আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
একাসপ্ততিতম অধ্যায়
লালবাজারের করিডোরে দাঁড়িয়ে নীচে রাজপথের দিকে একমনে চেয়েছিলেন বড়দা । মসলন্দপুর থেকে পাঁচ জন পুলিশরূপী আসামীদের নিয়ে এস ডি পি ও বীরেন শাসমলের আসার কথা । আড়াইটে বেজে গেছে ; এখনও আসেননি দেখে চিন্তিত হলেন।
মিঃ মুখার্জীও ছটফট করছিলেন । তিনি বড়দার কাছে এসে বললেন - কি করা যায় বলুন তো মিঃ রায়চৌধুরী?
বড়দা চেয়েছিলেন একদৃষ্টে । দুটো পুলিশের গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল । নাহ্ এই গাড়িগুলোও তো নয় । মিঃ মুখার্জী মিঃ শাসমলকে ফোন করলেন।
বড়দা বললেন - লাভ নেই মিঃ মুখার্জী। আমার আশঙ্কাই মনে হচ্ছে সত্যি হল ।
- আশঙ্কা ? কিসের আশঙ্কা ?
- বীরেশ্বর রক্ষিতের কেরামতি । সেলিম এবং দলবলকে ঠিক ছিনতাই করে নিয়েছেন । চলুন আমরাও কিছু কেরামতি দেখাই ।
মিঃ মুখার্জী বিস্মিত হয়ে বললেন - কি বলছেন স্যার ? এস ডি পি ওর হাত থেকে আসামী ছিনতাই করেছে বীরেশ্বর রক্ষিত ?
- এক্জাক্টলি । ওঁর কাজের ধরণের সঙ্গে সম্যক পরিচিতি আছে । আমার কুটুম্ব কি না । বুঝতে পারছি তাই ।
- কুটুম্ব ? রক্ষিত ব্রাদার্স আপনার আত্মীয় নাকি?
- ছিলেন না । তবে ইদানিং হয়েছেন ।
বলে ইতিহাসের বিবরণ দিলেন । মিঃ মুখার্জী শুনে বললেন - আপনি আর পরিবার পেলেন না!
- কি করি বলুন তো ? বিবেক দংশনের যে ভীষণ জ্বালা ! তবে জেনে খুশী হবেন আমার ভাইপো একজন উঁচু পদের সরকারী অফিসার । অরিত্র রায়চৌধুরী, দ্য ডেপুটি কমিশনার অব দুমকা ডিস্ট্রিক্ট । বিহার ক্যাডারের অফিসার ।
মিঃ মুখার্জী বললেন - এ তো আমাদের পক্ষে একটা বড় প্লাস পয়েন্ট ।
- অরিত্রই হাজি মস্তানকে এরেস্ট করিয়েছে ।
- হুমম। ওকে তো ট্রানজিট রিমাণ্ডে আনা হয়েছে । ভেবেছিলাম সেলিমের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করব । তা' তো হল না ।
একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে এল মিঃ মুখার্জীর বুক থেকে ।
- কি এত আলোচনা করছেন মিঃ রায়চৌধুরী?
হঠাৎ পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্যের গলা পেয়ে ওঁরা দু'জনই তাঁর দিকে চাইলেন।
পরমেশ্বর বললেন - আপেক্ষার অবসান হতে চলেছে । মিঃ শাসমল এই মাত্র জানালেন তাঁরা প্রায় চলে এসেছেন ।
বুক থেকে যেন একটা বিশাল পাথর নেমে গেল । মিঃ রায়চৌধুরী বললেন - যাক, এ যাত্রা বীরেশ্বর সুযোগ পাননি তা'হলে !
মিঃ মুখার্জী বললেন - চলুন এবার আমরা কোশ্চেন রুমে গিয়ে বসি ।
মিঃ শাসমল ওদের নিয়ে এসে উপস্থিত করলেন সেই কক্ষে । আলোগুলো সব নেভানো ছিল । রুমে এত অন্ধকার দেখে মিঃ শাসমল অবাকই হলেন । তখনই পরমেশ্বর আলো জ্বালিয়ে মিঃ শাসমলকে বললেন - ওয়েলকাম মিঃ এস ডি পি ও । পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো ?
- তা' কিছুটা হয়েছিল বৈকি ! একটা গ্যাঙ প্রিজন ভ্যান ছিনতাই করার চেষ্টায় ছিল । আমরা সম্মিলিত ভাবে সেই প্রচেষ্টা বানচাল করে দিতে সক্ষম হয়েছি । একজনকে ধরেও এনেছি কিন্তু সে নেহাতই কোন ছোটখাটো আনকোরা অপরাধী । হয়তো হাতেখড়ি হচ্ছিল তার । যাক আসামীদের আনতে বলি ?
মিঃ মুখার্জী বললেন - অবশ্যই । আর দেরী নয় । স্বীকারোক্তি আদায় করতে কত দেরী হবে কি জানি ! মিঃ ভট্টাচার্য্য ! ববি আফসারকে আগে নিয়ে আসুন। ওকে পাশের ঘরে নিয়ে আসতে বলুন।
পাঁচ পুলিশ -অপরাধী মুখ নীচু করে এসে রুমে ঢুকল ।
মিঃ মুখার্জী বললেন - মিঃ সেলিম ! ববি আফসার আপনার কে হয় ?
সেলিম যেন আকাশ থেকে পড়লেন । ববিকে এঁরা কি করে জানলেন! বললেন - ববি? কে ববি? জানি না তো ?
বড়দা বললেন - ববি আপনাকে ফোনে কিছু বলেনি ? এই যেমন ধরুন প্রমোশন হাতের মুঠোয়, কাজ হয়ে গেলে বীরেশ্বরের কাছ থেকে মোটা রকমের অর্থ ! কি? এগুলো সব ঠিক কি না ?
- স্যার, ভুল হচ্ছে ..
বড়দা বললেন - হ্যাঁ কি না ? এক কথায় বলুন ।
পুরোপুরি অস্বীকার করলেন মহম্মদ সেলিম । তেমন কোন ফোন কেউ আমাকে করেনি ।
- বেশ ! করেনি মেনে নিলাম । কিন্তু এই দু'তিন ঘন্টা আগে ওর ফোন থেকে কোন কল যায়নি ? কই দেখি আপনার ফোনটা ।
সেলিম তথাপি কোন উত্তর দিলেন না । মিঃ ভট্টাচার্য্য বললেন - এখনও ভেবে দেখুন , চাকরি তো গেলই; শাস্তিটাও কিন্তু অবধারিত।
বড়দা বললেন - বেশ তো , না বলুন , কোন ক্ষতি নেই ।
মিঃ মুখার্জী ! ববি আফসারকে এখানে আনতে বলুন তো !
সেলিম যেন চোখে সর্ষেফুল দেখছেন । ববিও ধরা পড়ে গেছে !
তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে ববির কথা মেনে নিলেন।
মিঃ মুখার্জী ববির পাছায় একটা মস্ত লাথি মেরে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন । মিঃ ভট্টাচার্য্য ববির পিঠে লাঠির বাড়ি বসিয়ে দিয়ে বললেন - একে চিনিস ?
- হাঁ সাব । মেরা চাচেরা ভাই ।
বড়দা বললেন - বীরেশ্বর রক্ষিতকে চেন ?
ববি - বিলকুল সাব । সেলিম ভাই ভি পহচানতে হ্যায় ।
- কি কি বিষয়ে তোমাদের লেনদেন হত ?
- সাব , মেরা ঔর সেলিমকে সাথ বাত হুয়া কি উনকা ভাইকো খতম কর দেনে কো বাদ দশ দশ লাখ রূপিয়া হমলোগোকো দেঙ্গে ।
- এডভান্স কুছ দিয়া থা ?
- নেহি সাব । তুরন্ত ইতনা টাইম নেহি থা ।
এরপর বাকি চারজন কনস্টেবল স্বীকার করে নিল তারা এই সাহেবের আদেশমত লাঠিচার্জ করেছিল । তবে বয়স্ক ভদ্রলোকের উপর তারা কেউ হাত তোলেনি ।
- তাহলে ওঁকে কে পিটিয়েছিল ?
- সেলিম সাহেব নিজে ।
জবানবন্দী রেকর্ড করে বড়দা লালবাজার থেকে বেরিয়ে এলেন । আমাকেও শিয়ালদার মেসে চলে আসতে বললেন । বড়দা শিউলিকে বললেন - সবাই ধরা পড়ে গেছে মা । তোমাদের আর কোন ভয় নেই । তবে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে যেতেই পার । উকিলকে বল কেস দিতে । পুলিশের সহায়তা পাবে । কোন চিন্তা নেই ।
নিদারুণ পিতৃবিয়োগেও শিউলির মুখে কোথাও যেন একটু হাসির ঝিলিক খেলে গেল । আমি ওকে বললাম - বড়দা ডেকেছেন, এখন আসি । কাল সকালে আমরা আবার আসব ।
- স্যার , আপনাদের কোন আতিথেয়তা করতে পেলাম না - এ' দুঃখ আমার চিরদিন থেকে গেল ।
- এ কি বলছ তুমি ? আমরা আবার আসব, তখন না হয় মন ভরিয়ে আতিথ্য দেখাবে ।
শিয়ালদার মেসে বড়দার মুখে অভিযানের গল্প শুনলাম। বলেও ফেললাম - ইস আমিও যদি যেতাম !
বড়দা বলল - আফশোষ করিস না । এ রকম ভয়ঙ্কর অভিযানে পুলিশ তোকে এলাউ করত না । নেহাৎ আমার গায়ে একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা গন্ধ আছে , তাই আমাকে নিয়েছিল ।
আমি বললাম - আসল কাজ তো আপনিই করে দিলেন বড়দা ।
- বলছিস ? কিন্তু মিঃ মুখার্জী আর মিঃ ভট্টাচার্য্যের মত ধুরন্ধর অফিসার না থাকলে ববির টিকিও পেতাম না । আমি তোর মুখ থেকে শোনা গল্প বলে ওর ডেস্ক্রিপশন দিচ্ছি একজন পুলিশ অফিসার স্কেচ এঁকে ববিকে উদ্ধার করে আমার হাতে তুলে দিল । আমি তো ' ইউরেকা ইউরেকা ' বলে খুশীতে ফেটে পড়লাম । তখন ওঁরা সেই স্কেচে রং লাগিয়ে হুবহু ববিকে পেয়ে গেল । খুঁজতে সুবিধা হল । এমন সময় দেখি একটা খাবারের দোকানে ঝামেলা হচ্ছে । কাছে গেলাম। দেখি ববিই মস্তানি করছে । ব্যস ধরা পড়ল ।
- আর ওই পুলিশগুলো?
- সেলিম তো স্বীকারই করছিল না । ববিকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেই গড়গড় করে বলতে লাগল । তবে হাজি গ্রেপ্তার হবার পরও তাকে লালবাজারে আনা যায়নি আইনি প্রক্রিয়ার বিলম্বের জন্য ।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল গোপাকে এখনই সব বলে দিতে । বড়দা বললেন - শনৈ: শনৈ: ।
( চলবে )
