Simanta Nandi

Abstract Classics Inspirational

4.3  

Simanta Nandi

Abstract Classics Inspirational

আমরা বাঙালী এসো বাংলা বলি

আমরা বাঙালী এসো বাংলা বলি

5 mins
223



ক্যালেন্ডারে ফের ফেব্রুয়ারি। আমরা, বাঙালিরা আবার একটু নড়েচড়ে উঠব। বাংলা ব্যবহারে একটু বেশি সচেতনও হয়ে উঠব হয়তো কতকটা অবচেতনেই।

এ মাস যে ভাষার মাস। আজ ভাষা দিবস। বুক ঠুকে আবার বলার সময় চলে এল, 'আমি গর্বিত, আমি বাঙালি!


জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ভাষার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙলিদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা মাতৃভাষা বাংলাভাষার স্বীকৃতি পাই। সেই আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালে নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করলে ২০০০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সকল দেশে এই দিনটি পালিত হচ্ছে।


সারা বিশ্বে বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলা প্রায় ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভীষণই গর্বের। কিন্তু বেশ কয়েক দশক ধরে একটি বিতর্ক মাথাচড়া দেয় বাংলা কেন পড়ব, বাংলায় কেন বলব? আধুনিক যুব সমাজ ভবিষ্যতের কর্মজীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে বাংলা ভাষা তাদেরকে কতটা সুদূরপ্রসারী ফল দিতে পারবে? অসংখ্য প্রশ্নচিহ্নের মাঝে রেখে তৈরি হচ্ছে ইংরেজি ভাষাচর্চার প্রতি আগ্রহ আর সেই উত্তুঙ্গ আগ্রহের বশবর্তী হয়ে কি বাংলা ভাষাচর্চা কি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে? বাংলায় কথা বলা, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান তা হলে সত্যিই কি জীবনের সাফল্যের পরিপন্থী?


এই সকল প্রশ্ন শুধু এখন নয়, ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবেশের পর থেকে চলে আসছে। এখন যুগ বদলেছে, সমাজ ও সময় বদলেছে। কিন্তু সমস্যা একই থেকে গিয়েছে।



যুগের চাহিদার সপক্ষে অবশ্যই বলতে হবে শিক্ষাগ্রহণের প্রাক্কালে ইংরাজিচর্চা বাদ দেওয়া ভীষণই কষ্টকর। ইংরেজি ভাষা বর্তমানে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের ভাষায় নয় এই বিশ্বায়নের যুগে সভ্যতার অগ্রগতির প্রধান ভাষা। তাই এই সময়ে ইংরেজি ভাষাচর্চা থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। কিন্তু তাই বলে বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির ভাষাকে রপ্ত করতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে দুয়োরানি করে রাখব— এটাও মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে, যখন আমরা বাঙালি। কেননা বিশ্বে যখন আমরা আঞ্চলিক ভাষাভাষী জাতি হিসাবে প্রথম দশের মধ্যে আছি। তবুও দিনের পর দিন বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে এই সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।


আমরা ‘শুভ জন্মদিন’ পালন না করে ধুমধাম করে পালন করি ‘হ্যাপি বার্থডে’। সঙ্গে অতিথিদের ‘রিটার্ন গিফ্ট’। মুঠোফোন আর ফেসবুক টাইমলাইনে শুধুই বার্থডে উইশ সবই ইংরাজিতে। স্মার্ট ফোন ফেসবুকেও দিব্যি বাংলা অপশন রয়েছে। সকালের প্রথম অফস্ক্রিন অথবা অনস্ক্রিন সাক্ষাতে বা চ্যাটে ভুলেও ‘সুপ্রভাত’ বলি না। এখন আর কেউ ‘ভেতো বাঙালি’ বলে ঠাট্টা করতে পারবে না। তাই তো সাত সকালেই চেনা পরিচিত দেখলেই প্রথমেই বলে দিই প্রথম আলাপে ‘হাই, গুড মর্নিং, হ্যাভ এ নাইস ডে’। বিদায়কালে বেশ গলা তুলেই বলি ‘বাই...সি ইউ সুন’। আমরা এমন সব কেতা দেখাই যে অবাঙালি পেলেই নিজের মাতৃভাষা বেমালুম ভুলে বাংলা উচ্চারণে প্রায় নির্ভুল হিন্দিতে কথা বলি। বাংলা বিজ্ঞাপনে অ-বাংলা শব্দগুচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদের তেমন ক্ষোভ নেই।


অথচ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ভাষাদিবস নিয়ে লিখতে বসি। ভারী যত্নে, পরম আবেগে কবি একদা লিখেছিলেন, “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা...”। আমাদের এই বাংলা ভাষা এমনই এক ঐতিহ্য আছে যা কিনা বৃহত্‌ এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আগলে রেখেছে নিজস্ব বনেদিয়ানায়। বস্তুত ভাষাকে মাধ্যম করেই এক একটি অঞ্চল বিশেষে এক একটি জনজাতির সৃষ্টি হয়। নিজেদের কথিত মাতৃভাষার গর্বেই একটা অঞ্চলের অধিবাসী নিজেদের মধ্যে একাত্মতা অনুভব করেন। এ ভাবেই ক্রমান্বয়ে একই অঞ্চলবাসী, যারা একই ভাষা ব্যবহার করেন, তারা নিজেদের এক জাতি এক প্রাণ বলে বিবেচনা করেন। মাতৃভাষাই সমস্ত গোষ্ঠীকে এক জাতিতে একত্রীভূত করে।


সমসাময়িক বিশ্লেষণে এটা দেখা যায়, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালির যে অতীত গৌরব ছিল, তা এখন অনেকখানি ইতিহাসে পরিণত। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ভাবের ঘরে চুরি করার মতোই এই ‘মহান একুশে’ পালন করে সত্যিই কী বাংলা ভাষার ব্যবহার বা প্রয়োগের ব্যবহারিক দিক মসৃণ হচ্ছে। বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সেমিনারে প্রথিতযশা সাহিত্যিককে সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায় বাংলা ভাষাটাই আদৌ ‘মোদের গরব মোদের আশা’ আছে কিনা।


পশ্চিমবঙ্গ তথা অন্য কিছু রাজ্যে নিজস্ব প্রাদেশিক ভাষা থাকলেও সেই সব মাতৃভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বাংলা ভাষার ব্যবহারও কমে আসছে। টিভি সিরিয়ালগুলোর বিরতির ফাঁকফোকরে বিজ্ঞাপন বিজ্ঞপ্তিতে বা বাংলা ম্যাগাজিনগুলোর বাংলার লিখিত বিজ্ঞাপনেও কোথাও কোথাও উদ্ভট বাংলা। হয়তো সেগুলি বিজ্ঞাপন কপিরাইটার মূল হিন্দি বা ইংরেজি বিজ্ঞাপনী বিবৃতির অক্ষম বাংলা অনুবাদ। বাংলা ভাষাটাই যেন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। এখন তো প্রকৃত বাংলার সঙ্গে হিন্দি-ইংরাজি ভাষার মিশেল দেখে দেখে, শুনে আমরা এতটাই ধাতস্থ হয়ে গেছি যে এই জগাখিচুরির ব্যাপারে আর কোনও তাপ-উত্তাপ বোধ করি না।


মার্কিন প্রবাসী বাঙালি মহলে অবশ্য প্রকৃত বাংলাভাষীরা ভেসে থাকে কিংবা ডুবে থাকে মূলস্রোতের বিপরীতে। ‘আমেরিকান বাঙালি সমাজ’-এ নীরদ চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙ্গালি’রা বিরাজ করছে সগৌরবে। তারা ‘বাংলার চর্চা নেই বহুদিন’ গোছের একটা কৈফিয়ত দিয়ে, চরম হীনমন্যতার সঙ্গে খসখসিয়ে দু’লাইন ইংরেজি লিখে ইনভাইট করে, মেসেজ পাঠায়, কনগ্র্যাচুলেশন জানায়, হ্যাপি বার্থডে বা হ্যাপি অ্যানিভারসারি বলে, কেউ মারা গেলে আরআইপি লেখে! তারা শুধু বাংলাভাষা ভোলেনি, ‘ভালবাসা’-ও ভুলেছে। তারা একে অপরকে আর ‘তোমাকে ভালবাসি’ বলে না, বলে ‘লাভ ইউ’! সারাক্ষণ গুচ্ছের অ্যাপ নিয়ে তারা খেলে চলেছে! অথচ বাংলা বর্ণমালার অ্যাপ চালাতে গিয়ে ভুল বানান লিখে, অর্থহীন বাক্য ফলিয়ে, ঘেমেচেমে একশা হয়ে যায় ওই বং জেনারেশন। এবং তার জন্য কোনও অনুতাপও নেই ওদের। বাঙালি লজ্জা পায় শুধু ভুল ইংরেজি বললে বা লিখলে। বাঙালি শুধু নির্লজ্জের মতো বলতে জানে যে, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’!


সত্যি কথা বলতে বাংলা ভাষা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবনার দিন এসেছে। যাতে আগামীতে ভাষাটা আরও বিপন্ন না হয়ে পড়ে। নতুন প্রজন্মের বড় অংশ মাতৃভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু দোষ তাদের নয়। দোষ অবস্থার। পরিকাঠামোর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে এই প্রজন্মের শিক্ষা শুরু হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। খাস কলকাতাতেই ইংরেজি-হিন্দির দাপটে বাংলা ভাষা বিপন্ন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বাঙালিয়ানাটা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছেও বাংলা ভাষা ক্রমে দূরের গ্রহের ভাষা হয়ে যাচ্ছে।


এই সঙ্কটমোচন হতে পারে কী ভাবে? সেই সমাধান সূত্রে আমরা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হতে পারি। তিনি ‘বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে একটি প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন তার সূত্র ধরে বর্তমানের যুগোপযোগী করে বললে বলা হয় যে, শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাও যাতে ভাল করে শেখানো হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার পথ করে দিলে তাদের শিক্ষার ভার যখন হাল্কা হবে তখন তারা আরও বেশি করে ইংরেজি শিক্ষায় মন ও শ্রম দিতে পারবে। অর্থাৎ, শিক্ষায় মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতেই হবে।


তবুও আশার আলো দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বাঙালি এখন তার নিজের মাতৃভাষায় কথা বলা, চর্চা করতে এগিয়ে আসছে। লোকদেখানো অপ্রয়োজনীয় হিন্দি, ইংরাজির স্থলে বাংলায় স্বচ্ছন্দ হচ্ছে, বাংলাটা ধীরে ধীরে তাদের কাছে আসছে। এই পরিবর্তনের মূলে অনেকাংশই অবদান রয়েছে যেমন নতুন বাঙালি হয়ে ওঠার তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ারও। নবীন, যুবা, বয়স্কেরাও ইংরেজি-বাংলা রোমান হরফ ছেড়ে বাংলায় লিখে মনের ভাব প্রকাশ করছে। এগিয়ে আসছে প্রযুক্তিবিদেরা। কারণ বিশ্বের প্রায় ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে সম্মান জানানো ছাড়া উপায়ও যে নেই। সময় এসেছে মোড় ঘোরানোর, এ বার আবারও প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের দিকে। কারন আমরা, আমজনতা, আগাগোড়া আটকে রাখি আমাদের আবেগের ভাষাকে। সেই আবেগে আতিশয‍্য আরকাঠি হয়ে আসেনা কোনোদিন। আমরা যারা এই আকালেও আনমনা আগন্তুক স্বপ্নের স্বপ্ন দেখি, তা তো কেবল আমাদের ভালোভাষা-ভালোবাসাকে অটুট রাখার জন‍্যই। আসলে আমরা সবসময় চাই, আমাদের ভাষা আমে, জামে, সর্বনামে আরামে থাকুক। ভালো থাকুক। আমাদের এইটুকু চাওয়াকে আমরা আদর দিয়েই পূর্ণ করবো।



"....তারই তো সময় বইছে এ ভাষার শিরায় শিরায় 

যে-শিরাকে নদী ভেবে ভেসে যেতে চাইছি আমিও 

নৌকা ছোট হতে পারে, কিন্তু তা ফিরেছে বাংলায়

এ-বাতাসে শ্বাস টানবো, এইটুকু অধিকার দিও!....."


--------শ্রীজাত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract