আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ত্রয়োত্রিংশতি অধ্যায়
সারারাত নিদ্রাহীন থেকে ভোরের দিকে চোখ দু'টো বুঁজে এসেছিল । কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই । এদিকে সকাল হতে না হতেই বাড়ীর ঝি-চাকরেরা এসে দরজায় নাগাড়ে করাঘাত করে যাচ্ছে ।
গোবরা মানে আমাদের মুনিশ গোবর্ধন সীমানার বিশাল পাঁচিল টপকে আমার শোবার ঘরের জানালায় উঁকি দিয়ে ' ছোড়দাবাবু ! ও ছোড়দাবাবু !' বলে ডেকে যাচ্ছে। ঘুম হাল্কা হতেই আমার তখন করুণ দশা । ভাবছি স্বপ্ন দেখছি না তো ! গত পরশু যেমন দেখেছিলাম!
গোবরা বলল - ছোড়দাবাবু গো ! দরজা খোলো । অনেক দেরী হয়ে গেল । এতক্ষণে অনেক কাজ হয়ে যেত ।
আমি বিছানা ছেড়ে কপাট খুলতে না খুলতেই গোবরা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গোরু বাছুর গোয়াল থেকে বের করে মাঠে নিয়ে চলল । ততক্ষণে খেন্তিখুড়ি, পদির মা , আর কান্তাদি এসে যে যার কাজে লেগে পড়ল । কেউ ঝাঁট দেওয়া, নিকোনো, কেউ বিছানাপত্র তুলতে , কেউ জল ভরতে শুরু করে দিল।
আমি নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করে চললাম বাবলুদার দোকানে চা খেতে ।
পদির মা বলল - যেতি হবেনিকো বাবু । আমি তো চা বানাচ্ছি ।
মাঝে মাঝে পদির মা চা করে দেয় । আজ যখন পেয়ে গেলাম তখন বাবলুদার দোকানে গেলাম না ।
বললাম - ও পদির মা ! আজ কি ব্যাপার বল তো তোমাদের ? সকাল সকাল সবাই একসাথে এসে হাজির?
পদির মা বলল - এইটা কাকতালীয়। আমিও বুঝি নাই।
একে একে সবাইকে জেরা করলাম । সকলেই প্রায় একই রকম উত্তর দিল। আমিও খুব বেশী মাথা না ঘামিয়ে ঘর ছেড়ে চলে এলাম বাবলুদার দোকানে ।
এসে দেখি দোকান বন্ধ । কি রকম যেন অদ্ভুত মনে হল । বাবলুদার দোকান কোনদিন কোন অবস্থাতেই বন্ধ থাকে না । এমনকি ওর শরীর অসুস্থ থাকলেও কর্মচারীদের দিয়ে দোকান চালু রাখে ।
কোন কর্মচারীকেও দেখা গেল না । ক্ষুণ্ণ মনে ফিরে আসছি । ভাবলাম বাবলুদার খবর নেওয়া উচিত। গতকাল আমার অর্ডার নিয়ে বর্ধমানে গেছে । রাতে ফিরতে পারেনি হয়তো ।
ওর বাড়ীতে এলাম । আমাকে অবাক করে দিল আমারই জোড়া চোখ । দেখি মস্ত ভিয়েন বসেছে বাড়ীতে । আর একটু এগিয়ে যেতেই বাবলুদার দেখা পেলাম।
- এস এস হে ছোকরা । বস এখানটায়।
বলে একটা বেতের মোড়া এনে বসতে দিল । আমি দোকান বন্ধের কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল - দেখছ না কি বিশাল যাগযজ্ঞ চলছে বাড়ীতে । দোকান খুলি কি করে?
এদিকটায় রান্না বান্না শুরু হয়েছে । তখন সবজিগুলো কাটাকাটি চলছে ।
বাবলুদা বলল - তোমাদের কাজ । হেলাফেলা করলে দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করে দিতে হবে । অগত্যা দোকান বন্ধ রাখতেই হল ।
আমি বললাম - সে না হয় তোমাকে পুষিয়ে দেব ।
বাবলুদা হাসতে হাসতে বলল - সে তো জানি। বড়দার জন্যই তো আজ এতদূর পৌঁছাতে পেরেছি । উনি সাহায্য না করলে কোথায় যে নরকে পঁচতাম কে জানে !
বাবলুদার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নতুন কিছু নয় । দোকানে এলেই তোতাপাখির বুলি দিনান্তে একটি বার অন্তত বলবেই । আমি সে সব গ্রাহ্য না করে বললাম - তোমার কিন্তু হাতযশ আছে বাবলুদা । নইলে বড়দা ইচ্ছে করলে বর্ধমানের কোন রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার দিতে পারতেন।
- কেন কেন ! আমার রান্না কি তোমাদের অপছন্দ হচ্ছে ছোকরা যে রেটুরেন্টের কথা ভেবে নিলে ?
আমার কথার উল্টো মানে করেছে বাবলুদা । তাই বললাম - তোমার রান্না আর অপছন্দ ? প্রশ্নই ওঠে না । আমি সেই সেন্সে কিছু বলিনি বাবলুদা । দেখ দেখি কেমন অহেতুক আঘাত দিয়ে ফেললাম!
এবার বাবলুদা হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল - নাহ্ তুমি দেখছি ইয়ার্কি ঠাট্টাও বোঝো না ।
আমি বললাম - তাহলে তোমার দুঃখ হয়নি বল । আমি তো উল্টো ভেবেছিলাম।
- তুমি লোকটাই উল্টোপাল্টা হে ছোকরা । কি ভাবে যে অত উঁচু পদে চাকরি করেছ !
আমার অহংকারে লাগল । কিন্তু ওকে কিছু বলতে পারলাম না। ও যদি আমার আণ্ডারে চাকরি করত আর এ ধরণের কথা বলত তো নির্ঘাত ওকে রুল-১৪ বা ১৬ কিছু একটা চার্জশিট ধরিয়ে দিতাম ।
আমি বললাম - এখন উঠি বাবলুদা । পরে এসে খবর নিয়ে যাব ।
চটজলদি বাবলুদা বলল - তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না । আমরাই তো সব খাবার দাবার নিয়ে তোমার ওখানেই উঠব । তুমি বরং বাড়ী বসে ওদিকটা সামলাও।
- কি সামলাব ?
- আরে তোমার বড়দা অতিথি অভ্যাগত নিয়ে আসছেন; তাঁদের অভ্যর্থনা করতে হবে না ?
আমি তো ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেইনি । বললাম - ঠিকই বলেছ বাবলুদা ! যাই দেখি , ড্রয়িং রুমটা ঠিকঠাক সাজানো হয়েছে কি না । ওখানেই তো ওদের বসাবো!
ফিরে আসছি । বাড়ীতে প্রবেশ করে দেখি পদির মা একলা বাড়ী আগলে বসে আছে ।
- কি হল পদির মা ! আর সবাই চলে গেছে নাকি?
- হাঁ গো দাদাবাবু । সকলেই চলে গেল ; আমাকে বলল তুই পাহারা দে ।
- যাও যাও । এবার তোমারও ছুটি। আমি তো এসে গেছি ।
পদির মা চলে গেল । আমিও দরজা বন্ধ করে আমার রুমে এসে বসলাম । গরমে ঘেমে গেছি । আরেকবার স্নান করতে হবে । বাথরুমে গেলাম। কয়েকটি মেয়ের গলার আওয়াজ পেলাম। কান খাড়া করে ধব্দের উৎস সন্ধানে তন্ময় হয়ে রয়েছি । এমন সময় দোতলি থেকে কারও চলাফেরা করার শব্দ পেলাম। স্নান করার কথা মাথায় রেখে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দোতলার সিঁড়িতে চেয়ে দেখলাম ।
নূপুর নিক্কিনি আমাকে স্তম্ভিত করে রাখল । যুগপৎ ভয় এবং ভাবনায় উৎকন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের বাড়ীতে মেয়ের পায়ের নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ ! আচ্ছা ! এই দু'দিনে কি বাড়ীটা ভুতুড়ে হয়ে গেছে ? দিনে দুপুরে আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে ভাবলাম বাবলুদার ওখানেই চলে যাই ।
এমন সময় গ্রামের কয়েকজন বধূ এবং মিনাক্ষী কাকিমা পিছন থেকে বলে উঠলেন - কোথায় যাচ্ছ ভোম্বল?
ভোম্বল আমার ডাকনাম । বড়দাই আদর করে ওই নামটা রেখেছিলেন । গ্রামে সকলেই ওই নামে এখনাও ডাকে ।
কাকিমার গলা পেয়ে পিছন ফিরে দেখি নারীবিহীন এই বাড়ীতে ললনাদের বিশাল সমাবেশ । একে একে সকলে নীচে নেমে এল । আমি বিস্মিত এবং নির্বাক তাঁদের দিকে চেয়ে রইলাম।
কাকিমা বললেন - এই ভোম্বল ! জিজ্ঞেস করলি না তো আমরা এখানে কেন এসেছি ?
আমি বললাম - কে-ন এ-সে-ছে-ন- !
সকলে একযোগে হেসে উঠল ।
- তোমরা এমন করে হাসছ কেন ?
- আমরা বিয়েবাড়ীতে এসেছি যে গো !
তারপর সে তো সকলে হেসে কুটিকুটি। আমি তো বাকরুদ্ধ। কার বিয়ে ? এ বাড়ীতে তো কারও বিয়ে নয় !
সেই মুহুর্তে আমার মনে হল - হয় এ বাড়ীটা ভুতুড়ে নয় তো আমি একটা আস্ত পাগল ।
তবু আমাকে তো কিছু বলতেই হয় ! নইলে সকলে একজন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসারকে বোকা ভাববে যে !
বললাম - তোমরা ইয়ার্কি করবার আর সময় পেলে না ? আজ তো পয়লা এপ্রিলও নয় !
মিনাক্ষী কাকিমা বললেন - আর বড়জোর এক ঘন্টা । তারপরই শঙ্খ-ঊলুধ্বণি উঠবে এখানে ।
( চলবে )
