাহে নয়... বরং সবটা জানার পর কিভাবে আদর্শর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজায়... তাই তো কাঁপা গলায় বলে ওঠে,
শ্রদ্ধা : ঠাম.. মী !! তুমি সত্যি বলছো ? আদি.. ও তোমাদের... র.. র.... তাহলে তুম.. তুমিই এত্তদিন কাউকে কিছু বলো নি কেন !! আদি কষ্ট পায় জেনেও তবে ওর অপমানে চুপ থাকতে কেন ?? কেন ঠাম্মি ??বলো, কেন ?? আর তাহলে তুমি কাউকে কিছু বলো না কেন !!
ঠাম্মি : দেবু RAW Officer ছিল... এই সত্যিটা শুধু আমি জানতাম... সাহস, শৌর্য্য সবকিছু যেন আদির একদম ওর বাবার মতো... সবাই আদিকে গুন্ডা বলে, কিন্তু আদি ওর বাবার মতোই অন্যায় একদম সহ্য করতে পারে না... আমার ঘরে তখন দুই নতুন বউ- উমা আর অনন্তা... আদির দুই মা- দেবকী আর যশোদা... উমার গর্ভে তখন দেবুর ভালোবাসার অঙ্কুর, আমার আদি... দিল্লি বিস্ফোরণে তদন্ত করতে দিল্লিতে Posting হয় দেবুর... গর্ভাবস্থার কারণেই হোক, বা নিয়তিই হোক- সেইবার উমাকে কিছুতেই বোঝানো গেল না... সে দেবুর সাথে জোর করে দিল্লী গেল... অনন্তা আমাকেও জোর করে ওদের সাথে পাঠালো... দিব্য তখন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত... দর্শনের তখন পড়াই শেষ হয় নি... সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল অনন্তা... আদির আসার তখন দিন দুই বাকি... অনন্তা দিল্লীতে এলো- আদি আর উমা সহ আমাকে কলকাতায় ফেরত নিয়ে যাবার জন্য... যেদিন অনন্তা দিল্লি পৌছালো, সেদিনই রাতে হঠাৎই দেবুর কোয়ার্টারে সেই বিস্ফোরণের মূল কান্ডারী- Underworld Don আক্রমণ করে... নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেবু আমাদের তিনজনকে নিরাপদে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেয়... বড় বউমা সেই আঘাত সহ্য করতে পারলে না... সেই রাতেই আদিকে জন্ম দিয়েই সেও দেবুর কাছে চলে গেল... সেই ডন তখনও দেবুর বংশকে নির্বংশ করতে উঠে পড়ে লেগেছে... আদির সুরক্ষার কথা ভেবে ওই মূহুর্তেও অনন্তা দেবু আর উমার সৎকার্যের সময় রটিয়ে দেয় উমার সন্তান গর্ভেই মৃত্যু হয়েছে... আদিকে অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে আসার মিথ্যে গল্প বলে সবাইকে... দিব্য বহুদিন এই অনাথকে দত্তক নেবার অপরাধে অনন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল... কিন্তু শত অপমান, অসম্মানেও অনন্তার মুখ থেকে কেউ যেমন সত্যিটা বের করতে পারে নি, ঠিক তেমনই আদিকেও কেউ ওর স্নেহসুধা থেকে বঞ্চিত করতে সক্ষম হয় নি... সত্যি বলতে কি, আদি-বাবিন-ছুটকি এরা পৃথক গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করলেও ওদের একটাই মা ছিল - আমার বাড়ির অন্নপূর্ণা 'অনন্তা'... সে তোকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তার আদির জন্য তৈরী করে গেছে... তার ভালোবাসার সম্মান রাখিস মা...
আজ চাইলেও যেন শ্রদ্ধা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারছে না... মনকে দমিয়ে রাখলেও চোখটা যেন কথা শুনছে না, এই যা... ভেসে যাচ্ছে এক প্রবাহমান নদীর মতো আর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার এতদিনের জমিয়ে রাখা অভিমান... বড্ড লজ্জা লাগছে... নিজের ওপর নিজেরই একটা প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হচ্ছে... এই যে ও সবসময়ই ভাবে যে ওর আদিকে ও নিজের থেকেও ভালো চেনে, জানে... তবে সবই কি ভুল !!! সত্যিই যদি চিনতো, তবে কি ওকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতো !!! না কি Divorce শব্দটাকে ও নিজের মনে স্থান দিত !!! নাহহ... নাহহহ... অন্যায় করেছে শ্রদ্ধা... ভুল চিনেছে এবং বুঝেছে তার মানুষটাকে... কিন্তু... উ... উ... এইটাই প্রশ্ন এখনও মনের কোণে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে যে... যদি সত্যিই !!! নাহহ... তবে তো আদর্শেরও বিপদ !!! ফুলসজ্জার রাতের ওই Time Bomb... গুলি চলা... সেই মূহুর্তে শ্রদ্ধার আদর্শের সামনে চলে না এলে তো গুলিটা আদর্শের বুকের বা'দিকে... নাহহহ... নাহহহ... ও যেটা ভাবছে, তা যদি সত্যিই হয় তাহলে !!! তবে !!!
শ্রদ্ধা : আচ্ছা, ঠাম... ঠাম্মি তোমার কি মনে হয়, আদিও ওর বাবার মতোই Defence-এর সাথে যুক্ত !!! তাই ও কাউকে নিজের সাথে জড়াতে চাইতো না !!!
ঠাম্মি : কাউকে নয় রে দিদি, তোকে... সে যে ছোট্ট থেকে একমাত্র তোকেই সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে... তবে হ্যাঁ, আমারও এটাই মনে হয়... মনে হয় বলা ভুল, আমার স্থির বিশ্বাস... দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল বলেই হয়তো, সেই রাতে আদি তোকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল... জানিস দিদি, ওকে সেদিন শেষ দেখা যায় তোর কেবিন থেকে বেরতে... হয়তো ও তোকে বলেই গিয়েছিল, তোর জ্ঞান না থাকায় তুই জানতে পারিস নি...
শ্রদ্ধা : ঠ্ঠা... ঠাম্মি, আমাকে ওর কাছে যে ক্ষমা চাইতে হবে... বড় অপরাধ করে ফেলেছি আমি ওর সাথে... আমি আজ কি করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো গো, ঠাম্মি !!! ও যদি আমাকে ঘৃণা করে ওর... ওর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়... ও আমার চেয়ে দূরে থাকুক, তাও সই... জানবো, সে তো আমারই আছে... কিন্তু ওর ওই দুই চোখে আমি যে অন্য কিছু দেখেছি... শ্রদ্ধা, সম্মান আর... আ... র... র...
কথা শেষ করতে পারে না শ্রদ্ধা... হঠাৎই চুপ করে যায়...
আদর্শ : (অস্ফুটভাবে) তুমি কি আমাকে একেবারেই চেনো না রাহী... একটুও অনুভব করতে পারো না আমার অন্তর... আমি তোমাকে ঘৃণা করব !!! আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসতে পারি রাহী... শুধু... মাত্র... ভালো... বাসতে...
ঠাম্মির হাতের ছোঁয়া পেয়ে ভাবনার জগৎ থেকে আবার ফিরে আসে...
শ্রদ্ধা : আমি এটা কি করলাম ঠাম্মি !!! কি করে বসলাম !!!
ঠাম্মি : জানিস রাহী, ভালোবাসায় অভিমান হলো পদ্মপাতায় পড়া জলবিন্দুর মতো... টলটল করে সবসময়ই... একটু আদরের প্রেমের স্পর্শ পেলেই তা টুপ করে ঝরে পড়ে... তাই যা দিদি, তাহলে দেরী করিস না...
এত কষ্টেও শ্রদ্ধার মুখে লজ্জার এক ফালি আরোক্ত ছায়া পড়ে... লাবণ্যময়ী মুখ লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো দেখায়, যেন সব সমস্যা কাটিয়ে এই ছোট্ট সংসারটায় নিজ হাতে সুখ সমৃদ্ধির পুষ্পকুঁড়ি ফোটাতে এসেছে... ধীরে ধীরে নিজের ঘরের পানে পা বাড়ায় শ্রদ্ধা... আদর্শ শ্রদ্ধার মুখের পানে ক্ষণিক তাকিয়ে আর দাঁড়ায় না... দ্রুত সেখান থেকে সরে গিয়ে নিজের খাটে শুয়ে পড়ে.... পাশের বাড়িতে তখন হয়তো কেউ সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে সন্ধ্যারতি করতে চলেছে... ভেসে আসছে শঙ্খের আওয়াজ... চারিদিক মুখরিত এক সুরেলা কন্ঠে, ভেসে আসছে,
'এসো মা লক্ষ্মী, বসো ঘরে... আমার এ ঘরে থাকো আলো করে...'
আদর্শের ঘর :
-----------------------
'তুমি পার হয়ে এসেছ মরু, নাই যে সেথায় ছায়াতরু
পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো, এমন ভাগ্যহত ॥
তখন আলসেতে বসেছিলেম আমি আপন ঘরের ছায়ে,
জানি নাই যে তোমায় কত ব্যথা বাজবে পায়ে পায়ে ॥
তবু ওই বেদনা আমার বুকে
বেজেছিল গোপন দুখে
দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো - গভীর হৃদয়ক্ষত ॥'
জলজোছনা :
--------------------
শ্রদ্ধা ঘরে ঢুকে দেখে আদর্শ অঘোরে ঘুমাচ্ছে... প্রথমে এই ভর সন্ধ্যেবেলায় আদর্শকে ঘুমাতে দেখে একটু অবাক হলেও সে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আদর্শের কাছে... ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,
শ্রদ্ধা : থাক মানুষটা সারাদিন পর হয় তো একটু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে.. আর এখন ডেকে বিরক্ত নাই বা করলাম... এমনিতেই তো ব্রহ্মচারী মানুষ- কি করে, কোথায় উধাও হয়ে যায় মাঝে মধ্যে, তাই বুঝি না...কিছুদিন ধরে আন্দাজ হয়তো করতে পারছি, কিন্তু নিশ্চিত যে নই... তবে পূর্বস্মৃতিগুলো পরপর মেলালে মনে হয়, আদি হয়তো নিজের জীবন আদর্শের পথেই হাঁটছে- কিছুটা জেনে আর কিছুটা না জেনে... কিন্তু সমস্ত সত্যিই জানার পর স্ত্রী হয়ে আমি কি করে পারবো ওকে ওই অচেনা শত্রুর গুহা মুখে ছেড়ে দিতে !!! সবচেয়ে বড় কথা- আদি কি জানে, কতটা জানে তাও তো আমি জানি না... ওর সাথে কথা যে বলবো, সেই মুখ কি আমার আছে !!! আদি কি কোনোদিন আমায় আর ক্ষমা করতে পারবে ?? স্ত্রী হিসেবে না হোক, বন্ধু হিসেবেও কি মনের দরজা খুলবে আমার কাছে ?? যে আঘাত না জেনে আমি ওকে করেছি... উফফ !!!
অজানা ভুলবোঝাবুঝির কারণে বিচ্ছেদের আশঙ্কায় আমূল কেঁপে অস্থির হয়ে ওঠে শ্রদ্ধা... চোখ বেয়ে আসে শ্রদ্ধার অশ্রুধারা, আদর্শের পায়ের কাছে বসে তার পায়ে হাত দিতে গিয়েও ঘুম ভেঙ্গে যাবার আশঙ্কায় আর দিয়ে উঠতে পারে না... অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শুধু..আর শ্রদ্ধার অশ্রুধারা আদির পা ধুইয়ে দিতে থাকে... আদর্শের পা তথা সর্বাঙ্গ তার স্পর্শে কেঁপে উঠল, কিন্তু অপরদিকে আদি তো আদিই... অসম্ভব তার সংযম ক্ষমতা... যতক্ষণ না সে নিজে থেকে ভাঙছে, ততক্ষণ তাকে আবরণ সীমার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা অতটাও সহজ কাজ নয়... তাই শ্রদ্ধার ভালোবাসা দিয়েই তৈরি কাঠিন্যের খোলস ছেড়ে সহজেই যে সে বেরিয়ে আস্তে পারে না... তবে কাঠিন্যই বলো বা দৃঢ়তা সবটাই তো বাহ্যিক, আজ এতগুলো সত্যির সামনে দাঁড়িয়ে সেই মানুষটাও তো ভেতরে ভেতরে একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে... তার উপর জমা হয়েছে নিজের ভালোবাসার প্রতি এক তীব্র অভিমান.. শ্রদ্ধা তো জানে, বোঝে যে আদর্শ সহজে সবটুকু মুখে প্রকাশ করতে পারে না.. সেটা ভালোবাসাই হোক বা মনের কথা... ও তো এতদিন না চাইতেও নিজের মতো করে আদর্শকে পড়ে ফেলতে পারত, তবে আজ কি ওদের মধ্যে এতটাই দূরত্ব বেড়ে গেছে যে ওরা পরষ্পরের থেকে যোজন যোজন নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে... শ্রদ্ধা তো জানে আদর্শ এইরকম...
আদর্শ : (মনে মনে) তবুও ও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলো !!! আমাকে... আমাকে ' মুক্তি' দিতে চাইলো !! কিন্তু কে চেয়েছে এই মুক্তি ?? আমি তো চিরকালই রাহির বন্ধনেই বন্দী হতে চেয়েছি !!! চেয়েছি ওর শাসন,আদর,যত্ন !! তবে নিজের সাথে এতটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারলো রাহী !! আমি নাকি ওকে ছাড়া ভালো থাকবো- এই ভাবনা নিয়ে নিজেকে যে চরম শাস্তি দিতে যাচ্ছিল মেয়েটা তার বেলায় !!! সারাজীবন শুধু পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলো, নিজেরটাই ভাবলো না !! আমার থেকে দূরে গিয়েও নিজে কি ও ভালো থাকবে !! না তোমায় ছেড়ে আমি ভালো থাকতে পারব !!! না তোমার চিন্তা আমায় ভালো থাকতে দেবে !! তুমি ছাড়া যে আমি অসম্পূর্ণ... এখন তো রাহী, "আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে"...
তবে শ্রদ্ধার প্রতি মান যতই তীব্রতা পাক, ভালোবাসার উষ্ণ স্রোত তার থেকে অনেক বেশি দ্রুত বেগে ধাবমান.. তাই শ্রদ্ধার কান্না স্রোতে তার পদযুগল স্নান করলেও তা আদর্শকে লজ্জিতই করেছে বার বার... কারোর ক্রন্দন স্পর্শে স্নাত হওয়ার মতো যোগ্যতা যে তার নেই- আর যদি সেই নারী তারই শ্রদ্ধা হয়, তবে তো আরোই নয়... তাই আদর্শ আর সহ্য করতে করতে না পেরে ঘুম ভেঙে উঠে শ্রদ্ধাকে নিজের কাছে টেনে নিতে চায়... প্রেমের স্পর্শে ভুলিয়ে দিতে চায় প্রেমিকার কষ্ট, বিলিয়ে দিতে চায় চেপে রাখা জন্মবৃত্তান্তসহ মনের আকুলতা উজাড় করে... কিন্তু সেই মুহূর্তেই শুনতে পায় শ্রদ্ধার কান্না ভেজা গলার স্বর,
শ্রদ্ধা : তোমাকে সরাসরি আমি কখনোই এই কথাগুলো বলতে পারব না আদি, কারন ছোট থেকে নিজের কথা কখনোই মুখ ফুটে বলে ওঠা হয় নি আমার... তাই আজ গোপাল হয়তো আমাকে এই সুযোগটা করে দিল... আদি আমি অন্তর থেকে উপলব্ধি করি তোমার কন্ঠহীন চোখের ভাষা আর বোবা মনের অনুভূতিগুলো... আমি জানি আমি তোমার ভালোবাসার বন্ধনে বন্দী... আমি বন্দী তোমার মুখ উজ্জ্বল করা হাসিতে, বন্দী তোমার ওই মায়াভরা চোখের আকুলতায়, বন্দী তোমার উদাত্ত কন্ঠের মধুর গানে... তাই তো তোমাকে আমি নিজের থেকে কখনো হারাই না... প্রতি ক্ষণে, প্রতি মূহুর্তে আমার অন্তরে তোমার বন্ধন অনুভব করি আমি... তাই বলে, নিজের সমগ্র সত্ত্বায় অকৃপন যত্ন দিয়ে যতক্ষণ পারা যায় প্রতিটা মূহুর্তে কেবল আমাকে আগলে রাখবে তুমি !!! এ কেমন ভগ্নাংশের ভালোবাসা তোমার আদি !!! তোমাকে নিস্তব্ধ করে যেসব ভাবনা কিংবা নাম না জানা কোনো বেদনা- যার থেকে একটু করে শক্তি সঞ্চয় করে তুমি নিজের মধ্যে সতেজতা আনো বা প্রতি মূহুর্তে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করো... সেইসব লক্ষাধিক ঘটনা থেকে একেকটা ক্ষণ যদি কালের স্রোতে কেবলই হারিয়ে যায় কিংবা বাদ পড়ে যায়- তাতে হয়তো তোমার কিছু যায় আসে না... কিন্তু আমার যায় আসে... সেইসব নিঃসঙ্গের রাজপথে তোমার একাকীত্বের ভিড়ে আমি তোমার হাত ধরে পথ হাঁটতে চাই আদি... অধিকার চাই সেই মূহুর্তের, যখন রাতের আঁধারে কড়া নাড়ে তোমার অস্পষ্ট অতীতের কষ্টরা বা যখন তুমি হাতড়ে বেড়াও কত শত না পাওয়ার বেদনা... শোনো আদি, অনেক হলো তোমার একলা দুপুর, একলা মন, আঁকিবুকি লুকোচুরি কথা... অনেক... অনেক হলো তোমার কারন না বলে, ঠিকানা না বলে হঠাৎ হঠাৎ চলে যাওয়া... বাতাসের কাছে, অবাধ্য হাওয়ার কাছে বারবার চুপিচুপি তোমাকে কত খুঁজি আমি... আর তারা বলে যায়, সে যে নিরুদ্দেশ... ঠিক যেমন নাম না জানা এক ফালি মেঘ এই পথ দিয়েই অজানার কোনো পথে পাড়ি দেয়... তখন আমিও যে কত বেনামী চিঠি লিখি- 'আকাশ, তুমি তারে পাঠিও দিও একবার... যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে... অনর্গল ভিজবে আমার শহর আর... আর আমার... আমার প্রহর...'
মনের বোঝা হালকা করে লঘু পায়ে উঠে যেতে যায় শ্রদ্ধা, কিন্তু টান পড়ে শাড়ির আঁচলে... পেছন ফিরে থাকলেও অনুভব করে এতক্ষণ যে মুহুর্তটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, বলা বাহুল্য যে মানুষটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিল- সেই মুহূর্ত উপস্থিত... চিন্তা আর উত্তেজনায় নিজের শাড়ি নিজেই খামচে ধরে শ্রদ্ধা... ঠিক তখনই শুনতে পায় এক নরম অথচ দৃঢ় গলার সম্মোধন,
"রাহী"
হটাৎ করেই চারপাশটা কেমন যেন ফাঁকা লাগে শ্রদ্ধার... নিজেদের ছাড়া বাকি সব কিছুর অস্তিত্ব ভুলে যায়.. এক রাশ লজ্জা যেন এসে চেপে ধরে তাকে... ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে.. এ কি দেখছে সে !! আদর্শের চোখে জল !! আদি.. তার আদি কাঁদছে !!! ব্যস্ত পায়ে ছুটে যায় প্রেমিকের কাছে... উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায়,
শ্রদ্ধা : আ... আ... আদি... কি হয়েছে আদি ?? কাঁদছ কেন ?? বলো, কি হয়েছে তোমার !!! আমার কথায় আঘাত পেয়েছো, তাই না !! আমি জানি তো, আমি এই রকমই, সকলকেই শুধু কষ্ট দিই.... তাই তো মা-বাবাও ছেড়ে চলে গিয়েছে কতকাল !! তোমাকেও তো যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই দিতে পারলাম না... তাই তো তোমার মুক্তির জন্যই Di..
ফোঁপাতে থাকে শ্রদ্ধা... আহত বাঘের হুঙ্কার শোনা যায় যেন...
আদর্শ : ব্যাস !!! চুপ !! একদম চুপ !! অনেক বলে ফেলেছো রাহী... অনেকখানি এগিয়ে ভেবে ফেলেছো...
তুমি তোমার কথাগুলো আমার মুখে বসিয়ে দিও না Please... কতদিন আর নিজেকে ছোট করে রাখবে রাহী... কতদিন !! ছোটবেলা থেকে তোমার মামিমা এত কষ্ট দিয়েছে... নিত্য অপমান, লাঞ্ছনা এমনকি তোমার নিজের স্বপ্নটাও বিসর্জন দিয়ে ওই লম্পট, দুশ্চরিত্র, Criminal- টার সাথে তোমার বিয়ে দিচ্ছিল যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে সুকৌশলে বিক্রি করে দেওয়া যায়...
শ্রদ্ধা : আ... আ... আদি !!! তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ উনি আমাদের গুরুজন...
অবাক হয়ে যেন কাঁদতে ভুলে যায় শ্রদ্ধা... মামিমা যেমন ই হোক, যাই অন্যায় করুক তার সাথে, সে কিন্তু চিরকাল মা আর ভালোমা-এর পরে তার মামিমাকেই স্থান দিয়েছিল পালিকা মা হিসেবে... যাই হয়ে যাক, যে নামেই ডাকা হোক, মা তো... সেই মামী কি না শ্রদ্ধাকে... অসুস্থ শরীরটা একটু টলে যেতেই আদর্শ এসে ধরে নেয়... বলে ওঠে,
আদর্শ : এইজন্যই এতদিন ধরে সত্যিটা জানার স্বত্ত্বেও তোমাকে জানায় নি... জানতাম সহ্য করতে পারবে না... বড্ড নরম মাটির তাল তুমি রাহী... তাই তো সবাই নিজের মতো করে অবহেলায় দলা পাকাতে চায় তোমায়... তুমি তাদের মন মতো মূর্তি তৈরি না হলেও তোমার মাটিতে আঁচড় তো কাটতে দাও... সেই যন্ত্রণাও নেহাত কম নয়... তাই তো এখনও আমার কাকিমা কিছু মনগড়া কথা দিয়ে তোমার পৃথিবীটা এই চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে দিতে চাইলেও তুমিই বোঝই না... তোমার সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত রাহী... সেই পথে পা না বাড়িয়ে কিছু ভুল ধ্যান ধারণা নিয়ে আমার কাছ থেকে চলে যেতে চাইছিলে ?? কেন রাহী, কেন ??
শ্রদ্ধা : কি কারণে থেকে যাবো তোমার কাছে !! কেন থাকবো !! কি পরিচয় আমার আদি, তোমার জীবনে !!
শ্রদ্ধার এহেন প্রশ্নে আদর্শ মুখটা ঘুরিয়ে নেয়... সত্যিই তো এর কোনো উত্তর তার জানা নেই... আজ যে দূরত্বটা তৈরি হয়েছে, সেটা তো স্বেচ্ছায় নিজেই তৈরী করতে চেয়েছিল আদর্শ এবং তার পরিকল্পনায় সে সফল.. তবে এই "Cobalt Operation" successful করতে গিয়ে কবে যে তার মন তার বিরুদ্ধেই নিজের "Love Operation" execute করে ফেলেছে, এটাই আদর্শ বোঝে নি...
"ভালোবাসা"
অস্ফুটে বলে ওঠে আদর্শ... একটা শব্দে যেন দুজনের মধ্যেকার সব শূন্যস্থান ধীরে ধীরে পূরণ হতে শুরু করে... শ্রদ্ধা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না...
শ্রদ্ধা : কি বললে !! আবার বলো !!
আদর্শ : ঠিকই শুনেছ রাহী, যা শুনেছো... তুমিই সে, যে আমায় ছোট্টবেলা থেকে খোলা বই-এর মতো পড়ে ফেলতে পারো, আমার না বলা কথাগুলো নিজে নিজেই বুঝতে পারো... আমি এতদিন অনাথ জেনেও একটা বংশ-পরিচয়হীন একটা ছেলেকে এই ভাবে ভালোবাসতে পারো... যত্নে ভরিয়ে দিতে পারো...
শ্রদ্ধা : আদি !!! তুমি ভুল ভাবছো !! তুমিই.. ই.. ই..
শ্রদ্ধার মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়....
আদর্শ : আমি দিগম্বর ও উমা ব্যানার্জীর হতভাগ্য সন্তান আদর্শ ব্যানার্জী, তাই তো !! যে জন্মানোর রাতেই তার মা বাবাকে বিসর্জন দিয়েছে বিস্ফোরণের কোলে...
দাঁতে দাঁত চেপে শব্দ গুলো উচ্চারণ করে আদর্শ...
আদর্শ : রাহী, তুমি নিজেকে দোষী বলেছিলে না !!! এবার তবে কি বলবে ?? আমার মতো পাপ আর ক'টা পরিবারেই বা আছে, যে জন্মমুহূর্তেই নিজের পরিবারের অশনিসংকেত হয়.. শুধু নিজেরটাই নয়, আবার আমার যশোদা মা আর নন্দরাজ পিতার সম্পর্কটা ধ্বংসের পেছনেও আমিই অনেকাংশে দায়ী.. অথচ এই পরিবারের মানুষগুলোই আমায় খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছে, আমাকে মানুষ করেছে... অবশ্য কতটা হয়েছি, তা নিয়ে সন্দেহ আছে !!! আমি কিন্তু এইসব চাই নি, রাহী... কোনো পরিবার বা সম্পর্ক ভাঙার নেপথ্য কারিগর আমি হতে চাইনি... চাই... ই.. ই.. নিইই... আমি.. ই.. ই...
দীর্ঘ অনাবৃষ্টির পর ঝেঁপে বৃষ্টি নামে ফুটি ফাটা মৃত্তিকায়... অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আদর্শ... এতবছর ধরে দেখা শক্ত, লৌহ কঠিন মানুষ টাকে ছোটো শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে শ্রদ্ধা জড়িয়ে ধরে পরম মমতায়... পাশে দাঁড়ায় বন্ধু হয়ে... কাঁদতে দেয় আদর্শকে, একটু হালকা করার প্রত্যাশায়... মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
শ্রদ্ধা : কেঁদো না আদি... আমরা সবাই আছি তোমার পাশে... তোমার পরিবার তোমার কাছে আছে, পাশে আছে আদি.. সবাই তোমায় ঘিরে রাখবে..
ফোঁপাতে থাকা অবস্থাতেই মুখ তুলে জানতে চায়,
আদর্শ : আর তুমি ??
উত্তর আসে,
শ্রদ্ধা : ছিলাম.. আছি.. আর থাকবোও সারাজীবন...
এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে কান্না ভেজা মুখে... পরস্পর পরস্পরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাশে থাকার নিরব প্রতিশ্রুতিতে... কঠিন হয় মানববন্ধন... তৈরি হয় আজীবন ভালোবাসার এক চিরাচরিত মিষ্টি ফ্রেম... শ্রদ্ধার কানে কানে আদর্শ গুনগুনিয়ে ওঠে,
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি, তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
মনে ক'রে, সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী, তোমার কনককঙ্কণে॥
চিহ্ন রাখা আছে শব্দহীনতায় :
------------------------------------------
হঠাৎই রাতে শ্রদ্ধার ঘুম ভেঙে যায়... দেখে আদর্শ একাগ্র মনে Computer-এ কিছু একটা করছে... আদর্শের এইরূপ দেখে শ্রদ্ধা বেশ অবাক হয়... এইটা কোন আদর্শ তার সামনে বসে আছে !!! মানুষটা তার পাশে থাকলেও যেন এই জগতেরই মানুষ নয় সে... বহু, বহু দূরের মানুষ, যেন সদাশয় রূপে সর্বজ্ঞ যোগী স্বয়ম্ভূ... গৃহস্থ রূপে দেবী পার্বতীর স্বামী হলেও এখন যেন কৈলাস পর্বতে যোগী রূপে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করছেন... ওর মুখ থেকে একটা অদ্ভুত দ্যুতি বের হচ্ছে- কাঠিণ্যের, একাগ্রতার, তন্ময়তার... শ্রদ্ধা কিছুটা ইতস্ততঃবোধ করলেও আলতো করে আদর্শের হাতের উপরে নিজের হাতটা রাখে... মূহুর্তে যেন কুপিত হলো ঋষি দুর্বাষা....
আদর্শ : কি হলো কি রাহী !! এত রাতেও চোখে ঘুম নেই !!!
শ্রদ্ধা : তু... তুমিও তো ঘুমাও নি আদি !!!
আদর্শ : আমার কথা আলাদা... তুমি ঘুমিয়ে পড়ো... আর দয়া করে আমাকে কাজ করতে দাও... Please !!! না হলে আমি কিন্তু উঠে চলে যাব....
শ্রদ্ধা : নাআআ.... নাহহহহহ.... আমি আর কথা বল...
আদর্শ : আমি তোমাকে আগেও বলেছিলাম যে, আমার তোমার জীবন চিরকাল সমান্তরালে চলবে... ভুলে গেছো তুমি !!!
শ্রদ্ধা : নাহহ... নাআআ... আমি শুধু জানতে চাইলাম, তুমি ঘুমালে না কেন !!!
আদর্শ : তোমার যদি ঘুম না পায়, আমাকে বিরক্ত না করে তুমি বই খুলে বোস... তোমার ভবিষ্যত সুরক্ষিত হবে... নিজের জীবনের লড়াইটা নিজেই লড়তে শিখবে... আর নিজের সম্মান-টাও নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে পারবে... 'আমি অপয়া'-র মতো মধ্যযুগীয় চিন্তা থেকেও মুক্তি পাবে... So Please...
শ্রদ্ধা : আমি তোমাকে এমন কি বললাম !!!
আদর্শ : আজ বলো নি, কিন্তু এতদিন !! আমি তোমাকে Earnest Request করছি...
শ্রদ্ধা আর কোনো কথা না বলে পেছন ফিরে ঘুরে শোয়... শ্রদ্ধাকে ঠাম্মি আজ একটা অন্যরকম মানুষ হতে বলেছিল, সম্পূর্ণ অন্য মানুষ- ভালোবাসার, আদরের, সোহাগের আকুলতায় কোনো পাপড়ি মেলা ফুলের মতো যেখানে বুকের রেণুর মধ্যে অনেক স্বপ্ন, কল্পনা আর ভালোবাসা ছিল... কিন্তু আদর্শের এই কথাগুলো ওর ভেতরের শরীর, মনের গোপন পাপড়িগুলোকে অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে যেন গুটিয়ে গেল... আর এমনভাবে গুটিয়ে গেল যে ওর মনে হলো অনেকদিন আর চেষ্টা করেও খোলা যাবে না... শরীর আর মনের কুলুপের চাবি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে.. শ্রদ্ধা শাড়ির আঁচলটা ভালো করে বুকের সামনে টেনে ঘুরে শুয়ে পড়লো... বুকের মধ্যে সুন্দর সব স্বপ্নগুলোকেও নিঃশ্বাস চাপা দিয়েই রাখতে হলো... আদর্শ ভেজা দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ শ্রদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে... শ্রদ্ধা দেখতে পেল না, সেই চোখের জলে সিক্ততার সাথে আগুনও ছিল...
আদর্শ : (মনে মনে) রাহী, আমার অনেক পূর্বনির্ধারিত কর্তব্য পরিশোধনীয় থেকে গেছে... আমার বাবা-মা এর খুনি হয়তো এখনো বেঁচে আছে... আমাকে দিল্লীর ওই বিস্ফোরণ সম্পর্কে সব তদন্ত করতে হবে... আমাকে সবটা জানতে হবে... আমার বাবার সম্পর্কে, তার কর্মক্ষেত্র সম্পর্ক, ওই বিস্ফোরণে সম্পর্কে... আর ওদের মৃত্যু সম্পর্কেও... তার বাবার অসমাপ্ত রেখে যাওয়া কর্তব্য এবার আমাকেই শেষ করতে হবে... এটা মেঘদূত ব্যানার্জির নিজেকে করা নিজের প্রতিজ্ঞা...
ভোরের দিকে কাজ শেষ করে আদর্শ উঠে বসে শ্রদ্ধার খাটের পাশে এসে দাঁড়াল... শ্রদ্ধার চোখের কোলে কান্নার দাগ- গাল বেয়ে জল পড়েছে, সমস্ত মিলে মিশে মা-মরা শ্রদ্ধাকে বড় অসহায় বলে মনে হলো আদির... হঠাৎই... একেবারেই হঠাৎই ওর বুকের মধ্যেটায় কি যে মুচড়ে উঠলো... গলার কাছে একরাশ অনামা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠলো... আদর্শ যেন সেই মূহুর্তেই প্রথম অনুভব করতে পারলো যে, বড় আশা নিয়ে শ্রদ্ধার ওর কাছে এসেছিল, ওকে আগলে নিতে চেয়েছিল... ওর উপর শ্রদ্ধা তার সমস্ত সমর্পণে বড় অসহায়ভাবে নির্ভর করেছিল... নিজের কাজের প্রতি সমর্পণে শ্রদ্ধার সেই নির্ভরতার, সেই আশ্বাস-এর কোনো দাম দেয় নি আদর্শ... এমন কি তার প্রাণসংশয়ের সময়ও নয়... যতবার শ্রদ্ধা অন্তরের আকুলতা নিয়ে তার কাছে আসতে চেয়েছে, সে ততোধিক নিষ্ঠুরতার সাথে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে... আদর্শ এই প্রথম ভোরে ভেবেই পেল না কি করে ও এত নিষ্ঠুর হলো, কোন দুর্বুদ্ধিতে ভর করে এমন নিষ্পাপ সহজ, সরল মেয়েটার সঙ্গে এমন কঠিন ব্যবহার করলো কাল রাতে...
আদর্শ : রাহী... এই রাহী...
শ্রদ্ধা কোনো সাড়া দিল না... আদর্শ ভেতরটা কেঁপে উঠলো, মেয়েটার তো শরীরটা এখনো ঠিক হয় নি, তাহলে !!! তার উপেক্ষা কি তাহলে এই মেয়েটার কোনো বিপদকে আবাহন করে নিয়ে এলো... শুধু ওর Divorce-এর সিদ্ধান্ত নিয়ে ওর উপর অভিমান করেছিল, কিন্তু কারণটা তো একবারের জন্যও ভেবে দেখলো না... ভেবে দেখা তো দূর, চিন্তনের মধ্যেই আনে নি... যদিও সে নিজেও কাল থেকে ভেঙেচুরে রক্তাক্ত হয়ে আছে, আর ওর ক্ষততে হাত রাখতে গিয়ে মেয়েটাকেও রক্তাক্ত করে দিল... মেয়েটা তো তাকে কালকেও নিজের বুকে আগলে সামলে রেখেছে- ভালোবাসার ওমে, বন্ধুত্বের বন্ধনে... কিন্তু বারবার আদর্শের কর্তব্য ওদের সম্পর্কের মধ্যে এসে পড়ছে... আদর্শের কর্তব্যই ওর ভালোবাসাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নেবে না তো !!!
আদর্শ ওর বুকের মধ্যে এমনভাবে ঘুমন্ত শ্রদ্ধার আড়ষ্ট শরীরটাকে টেনে নিল যে, শ্রদ্ধা ঘুমের মধ্যে চমকে উঠলো... চমকে উঠে ওর চোখের সামনে আদর্শকে দেখে, ওর সমস্ত শরীরে আদর্শকে অনুভব করে মূহুর্তের জন্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো...
আদর্শ : I am Sorry, রাহী... আমি কাল একটা কাজ নিয়ে খুব Disturbed ছিলাম... আমাকে ক্ষ...
শ্রদ্ধা : (ঘুম জড়ানো গলায়) একটা নতুন ভোর এসেছে আমাদের জানলাতে আদি... আজ একটা নতুন দিনের শুরু হয়ে গেছে... অনেক কাজ আছে আমার, আদি... ছাড়ো... আমি দুধ গরম করে এনে দিই, তুমি মাঠে দৌড়ে এসো... আর, আমি তোমার উপর অভিমান করে কখনোই তোমার থেকে দূরে সরে যাব না... এবার তোমার সব কর্তব্যে তুমি তোমার শক্তি হয়ে আমাকে তোমার পাশে পাবে আদি, তোমার অন্তরে আমাকে অনুভব করবে... আজ থেকে তোমাকে আমাকে কেউ কখনো দূরে করতে পারবে না... কারন, আমি তোমার ভালোবাসা হয়ে তোমার অন্তরে থাকব, সবসময়ই... জানো আদর্শ, দেবী সরস্বতী শুধু বিদ্যার দেবী নন... এই পৃথিবীতে যা কিছু সাধনার, যা কিছু শুভ্র, যা কিছু সুন্দর- উনি তার দেবী... আজ থেকে নয় আমাদের সেই উপাসনার সূচনা হলো.দূরে কোনো সরস্বতীর পূজোর মন্ডপে বেজে ওঠে,
"কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না
শুকনো ধুলো যত !!
কে জানিত আসবে তুমি গো- অনাহূতের মতো ॥"

