তামাক সেবন একটি অভিশাপ
তামাক সেবন একটি অভিশাপ
"Tobacco is a terrorist that makes you hollow day by day and then end your life."
মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হল তামাক সেবন। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে একজন ধূমপায়ীর কাছে তার প্রধান খাবারের চেয়েও ধূমপানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকের মধ্যেই একটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, তামাক সেবন করলে স্ট্রেস কমে বা টেনশন কমে যায়, তাই অনেকে ধূমপানের ব্যবহৃত তামাককে বলে ‘ব্রেইন টনিক’। অনেকেই আবার মনে করেন ধূমপান করা একধরনের ফ্যাশন বা স্মার্টনেস, আভিজাত্যের প্রতীক। তবে ধূমপায়ীদের কোনো ব্যাখ্যারই বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই বরং প্রতিটি সিগারেট বা বিড়িতে ছয় মিনিট আয়ু কমে যায়। মূলত এক প্রকার আসক্তির কারণে তারা ধূমপান করে থাকে। অর্থহানির সঙ্গে ঘটে স্বাস্থ্যহানি, যার পরিণাম মৃত্যু।
গবেষণায় দেখা যায়, সিগারেটে ৭০০০ এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে। যা ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ সহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগের জন্য সরাসরি দায়ী। এছাড়া বিড়ি, হুক্কা এবং ধোঁয়াবিহীন বিভিন্ন তামাকপণ্য সমানভাবে জনস্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। সরাসরি তামাক আসক্তির কারণে পৃথিবীতে বছরে ৮০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ধূমপান না করেও পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ১২ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। তামাক সেবনের ফলে ভারতে প্রতি বছর ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
অন্যতম তামাকজাত দ্রব্য, যেমন- পান, গুটখা, খৈনি, বিড়ির ব্যবহার দিন দিন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন পাবলিক সেক্টর, সরকারি চত্বর, কার্যালয়গুলিতেঔ পান, গুটখা ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট দৃশ্যদূষন প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ধূমপান হলো বিষপান। এটা মূলত জেনে শুনে বিষপান করা। ধূমপানের ফলে মানুষ যে ধোঁয়া তার ফুসফুসের মধ্যে টেনে নেয় তাতে থাকে নিকোটিন। এটি কিছু সময়ের জন্য মানুষের মস্তিষ্ককে হয়তো চঞ্চল করে তোলে কিন্তু শরীরের জন্য রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। শরীরের নিউরােট্রান্সমিটার এসিটাইকোলিন (এ সি এইচ) যা এক নিউরন থেকে অন্য নিউরনে তথ্য সংবাহন করে এসিটাইকোলিন এমন এক গুরুত্বপূর্ণ নিউরােট্রান্সমিটার যা শারীরিক উত্তেজনা, শিক্ষাগ্রহণ ও স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এসিটাইকোলিনের সঙ্গে মিশে নিকোটিন এক প্রকার ট্রিগার ইমপাল্প হিসেবে কাজ করে।
ধূমপানের ফলে মানুষ তৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করে না।
কিন্তু এর নিকোটিন মিশ্রিত ধোঁয়া ধীরে ধীরে ফুসফুসকে গ্রাস করে, অকেজো করে দেয়। ফলে মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কাশি, হাঁপানি, বক্ষব্যাধির মতো রোগগুলোকে ধূমপান কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সারই নয় কখনো কখনো তামাক সেবন মুখের ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, মুত্রথলীর ক্যান্সার, অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের মতো জীবননাশী রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ধূমপান মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় লক্ষাধিক লোক হৃদযন্ত্রের রক্তনালীর সমস্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। যার জন্য দায়ী হলো ধূমপান। তামাক সেবন শরীরের অন্যান্য রোগকে আরো জটিল করে তোলে। ধূমপায়ী গর্ভবতী নারীদের সন্তানের জন্মের আগেই নানা রকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই ধূমপান শুধু ধোঁয়া সেবনই নয় বরং ধোঁয়ার আড়ালে বিষপান। ধূমপানের ফলে মানুষ খুব সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
তামাক প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি ও কার্যকরী পদক্ষেপ হলো ব্যক্তির সদিচ্ছা ও একান্ত প্রচেষ্টা। একজন ব্যক্তি যদি সচেতনভাবে তামাককে এড়িয়ে চলে, আসক্ত হতে না চায় কিংবা ধূমপান ছাড়তে চায় তাহলে সে খুব সহজেই তার মনোবল দিয়ে তামাককে প্রতিরোধ করতে পারে। তামাক সেবন প্রতিরোধ করতে হলে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সবার আগে তামাক উৎপাদনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ, নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তামাক বিরোধী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে বিশ্বমানের সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দেশব্যাপী ধূমপানের বিরুদ্ধে প্রবল সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
কেউ কেউ বলে মানুষ অভ্যাসের দাস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ কখনোই অভ্যাসের দাস নয়। মানুষ চাইলেই তার যেকোনো অভ্যাসকে পরিত্যাগ করতে পারে। তাই শুধুমাত্র অভ্যাসের দোহাই দিয়ে কেউ তামাক ছাড়তে না পারলে বুঝতে হবে সেটি তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা। তামাক সেবন মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়, মরণব্যাধিতে আক্রান্ত করে। তাই ধূমপায়ীদের উচিত যেকোনো উপায়ে ধূমপান বন্ধ করা। সচেতনভাবে দৃঢ়তার সাথে ধূমপানকে 'না' বললে যে কেউ ধূমপানকে প্রতিরোধ করতে পারবে আর নিজেকে বিষপান থেকে দূরে রাখতে পারবে। এবং এই ভাবেই আমরা আমদের স্বপ্ন- "একটি তামাকমুক্ত সমাজ" গড়ে তুলতে সাফল্য লাভ করবো কারন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও লেখক John Lennon বলেছেন-
"A dream you dream alone is only a dream. A dream you dream together is a reality."