আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ঊনাশীতিতম অধ্যায়
অনেকদিন শিউলিদের খোঁজ নেওয়া হয়নি । কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে আমি বড়দাকে বললাম - একবার শিউলির সঙ্গে দেখা করলে হত !
বড়দা বললেন - এখন ? সেই তো মসলন্দপুরে যেতে হবে !
আমি বললাম - না না মসলন্দপুরে কেন ? এই তো সামনেই সি টি ও । ওখানে জেনে নেব ।
বড়দা বললেন - চল তবে দেখা করে আসি ।
সি টি ওর গেটে ঢুকতেই পরিচিত জনেরা ছেঁকে ধরল । তাঁদের পাশ কাটিয়ে যেতেই অনেকটা সময় চলে গেল ।
বড়দা বললেন - আমরা শিউলি রায়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই ।
কেউ একজন বললেন - ও তো অনেকদিন থেকে আসছে না । বাড়ীতে নাকি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে ।
আমি বললাম - তা' জানি । সেজন্যই দেখা করতে এসেছিলাম। আসছে না কেন একবার খবর নিতে হবে ।
বলে ফোন করলাম ওর ফোনে । ফোন বেজে গেল । হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছে । আমরা বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
বাস শক্তিগড়ে বেশ কিছুক্ষণ স্টপেজ দেয় । যাত্রীরা নেমে মিষ্টান্ন যেমন - ল্যাংচা, সীতাভোগ, মিহিদানা, লেডিকেনি বা পানতোয়া কেনে, কেউ টয়লেট সেরে নেয় । নিদেনপক্ষে চা, তেলেভাজা রুচি অনুযায়ী গ্রহন করে ।
আমি নেমে কিছু মিষ্টান্ন কিনে বাসে উঠলাম । বড়দা বললেন - ফোনটা ব্যাগে রেখেছিস, বাজছিল । দেখ কে কল করেছে !
আমি মিসড কল লিস্ট দেখে বললাম - অজানা নাম্বার ।
বড়দা বললেন - কই দেখি !
দেখালাম । বড়দা ফোন নিয়ে কল ব্যাক করতেই ওপার প্রান্ত থেকে অচেনা গলায় কেউ বলল - গোয়েন্দা হবার বড় শখ না ? আর আধঘন্টার মধ্যেই শখ মিটিয়ে দিচ্ছি ।
ফোন কেটে দিল বড়দা কিছু বলার আগেই। আমাকে বললেন - চল চল । বাস থেকে নেমে পড়তে হবে । এখানে বোমাজাতীয় কিছু রাখা আছে ।
সব যাত্রীদের বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বললেন - এখনই আপনার গাড়ি লোকালয় থেকে দূরে নিয়ে চলুন । এই বাসে বোম্ব ফিট করা আছে ।
সকলেই আতঙ্কিত । ড্রাইভার বা কণ্ডাক্টর দু'জনই হতবাক । বড়দা বললেন - কি হল ? গাড়িতে স্টার্ট দিন । চলুন আমরাও তো আছি । এত ভয় কিসের ? আধ ঘন্টার মত সময় আছে।
গাড়ি বাজার ছাড়িয়ে দু'নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে একটা ফাঁকা মাঠে নিয়ে যাওয়া হল । আমরা গাড়ি থেকে নেমে বোমা খুঁজছি । টিকটিক আওয়াজ আসছে ; কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না । পুলিশের বোম্ব স্কোয়াডে খবর দেওয়া হল । ওঁরা বললেন - আপনারা অন্তত এক মাইল তফাতে চলে যান । আমরা আসছি ।
অবাক কাণ্ড । দশ মিনিটের মধ্যে বোম্ব স্কোয়াড খানা তল্লাশি করে টাইম বোমা উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করে দিল । আমরা সহ যাত্রীরা সকলে এবং গাড়ির স্টাফ প্রাণে বেঁচে গেলাম ।
বড়দা আধঘন্টা অপেক্ষা করার পর সেই অজানা নাম্বারে ফোন করলেন ।
- আপনি তো মশাই দারুন শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সজ্জন । ভাগ্যিস সাবধান করে দিয়েছিলেন তাই এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলাম । মহাশয় ! আপনার পরিচয় জানতে পারি কি ?
- কেন নয় মিঃ রায়চৌধুরী ! পরিচয় তো আগেও পেয়েছেন আবার কি নতুন করে বলতে হবে?
- তবুও...
- শুনুন, আপনাদের আমি এখনই শেষ করতে চাই না । টোপ ফেলে বড়শি হাতে বসলাম, মাছে টোপ খেল, অমনি ঘাই মেরে ডাঙায় তুলে দিলাম - তেমন মাছুড়ে আমি নয়। আমি পুকুরের মাছ খেলিয়ে খেলিয়ে ডাঙায় তুলি । এবার তো পেলেন আমার পরিচয় ?
বড়দা বললেন - কিন্তু মাছ যে টোপের ধারেকাছেও গেল না । উল্টে বড়শিটাই ভেঙে ফেলল যে !
এবার ও প্রান্ত থেকে উপহাসের হাসি ভেসে এল - হো হো হো । নিজেকে বড় চালাক মনে করেন, না ?
বড়দা বললেন - অন্তত আপনার মত বোকা নই ।
- কি ? আমি বোকা ? আপনার তো স্পর্ধা কম নয় ! তাহলে পরবর্তী অ্যাকশনের জন্য তৈরী থাকুন ।
আমি বললাম - বড়দা কে কথা বলছে ?
- ভাবিস না; এ' ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত নয় । তাঁর কোন সাগরেদ হবে হয় তো !
ও প্রান্ত থেকে বলল - ঠিক বলেছেন। সাগরেদ ! এই সাগরেদই আপনার কাজে আসতে পারে ।
- মানে ? আপনার মত দুষ্টুলোক আমার কি কাজে আসবে ?
- লালবাজার বলতে পারে । সেখানে তো গিয়েছিলেন ? কিছু শোনেননি ?
বড়দার মত লোকও এই কথায় চমকিত হয়ে উঠলেন । লোকটা অন্দরমহলের কথা জানল কি করে ? তবে কি লালবাজারেও কেউ ওর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ?
- আপনি মশাই বড় রসিক লোক আছেন মিঃ রায়চৌধুরী।
কি, ভয় করছে তো ?
বড়দা হা হা করে হেসে উঠলেন ।
- উৎসব রায়চৌধুরী ভয় পাবার পাত্র নয় সুধীজন !
- সুধীজন ! হা হা হা ! ভয় না পেলে কেউ এমন ভয়ংকর লোককে ও ভাবে সম্বোধন করে ? যাক যা বলতে চাইছি তা' হল ...
লোকটা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল । ভাবল হয়তো বড়দা ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন । কিন্তু বড়দা ফোন কেটে দিলেন। তারপর জি পি এস অন করে রাখলেন।
ফোন কেটে দিয়েছেন দেখে সেই লোকটা রেগে গিয়ে আবার ফোন করল ।
- আপনার এতবড় সাহস আপনি আমার ফোন কেটে দেন ? বুঝতে পারছি আপনি রেগে গিয়ে কেটে দিয়েছেন।
কথার মাঝে বড়দা ঢুকে পড়লেন - শুধু রেগে গেলে নয় ; এরিগেরি লোকের ফোন আমি তুলি না ।
- কি ? আমি এরিগেরি? কলকাতার ভিখারীরাও জানে আমি কে !
- তা তো জানবেই, আপনি নিজেই তো একজন ভিখারী । ভিখারী না হলে ভিক্ষুকদের নিয়মকানুন আপনি জানবেন কি করে ! শুনুন মশাই, আপনি ভিখারীই হোন বা দরবেশ, তা' জেনে আমার কোন লাভ নেই । তবে ওই যে বলছিলেন না লালবাজারের কথা । অমন লালবাজার আমার প্রচুর আছে ।
লোকেশন ট্র্যাক করে জানা গেল ফোন করা হচ্ছে বর্ধমান থেকে । তার মানে আমরা তো এখনও শক্তিগড়েই আছি । আর তিনি একটু এগিয়ে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন । তাঁর দুর্বোধ্য মতলব বুঝতে পারলাম না । বড়দাকে বললাম - আপনি কিছু আন্দাজ পেলেন ?
বড়দা বললেন - কিছু নয়, গোটা বিষয়টাই বুঝে গেছি ।
আমি অবাক চোখে বড়দাকে দেখছি । তিনি বললেন - লোকটা কে জানিস ?
মাথা নেড়ে বললাম - কে ?
- শিউলি রায়ের বাবাকে যে পিটিয়ে মেরেছিল ; সেই সাব-ইনস্পেক্টর মহম্মদ সেলিম ।
- কিন্তু সে তো এখন জেলে ?
- সে তো তুই জানিস, দেশশুদ্ধ সবাই জানে। ও জেলে আছে। বারাসতের এস ডি পি ও ওকে জেল থেকে পালাতে সাহায্য করেছেন । তাই সে এখন আমাদের টার্গেট করেছে বর্ধমানে এসে ।
সাহস হচ্ছিল না ; তবু প্রশ্ন করে বসলাম - আপনি কি করে জানলেন সেলিম জেল পালানো কয়েদী ?
- এখানে একটা ইতিহাস আছে বুঝলি ! সেই ইতিহাস মিঃ মুখার্জী এবং মিঃ ভট্টাচার্য্যও জানেন । তাঁরাই আমাকে খবর দিয়েছিলেন । আমি তোকে বলতে ভুলে গেছি ।
- এতবড় ঘটনাটা আমাকে বলেননি বড়দা ?
আমার খুব অভিমান হল । বড়দা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন - তোর বুদ্ধির পরীক্ষা নিতেই তোকে বলিনি। খানিকটা ইচ্ছে করেই ।
- মানে ? এদিকে পিঠ চাপড়ে বলছেন ' তোর হবে' । আর সব সুত্রগুলো গুটিয়ে রেখে দিয়েছেন ?
বড়দা হেসে হেসে বললেন - লালবাজারে বৈঠক সেরে আমরা যখন বেরোচ্ছি ; তুই খেয়াল করিসনি, মিঃ মুখার্জী আমাকে আসতে আসতে বলেছিলেন - মহম্মদ সেলিম জাত বজ্জাত লোক । ববি আফসারের চাচাতো ভাই। অপরাধ ওদের রক্তে । আপনার ভাই যখন বললেন ত্রিলোকেশ্বরকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, আবার পুলিশ নিজে এনকাউন্টার করবে না অথচ ওকে মারতে হবে এবং আততায়ীকে ছেড়েও দিতে হবে ; আমার মনে পড়ে গেল সেলিমের কথা । এস ডি পি ও যে ওকে পালাতে সাহায্য করেছেন সেজন্য ওঁর চাকরি বাঁচাতে সেলিমের অবস্থান জানাতে শর্ত দিয়েছিলাম । কারণ আমার লক্ষ্য ছিল পাকা গানম্যান জোগাড় করার ।
পেয়ে গেলাম । সেলিম ত্রিলোকেশ্বরকে মেরে যদি চলেও যায় আমাদের কিছু আসে যায় না । সেজন্য সেলিমকে এই বোমা বোমা খেলা দেখাতে বলেছি, আপনারা কিন্তু ভয় না পেয়ে এর মোকাবিলা করবেন । পরে সেলিমের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ করিয়ে দেব । আগে কাজ তো হোক ।
আমার মনে পড়ে গেল বড়দার আমার থেকে পিছিয়ে যাওয়ার কথা । বললাম - ওওও।
( চলবে )
