আঁধারে আলো
আঁধারে আলো
দীপাবলী দাশগুপ্ত... সংক্ষেপে DD, রাজধানী শহরের বা সাংস্কৃতিক মহানগরের অর্থাৎ শহর কলকাতার একটি অন্যতম জনপ্রিয় গড় মাঝারির থেকে কিছুটা বড় মাপের পাক্ষিক পত্রিকা "আঁধারে আলো"র চিফ এডিটর। অনি মানে অনিন্দিতা বসুর দু-একটি ছোটগল্প "আঁধারে আলো"তে ছাপা হলেও বেশির ভাগই অমনোনীত। লেখা জমা দিতে বারবার আসার সুবাদে অনি অফিসের সবার পরিচিত ও প্রিয়।
DD এর সাথে অনির এক অসমবয়সী বন্ধুত্ব জমাট বেঁধেছে। অনির একটা নির্দিষ্ট রোজগার চাই জেনেছিলো DD, ব্যাস্, পরিচয়ের এই সূত্রটুকু ধরেই "আঁধারে আলো" পত্রিকা অফিসে একটা ট্রেনী সাব-এডিটরের কাজ জুটে গেলো অনির। অনি ইয়ং ডিলিজেন্ট ও কম্পিটেন্ট, কাজেই অফিসের ডিউটি বুঝে নিতে ওর খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি।
মাঝে বেশ কটা বছর পার, অনি আজকাল আর লেখার তেমন উৎসাহ পায় না, রসদটাই যেন ফুরিয়ে গেছে। অন্যের লেখা কারেকশন করতে করতেই দিন কাবার। তবে চাকরিটা অনি মন দিয়েই করছে। DD কদিনের জন্য ছুটি কাটাতে গেছে কলকাতা শহরের বাইরে, অনিকে এডিটোরিয়ালের অস্থায়ী দায়িত্বে রেখে।
ভারী খুশি অনি, টগবগিয়ে ফুটছে। দরকারী একটা রাবারস্ট্যাম্প খুঁজতে অনি DD-এর কেবিন তোলপাড় করে ফেললো। ড্রয়ার, স্টীলসেফ, শেল্ফ এমনকি কোণে রাখা কাবার্ডটাও বাদ দিলো না। হতাশ অনি, পায় নি দরকারী স্ট্যাম্পটা। ক্লান্ত অনি চায়ের জন্য কেবিনের বাইরে যাবে, এমন সময় দেওয়ালে আটকানো ছোট্ট একটা ক্যাবিনেটে চোখ আটকে গেলো, ওতেই হয়তোবা থাকতে পারে রাবারস্ট্যাম্পটা!
একটা কম্বিনেশন লক লাগানো ছোট্ট ক্যাবিনেটটায়। এধার ওধার ঘোরাতে ঘোরাতেই কট করে খুলে গেলো লকটা। পাল্লাটা স্লাইড করে অনি খুলে ফেললো ক্যাবিনেটটা। কিন্তু ওটা অনেক রোল করা কাগজে ভরা। কি ওগুলো? খুলে ফেললো একটা রোল করা কাগজ। ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে একের পর এক জমা হতে থাকা অমনোনীত তাড়া তাড়া লেখা এখানে? এইভাবে?
কাগজের অফিস থেকে মুখ শুকনো করে ফিরে যাওয়া উঠতি লেখকদের মুখের মিছিলে নিজের মুখটাও অনি দেখতে পেলো। নিজের অমনোনীত সব লেখাগুলো অনি আবিষ্কার করলো পান্ডুলিপির আকারে, একটা কন্ট্র্যাক্ট ফর্ম সমেত। অনির অমনোনীত লেখারা সব রাশিকৃত, জমেছে পান্ডুলিপিরূপে, লেখকের নামের জায়গায় দীপাবলী দাশগুপ্ত।
অনি নিজেকে ভারী চালাক চতুর ভাবতো, তবে প্রমাণ হয়ে গেছে আসলে অনি একটা বোকার হদ্দ। বোকাসোকা অনি নিজের ব্যাকপ্যাকে সব লেখা... থুড়ি পান্ডুলিপিগুলো ঠেসে ঠেসে ভরলো! অনি ভাবছে... আকাশ-পাতাল... সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব। ভাবছে অতীত, ভাবছে বর্তমান আর ভাবছে অদূর নিকষ কালো অন্ধকার ভবিষ্যৎও। তবে দেখছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এক আলোকরশ্মি সেই অন্ধকারে।
আজ নিজের একটা পুরোনো লেখা, DD-এর কেবিনের ক্যাবিনেটের ভেতরে খুঁজে পেয়েছে। ভুলেই তো গিয়েছিলো ও ঐ লেখাটার কথা! মায়ের চোখ ছলছল করেছিলো লেখাটা পড়ে। এমনকি অবনীস্যারও লেখাটা পড়ার পর অনেকক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে নিশ্চুপ বসেছিলেন। তুতুকে লেখাটা পড়তে দিতেই ও এককপি জেরক্স করে নিয়েছিলো। তারপর লেখাটা ওদের বন্ধুমহলের সবার হাতে হাতে ঘুরেছে দিনের পর দিন। নিখিলদার হাতেও লেখাটা পৌঁছেছিলো হাত ঘুরে ঘুরে। একসন্ধ্যায় অনিকে ডেকে পাঠালেন নিখিলদা। আরও অনেকেই ছিলো সেদিন সেখানে। সবাই জমায়েত হয়েছে অকৃতদার নিখিলদার সাদামাটা দু-কামরা বাড়ীর বড় ঘরটায়, রিহার্সাল চলত
ো রোজ যেখানে। জগাদার দোকান থেকে সবার জন্য চায়ের সাথে মোচার চপ আর মাংসের ঘুগনিও এসেছিলো।
উপলক্ষ্যটা ছিলো অনির ঐ লেখাটার সেলিব্রেশন। আর একটা প্রস্তাব... নিখিলদা অনিকেই বললেন লেখাটার নাট্যরূপের স্ক্রিপ্ট করতে। দরকার পড়লে নিখিলদা নিজেও কিছুটা সাহায্য করবেন অনিকে। সবাই হৈহৈ করছে, তার মধ্যেই অনি বলেছিলো, ও চায় ঐ লেখাটা আগে "আঁধারে আলো" পত্রিকায় ছাপা হোক, তারপর ও নিখিলদার প্রস্তাব ভেবে দেখবে। নিখিলদা কিন্তু অনির পিঠ চাপড়ে অনির ইচ্ছে আর সংকল্পের সম্মান জানিয়েছিলেন। এরপর অনি উঠে পড়েছিলো সবাইকে বিদায় জানিয়ে।
তখন অনির দু-চারটে লেখা এদিক ওদিক ছেপে বেরিয়েছে, চোখে অনেক স্বপ্ন, মনে অগাধ বিশ্বাস। অটুট মনোবল নিয়ে ছোট বড়ো মাঝারি সব কাগজেই আরও লেখা পাঠাচ্ছে। "আঁধারে আলো" মাঝারি হলেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। অনি লেখাটা "আঁধারে আলো" পত্রিকা অফিসে নিজে গিয়ে জমা দিয়েছিলো, একবুক আশা নিয়ে। এখন অনি ভাবলো, আচ্ছা, নিখিলদাও তো পারতেন অনির লেখাটার নাট্যরূপ করে কাহিনীকার হিসেবে নিজের নাম রেখে নাটকটা মঞ্চস্থ করতে! কিইবা করতে পারতো অনি? তা না করে, নিখিলদা অনিকেই অনেক বড়ো একটা সুযোগ দিয়েছিলেন, সম্মান করেছিলেন অনির কলমের। অনিই বরং সে প্রাপ্তির সম্মাননা দেখাতে পারে নি। সেদিনের সেই উদ্ধত অহমিকা আজ নিজের চোখে অনিকে অনেক খাটো করে দিয়েছে।
অনি আরও ভাবছে, নিজের আধা শহর মফস্বলটা,
চেনা মুখগুলো আর পিছনে ফেলে আসা সমস্ত সম্পর্কগুলো। সেই টানাপোড়েনের দিনগুলো, স্বর্ণালী সব সূক্ষ্ম বিশ্বাস ভরা মুহূর্তগুলো। অনি ভাবছে সম্পর্ক কি বিশ্বাসের পরিপূরক ? এই পৃথিবীতে কিছুই হারায় না, ফিরে ফিরে আসে। লেনদেন ঠিক থাকলেই সম্পর্কগুলোও ঠিকঠাক থাকে আর সৌন্দর্য্য বিকিরণ করে। তবে সম্পর্ক বোধহয় সতত সঞ্চরণশীলও বটে। পথ বদলায়, ঘাট বদলায়, দাম বদলায়, ওজন বদলায়, গতি বদলায়, মায় গন্তব্যও বদলায়! তবুও সবাই সম্পর্কে বিশ্বাসী এবং বিশ্বাসে অটুট আস্থা রাখতেই সচ্ছন্দ-সচেষ্ট-সচেতন, সচরাচর সদাসর্বদা বিশ্বস্ত থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার আবেগে বিশ্বাস-নির্ভরতার দিনাতিপাতে বিশ্বাসী! সম্পর্ককে অর্জন করতে অবশ্যই চাই বিশ্বাসের রাংতার সুদৃশ্য মোড়ক! অনি মোহভঙ্গে ভারাক্রান্ত, বিশ্বাসভঙ্গে বেদনাতুর, আশাভঙ্গে হতাশাগ্রস্ত, কিন্তু সাথে মোহমুক্তির আনন্দে আত্মহারা প্রায়। অনি এই রঙচঙে ঝলমলে মেকী মহানগরের জটিল গোলকধাঁধা থেকে বিদায় নেবে। এ মহানগরের মানুষের মনের ভেতরের পঙ্কিল জটিল ভুলভুলাইয়াতে আর সে পথ হারাতে চায় না। নিজেকে খুঁজে পেয়েছে সে, ফিরে পেয়েছে আবার।
নিজের ছোট্ট শহর ছেড়ে এই মহানগরের নাগরিক স্রোতে সে মিশতে চেয়েছিলো। হাতে কলম, মাথায় অক্ষর-শব্দ-যতির দঙ্গল আর মনের পটভূমিতে কল্পনার কারিকুরিকে সঙ্গী করে। হারানো আত্মবিশ্বাস তাকে ফিরে পেতেই হবে, আর তা ফিরে পেতেই সে ফিরবে নিজের সেই আধা শহরে। তবে ফেরার আগে অনির একটা কাজ আছে, কাজটা তাকে করতেই হবে। অনি হাঁটছে.... একা, তিলোত্তমা মহানগরী সুন্দরী কলকাতার রাজপথ থেকে অলিগলি, তবে উদ্দেশ্যহীন নয়। ভরসা পত্রিকা অফিসে লেখা জমা দেওয়া লেখকদের ঠিকানাগুলো, লেখার সাথেই জমা দেওয়া থাকে তো, ঠিক খুঁজে নেবে ওদের! একটা আন্দোলন অনি একলাই টেনে নিয়ে যাবে... আঁধারে আলোর সন্ধান করতে, কাউকে সঙ্গে না পাক, নিজের কলমকেই সঙ্গী করে।
(বিষয়: আন্দোলন)