আকাশ নীল
আকাশ নীল
অরুণ এখন ল্যাপটপে। চৈতি ড্রেসিংটেবিলে এসে বসলো।
ইশ! চুলের কী অবস্থা! ডগা ফেটেছে, চিটচিটে, গেলো জানুয়ারিতে দুই ইঞ্চি কেটেছিল, এখনও লম্বায় যেই কে সেই? কপালের কাছটা অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে, বেশ পাতলা হয়ে গেছে চুলের গোছা। পার্লারের মেয়েটা তো পরশু আইব্রো প্লাগ করতে করতে বলেই ফেললো, "আগে তুমি কতো মেন্টেইন্ড থাকতে দিদি, এখন শুধু আইব্রো করতেই পার্লারে আসো, তাও কালেভদ্রে। একবার হোল বডি স্পা করিয়ে নাও, চুল স্কিনে যা যা সমস্যা সব ঠিক হয়ে যাবে"।
কপাল থেকে চোখের তলায় চৈতির নজর আটকে গেলো। পুরু কালি, পাশে বলিরেখা, মুখের চামড়াটাও খসখসে। সারাদিনে ওই একবার স্নানের সময় যা একটু ফেস ওয়াশ। স্কিন ভালো থাকেই বা কিকরে?
মগজে আবার পার্লার টোকা দিলো, "হেয়ার স্পা টাই আপাতত কমের মধ্যে আছে, আমরা সাত শো তে করে দিই, আর হোল বডি যদি করো..."
চৈতি চোখ বন্ধ করে নিলো, একটা হেয়ার স্পা করতে সাতশো টাকা?
থাক, দরকার নেই। তাছাড়া নিজের সাজগোজের জন্য অরুনের কাছে চাইতে খারাপও তো লাগে!
চুলে হালকা চিরুনি বুলিয়ে পিপাইএর ঘরে এলো চৈতি।
বেডরুমের বাইরে চব্বিশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট স্পেস, সেখানেই ছোট ছোট থালা বাটি গ্লাস নিয়ে পিপাইএর খেলনাঘর।
তিন পুরিয়ে চারে পড়েছে মেয়েটা। প্লে-হাউস থেকে ফিরে সারাদিন রান্নাবাটি খেলে, খেলতে খেলতেই নিজের মনে পড়ে।
মাকে দেখেই পিপাই ছুট্টে এলো, "মা, এট্টা বার্বি ডল কিনে দেবে? আমি আন্না কব্বো খাবাবো, চান কয়াবো, ইত্কুলে পাটাবো..."
চৈতি হাসে, কী সংসারী হয়েছে তার মেয়ে! অনেকদিন থেকেই এই অবদারটা করছে, কিনে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও কিনে দেয়নি চৈতি। পুপাইও অন্য বাচ্চাদের মতো জেদ করেনি, মা কিনে দেবে বলেছে, এটাই তার কাছে যথেষ্ট।
বাইরে ফোনটা বাজছে অনেকক্ষণ। চৈতি দৌড়ে ফোনটা ধরলো, মায়ের ফোন। রোজ এসময় সে মাকে ফোন করে, আজ ভুলে গেল?
কিছুক্ষণ মায়ের খবরাখবর নিয়ে ফোনটা রেখে দেয়।
ঘড়িতে নটা বাজে। চৈতি রান্নাঘরে এলো। আটা মাখতে মাখতে নানা চিন্তা মাথায় ভিড় করে। হাঁটুর যন্ত্রণাটা বেশ বেড়েছে মায়ের। এতদিন ধরে হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি, দৈব সব রকমই চললো। চৈতিই জোর করে গেল মাসে অ্যাপোলোয় নিয়ে গেল, ডক্টর সিনহা অপারেশন প্রেসক্রাইব করলেন। অনেক টাকার ধাক্কা। মা স্ট্রেট না করে দিলো, "আজ আছি কাল নেই, মিছিমিছি অতগুলো টাকা খরচে কী লাভ, তাছাড়া হোমিও তেই ভালো আছি আমি।"
চৈতি জানে, মা ভালো নেই, বাবার সেরকম পুঁজিও নেই।
সেও যে কিছু করবে, বাবা নেবেইনা, জামাইয়ের টাকায় চিকিৎসা? অসম্ভব!
আজ চৈতি নিজে কিছু রোজগার করলে বাবা না করতে পারতো?
সাড়ে দশটা। পুপাই খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। চৈতি অরুনের পাতে চারটে রুটির পাশে ডিমের ডালনা তুলে দিতে দিতে বলল, "একটা বার্বির সেটের দাম কত পড়বে?"
অরুণ রুটি চিবানো থামিয়ে বলল, "কেন? এই বয়সে আবার পুতুল খেলার ইচ্ছে হলো নাকি?"
-" মেয়েটা বেশ কয়েকদিন ধরেই বায়না করছে, তাই..."
অরুণ আবার খাওয়ায় মন দিয়েছে, "বাচ্চারা অনেক কিছুই বায়না করে চৈতি , ওদের সব বায়না মেটাতে নেই। অভ্যেস হয়ে গেলে পরে আর ছাড়াতে পারবেনা।"
-"মেয়েটা কিই বা এমন বায়না করে, আর কোন বায়নাই বা মেটানো হয়?"- কথাটা না বলে রুটির সঙ্গে গিলে ফেললো চৈতি।
অরুণ বলে চলেছে, "এরই মধ্যে মেয়েকে স্কুলে দিলে, কী? না প্লে স্কুল, আরে আমাদের সময় ওসব ছিলো? নাকি আমরা লেখাপড়া শিখিনি?"
চৈতির অভিব্যক্তি আড়চোখে দেখে নিলো অরুণ, তারপর বলল, "ফ্ল্যাটের ইএমআই এখনো আট বছর চলবে চৈতি, তার ওপর তোমার পাল্লায় পড়ে ন'লাখের মেডিক্লেম করে ফেললাম, তাছাড়াও ভবিষ্যৎ সেভিংস, আমার একারই তো রোজগার, বোঝই তো, একটু বুঝেসুঝে না চললে..."
চৈতি বোঝে। বোঝে বলেই না কত সমঝে চলে এখন! গত তিন বছর বিবাহবার্ষিকী পালন করেনি, নিজের জন্মদিন তো ভুলেই গেছে, স্বামী আর মেয়ের জন্মদিনে একটু যা পায়েস বানিয়ে দেয়, ব্যাস।
অথচ কত ইচ্ছে ছিল বছরের বিশেষ কয়েকটা দিন ধুমধাম করে কাটাবে। লোকজন আসবে, খাওয়া দাওয়া হবে, হৈচৈ...
কতদিন বাইরেও খায়নি চৈতি, অবশ্য অরুণ বাইরের খাবার বিশেষ পছন্দ করেনা।
এই তো কাজের মেয়েটা আট মাস কাজ করতে না করতেই হুট করে আরো হাজার টাকা বাড়াতে বললো।
কাজ বলতে তিনটে ঘর মোছা, দুবেলা বাসন মাজা, আর মাসে দুবার ঘর দোর ঝাড়পোঁছে তাকে সঙ্গ দেওয়া, তাতেই দুহাজার টাকা? গায়ে লাগে না?
চৈতি ওকে আসতে বারণ করে দিলো। অরুণ অবশ্য বাধা দিয়েছিল, তাছাড়া আজকাল বিশ্বাসী লোক পাওয়াও তো মুশকিল। চৈতি আর কোনো লোক রাখেনি, ঐতো কয়েকটা কাজ, সে ও নিজেই সামলে নেবে।
চৈতি বাড়তি খাবার ফ্রিজে তুলে রাখলো, থালাবাসনগুলোও মেজে রাখলো। তারপর রান্নাঘর পরিষ্কার করে দুটো কটন বলে ফিনাইলে মাখিয়ে কোনায় রেখে রান্নাঘর বন্ধ করে বিছানায় এলো।
পুপাই অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ডায়পারটা ঠিক করে পরানো হয়নি, চৈতি ঠিক করে পরিয়ে মেয়েকে সযত্নে শুইয়ে দিল। ডায়পারের দামও তো ভালোই বাড়ছে। তবু অরুণ অনলাইন কেনে, রেগুলার চেক করে ডিসকাউন্ট দিচ্ছে কিনা, বিভিন্ন ওকেশনে যখনই দাম কয়েক পার্সেন্ট কমে যায়, অরুণ দুটো অর্ডার করে দেয়। অনেকটা সাশ্রয় হয়।
এবার মেয়েটাকে ডায়পার ছাড়া শোয়ানো অভ্যেস করাতে হবে। রাতে নাহয় বার দু তিনেক উঠবে, মেয়েকে বাথরুমে নিয়ে যাবে, ঘুমের একটু ব্যাঘাত হবে, হোক গে!
অরুণ আবার ল্যাপটপে বসেছে, আহা, এত পরিশ্রম করে মানুষটা, চৈতির আরও সাশ্রয়ী হওয়া উচিত।
পুপাইএর কাছে শুলো চৈতি, যা গরম! পাতলা সুতির জামাটা ঘামে ভিজে সপসপ, চৈতি মেয়ের জামাটা বদলে দিলো। নিজের ঘাড় গলা মুছে নিলো ভালো করে, কাঁধের খোলা জায়গায় বেশ কয়েকটা ঘামাচি! চৈতি উঠে ঘাড়ে গলায় সুথল লাগিয়ে নেয়। দিন দিন দেশটা পুরো রাজস্থান বনে যাচ্ছে। এ সি ছাড়া থাকাই দায়!
তার বাড়িতে এসি নেই, চৈতি নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, মানুষ অভ্যেসের দাস, দরকার নেই বিলাসিতার। চৈতি এই বেশ আছে।
*************
পুপাইএর প্লে স্কুল তিনঘন্টার। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে আর বাড়ি ফেরেনা চৈতি। স্কুলের সামনে বিশাল কম্পাউন্ড। অনেক মায়েরাই বসে থাকে, মায়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়, সুখ দুঃখের আনন্দ আহ্লাদ অহংকারের কথা হয়।
আজ পুপাইকে ভেতরে পাঠিয়ে চৈতি আর মা-মহলে ঢুকলনা। একটু মার্কেটের দিকে যাবে, টুকটাক কেনার আছে। গেটের বাইরে একটা ছোকরা। হাতে কিছু বুকলেট। চৈতিকে সামনে পেয়েই একটা ধরিয়ে দিল ,...
" আত্মরক্ষা ট্রেনিং সেন্টার... আজকালকার দিনে বিশেষত মেয়েরা কোথাও সুরক্ষিত নেই, না ঘরে, না বাইরে, তাই ঘরে বাইরে নিজের সন্তানকে নিজেদের আত্মরক্ষায় পারদর্শী করে তোলাটা আপনার কর্তব্য।
যোগাযোগ করুন ********** নম্বরে আর নিজের সন্তানকে উপহার দিন এক আত্মনির্ভর সুস্থ নিরাপদ জগৎ।
এখানে নিষ্ঠার সঙ্গে ক্যারাটে কুম্ফু শেখানো হয়... "
কাগজটা পড়ে বাগে রেখে দিল চৈতি। কথাগুলো অহেতুক নয়, সত্যিই আজকাল মেয়েদের আত্মরক্ষা -বিদ্যা শেখানো উচিত বই কি!
একটা বেবি পাউডার, বেবি সোপ, বেবি শ্যাম্পু, আর... একটা 200ml নিহার হেয়ার অয়েল, আর ওই যে ওই স্যান্ডেল সোপটা, তিনটার সঙ্গে একটা ফ্রি, ঐটা, আর লরিয়াল প্যারিসের বারো পাতা শ্যাম্পুর স্যাশে (বোতলের তুলনায় অনেকটা সাশ্রয় হয়)।
আর কী? অরুনের ডিও টা শেষ হয়ে আসছে।
নাই হোক ডিও, গোল্ডির একটা বোতল নিলে কর্তা গিন্নি দুজনেই মাখতে পারবে, দামটাও কম, চলেও বহুদিন।
বেশ, গুনে গুনে জিনিসগুলোর বিল নিতে গিয়ে চৈতির চোখ আটকে গেলো পাশে।
কী সুন্দর অক্সিডাইসের সেট! অ্যান্টিক কালেকশন, সামনের মাসে তাদের অ্যানিভার্সারী, এমন একটা জিনিস কিনলে বেশ হয়। চৈতি দ্বিগুন উৎসাহে মোড়কের দাম দেখে নিলো, তেত্রিশশো। থাক, দরকার নেই।
কোথায় আর তেমন বেরোয় সে? ওতো দামি জিনিস কিনে ঘরে ফেলে রাখার কোনো মানেই হয়না।
কসমেটিকস থেকে বেরিয়ে সামনে আরো একটা শপ, নতুন মনে হয়, বুটিক!
বাহ কী দারুণ দারুণ কালেকশন! যাবে নাকি ভেতরে? নিশ্চয় খুব দামি দোকান? হোক গে, দেখলেই তো আর কিনতে হবেনা, দেখতে দোষ কী?
ভেতরে ঢুকতেই সামনে একটা লং এমব্রয়ডারি পাঞ্জাবি, আকাশ নীল কাপড়ে সোনালী জরি, কী সুন্দর দেখতে! যদি সে অরুনকে এটা কিনে দিতে পারতো, অ্যানিভার্সারীর গিফট!
প্রথম বছর চৈতি নিজের হাতে সাদা কুর্তায় গোলাপি সুতোর নকশা তুলে উপহার দিয়েছিল অরুনকে। সবাই ধন্য ধন্য করেছিল।
এটা নিশ্চয় খুব দামি হবে?
-"ডু ইউ লাইক দিস ওয়ান ম্যাম?"
হঠাৎ সম্বোধনে চৈতি পিছন ফিরলো। জয়িতা? তুই?
অপর মানুষটিও সমানভাবে বিস্মিত।
-" আরে চৈতি! কী ব্যাপার তোর? কলেজের পর পাত্তাই নেই? ভালোই তো বুড়িয়ে গেছিস, স্বামী সংসার সুখী গৃহিণী, অ্যা? নাকি, জব টব করিস?"
-" ওই আর কি, আমার সংসারই সারবস্তু। তারপর তোর কী খবর? বুটিকটা তোর ? কবে খুললি?"
-" হ্যাঁ, আমারও সেই, বর বাইরে থাকে, অনেকদিন তো হলো ছেলেপুলের দেখা মিলল না। ভাবলাম অন্য কিছু চেষ্টা করি। ডিপ্রেশন কমবে নিশ্চয়ই।
খুলে ফেললাম বুটিকটা, সময়ও কাটে, দু পাইস ইনকামও হয়...
এই তুই এমব্রয়ডারি করিস এখনও? কী দারুন হাতের কাজ ছিল তোর! লেটস হ্যাভ এ ডিল, আমার বিজনেসে আয়, টেন পার্সেন্ট শেয়ার তোর, বদলে তোর শিল্পীসত্তা আমার মূলধন হবে, রাজি?"
-" কিন্তু সংসার সন্তান ফেলে...?"
-" তুই বাড়িতেই কাজ করনা, ডায়াগ্রাম তৈরি করে দিবি, তোর হাতের গুণে আমার দোকান রমরমিয়ে চলবে সখী, দোকানে প্রয়োজন পড়লে একটু সময় বের করে চলে আসিস।"
জয়িতা এগিয়ে এসে চৈতির কাঁধ ধরলো, "অন্য কারুর জন্য না, নিজের জন্য, আজকে সব মেয়েদের ইকোনোমিক্যাল লিবারেশন থাকা দরকার। চিন্তা করিসনা, সব ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে দেখিস, এত ট্যালেন্ট তোর, হেলায় হারাস না, প্লিজ!"
শিরদাঁড়াটায় হঠাৎ বেশ জোর এলো চৈতির। সামনে জ্বলজ্বল করছে আকাশ নীল সোনালী জরীর এমব্রয়ডারিটা।