STORYMIRROR

Abanti Pal

Classics

4  

Abanti Pal

Classics

অবিস্মৃতির আকাঙ্খায়

অবিস্মৃতির আকাঙ্খায়

4 mins
257

অবশেষে অবসরপ্রাপ্ত হলেন প্রান্তিকবাবু। অবসর গ্রহণে অবশ্য কোনোভাবেই বিষাদগ্রস্ত হলেন না তিনি। দীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তিতে শেষের কয়েক বছর এবার গুছিয়ে নেবার পালা। উচ্চপদস্থ অফিসার হিসেবে তাঁর তর্জন গর্জন ছিল বিশাল, নিজেকে নিয়ে অহংবোধ ছিল অদম্য, সম্মানজ্ঞান সর্বদা তুঙ্গে। এখন সময় হয়েছে সেগুলো বজায় রেখে বাকি জীবনটা নিরুদ্বিগ্নভাবে কাটানোর। নিজেকে আরেকটু অন্বেষণ করার। সারাটা জীবন তো ভবিষ্যত ঘোছাতেই কেটে গেল, এবার না হয় নিজের পরিচয়টা একটু গুছিয়ে নিলেন, যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতেও সকলে তাঁকে মনে রাখে। খ্যাতিলাভের প্রত্যাশা যে তাঁর আজও অনেক!


নতুন অখণ্ড মুক্তির জীবনের প্রথম দিন খুব সকালে ছেলের ফোন এলো,

'বাবা, একবার দেখা করতে চাই তোমার সাথে। এবারে আর না করো না। ব্যস্ততার খাতিরে এতদিন তো দূরে ঠেলে রেখেছিলে...'


কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রান্তিকবাবু ধমকে উঠলেন,

'দূরে কে ঠেলে রেখেছে প্রণবেশ? তুমি যদি নিজ ধর্মের বাইরে সহধর্মিণী পছন্দ করে বেশ থাকো, আমার মতামতকে সম্মান জানাতে না পারো, তাহলে আমাকেও একা আমার মতন বেশ থাকতে দাও। তোমাকে ক্ষমা করে দিয়ে সমাজের সামনে নিজের সম্মানকে ধূলোয় মেশাতে আমি কোনদিনই পারবো না। তাই অকারণ এসব আবেগপূর্ন প্ররোচনার চেষ্টা করো না'


'বারো বছর হতে চলল বাবা। এখনও কি ধর্মের দোহাই দিয়ে দূরে সরে থাকবে? গতকাল অবসর নিলে। এখন তোমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। আমরা সবাই চাই তুমি এই একাকীত্বের জীবন ছেড়ে আমাদের সাথে এসে থাকো। তোমার যত্ন নেওয়ার সুযোগ পাবো কাছ থেকে। তুমিও তোমার নাতি নাতনিদের সংস্পর্শে থেকে আনন্দে থাকবে। একবার এসে দেখোই না বাবা। ফতিমাও কাতর অনুরোধ করছে'


ফতিমা প্রণবেশের স্ত্রী। তেইশ বছর বয়সে পালিয়ে এক মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে প্রান্তিক সেন তাঁর ছেলেকে মুহুর্তমধ্যে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। প্রণবেশ অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে তার গোঁড়া বাপকে বোঝানোর। কিন্তু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রান্তিকবাবু নিজের আদেশ ছাড়া আর কারুর কথা শুনতে অভ্যস্ত নন। প্রণবেশ ভেবেছিল এতদিন পর বাবার মন নিশ্চয়ই গলেছে। অতীত থিতিয়ে ঘোলাটে জল পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ফের মুখ ঝাম্পটা দিয়ে ফোন কেটে দিলেন প্রান্তিকবাবু। 


রাগের মাথায় বরাবরই হিতাহিত জ্ঞান না করে ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। আজ সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন ব্যবস্থা করবেন যে লোকে তাঁকে তাঁর অদম্য নীতির জন্য মনে রাখবে। যারা তাঁর চোখে ভালো, তাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। আর যেই সন্তানের ওপর রেগে আছেন তাঁর অমতে এতবড় অধর্ম করার জন্য, তাঁর নীতির বিরুদ্ধে গিয়েও খুশি থাকার জন্য, তাকে মৃত্যুর পরেও ছুঁতে দেবেন না। সেই মতন পরিকল্পনা করলেন। কবে যে জীবনটা হুট করে শেষ হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। জীবন থাকতে মানুষে কি না করে, কতই না তার সন্মান! কিন্তু ঠিক যেই মুহুর্তে তার ইতি ঘটলো, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ থেকে পৃথিবী তাকে ছাড়াই অক্লেশে এগিয়ে যাবে। এই তো নিষ্ঠুর লঙ্ঘনহীন নিয়ম। কিন্তু তাঁর বেলায় হবে অন্য। কি সেই উপায়? 


অনেক খবরাখবর নিয়ে প্রান্তিকবাবু খোঁজ পেলেন শহরে নতুন চালু হওয়া 'আশীর্বাদ শ্রাদ্ধকার্য পরিষেবা' সংস্থার। শহরে এদের পরিষেবা নতুন চালু হয়েছে বলে শুনেছেন। রমরমিয়ে ব্যবসা খুব একটা না চললেও, এদের পরিষেবার বেশ সুনাম আছে। এখানে কোনো গ্রাহকের ইচ্ছা অনুযায়ী তার পরিচিত মানুষের শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রান্তিকবাবু ঠিক করলেন, তিনি নিজেই নিজের অজানা সেই দিনটার কাজ গুছিয়ে রাখবেন। অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতকাল তো কি হয়েছে, সেই দিন তো একদিন আসবেই। কে থাকবে সেদিন তাঁর পাশে? কেউ না। তাই নিজেরটা নিজেকেই গোছাতে হবে। দরকার হলে বেশি পারিশ্রমিক দেবেন। তাঁর সৎকার কার্য থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান, সবশেষে তাঁর উইল অনুসারে সমস্ত উল্লিখিত সম্পত্তি যথাযথ স্থানে হস্তান্তর করা, এই সব কিছুই উনি ওই সংস্থার দায়িত্বে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ছেলে প্রণবেশকে ধারেকাছেও আসতে দেবেন না। 


দুর্ভেদ্য এই ক্রোধের দুর্গ ভেদ না করতে পেরে প্রণবেশ আর ফতিমাও ক্লান্ত। তারা চিন্তিত এই দেওয়ালের পেছনে আসলে অবসাদে আক্রান্ত মানুষটিকে নিয়ে। কি করলে যে মানুষটাকে তাদের সান্নিধ্যে আনতে পারবে, মান অভিমান কাটিয়ে একটু শান্তি দিতে পারবে, কোনোভাবেই ভেবে পায় না তারা। ফতিমা খুব ছোটবেলা থেকে অনাথ। অল্পবয়সে মা হারা হওয়া প্রণবেশকে যে তাদের বিবাহের কারণে এত বড় শাস্তি পেতে হবে, আজীবন বাবা থেকেও সেই ছত্রছায়ার থেকে বঞ্চিত হতে হবে, সে কথা সে কল্পনাও করতে পারেনি। 


ওদিকে প্রান্তিকবাবু মেতে উঠেছেন নিজের শেষকৃত্য গোছানোর তাগিদে। জীবনটা উপভোগ করার বদলে, এই এখন হয়ে উঠেছে তাঁর প্রধান লক্ষ্য। কি কি বাড়তি শ্লোক পড়বেন ঠাকুরমশাই, কতজনকে নিয়মভঙ্গের দিন নিমন্ত্রণ তালিকায় রাখবেন, খাওয়াদাওয়ার কি এলাহী ব্যবস্থা করবেন, কতগুলো অনাথ আশ্রমে তাঁর সম্পত্তির কিছু অংশের ভাগ দেবেন আর তারা কিরকম প্রশংসা করবে, কোন মন্দিরের ফলকে নিজের নাম খোদাই করবেন জন্ম-মৃত্যু তারিখ সমেত, নিজে না থেকেও আর কি কি ভাবে নিজের প্রগাঢ় উপস্থিতি জাহির করবেন, এইসব ভেবেই দিন তিনেক কাটিয়ে ফেললেন। বর্তমানকালে তাঁর উপস্থিতি আর কর্ম দিয়ে কাছের মানুষদের ভরিয়ে রাখার কথা নির্দ্বিধায় ভুলে থাকলেন তিনি।


সপ্তাহখানেক পর, বেশ আহ্লাদিত হলেন ভেবে যে তাঁর এই অভিনব উদ্যোগের জন্য নিশ্চয়ই সেন সাহেবকে লোকজন বছরের পর বছর মনে রাখবে। এমন সাহস আর মনের জোর কি সবার হয়? একবারও ভাবলেন না, অতীতের তলিয়ে যাওয়া দ্বীপ ইতিহাসের পাতায় ছাপ রেখে গেলেও, বর্তমানে তার প্রভাব প্রায় শূন্য। যাদের ওপর ছাপ ফেলে যায়, তারাও যে একদিন শূন্যে তলিয়ে যাবে। কিন্তু হাতে হাত ধরে দ্বীপ থেকে দ্বীপপুঞ্জ, দ্বীপপুঞ্জের থেকে দেশ হয়ে ওঠার কাজটাই আসলে বড়ো হতে থাকে, স্তিমিত হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার বদলে, সেই যে আসলে উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে টিকে থাকে শাশ্বতকাল, সে কথা একবারও তাঁর মনে এলো না।


মাসখানেক পর 'আশীর্বাদ শ্রাদ্ধকার্য পরিষেবা' সংস্থায় ফোনটা করেই ফেললেন প্রান্তিকবাবু। আজ তিনি উড়ছেন, আজ তিনি তাঁর নিয়মের রাজা, আজ তিনি সকলের ঊর্ধে!


ওপাশে সংস্থার মালিকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

'নমস্কার, আমি আশীর্বাদ শ্রাদ্ধকার্য পরিষেবা সংস্থার কর্ণধার মিস্টার প্রণবেশ সেন বলছি। বলুন, কিভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?'


থমকে গেলেন প্রান্তিকবাবু। থেমে থাকা মুহুর্তেরা চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, 

বেরিয়ে এসো প্রান্তিক, নিজের ছদ্ম সম্মানের বেড়াজাল ভেঙে উন্মুক্ত পৃথিবীর শ্বাস নাও! তাকিয়ে দেখো! বেঁচে ওঠো!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics