Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

4.0  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

অন্তরালে (পর্ব ২)

অন্তরালে (পর্ব ২)

13 mins
432


(সমাপ্তি থেকে যেখানে ভালোবাসার সূচনা)

(শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)

বিবাহ বাসর :

--------------------

ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় শ্রদ্ধা... তার মাথার কাছে বসে তার সদ্য-বিবাহিত দিভাই শ্রেষ্ঠা আর ওর সবথেকে প্রিয় বন্ধু সংস্কার... পায়ের কাছে ওর মামা বসে... শ্রদ্ধার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে ম্লান হাসি ফুটে ওঠে... শ্রেষ্ঠার হাতটা নিজের বুকের কাছে ধরে ধীরে ধীরে বলে,

শ্রদ্ধা : তো... তোকে ক্কি... কি সুন্দর লাগছে রে দি... দিভাই... বাব... বাবিন আমার দিভাইকে ভা... ভালো রাখিস... খু... খুব ভালো রাখিস... ভালো... ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখিস...

শ্রেষ্ঠা : এখন কেমন লাগছে রাহী !!!

শ্রদ্ধা : ক্কি !!! কি হয়েছিল আমার !!!

সংস্কার : Senseless হয়ে গিয়েছিলিস তুই...

শ্রদ্ধা : ওহহহ... ওই জন্যই... বোধ... বোধহয় এত ক্লান... ক্লান্ত লাগছে... এবার... আমাকে আমার... কথা... কথা রাখতে হবে... দিভাই আমাকে একটু ধরবি !!!

শ্রেষ্ঠা আর সংস্কারের সাহায্যে উঠে বসতেই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদর্শকে... মূহুর্তের জন্য শ্রদ্ধার জলভরা চোখে আগুন জ্বলে ওঠে, যেন একটা আগ্নেয়গিরির নীচে একটা ঝর্না লুকিয়ে আছে... এবার শুধু আগ্নেয়গিরি বয়ে সেই ঝর্নার ঝরে পড়ার অপেক্ষা... আদর্শের চোখে কঠিন দৃষ্টি রেখেই কঠোর স্বরে বলে,

শ্রদ্ধা : মামাই, মামী কোথায় !!! একবার ডাকো...

লতিকা : আমি এখানেই আছি রাহী... বল আর কি বলার আছে তোর !!!

আদর্শের থেকে চোখ সরিয়ে কোনোপ্রকারে উথলে আসা কান্নাটা গিলে নিয়ে লতিকার হাত ধরে বলে,

শ্রদ্ধা : আমাকে অনেক কষ্টে তোমরা বড় করেছো... সেই ঋণ আমি কোনোভাবেই শোধ করতে পারবো না... আমার মায়ের এইটুকুই স্মৃতি আমার কাছে ছিল, এইটা তুমি রাখো মামী... এইটা তোমারই প্রাপ্য...

শ্রদ্ধা কথাগুলো বলে নিজের গায়ের স্বর্ণালঙ্কার খুলতে গেলে শ্রেষ্ঠার ওর হাত ধরে বাঁধা দেয়... বড় দিদির মতো শাসনের সুরে বলে,

শ্রেষ্ঠা : নাহহহ... একদম গা থেকে গয়না খুলবি না... আজ পরের লগ্নেই তোর সাথে দাভাই-এর বিয়ে হবে... দাভাই রাজি আছে...

একটা অদ্ভুত হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে শ্রদ্ধা... আদর্শ বোঝে আগ্নেয়গিরির গা বেয়ে এবার কান্নার ঝর্না হাসির রূপ নিয়ে রিনরিনিয়ে করে ঝরে পড়ছে... এতক্ষণ আদর্শ সবার সামনে চোখের জল আড়াল করতে পারলেও এবার আর পারলো না... নির্লজ্জ চোখের অশ্রু আর বাঁধা মানলো না, ঝরে পড়তে লাগলো অনর্গল... আদর্শ জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয়...

শ্রদ্ধা : আর কত দয়া নেব বলতো দিভাই এক জীবনে !! এই মনটা যে বড় হয়ে ওঠার দয়ার ভারেই ন্যুব্জ হয়ে আছে... তারপর বিয়ের দয়া !!! আদর্শবাবুর যে বিয়েতে অমত আছে, সেটা তো আমরা সবাই জানি... তাহলে এই মূহুর্তে আমাকে করুণাটুকু না করলেই নয় !!! আমি এই বিয়েটা করতে চাই না... আর দয়া বা করুণা কোনোটাই আর আমি নিতে পারছি না...

শ্রেষ্ঠা : 'না' করিস না রাহী... আমরা তিনদিনের ছোট বড়... প্রায় যমজ বোনের মতো আমরা একসাথে বড় হয়েছি... হয়তো ভগবান চেয়েছিলেন, আমরা যেন কখনো আলাদা না হই... তাই তোর সাথে এমনি হলো... আর তাই তো দাভাই এতদিনে রাজি হলো বিয়ে করতে... তুই 'না' করিস না রাহী...

কয়েকফোটা অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে শ্রদ্ধা আর শ্রেষ্ঠার গাল বেয়ে... সামনের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্রদ্ধা বললো,

শ্রদ্ধা : নিজের ছোটো বোনের প্রতি ভালোবাসার জন্য এতটা স্বার্থপর হোস না দিভাই... যে মানুষটা কোনোদিন কাউকে নিজের সাথে জড়াতে চায় নি, তাকে...

হঠাৎই জানলার দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়েই নিজের জলদগম্ভীর গলায় আদর্শ বলে ওঠে,

আদর্শ : আমি পাঁচ মিনিট রাহীর সাথে কথা বলতে চাই... আপনারা কি আমাদের পাঁচটা মিনিট একটু একান্তে ছেড়ে দেবেন !!! বিয়ের লগ্নের তো আর দেরী নেই... আপনারা বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করুন... আমি রাহীকে নিয়ে আসছি...

শ্রেষ্ঠা আর সংস্কার শ্রদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাসের হাসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়... বেরনোর আগে শ্রেষ্ঠা নিজের মায়ের হাত ধরে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে চলে যায়... মামা দুইহাত দিয়ে নিজের মা মরা ভাগ্নিটার মুখে আদর করে চোখের জল আড়াল করতে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়...

শ্রদ্ধা : আপনার আমার প্রতি এই করুণা করার কারণটা জানতে পারি !!!

আদর্শ : কাউকে করুণা করার মতো বড় মানুষ আমি নই রাহী... তবে, অন্যের করুণার, দয়ার পাত্রী না হবার জন্য নিজের একটা পরিচয় তৈরি হওয়া, নিজের সম্মান অর্জন করার দরকার পড়ে... আর সেই Journey-তে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই... ব্যাস এইটুকু... কিন্তু, তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ- আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িও না... আমাদের দু'জনের জীবন সমান্তরালে চলুক... আমি তোমার থেকে এগিয়ে নয়, তুমি আমার থেকে পিছিয়ে নও... পাশাপাশি, পা-এ পা মিলিয়ে, সমান্তরালে... কিন্তু, আমার জন্য তোমার মনের কোণে কোনো নরম অনুভূতি তৈরি হতে দিও না, আমিও দেব না... কিন্তু, আবারো বলছি, আমাকে নিজের সাথে জড়িত করো না...

শ্রদ্ধা : আপনি যে গুন্ডা, সেটা আমি আর আপনি দু'জনেই জানি... কিন্তু, আপনার যে মাথা খারাপ- সেটা আপনাকে কেউ বলে নি, তাই না !!!

আদর্শ : তাহলে ধরেই নাও না, একজন পাগল, গুন্ডার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে... (শ্রদ্ধার হাত ধরে টেনে) এসো এবার... লগ্ন বয়ে যাবে...

শ্রদ্ধা : (হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে) হাত ছাড়ুন... হাত ছাড়ুন আমার... আপনি কি আমার আর আপনার জীবন নিয়ে ইয়ার্কি করছেন না কি !!!

আদর্শ : জন্ম থেকে আমাকে দেখছো, আমার মায়ের কাছেই প্রায় বড় হয়েছো- সুতরাং খুব ভালো করেই জানো আমি ইয়ার্কি, মজা করি না...

শ্রদ্ধা : তা করবেন কেন !!! সেসব সাধারন মানুষরা করে... আপনার তো মাথার পুরো তারকাটা... এই ছাড়ুন তো, আমি আপনাকে বিয়ে করবো না...

আদর্শ : তাহলে কাল নিজের মামার সম্পর্কে যা বলেছিলেন সব শুধু কথার কথা ছিল... নিজের মামার মুখ চেয়েও আমাকে বিয়ে করা যায় না রাহী !!! একবার নিজেকে সুযোগ দেওয়া যায় না, নিজেকে তৈরী করে সবার চোখে নিজের জন্য সম্মান অর্জন করতে !!! আমি মানুষটা গুন্ডা হতে পারি, তারকাটা হতে পারি- তাই বলে কি এতটাও খারাপ !!!

উন্মুক্ত জলরাশির প্রবল বেগ যেন আছড়ে পড়ছে তটভূমিতে... আদর্শের হাত ধরে শ্রদ্ধা হেঁটে চলেছে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যতায় এক অজানা কোনো পথের পানে... তেপান্তরের শূন্যতা তাকে গ্রাস করছে, ভাঙা হৃদয়ে কেবলই মন পুড়ছে... কঠিন বাস্তব আজ তার কাছে শুধুই ত্রাস... দুই চোখে শূন্যতা, তারই মাঝে বেজে চলেছে কোনো এক অজানা সুর... শত সহস্র কলরবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিষাদের তিক্ত ব্যথিত জিজ্ঞাসার চিহ্ন...

একে একে সব সব আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়- পান পাতায় মুখ ঢাকা, সাতপাক, শুভদৃষ্টি, মালাবদল, হস্তবন্ধণ, কন্যাসম্প্রদাণ, সপ্তপদী শেষ করে এখন আদর্শ আর শ্রদ্ধা পাশাপাশি বসে... দুজনের মাঝে ভীষণ দূরত্ব, স্তব্ধ নীরবতা... আদর্শের হাতে সিঁদুর তুলে দিয়ে পুরোহিত মশাই আদর্শকে শ্রদ্ধার সিঁথিটা ভালো করে দেখে নিতে বলে, কারণ সিঁদুরদান তাকে শ্রদ্ধাকে না দেখেই করতে হবে... আদর্শ সিঁদুর করতে যাবে, এমনসময়ই পুরোহিত মশাই বলতে শুরু করেন...

পুরোহিত মশাই : একটা অজানা সম্পর্ক সিঁদুর দানের সাথে সাথেই চির পরিচিত একটাই পরিচয়ে বেঁচে থাকার অঙ্গীকার নেয়... সিঁদুর দান সাত জন্মের সম্পর্ককে আজীবন বেঁধে রাখার এক অভেদ্য অঙ্গীকার, যেখানে অভেদ্য দায়িত্ববোধের সাথে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতিকে বেঁধে দেয়... জীবন তাকে ভালোবাসতে শেখায় আরেকজনের জন্য... তাই তো সিঁদুর দানের মতো পবিত্র মূহুর্ত খুব কম...

রাহী মা, এই এক চিলতে সিঁদুর কিন্তু চিনতে শেখায় অনেক নতুন দায়িত্ব নিতে... শেখায় এখন থেকে আর আমি-তুমি নই, 'আমরা'-তে পরিণত হতে... হাজার তারার আলোর মাঝে মিষ্টি ভালোবাসার সাক্ষী এই সিঁদুর, প্রতিটা সকাল রঙীন করার সাক্ষী এই সিঁদুর, তোমার বুক ভরা আনন্দে আমার খুশি খুঁজে নেবার কারণ এই সিঁদুর... দাও বাবা, মায়ের সিঁথি তোমার ভালোবাসার রক্তিম সুধায় রাঙিয়ে দাও...

যে ভালোবাসার রক্তিম সুধা মিশে থাকে লাল সিঁদুরে- আজ শ্রদ্ধার সিঁথিতে মাঝে তাই মিছে আঁকা, ঠিক যেন এক ফোঁটা সিঁদুর কবরে শায়িত... আজ আদর্শ আর শ্রদ্ধার জীবনে সে রঙ কেবলই বোঝা... শ্রদ্ধার চোখ এখন পুরো শুষ্ক, তার এই মিথ্যে দিয়ে সাজানো অভিনয়ের ছল দেখে যেন চোখের জলও আড়ালে হেসে ফেলছে...

রাত্রি পেরোয়, ভোর আসে ক্লান্ত পায়ে... গোধূলির উপত্যকা ছুঁয়ে গেছে আধোচেনা সোহাগ বাসর... এই বসন্তেও বাড়ছে অবুঝ ক্ষতের মাঠ, এক তরঙ্গ কাহিনি তখনো লুকানো... শ্রেষ্ঠার অনুরোধে শ্রদ্ধার গান তখন ভেসে যাচ্ছে দূর দূরান্তে...

শ্রদ্ধার গান :

------------------

কখনো সঘন বাদলের পরে,

প্রেমলিপি লেখে বিজলি অখরে...

কখনো দখিন পবনে আমার ব্যাথাটুকু রেখে যাই...

কি যে করি বলো এত আশা লয়ে,

বোবা হয়ে মরি এত ভাষা লয়ে...

তোমার আমার এমনিই এ খেলা,

দু'জনে দু'কুলে বেয়ে যাব ভেলা...

কখনো সহসা ঢেউ-এ ঢেউ-এ মিলে,

কিছু ছোঁয়া কভু পাই...

কি যে করি, দূরে যেতে হয় তাই,

সুরে সুরে কাছে যেতে চাই, তাই কি যে করি....


ফুলসজ্জা :

-----------------

গাঢ় নীল রঙের বেনারসি পড়ে বিছানায় বসে আছে নতুন বউ... ব্যানার্জি বাড়ির নতুন বউ... সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর টানা, চোখ দুটোতে কাজলের ছোঁয়া যা চোখ দুটোকে আরো মায়াবী করে তুলেছে... ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, ঠোঁট দুটোকে ঠিক গোলাপের পাপড়ির মতো দেখতে লাগছে... তার গা ভর্তি গয়না... ঘরখানা গোলাপ আর রজনীগন্ধায় সুসজ্জিত... বাইরে থেকে শ্রদ্ধা আর সম্প্রীতির গলার আওয়াজ পেল শ্রেষ্ঠা, ওরা সংস্কারকে নিয়ে আসছে... অজানা কারনে সদ্য বিবাহিতা শ্রেষ্ঠার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল... ছোট্টবেলার ভালোবাসা আজ পরিণয়ে পূর্ণতা পেয়েছে... আজ শুরু হবে তাদের প্রেমের আরো এক নতুন অধ্যায়, এক নতুন বোঝাপড়ার পাঠ... সংস্কার ঘরে এসে ছিটকিনি তুলে দিয়ে ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠার পাশে বসলো... একরাশ মাদকতা আজ ঘিরে ধরে তাদের দু'জনকে... আদুরে সংস্কার একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে শ্রেষ্ঠার কোলে মাথা রেখে শুতেই শ্রেষ্ঠা তার ভালোবাসার পরশ দিয়ে সংস্কারের চুলে বিলি কেটে দেয়...

শ্রেষ্ঠা : হ্যাঁ রে বাবিন, আজ দাভাই আমার বোনটার কাছে যাবে তো রে !!

সংস্কার : মানে !!! এ আবার কি কথা শ্রী !!! আজ তো ওদেরও...

শ্রেষ্ঠা : হ্যাঁ... কিন্তু, বউ নিয়ে এসে থেকে তো তোর দাভাইকে আমার বোনের কাছে যেতে দেখলাম না... আচার অনুষ্ঠানগুলোও তো কোনোরকমে এসে করে গেল...

সংস্কার : আমি আমার দাভাই যতটুকু চিনি, ও ছোট থেকেই রাহীকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে... পাছে প্রকাশ পেয়ে যায়, তাই পালিয়ে বেড়ায়... আমার দাভাই-এর প্রকাশ কম, অনুভূতি নয়... ও ঠিক আমাদের মতন নয়... ওকে বুঝতে গেলে একটা অন্যরকম মন লাগে রে... আর আমার বিশ্বাস, আমাদের রাহীর মধ্যেই সেই মনটা আছে... ও একদিন না একদিন ঠিক বুঝতে পারবে দাভাইকে... আর দাভাই-ও ওকে আপন না করে বাঁচতে পারবে না... দেখিস...

শ্রেষ্ঠা : (মুখ নিচু করে শুধু বললো) হুমমমম...

সংস্কার : কি হলো !! শুধু হুমমম !!!

শ্রেষ্ঠা : আমাকে একটু চুলটা খুলতে help কর না বাবা... পার্লার থেকে কি শক্ত করে বেঁধে দিয়ে গেছে... বাপ রে বাপ...

সংস্কার : Always at your Service Mam...

চুল খোলার নামে সংস্কারের আঙ্গুলগুলো শ্রেষ্ঠার চুলে খেলা করতে থাকে... আস্তে আস্তে যত আঙুলগুলো নীচে নামতে থাকে, ততই দু'জনের হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে... সংস্কার শ্রেষ্ঠার কানের পাশের খোলা চুলগুলো সরিয়ে ওর কানে কানে বলে,

সংস্কার : একবার আমার বুকে মাথা রাখবি রে !!!

শ্রেষ্ঠা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, মিশে গেল সংস্কারের বুকের মাঝে...

শ্রেষ্ঠা : এইভাবেই তোর বুকে মাথা রেখে সারাজীবন ঘুমাতে দিবি... কথা দে আমাকে !!!

সংস্কার : কথা দিলাম... কথা দিলাম... কথা দিলাম....

শ্রেষ্ঠা এবার এক সুখের ছোঁয়া পেল, সুখের আবেশে চোখ বুজে আসতে লাগল শ্রেষ্ঠার... আর কোনো লজ্জার চাদর অবশিষ্ট নেই দু'জনের মধ্যে... তারা দু'জনেই আজ অন্তরের থেকে চায় এই সময় যেন চলে না যায়, থমকে থাকুক.... তাদের ভালোবাসার, স্বপ্নের মূহুর্তের শেষে সংস্কার শ্রেষ্ঠার কপালে একটা গাঢ় চুম্বন করে পরষ্পরকে নিজেদের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ঘুম পাড়িয়ে দিল...


আদর্শ যখন নিজের ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, তখন রাত ভোর হতে আর কয়েকঘন্টা বাকি... বিয়েবাড়ির সব কাজ শেষ করে ফিরতে তার অনেক দেরী হয়ে গেছে... ঘরে ঢুকে সে দেখে শ্রদ্ধা তার জন্য অপেক্ষা করে করে হাঁটুতে মাথা রেখে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে... আজ ঘুমন্ত শ্রদ্ধাকে একদম অন্যরকম লাগছে... হাল্কা দুধ আলতা রঙের বেনারসি পড়ে আছে সে... সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, কপালে লাল টিপের চারধারে অল্প চন্দন আঁকা, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপী লিপস্টিক... তার মণিমা, মানে আদর্শের মায়ের কোনো গয়নাই তাকে দিতে দেয় নি আদর্শের বাবা দিব্য ব্যানার্জি... তাই নিজের মায়ের কিছু স্বল্প স্বর্ণালঙ্কারেই সজ্জিত আছে শ্রদ্ধা... খাটের উপর শুধু কিছু গোলাপের পাপড়ি দিয়েই তাদের ফুলসজ্জার খাট সাজানো হয়েছে... কিন্তু, গোটা ঘর আলো করে আছে শ্রদ্ধার মিষ্টি মায়াবী রূপখানা...

শ্রদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকার ঘোর কেটে হঠাৎই আদর্শের সব ক'টা ইন্দ্রিয় সক্রিয় হয়ে ওঠে একটা টিক টিক টিক শব্দে... এই আওয়াজটা তো কোনো ঘড়ির নয়... এই আওয়াজ তার খুব পরিচিত... অতি সুদক্ষতার সাথে সে গোটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে...শ্রদ্ধারও ঘুম ভেঙ্গে যায়...

শ্রদ্ধা : কখন এলেন আপনি !!! আসলে... আমার একটু চোখ... কি খুঁজছেন ওভাবে !!! আদর্শ বাবু !!! কি খুঁজছেন !!!

আদর্শকে এইভাবে খুঁজতে দেখে খাট থেকে নামে বিস্মিত শ্রদ্ধা...

শ্রদ্ধা : আপনি ওভাবে কি খুঁজছেন বলুন না !!! আমি কি সাহায্য করতে পারি !!!

আদর্শ : খবরদার না... চুপ করে খাটে বসে থাকো...

শ্রদ্ধা : জানেন, একটা Gift এসেছে- লেখা আছে 'Wish you A Happy Married Life, Meghdut'...

আদর্শ : (আৎকে উঠে) What !!! কোথায় Gift টা !!!

শ্রদ্ধা : এই তো... টেবিলে রাখা... কে এসে যে কখন রেখে গেছে... দাঁড়ান দিচ্ছি...

শ্রদ্ধার এগিয়ে এসে Gift টাতে হাত দিতে গেলেই আদর্শ ওকে হেঁচকা টেনে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়...

আদর্শ : নাহহহ রাহী... ওটা ছোঁবে না তুমি... সরে দাঁড়াও...

আদর্শের এই ব্যবহারে শ্রদ্ধা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে... আদর্শের উপর সব অভিযোগ ভুলে গিয়ে ওর বুকের উপর হাত রেখে বলে,

শ্রদ্ধা : কি হয়েছে আদি তোমার !! মেঘদূত কে !!! আর তুমি এইরকম করছো কেন !!

আদর্শ : তুমি এইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো... আর একদম চেঁচাবে না... একদম চুপ করে থাকবে...

আদর্শ ওর দেওয়াল আলমারি থেকে একটা কাঁচি বার করে নিয়ে এসে Gift টা খুললেই আৎকে ওঠে শ্রদ্ধা... একটা Time Bomb রাখা ওর ভেতর...

শ্রদ্ধা : (চাপা আর কাঁপা গলায়) আআআ... আদিইইই... বো... বো...বোম্ব...

শ্রদ্ধা ছুটে আদর্শের কাছে আসতে গেলে আদর্শ রুদ্রমূর্তি নেয়... 

আদর্শ : চুপ করে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম না... একদম কথার অমান্য করবে না...

আদর্শ কয়েক সেকেন্ড বোম্বটাকে দূর থেকে ভালো করে লক্ষ্য করে... আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি...

20

19

18

17

16

আদর্শ কাঁচি নিয়ে এগিয়ে যেতেই শ্রদ্ধা চোখ বন্ধ করে... আদর্শ সুনিপুন দক্ষতায় Bomb Defuse করে দেয়...

আদর্শ : Done...

শ্রদ্ধা সবকিছু ভুলে একবুক আশঙ্কা, ভালোবাসা, ভালোলাগা নিয়ে আদর্শের বুকের উপর শরতের শিউলির মতো ঝরে পড়ে... আদর্শও মূহুর্তের জন্য সবকিছু ভুলে ঠিক ফুলের মতোই শ্রদ্ধাকে আদরে নিজের বুকে আগলে জড়িয়ে ধরে... মেয়েটা বড্ড ভয় পেয়ে গেছে... শ্রদ্ধার শরীরের গন্ধ ভেতর ভেতর তোলপাড় করে দিচ্ছে আদর্শকে... আদর্শের স্পর্শ পেয়ে শ্রদ্ধা আরো শক্ত করে, দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে আদর্শকে, নিজের মুখ গুঁজে দেয় ওর ঘাড়ে... বেশ কিছুক্ষণ আদর্শের বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ থাকার পর শ্রদ্ধা নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে আসে...

শ্রদ্ধা : Sorry... Extremely Sorry....

আদর্শ : It's Okkk... আমি বেঁচে থাকতে আমার আপনজন, আমার পরিবার, আমার দেশের গায়ে কেউ আঁচড় কাটতে পারে না রাহী...

শ্রদ্ধা : (জ্বলে উঠে ঋজু স্বরে) একজন গুন্ডা হয়ে !! যেখানে তোমার বিয়েতে কেউ বোম্ব উপহার দেয় !! আজ যদি তোমার ফিরতে পনেরো মিনিট দেরী হতো, তাহলে (আদর্শের বুকের উপর তর্জনী রেখে) তোমার... তোমার আপনজনদের কি অবস্থা হোত !!! আমাকে তো তোমার স্ত্রী বলে মনে মনে মানো না, আমাদের তো অভিনয়ের দাম্পত্য... কিন্তু, বাকিদের !!! তারা তো তোমার আপন !!! ছিঃ আদর্শ !!! ছিঃ !! হ্যাঁ, ক্ষণিকের জন্য আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে... কিন্তু, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, সেই অধিকার তো আমার নেই...

বলতে বলতে দৌড়ে উঠে গিয়ে বাথরুমের দরজা আটকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শ্রদ্ধা... শ্রদ্ধা যতটা সম্ভব নিজের মুখ চেপে কান্নার আওয়াজ রোধ করার চেষ্টা করলেও আদর্শের মতো গুন্ডার কানে তা ঠিকই গুঞ্জরিত হতে থাকে... বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে স্থবির হয়ে বসে থাকার পর আদর্শ উঠে বাথরুমের দরজায় ঠোকা মারে...

আদর্শ : রাহী... রাহী... দরজা খোলো... বেরিয়ে এসে একটু জল খাও... রাহী... রাহী... দরজা খোলো... দেখো, আমি কি এনেছি তোমার জন্য...

ছোট্ট মেয়ের মতো গাল ফুলিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে শ্রদ্ধা... ফোলা ফোলা টোপা কুলের মতো গালদুটো টিপে দেবার অদম্য লোভ সংবরণ করতে পারলো না আদর্শ... কিন্তু, শ্রদ্ধা চোখ তুললো না... শ্রদ্ধার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে খাটে বসায় আদর্শ... একটা বড় উপহারের বাক্স তুলে ধরে তার সামনে...

শ্রদ্ধা : কি এটা !!!

আদর্শ : খুলে দেখো...

শ্রদ্ধা খুলতেই অবাক হয়ে যায়... Competitive Examination-এর Form আর সেই সংক্রান্ত কিছু বই... অবাক হয়ে শ্রদ্ধা এবার চোখ তুলে আদর্শের দিকে তাকায়...

আদর্শ : আজ থেকে তোমার নিজের পরিচয়, নিজের সম্মান-এর জন্য লড়াই শুরু হলো রাহী... বিয়ে মানে সব কিছু শেষ, এটা আমি মানি না... বিয়েতে মেয়েদের নতুন করে জন্ম হয়... সবাই বলে অন্যের গৃহলক্ষ্মী, অন্যের স্ত্রী, তারপর মা হয়ে নব নব পরিচয়ে তার রূপান্তর ঘটে... কিন্তু, সেই মেয়েটার স্বত্ত্বা !!! তার আত্মা !!! তার নিজের পরিচয় !! আমি চাই, তুমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হও- কারুর কন্যা নয়, কারুর বোন নয়, কারুর স্ত্রী নয়, কোনো পরিবারে গৃহলক্ষ্মী নয়... শ্রদ্ধার আত্মপ্রকাশ ঘটুক... আজ যারা তোমাকে হেয় করছে, একদিন তাদের মাথাই লজ্জায় হেঁট হয়ে যাক... এই লড়াইটা তোমাকে লড়তে হবে রাহী... পারবে না !!! (দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে) না কি এক গুন্ডার অনুরোধ বলে রাখবে না !!!

রাহী মুগ্ধ দৃষ্টিতে আদর্শের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে... তার সামনে এটা কে দাঁড়িয়ে !! যাকে সবাই গুন্ডা বলে !! সত্যিই কি সে গুন্ডা !!! না কি গুন্ডাদের মন তথাকথিত সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের থেকে অনেক বড় হয়, দৃষ্টিকোণ অনেক মহৎ হয়- ওই অনেকটা ভোলা মহেশ্বর মহাদেবের মতো... মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে আদর্শর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধা... কিছু কিছু অনুভূতি থাকে যার জন্য হয়তো সব শব্দই কম পড়ে, তাই তা অব্যক্ত থাকাই শ্রেয়... কিন্তু অনুভূতিরা অব্যক্ত থাকলেও তা বোধহয় স্পর্শের মধ্যে দিয়ে অপর ব্যক্তির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়... তাই আবারও শ্রদ্ধার ছোঁয়াতে আদর্শের সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে... সে দ্রুত শ্রদ্ধার দুই কাঁধ ধরে তোলে...

আদর্শ : অনেক রাত হয়ে গেছে রাহী, তুমি Dress Change করে খাটে শুয়ে পড়ো...

শ্রদ্ধা : আর তুমিই !!!

আদর্শ : আমি সোফাতে Manage কর...

শ্রদ্ধা : ছোটবেলা থেকে দিভাই-এর সাথে শোওয়া অভ্যাস... আমি একা শুতে পারি না... তুমি খাটে শোও না... আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে ছোবো না... কথা দিলাম...

শ্রদ্ধার কথা দেবার পর আধঘন্টাও কাটে নি... আদর্শ অনুভব করলো তার বুকের উপর তার পাঞ্জাবি আঁকড়ে কেউ শুয়ে আছে... আসলে আদর্শের চিরকালই একা ঘুমানো অভ্যেস... চোখ খুলে সে দেখে, রাহী তার বুকে মাথা রেখে ছোট্ট বাচ্চার মতো গুটিসুটি হয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে... মূহুর্তের জন্য আদর্শের মাথাটা গরম হয়ে গেল- বালিশের কি এতই অভাব পড়েছিল যে তার বুকটাকে বেছে নিতে হলো !! আদর্শ শ্রদ্ধার মাথাটা পাশে রাখা বালিশে রেখে খাট ছেড়ে উঠে পড়তে চাইল... কিন্তু, চাইলেই কি আর সব হয় !!! শ্রদ্ধা খুব শক্ত করে আদর্শকে জড়িয়ে ধরে আছে... শ্রদ্ধার ছোট্ট বাচ্চার মতো তাকে আঁকড়ে ধরে রাখা নিষ্পাপ, কোমল মুখটা দেখে আদর্শ নিজের মনের অজান্তেই কখন যে শ্রদ্ধার চুলে বিলি কাটতে শুরু করলো, তা সে নিজেও জানে না... কিন্তু, কেন এমন হলো !!! আদর্শ তো সত্যিই চায় না কোনো মায়ায় বাঁধনে নিজেকে জড়াতে, তাহলে কি তার হারানো অনুভূতিগুলো আবার ফিরে পাচ্ছে !!! কেন তার প্রবল ইচ্ছে করছে শ্রদ্ধার কপালে ছোট্ট করে একটা স্নেহ চুম্বন দিতে... কেন মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, শুধু অনুভব করতে পারে নি পরিস্থিতিতে পড়ে... তার এইভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো কি তারই প্রমাণ দিচ্ছে !!! আদর্শের মুখে দীর্ঘদিন পর এক অনাবিল আনন্দের হাসি খেলে যায়, যা হয়তো শরীরী মিলনের আনন্দের চেয়েও কয়েক কোটি গুন আনন্দের, শান্তির, ভালোবাসার....


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance