Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

4  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

অন্তরালে (পর্ব ১)

অন্তরালে (পর্ব ১)

14 mins
332


(সমাপ্তি থেকে যেখানে ভালোবাসার সূচনা)


    'গ্রহণ যত করিবে মোরে, ততই করিবে ঋণী'

ভালোবাসা অদ্ভুত এক শব্দ, যার অর্থ এক কিন্তু বিস্তার তথা গভীরতা অনেক... জোর করে যেমন ভালোবাসা পাওয়া যায় না, তেমনই দূর থেকেই ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দেখেও ভালো থাকা যায়... ভালোবাসায় হৃদয় উপুড় করে সবটুকু বিলিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু বিনিময়ের প্রত্যাশা করে না কেউ-উ... সেই ভালোবাসা অনেক সময়ই অপ্রত্যাশিত থেকে যায়, কিছু কিছু অনুভূতি হৃদয়ের অন্তরালেই থেকে যায়... অতীতে যে ভালোবাসা অব্যক্ত রয়ে গিয়েছিল, তা কি ভবিষ্যতেও অব্যক্ত রয়ে যাবে !! না কি প্রকাশ পাবে মনের গভীর অনুভূতি !!! তাদের পরস্পরের পরিপূরক ভালোবাসা কি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে, যারা জীবন সংগ্রামে পাশাপাশি পরস্পরের একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেবে !! তারা কি যথার্থ অর্থে হয়ে উঠবে একে অপরের পরিপূরক !!!

My innermost one resides within me,

And He seems omnipresent hence.

He rests within my eyes,

I need not search Him at all -

Whichever direction I look at -

He seems within sight, hence.

Traveling distances, in vain, for my wish -

To listen to your sapient words,

On homecoming I find, thus,

Lyrics of my songs having your words.

You knock doors in frenzy

In order to search Him -

O' rush at me, look at my core,

How He resides between my eyes.

অনেক সময় ব্যস্তময় জীবনে অতীতের নানান স্মৃতি আনমনেই ভেসে আসে... সে স্মৃতি হয়তো কখনও উজ্জ্বল, রঙীন, আনন্দমুখর, আবার কখনও বিবর্ণ, ধূসর, বিষাদময়... কিন্তু, স্মৃতি সবসময়ই মনে দোলা দিয়ে যায়... কেউ কেউ স্মৃতিকে সম্বল করে ক্লান্তি আর যন্ত্রণা লুকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে সবার জীবনে খুশির রঙ লাগিয়ে দেয়, আবার কেউ কেউ নিজের অজান্তেই স্মৃতিসরনী বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারাকে আড়াল করে রাগ আর বদমেজাজের খোলসে...

বর্তমানেও বারবার ফিরে আসে অতীতের অধ্যায়গুলো... এই অতীত আর বর্তমানের আবর্তে কিভাবে আবর্তিত হবে শ্রদ্ধা আর আদর্শের জীবন...

শ্রদ্ধা চ্যাটার্জি... সুন্দরী, সুশীলা, সংস্কারী, নম্রতা, ভদ্রতা এই গুনগুলো মিলেই বয়স ২৬-এর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা শ্রদ্ধা... দেখতে ডানাকাটা পরী না হলেও কেউ তাকে গোমড়া মুখে আর চুপচাপ থাকতে কখনো দেখে নি... মুখে এক মিঠে রোদ্দুরের মতো হাসি তার সবসময়ই লেগে থাকে, আর পাতলা পাতলা গোলাপী পাপড়ির মতো ঠোঁট সবসময়ই চলছে... লেখাপড়ার প্রতি তার খুবই টান... সাথে গান তার আত্মার এক বিশেষ অংশ... সবসময়ই সবার সাহায্য করতে সে তৈরি, সে সহপাঠীদের পড়াশোনার নোট দিয়ে হোক বা গরীবদের টাকা... মা-এর মৃত্যুর পর মামাবাড়িতে খুব ছোট থেকেই মানুষ বলে নিজের চাওয়া-পাওয়ার বিশেষ চাহিদা সে মনে তৈরি করে নি... উপরন্তু খুব ছোট থেকে নিজের টিউশন পড়িয়ে নিজের পড়া আর গানের খরচ তুলেছে... এখন তো মামার হাতে বেশকিছু সংসার খরচের টাকাও সে তুলে দেয়... সে জানে মামিমা তাকে একেবারেই পচ্ছন্দ করে না, গলগ্রহ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না... কিন্তু, সে হাসির আড়ালে যন্ত্রণা আড়াল করে মুখ বুজে সবকিছু করে যায়...

আদর্শ ব্যানার্জি... পাড়ার সবাই এক ডাকে চেনে... পাড়ার অন্যতম গুন্ডা বলতে যা বোঝায় আর কি !!! গুন্ডা বলা হয়তো ভুল, কিছুটা ওই রবিনহুড গোছের... অন্যায় সহ্য করা তার ধাতে সয় না... সে যে কি কাজ করে কেউ জানে না... বয়স তার ৩২... দেখতে শুনতে সুন্দর, মানে মুখশ্রীটি মায়াবী... ব্যায়াম করা চর্বিবিহীন পেটানো শরীর... তবে রাজপুত্তুর একদমই বলা যায় না তাকে... হাসতে না জানা নিরস একটা মানুষ, রাগ তার সবসময়ই তুঙ্গে...

তার এই রাগের পিছনে যদিও একটা কারণ আছে... তাকে দিব্য ব্যানার্জির স্ত্রী অনন্তা দেবী অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেন... দাম্পত্যের দুই বছর পরও যখন সন্তান এলো না, আদর্শকে তারা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে আসে... দীর্ঘ তার ছয় বছর পর দিব্য আর সরলার সংসারে আসে তাদের পুত্র সন্তান, 'সংস্কার'... কিন্তু, বংশের প্রদীপ আসার পর থেকেই আদর্শের প্রতি সরলা দেবী বাদ দিয়ে সবার টান কমতে থাকে... কলেজে পড়ার সময় সরলা দেবীর আকস্মিক মৃত্যু আদর্শের জীবন আরো দুর্বিষহ করে তোলে... তবে দুই ভাইয়ের মধ্যে টান খুব বেশি... ছয় বছরের ছোট ভাইকে প্রথম দিন থেকে পরম মমতায় বড় করেছে আদর্শ... মা মারা যাবার পর থেকে সেই বাঁধন আরো দৃঢ় হয়েছে... সংস্কার একদমই আদর্শের বিপরীত মেরুর মানুষ... হাসিখুশি, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটা মানুষ, আর শ্রদ্ধার সবথেকে প্রিয় বন্ধু...

তবে আদর্শ আর শ্রদ্ধা পরষ্পরের একেবারেই চক্ষুশূল... তার প্রথম কারন বিপরীত মেরুর অবস্থান... আর এটাই সংস্কারের সবচেয়ে বড় সমস্যার কারন... তার পরম প্রিয় দু'জন মানুষের কখনোই ভাব হয় না... সংস্কার মন থেকে চায় তার দাভাই-এর জীবনে খুশির ফাগুন নিয়ে কেউ আসুক... কিন্তু, কে আসবে !!! কেউ তো জানেই না, তার দাভাই ঠিক কি কাজ করে !!! এমনকি সংস্কার নিজেও না... শ্রদ্ধার সাথে কথাটা আলোচনা করতে গিয়েছিল সে, কিন্তু সে তো হেসেই কুটোপাটি হয়ে গেল...

গীতবিতান :

------------------

যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি

পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি।

যে আমার নতুন খেলার জন

তারি এই খেলার সিংহাসন,

ভাঙারে জোড়া দেবে সে কিসের মন্তরে॥

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।

কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে॥

গানের ক্লাস শেষ করে শ্রদ্ধা গানের স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে... এমনসময় তার সামনে বাইক নিয়ে এসে দাঁড়ায় আদর্শ...

শ্রদ্ধা : এ কি অসভ্যতা আদি !!!

মূহুর্তে আদর্শের ব্রহ্মতালু জ্বলে যায়... সেই ছোট্ট থেকে আদর্শের মায়ের আদরের ডাক 'আদি' বলা যে ধরেছে, সেটা এতবড় হয়েও ছাড়লো না... কেন বোঝে না, এই ডাকটার সাথে আদর্শের কত আবেগ, কত অনুভূতি, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে !!! অনেকবার আদর্শ বারণ স্বত্ত্বেও এই বিচ্ছু মেয়েটা কিছুতেই কথা শোনে না... শ্রদ্ধার চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে আদর্শ বলে ওঠে,

আদর্শ : রাহী, তোমার সাথে আমার দরকারি কথা ছিল... তাই আসতে বাধ্য হলাম...

শ্রদ্ধা : আমার সাথে !!!

আদর্শ : হ্যাঁ... তুমি নীলাভকে বিয়ে করো না রাহী... ও তোমার যোগ্য নয়... একটা মেয়ের জীবনে বিয়েটাই কি সব !!! তোমার কি নিজের জন্য কোনো স্বপ্ন, কোনো লক্ষ্য নেই...

আদর্শের উদ্বিগ্নতা শ্রদ্ধার মনে এক নতুন দাগ কেটে যায়, বুকটা ধুঁক করে ওঠে... এতটা চিন্তা, এই স্থির দৃষ্টি, এত মায়া জড়ানো কথা, আর সুপ্ত ভালোবাসার ছাপ উপেক্ষা করা কি এতটাই সহজ !! এই প্রথমবার কেউ শ্রদ্ধার স্বপ্ন নিয়ে ভাবছে !!!

শ্রদ্ধা : (তার গোপন যন্ত্রণা হাসির আড়ালে লুকিয়ে বলে) স্বপ্ন দেখার, লক্ষ্যপূরণ করার স্পর্ধা নেই আমার... আর তুমি এই কথাটা কিভাবে বলছো আদি !!! আমার আর দিভাই-এর বিয়ে তো একইদিনে... দিভাই-এর বিয়ে তাও তোমার ভাই-এর সাথে... এখন আমি বিয়ে ভেঙ্গে দিলে দিভাই আর সংস্কারের বিয়ের কি পরিণতি হবে, তুমি ভাবতে পারছো !!! আমার মামা প্রাইমারি স্কুলের একজন সাধারণ শিক্ষক... বিয়ের সব যোগাড় শেষ... এখন যদি বিয়ে ভেঙ্গে যায়, তার আর্থিক ও সামাজিক ধাক্কা মামা সহ্য করতে পারবে না... দেখো, তুমি নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবেই আমাকে এইভাবে এই কথাটা বলতে এসেছো... (দৃঢ়স্বরে) কিন্তু, বিশ্বাস করো আমার মামী আমার জন্য যাকে ঠিক করেছে- সেই আমার জন্য সবচেয়ে যোগ্য... আমি তাকেই ভালোবেসে ঘর বাঁধতে চাই... আমাকে আমার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দাও... তুমি এতকিছু নিয়ে ভেবো না Please...

এতটা বলে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রদ্ধা... আদর্শের চোখ আগুনের মতো জ্বলে ওঠে... রাগী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

আদর্শ : যে নিজের ভালোটা বোঝে না, তার সর্বনাশ কেউ আটকাতে পারে না... যা খুশি করো, মরতে হলে মরো...

আদর্শের কথাগুলো তীরের মতো বিঁধলো শ্রদ্ধার বুকে...আদর্শ শ্রদ্ধার মুখমন্ডলীতে সৃষ্টি হওয়া অন্ধকারের ছাপ উপলব্ধি করতে পারে... শ্রদ্ধার নিস্তব্ধতা ক্ষণিকের জন্য একটা অস্বাভাবিক নীরবতা সৃষ্টি করে... যদিও শ্রদ্ধা খুবই প্রাণবন্ত, তবুও আজ যেন তার কথা বলার ইচ্ছেটুকুই সৃষ্টি হচ্ছে না, আদর্শের বলা প্রত্যেকটা শব্দ শ্রদ্ধার মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে... নির্লিপ্তভাবে সে তাকিয়ে থাকলো সামনের মানুষটার দিকে... কিন্তু ক্ষণিক পরেই মুখে এক চিলতে হাসি এঁকে নেয়... সেই হাসিতে কোনো সুখের সুভাস নেই, বরং আছে বেদনার আভাস... ডাগর চোখ তুলে স্বল্প কন্ঠস্বরে শ্রদ্ধা বলে ওঠে,

শ্রদ্ধা : তোমার নিশ্চয়ই চোখে অনেক স্বপ্ন... তুমি নিশ্চয়ই তোমার স্বপ্নের জন্য বাঁচো, সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে তোমার স্বপ্ন সত্যি করতে চাও... একদা মায়ের স্নেহের পরশে ভালোবাসার প্রতি প্রচুর বিশ্বাস থাকলেও নিজের স্বপ্নপূরণ আর পরিবারের মানুষগুলোর অবহেলায় ভালোবাসার আকাঙ্খাটা চাপা পড়ে গেছে... বাইরে থেকে প্রচুর কঠিন দেখালেও আসলে তুমি মায়ের সেই ছোট্ট আদি-ই থেকে গেছো... নয়তো কাল যার আইবুড়োভাত তাকে আজ তুমি এই কথাগুলো বলতে পারতে না... প্রত্যেকটা মেয়েরই একটা স্বপ্ন থাকে, যার সাথে সে সারাজীবন থাকবে- সে যেন তাকে বুঝতে পারে, সে যেন তার মনের কথা পড়তে পারে... আর আজকে তোমার কথাগুলো শোনার পর থেকেই আমার সেই স্বপ্নগুলো আপনা থেকেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে শুরু করেছে, ভাঙতে শুরু করেছে... আমি শুধু এইটুকু জানি, বাস্তব অতোটা সহজ নয়... জীবনের পথ অত সহজ আর সরল নয়, যতটা বাইরে থেকে দেখে মনে হয়... পরিস্থিতি মানুষকে এমন জায়গায় টেনে নিয়ে যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে আত্মবিসর্জন দেওয়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না... ধরে নাও, আমিও তেমন পরিস্থিতির মধ্যেই আছি... একবার ওই গাছটার দিকে দেখো....

শ্রদ্ধার আঙুল অনুসরণ করে আদর্শ খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গাছটার দিকে তাকায়... কিন্তু বিশেষ কিছুই দেখতে না পেয়ে রাগী চোখে শ্রদ্ধার দিকে তাকায়...

শ্রদ্ধা : ওই গাছটাতে নবীন কচি কচি পাতাগুলো কি সুন্দর বসন্তের আগমনে সবুজ রঙে সেজে উঠেছে !!!

সত্যিই !!! শীতের হলুদ অরণ্যের ঝরে পড়া পাতারা আবার নবপল্লবের সবুজতার দীপাবলিতে সেজে উঠেছে খুব সুন্দরভাবে... ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে তার সৌন্দর্যতা উপলব্ধি করার ক্ষমতা সাধারন মানুষের নেই, ঠিক যেমন ক্ষণিক আগে আদর্শ করতে পারে নি...

শ্রদ্ধা : এই গাছটার রঙিন পাতাগুলো মতো আমার জীবনটাও সুন্দর, রঙীন হতে পারতো... কিন্তু, তা তো হলো না... আমার মতো একাকী নিঃসঙ্গ পত্রপল্লব কখনোই ওই বৃক্ষের সবুজতায় মুগ্ধ হবার সুযোগ পায় না... আমি ঝরা পাতার দলে... যেখানে মুছে ফেলা সুখের স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নরা এক চিলতে বৃষ্টির অভাবে নিঃসঙ্গে অনন্তে হারিয়ে গেছে- সেই বৃষ্টি বিশ্বাসের, সেই বৃষ্টি প্রত্যাশার, সেই বৃষ্টি অনুরাগের, ভালোবাসার... লুকোনো স্বপ্নের অস্থির মোহ-রা আমার মতো হলুদ অরণ্যের ঝরে যাওয়া পাতার সাথে কখন যে হারিয়ে যায়, অরণ্যের বৃক্ষরা কি তার খবর রাখে !!! তাই বলছিলাম, আমাকে নিয়ে ভেবো না... আসি...

কথাগুলো শ্রদ্ধা আদর্শের আঁখিজোড়ায় নিক্ষেপ করলেই সে স্তব্ধ হয়ে যায়... তার প্রত্যেকটা শব্দের সাথে আদর্শের হৃদয়ের স্পন্দন আরো গতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করে... আদর্শকে পেছনে ফেলে শ্রদ্ধা এগিয়ে চলে যায়... আদর্শ শ্রদ্ধার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মনে মনে বলে,

আদর্শ : মা একদিন তোমার আর আমার বিয়ে ঠিক করে গিয়েছিল রাহী... তখন বাবার ব্যবসাও ভালো ছিল বলে তোমার মামী আমার মাকে কথা দেয়... আজ উনি আমাকে দেখে সেই প্রতিজ্ঞাচ্যূত হচ্ছেন... হ্যাঁ এটা ঠিক যে, আমি যে জীবনের সাথে জড়িত তাতে আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়... আমার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে পারব না আমি... কিন্তু, মা যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসতো... সেই তোমাকে আমি নীলাভ-র মতো পাত্রের হাতে কি করে পড়তে দিই !! এটাও তো ঠিক, সেদিন ভাই আর শ্রেষ্ঠার বিয়ে... আমি কি করব মা আমাকে বলে দাও Please...

বিবাহ বাসর :

--------------------

সংস্কারের গায়ে হলুদ নিয়ে আদর্শ যথা সময়েই শ্রদ্ধাদের বাড়ি এসে গেছে... শ্রেষ্ঠার গায়ে হলুদ নির্বিঘ্নেই পার হয়ে যায়... কিন্তু, নীলাভ-র গায়ের হলুদ আর শ্রদ্ধার গায়ে উঠলো না... নীলাভ-র বাড়ি থেকে খবর এসেছে তারা হলুদ নিয়ে একেবারে বিয়েতেই আসবে... শ্রদ্ধার মামী কোনোপ্রকারে নমঃ নমঃ করে শ্রদ্ধার সব আচার অনুষ্ঠান শেষ করে, যাতে শ্রদ্ধার তত্ত্বাবধানে শ্রেষ্ঠার আচার অনুষ্ঠান সুসমপন্ন হয়... ব্যাপারটা কেউ তেমন বুঝতে না পারলেও এক জোড়া চোখের দৃষ্টি থেকে তা এড়ায় নি... দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদর্শ, যার দৃষ্টির একমাত্র প্রাণকেন্দ্র এখন শ্রদ্ধা... তবে মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যে কোনো পুরুষের থেকে একটু বেশিই সক্রিয়... এক জোড়া চোখ যে তার দিকে অপলকে চেয়ে আছে, সেটা বুঝতে তার খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না...

একজন নারী তার পরিবারকে ভালো রাখতে ঠিক কতটা অপরূপ অভিনয় করতে পারে, তা সত্যিই অতুলনীয়... চাপা বেদনা, কষ্ট সর্বদা মনের মধ্যে চেপে রাখার পরেও কেউ সেই মেয়েটির মুখ দেখে বলতে পারবে না যে সে জীবনের ঠিক কোন বিষাদময় অধ্যায়কে পারাপার করছে... শ্রদ্ধা ঠোঁটের কোণে সামান্য একটা হাসির রেশ নিয়ে মামার পাশে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে বিয়ে পার করছে... কে বলবে আজ তারও বিয়ে !!! আদর্শ দূর থেকে শুধু তাকে আড় চোখে দেখে যাচ্ছে... কাল আদর্শের বলা কথাগুলোর কোনো প্রভাব তার অন্তরে কি হচ্ছে, তা তাকে দেখে বলা অসম্ভব... শ্রদ্ধা নিজের অপরূপ অভিনয় দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে, কিন্তু এই অভিনয় করতে করতেই সে অন্তর থেকে হাঁপিয়ে উঠছে... আর এর কোনোটাই আদর্শের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি... সত্যিই ভগবান কি অসীম ক্ষমতা দিয়ে নারীকে সৃষ্টি করেছে !!! শ্রদ্ধা কি করে এত যন্ত্রণা অন্তরে সহ্য করছে, আদর্শ ভেবে পাচ্ছে না... ওর মুখটা দেখলেই ভেতরটা তোলপাড় হতে থাকে... শ্রদ্ধার সামনে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে আদর্শর... ইচ্ছা করছে সমস্ত শক্তি দিয়ে শ্রদ্ধাকে রক্ষা করতে... কিন্তু, ওরা দু'জনেই বড্ড নিরুপায়....


বিবাহ বিভ্রাট :

-------------------

আসলে মানুষের মন কখন কাউকে ভালোবাসে, তখন কখনোই কোনো ব্যাকরণ মেনে ভালোবাসতে পারে না... মানুষ যাকে মন থেকে ভালোবাসে, তাকে হঠাৎ করেই মন থেকে চেয়ে বসে... হয়তো সে নিজেও তখন সেই ভালোবাসার অঙ্কুরকে অনুভব করতে পারে না... তবু প্রেম হয়, দেরিতে হলেও হয়... আর সেই ভালোবাসায় কখনোই কোনো দূরত্ব থাকে না, সীমানা থাকে না... সত্যিকারের ভালোবাসার কোনো এপার-ওপার বলে কিছুই থাকে না, চাওয়া থাকে না, পাওয়া থাকে না, রতি থাকে না, শরীর থাকে না... হয়তো যেটুকু থাকে, তাকে ক্ষণিকের ভুলে আমরা 'অপেক্ষা' বলে থাকি....

ভালোবাসা স্বততঃ ঘর পূরণ করতে জানে, কারন ভালোবাসার ঘর অপূর্ণ থাকে না সবদিন... একটা সামান্য অপেক্ষা যুগ যুগান্তের মতো মনে হয়...

তারপর বিয়ের দিনের গোধূলি আসে যেন আচমকাই, মরতে বসা সূর্যের লাল মেখে হঠাৎই শ্রদ্ধাকে আড়াল থেকে দেখে আদর্শ... স্বল্প অলঙ্কারে বধুবেশে সজ্জিতা লাল বেনারসি পরিহীতা চির পরিচিত শ্রদ্ধার দিকে ভারি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে অল্প হেসে আদর্শ নীরব চোখের ভাষায় বলে,

আদর্শ : (মনে মনে) জানি তুমি কখনোই বুঝবে না, হয়তো ভুলই বুঝবে আমাকে... তবুও খুব খুব খুব ইচ্ছে করছে মুখ ফুটে বলি, 'ভালো থেকো'...

আদর্শের কথাগুলো চেপে রাখা দুঃখের মতো একটা জমাট কষ্টের বেশে গলায় এসে জমা হয়... যে শ্রদ্ধাকে নিয়েই আদর্শের সব শব্দ, তার একটা বর্ণও সে নিজেও বুঝতে পারে না আর শ্রদ্ধাকেও বোঝাতে পারে না... হঠাৎই বর আগমনের উল্লাসে ভরে যায় চারিদিক... আদর্শ দেখলো শ্রদ্ধা সব দেখলো- সেই দৃষ্টিতে নেই কোনো অপেক্ষা, নেই কোনো নরম কিন্তু উষ্ণ অনুভূতি, আছে শুধু মানসিক ক্লান্তি... অদৃষ্টের পরিহাস দেখে মনে মনে সে হাসল... সারাদিনের উপোস, তার উপর শারীরিক আর মানসিক ক্লান্তিতে মাথাটা বোধহয় ঘুরে গিয়েছিল, দেওয়ালটা ধরে নিজেকে সামলে নিল... সৌজন্যতার খাতিরে আদর্শ আড়াল থেকে শ্রদ্ধার সামনেও আসতে পারল না... আর তো কিছুক্ষনের অপেক্ষা...

ভাবতে ভাবতেই কখন যে মূহুর্তগুলো পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারলো না... বাইরে তখন মেঘের গুরুগম্ভীর তর্জন গর্জন শুরু হয়ে গেছে... শ্রদ্ধা মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের এত জটিলতা না বুঝেই টলোমলো পায়ে সেই আওয়াজ অনুসরণ করে বিবাহ মন্ডপে বেরিয়ে এলো... চারিদিকে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ... অনেকেই অনেক কিছু বলছে, যেগুলোর কোনোটাই শ্রদ্ধার কান অব্দি পৌছাচ্ছে না... শ্রদ্ধার সামনে থেকে পুলিশ নীলাভকে Arrest করে নিয়ে চলে গেল... যাবার সময় নীলাভ একবার আদর্শের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, এবং পরস্পরের কঠোর দৃষ্টি বিনিময়ে কারুরই বুঝতে বাকি রইলো না যে, এই Arrest-এর পেছনে ঠিক কার ভুমিকা আছে... শ্রদ্ধার চারিদিকে তখন যেন ধূসর কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার আস্তরণে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সামনের...

হঠাৎই এই ঘটনার ফলস্বরূপ শ্রদ্ধার মামী রূপী মায়ের হাতের সজোরে এক থাপ্পড় এসে পড়ে শ্রদ্ধার গালে... ঘটনার আকস্মিকতা আর আঘাত সামলাতে না পেরে শ্রদ্ধার লুটিয়ে পড়ে মাটিতে... তার কপালটা গিয়ে লাগে কংক্রিটের দেওয়ালে... অঝোরে উষ্ণ রক্তের স্রোত ঝরে পড়তে থাকে ওর কপাল থেকে, ঠোঁটের কোণ দিয়ে... দৌড়ে গিয়ে শ্রেষ্ঠা বুকে টেনে নেয় তার তিন দিনের ছোট বোনকে... শ্রদ্ধা কিছুক্ষণ বিমূর্তের মতন তাকিয়ে থাকে তার মামী দিকে- দেখে মামীর দৃষ্টিতে নেই কোনো মায়া, নেই মমতা, আছে শুধু একরাশ বিদ্বেষ... এই সমস্ত কিছুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী করলো, নিজের উপর চরম বিতৃষ্ণা জন্মালো... এক অনন্ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে আজ...

শ্রেষ্ঠা : মাআআআ... কি করছো কি তুমি !!! ওর কষ্টে সহমর্মী হতে নাও পারো, একটু সহানুভূতিশীল তো হতে পারো !!! ও তো তোমাদের উপরই সবটা ছেড়ে দিয়েছিল... কোনোকিছুতেই কোনোদিন আপত্তি জানায় নি...

শ্রদ্ধা : ছেড়ে দে দিভাই...

লতিকা : অপয়া... রাক্ষসী মেয়ে একটা... জন্মে থেকে মাকে খেলো... বাপ তো মেয়ের মুখটাও দেখলো না... নিজের দ্বিতীয় পরিবার নিয়ে দিব্য সংসার করছে... আর এই গলগ্রহকে আমার গলায় ঝুলিয়ে রেখে গেল... তুই ওকে ছাড় শ্রী... ছেড়ে দে ওকে... ভাবলাম, এইবার অন্ততঃ নিষ্কৃতি পাবো... কিন্তু, নাহহহ... তা তো হবার নয়... সেই আমার গলার কাঁটা হয়ে ঝুলে রইলো...

শ্রেষ্ঠা : গলার কাঁটা মা !!! কোনোদিনও ভেবেছো বাবার ওইটুকু পেনশনের টাকায় কি করে সংসারটা চলে !! ভাবো নি !!! আসলে ভাবার সুযোগ দেয় নি এই মেয়েটা !!! কোনোদিকে না তাকিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে যাতে মামার একটু সুরাহা হয়... নিজের জন্য একটা ভালো জীবনসাথী খোঁজার মতো সময় পায় নি এই মেয়েটা, শুধুমাত্র তোমার সংসারের জন্য মা...

লতিকা : কেন !!! সে নিজে গেলে নি !! একা আমাদের জন্য করেছে !!!

শ্রদ্ধা : মামী... তোমার যা বলার তুমি আমাকে পরে বলো... আগে দিভাই-এর বিয়েটা হয়ে যাক...

লতিকা : আর তুমি কি করবে মা !! লগ্নভ্রষ্টা হয়ে আমার গলার ঝুলবে !!!

শ্রদ্ধা : শুধু দিভাই-এর বিয়েটা হতে দাও মামী... আমার মুখ আর তোমাকে দেখতে হবে না...

নিজেকে কোনোরকমে টেনে তুলে বিবাহ মণ্ডপ থেকে যন্ত্রমানবীর মতো বেরিয়ে যায় শ্রদ্ধা... হঠাৎই শাড়িতে পা আটকে হোঁচট খেয়ে শ্রদ্ধা পড়ে যাবার উপক্রম হয়... এতক্ষণ বিবাহ মন্ডপে অনুপস্থিত আদর্শ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দৃঢ় হাতে শ্রদ্ধার হাতটা ধরে তার পতন রোধ করে... চন্দন আঁকা ছোট্ট কপাল, মাঝখানে লাল টিপ, স্বল্প স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত মিষ্টি মুখটা দেখে বড় মায়া হয় আদর্শর... শ্রদ্ধার ক্ষতে নিজের রুমাল চাপা দিয়ে রক্তরোধ করতে গেলে শ্রদ্ধা আদর্শের বুকের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে শ্রদ্ধা শুধু বলে,

শ্রদ্ধা : কেন !!! কেন !!! কেন এটা করলে আদি !!!

আদর্শ : পুলিশ ওকে নিয়ে গেছে রাহী...

শ্রদ্ধা : আমি... আমি তো বারন করেছিলাম তোমাকে... বুঝিয়েছিল... সবাই তোমাকে গুন্ডা বলে... বলে তোমার মুখের থেকে হাত-পা বেশি চলে... কিন্তু, আমি বিশ্বাস করতাম না... মণিমার ছেলে কখনো গুন্ডা হতে পারে না... আজ আমি বুঝলাম, সবাই ঠিক বলতো... তুমি একজন গুন্ডা... শুধুই হৃদয়হীন এক... একজন... গুন... গুন্ডা...

আদর্শ : রা... রাহী... রাহীইইই...

এরপর আর কিছু বলতে পারে না শ্রদ্ধা... চোখের সামনে থাকা আদর্শের মুখটা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসে শ্রদ্ধার চোখে... একরাশ অন্ধকার নেমে আসে তার চোখে... নিজের শরীরের সব ভার ছেড়ে দেয় আদর্শের উপর, আর আদর্শও তার সর্বশক্তি দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শ্রদ্ধাকে... শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যায় একটা শীতল স্রোত... কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আদর্শকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়... আদর্শ তখনো কি জানতো যে এই অদৃশ্য শক্তি মাধ্যাকর্ষনের মতো তাদেরকে বেঁধে রেখেছে, তার থেকে পালানোর সাধ্যি তার নেই...

আদর্শ শ্রদ্ধাকে ভালোবাসে বললেও ভুল হবে, না বলেও অসত্য হবে... অথচ, ভালোবাসার উপকরণ যে কম ছিল এমন নয়, আবার না বাসবার উপাচার যে কম ছিল তাও নয়... না যতটা প্রবল ছিল, হ্যাঁ ততটাই প্রকট ছিল... যে মানুষটার জন্য অন্তরে কোনোদিন কোনো টান অনুভব করে নি... ঘৃণা, ঘৃণা, ঘৃণা আর কেবলই ঘৃণা করেছে- আজ তাকে নীরব, নিথর থাকতে দেখে অন্তর হু হু করে উঠলো... মনে হলো, শ্রদ্ধা আর শ্রদ্ধার কলতান তার জীবনে ছিল... আজ শ্রদ্ধার এই নীরবতা, নিস্তব্ধতা অন্তরের কোন এক সূক্ষ্ম অনুভূতিকে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে... হঠাৎই বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো... শুধু বাইরে কেন, আদর্শের অন্তরের অন্দরমহলেও কি বারিবিন্দু বইছে না !!! সিক্ত হয়ে উঠছে না তার দুই চোখের কোণ !!! তথাকথিত সংসারে থেকেও শ্রদ্ধার মতো অতি সামান্য মেয়ে তার কাছে এত অসামান্য হয়ে উঠবে, তা উপলব্ধি করা মাত্রই মুখোমুখি হতে হলো সেই চরম সত্যের- নিজের জীবনের সঙ্গে কাউকে না জড়ানোর ব্রত নিয়েও শ্রদ্ধার প্রতি সে দুর্নিবার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে ক্রমশই... এত ভালোবাসার পাবার অধিকারই তো তার নেই...


(অতঃপর !! কেন আদর্শ চাইছে না শ্রদ্ধার সাথে নিজেকে জড়াতে !!! কোন কাজের সাথে যুক্ত সে !!! কি হবে আদর্শ আর শ্রদ্ধার জীবনের পরিণতি !!কি মনে হয় তোমাদের !!!)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance