Md Nafis Ullah

Action Inspirational Others

3  

Md Nafis Ullah

Action Inspirational Others

আমাদের স্বাধীনতা

আমাদের স্বাধীনতা

6 mins
275



৩রা মার্চ, ১৯৭১

কিছুই বুঝতে পারছি না! আজ সকালে দেখলাম পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা আমাদের ছাদ থেকে সরানো হয়েছে। 

তার পরিবর্তে লাল-সবুজ একটি পতাকা লাগানো হয়েছে। যা হোক! এই নতুন পতাকা আগেরটার তুলনায় বেশ সুন্দর। বাবা আর্মি অফিসে চাকরি করেন। কয়েকদিন ধরে তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। 

“বুঝলি, দেশ দ্রুত একটি ভয়ংকর যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।”

“কেন বাবা?”

“তুই এসব রাজনীতির বিষয় বুঝবি না। তুই এখনো অনেক ছোট ।”

বাবার কথার কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, বাবা-মা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের একটি মানুষ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত কথা বলছেন। তিনি নাকি মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। আমার খুব দেখার ইচ্ছে হলো এই মানুষটাকে। 


৭ই মার্চ, ১৯৭১

আজ সকালে দেখলাম বাবা খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচ্ছে। 

“কোথায় যাচ্ছো বাবা? ”

“রেসকোর্স ময়দান।”

“আমাকেও সাথে নিয়ে চলো বাবা।”

“তুই ও যাবি? আচ্ছা চল্।”

রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে দেখলাম কানায় কানায় লোকে ভর্তি। আমি আর বাবা মাঠের বাইরে ছোট একটি জায়গায় গিয়ে বসলাম। হঠাৎ করে দেখলাম গায়ে কালো কোট পরা একটি লোক মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে। সবাই তাকে ঘিরে উল্লাস করছে। এ সময় বাবা বললেন, 

“ইনিই শেখ মুজিব। বাংলাদেশের জাতির পিতা।”


কি বলে! বাংলাদেশের জাতির পিতা! অথচ এত সাদামাটা জীবন! কোন দাম্ভিকতা নেই, কোন দেহরক্ষী নেই, মনে হয় যেন জনগণই তাঁর প্রাণ। তারপর হঠাৎ কানে ভেসে এলো এক বজ্রকণ্ঠ: 

  “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম 

   এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

তর্জনী উঁচিয়ে ভাষণ দেওয়া, জনগণের চোখে স্থির দৃষ্টি, গায়ে কালো কোট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মনে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয়,যেন সত্যিকারের ইতিহাসের এক মহানায়ক। কেন জানি হঠাৎ করে আমার মনে এই মহামানবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় ভরে উঠল। 


২৫শে মার্চ, ১৯৭১ 

সকালবেলা আমি ও আমার বন্ধু তুহিন ফুটবল খেলছিলাম। তারপর আগামীকালের খেলার প্ল্যান করে বাড়ি ফিরে গেলাম। রাতে বাসার সবকাজ শেষ করে ঘুমাতে গেলাম। 

মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে ট্যাংকের ট্যার ট্যার আওয়াজ। 

বাবা-মা প্রচুর চিন্তিত ছিলেন। সারারাত না ঘুমিয়ে কাটালাম। পরদিন সকালে বাবা বললেন-

“রাতে পাকিস্তানি আর্মি ঘুমন্ত বাঙালি ও পুলিশদের উপর হামলা চালিয়েছে। অনেক মানুষ নিহত হয়েছে।”

বাবার কথা শেষ হতে না হতেই তুহিনের বাড়ি থেকে প্রচন্ড কান্নার আওয়াজ শুনতে পারলাম। ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকি রইল না। তুহিনের বাড়ি যেতেই দেখলাম তুহিনের বাবার লাশ মাটিতে পড়ে আছে। সারা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আমার মন ঘৃণায় ভরে উঠল। এ দৃশ্য দেখে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কিছুটা উপলব্ধি করলাম। রাস্তায় বেরোতেই দেখি সারি সারি লাশ উপরে ফেলা হয়েছে। এখন বুঝলাম স্বাধীনতা মানে কি। আমাদের জন্য স্বাধীনতা কতটা প্রয়োজন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এই রক্ত বৃথা যেতে দিব না। দেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবই।


২৬শে মার্চ, ১৯৭১

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম বাবা-মা সবাই রেডিও হাতে নিয়ে খবর শুনছে। শুনলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তাকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে এই কি সেই স্বাধীনতা! যার জন্য এত অপেক্ষা! এত ত্যাগ! 


বিকালবেলা। বাবা হঠাৎ করে তার কয়েকজন বন্ধুকে বাড়ি নিয়ে এলেন। তাদের সবার সাথে রাইফেল। আমার মাথায় বাবা হাত বুলিয়ে বললেন –

“বাবা! যুদ্ধে যাচ্ছি। ফিরে আসতেও পারি,নাও আসতে পারি। তবে তোমরা হলে এদেশের ভবিষ্যৎ। তোমারই এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ কথা সবসময় মনে রেখ।”

বাবা বিদায় নিলেন। খুব খারাপ লাগছিল। বারবার শুধু বাবার কথা মনে পড়তে লাগল।


৭ই এপ্রিল, ১৯৭১

আমি আর তুহিন খেলছিলাম। হঠাৎ মনে হলো দেশের জন্য সবাই যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, তবে আমরা কেন পারব না? আমরাও যাব। আমরা সেই রাতেই তৈরি হয়ে রওনা দিলাম বর্ডারের উদ্দেশে। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিলাম। আমাদের দুজনকে একটি দলের সাথে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। দলের সবাই ছিলেন খুবই ভালো। প্রথমে আমরা ধোঁয়া-মোছার কাজ করতাম। তারপর একদিন সাহস করে অস্ত্র হাতে নিলাম। বড় ভাইদের বললাম আমিও যুদ্ধ করব। আমরা দুজনেই অস্ত্র চালানো শিখতে লাগলাম। হঠাৎ একদিন পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। আমি বললাম, “আমরাও যাবো।” দলের সবচেয়ে বড় তাসকিন ভাই আমাদের বললেন, “দেখ, তোরা এখন অনেক ছোট। তোরা যাস না।” কিন্তু আমরা নাছোড়বান্দা। অবশেষে আমাদের জেদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদেরকে দলে নেওয়া হলো। ক্রলিং করে আমরা বিপক্ষ দলের নাগালে গেলাম। তুহিন চুপিসারে জিজ্ঞাসা করল, “ফায়ারিং শুরু হবে কখন?” আমি বললাম,“এখনই।” হঠাৎ করে ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। আমরাও খুব সাহসের সাথে যুদ্ধ করলাম। তিন তিনটে পাকিস্তানিকে শেষ করে দিলাম। হঠাৎ করে একদিন সাবুভাই এসে বলল, রাজু, দেখতো। তোর সাথে কে যেন দেখা করতে এসেছে। গিয়ে দেখি আমার বাবা! কিন্তু তার এক পা ভাঙা। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। 

“বাবা, তোমার এ অবস্থা কেমন করে হলো? কে করল এসব?”

“আরে বোকা! আমাদের এই ভাঙা পায়ের উপরেই তো এ দেশ দাঁড়িয়ে আছে।”

বাবার কথায় আমি যেন অবাক হয়ে গেলাম। নিজের এক পা হারিয়ে বাবার যেন সামান্যতম দুঃখ-কষ্ট নেই। কিছুক্ষণ পর বাবা তার দলের সাথে চলে গেলেন।

হঠাৎ এক সপ্তাহ পর খবর পেলাম গ্রামে রাজাকার বাহিনী আসছে। তারা পাকিস্তানিদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। ভাবলাম এই জানোয়ারগুলোকে শেষ করে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো। মোহনপুর গ্রামের রোড ধরে তারা এগিয়ে আসবে। সেখানেই তাদেরকে উড়িয়ে দিতে হবে। 

কমাণ্ডার আনিসুজ্জামান বললেন, “আমরা দুজন বয়সে ছোট বলে আমাদেরকে নেওয়া হবে না।”

আমি বললাম, “স্যার আমরা পারব। আমরা বয়সে ছোট হলেও দেশের জন্য জীবন বলিদান দিতে প্রস্তুত।”

অবশেষে স্যার আমাদের সাথে নিলেন। মুবারক ভাই

দূর থেকে নজর রাখছিলেন। হঠাৎ করে একটি গুলি এসে তার বুকে লাগে। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমি দ্রুত তাকে কভার করে সরিয়ে নিয়ে এলাম। 

তিনি আমাকে বললেন,“আমাকে কথা দে, তোরা এই দেশটাকে স্বাধীন করবি। সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবি।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। কথা দিলাম। এ অঞ্চল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সনা তাড়ানো পর্যন্ত আমি এ অঞ্চল ত্যাগ করব না।”

এরমধ্যে ভাইয়া তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমি দুহাতে তার চোখ ঢেকে দিলাম। মনকে শক্ত করলাম। ভাবলাম, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হলে আমাদেরকে আরো দূর এগিয়ে যেতে হবে। 

ডিসেম্বর মাস এসে গেল। চারদিক থেকে শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করার খবর আসছে। কিন্তু আমাদের অঞ্চল এখনো শত্রুমুক্ত হয়নি। এবার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হলো। এইবার আমাদের অঞ্চল শত্রুমুক্ত হবেই।


১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর আসছে। শোনা যাচ্ছে আজ বিকেলেই নাকি পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।

আজ আমাদের চূড়ান্ত অপারেশনের দিন। জানি না কেন সকাল থেকে বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আজ তাদেরকে অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে। কে জানে, হয়তো আজ আমার শেষ দিন। আর কোনো দিন হয়তো মা-বাবা, তুহিন কারোর সাথেই দেখা হবে না। 

অপারেশনে যাওয়ার আগে তুহিনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। 

অবশেষে অপারেশনে যাওয়ার সময় এসে গেল। আমরা সকলে জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শন করে, আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চাইলাম। 

সাবুভাই এবার গাছের উপর বসে সেনাদের উপর নজর রাখছিলেন। তার ইশারায় তুমুল ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। তখন প্রায় মধ্যরাত। ফজলের আজান শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষেই তুমুল যুদ্ধ চলছে। এমন সময় হঠাৎ করে পাকিস্তানি বাহিনীর এক সেনার ছোঁড়া গুলি সাবুভাইয়ের বুকে এসে লাগে। আমি দ্রুত তাকে কভার করে পাশে নিয়ে আসছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করে কি একটা যেন আমার বুকে এসে বিঁধল। কিন্তু তা দেখার সময় এখন আমার হাতে নেই। এরই মধ্যে সাবুভাই বিদায় নিলেন। আমারও হঠাৎ খুব কষ্ট হতে লাগলো। এমন সময় বুকে হাত লাগতেই দেখি টাটকা রক্ত! এরই মধ্যে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। উঠবার আর কোনো শক্তি রইলো না।

হঠাৎ খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এসময় শুধু বাবা-মা, তুহিন, তুহিনের বাবা, সাবুভাই সবার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। সবাই লাল-সবুজ রঙের এক নৌকায় করে দেশে ফিরে আসছে। সবার মুখে সেই অমলিন হাসি। তুহিন ও তার বন্ধুরা সেই নদীতে গোসল করছে। নদীর রঙ, আকাশের রঙ সবই লাল-সবুজ লাগছিল। এখনো মনের মধ্যে কেমন যেন আলাদা একটা আনন্দ হচ্ছে। আচ্ছা! মৃত্যুর সময়ও কি আনন্দ হয়? হয়তোবা না। তবে আমার কেন এত আনন্দ হচ্ছে? চারদিক থেকে শুধু মুক্তিবাহীনির জয়ধ্বনি আসছে। তবে এই কি সেই স্বাধীনতা, যার জন্য কোটি কোটি মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিল। এত মানুষ তাদের সকল কিছু ত্যাগ করল। স্বাধীনতার স্বাদ কি এতই মধুর! মুখ দিয়ে তখন শুধুমাত্র একটি কথাই উচ্চারিত হলো-


                      জয় বাংলা





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action