STORYMIRROR

Dola Bhattacharyya

Tragedy Fantasy Others

3  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Fantasy Others

সুবলের বৌ

সুবলের বৌ

3 mins
250

 

সব পাখি ফিরে গেছে নীড়ে, 

শান্ত সন্ধ্যায়, নির্জন নদী তীরে একাকিনী বধু। 

পতি তার আজ ছেড়ে গেছে নীড়। মঙ্গল কামনায় তারই 

এসেছিল নদী স্রোতে ভাসাতে প্রদীপ। 

ভোরবেলায় বনবিবির থানে 

গিয়েছিল সে, মানত রেখেছিল সিঁথির সিঁদুর, 

সবাকার মতো। দয়া কোরো মা গো বনবিবি, 

পতি দেবতারে মোর রেখো গো সুরক্ষিয়া ।

ঘরে যেন ফিরে আসে সে, তোমার কৃপায় ।


            2

মউলে যে পতি তার, বনে গেছে মধু অন্বেষণে, 

জীবিকার টানে। 

আভরণহীন দেহে একাকীনি গৃহকোণে, 

তরুণী বধুটি পালিবে সংযম। সধবার বেশ ছেড়ে, 

এ কদিন থাকবে সে বিধবার বেশে, 

তৈল সিন্দুর হীন অবিন্যস্ত কেশে। 

এইটাই রীতি। খুশি হয়ে বনবিবি 

রক্ষা করিবেন প্রাণ প্রিয় পতি দেবতারে তার। 

ঠিক এই স্থান হতে ছেড়েছিল নৌকাগুলি, 

অকুল দরিয়ার বুকে পাল তুলে, ভোরের বাতাসে 

গিয়েছিল ভেসে। 

এই সন্ধ্যার ক্ষণে, 

শান্ত নিস্তরঙ্গ নদীটির জলে, 

ছায়া খানি কাঁপে তার থির থির করে। 

সহসা উদ্বেলিয়া ওঠে তরুণী হৃদয় —

ওগো, প্রিয় পতি মোর, এ সময়ে তুমি 

রয়েছো কোথায়? 

             3

দিন পরে দিন যায়, অতি দ্রুত কেটেছে সময়। 

ফিরে আসে মউলের দল। 

এই বারে মধু পাওয়া গিয়েছে অনেক। 

বনবিবি র কৃপায়, 

বিপদ হয়নি কারো কোনো। দুটো দিন পরে 

প্রতিটি মানুষ, ফিরে যাবে যার যার ঘরে। 

ভয় থাকে প্রতিবার, 

যতজন যাবে, ততজনই ফিরবে কি! 

এ জীবিকা কঠিন ভারি। 

এ রকমই রীতি। 

এবারে তো রয়েছে সবাই। 

সদয় ছিল যে বাবা দক্ষিণ রায়। 

একটিন বাড়তি মধু 

এইবারে পেয়েছে সুবল। 

ঘরেতে আহ্লাদী বৌটি তার, 

মধু খেতে ভালবাসে বড়। 

মধু খেয়ে, মধু মেখে, মধুতে করিয়া স্নান, 

প্রেমভরে বধু তারে দেহরূপ সুধা 

 বিলাইবে অকাতরে, ধন্য হবে যে প্রাণ। 


              4

সহসা সুবলের কেটে যায় ঘোর। 

এ কেমন দিন ! 

ফিসফিস বৃষ্টির সাথে ঝোড়ো হাওয়া, 

হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজে ওঠে বেদনার বীন। 

খাঁড়ির মুখটাতে নৌকা ফেলেছে নোঙর, 

এখানেই রান্না খাওয়া সেরে, দুপুরের দিকে

আসিলে জোয়ার, ভেসে যাবে নৌকাখানি 

নিজ গ্রাম অভিমুখে। 

দূরে কারা ভেসে যায়, চলে যায় দূরে। 

কি যেন কি বলে যায় বাতাসের সুরে, 

শোনো শোনো মউলেরা, শোনো।সাবধান। 

বড়মিঞা বেরিয়েছে আজ। 

ওই দ্যাখো পড়ে আসে বেলা, আর কোরোনাকো হেলা। 

যত তাড়াতাড়ি পারো ফিরে যাও গ্রামে। 

শুনে সর্বজনে, ভীত ও চকিত নয়নে 

দেখে নেয় আশপাশ, এ বিপদ ভারি! 

বড় তাড়াতাড়ি দিতে হবে পাড়ি। 

মাঝি সাথে নৌকাতে একলা সুবল, ভয় জাগে মনে। 

ওরা সব বলে, ওখানেই থাক রে সুবল। 

ওখানেই নিরাপদ তুই।

আমাদের পার হয়ে ছুঁতে তোকে পারবে না সে। 

এইখানে দশজনে আছি আমরা, 

একই সাথে আছি, অতি কাছাকাছি। 

শুধু দুটো ঝোল ভাত 

রেঁধে নিয়ে নৌকাতে উঠবো এখন, 

লাগবে না আর বেশিক্ষণ। 


            5

মেঘে ঢাকা আকাশের পটে, 

গিয়েছিল কারা যেন জল নিতে ঘাটে। 

তিনখানা নৌকো ভিড়েছে তখনই, 

মউলেরা সদলে ফিরেছে ঘরে। 

বধুগণ বাতাসেতে উড়ায় খবর —

এসো এসো সবে , 

পতিরা ফিরেছে ঘরে দেখে যাও এসে। 

সহর্ষে ছুটে আসে সব। 

সাথে আসে সুবলের বৌ। 

নৌকার বুড়ো মাঝি বলে —একখানা নৌকো যে 

পেছনে এখনো আছে। 

ভেবো নাগো বধুগণ, তোমাদের ঘরের মানুষ, 

সুস্থ আছে সকলেই। সন্ধ্যার আগে, 

ওরা ঠিক ফিরে যাবে ঘরে। 


             6

রান্না হলো শেষ, এবার ফেরার পালা। 

স্তব্ধ প্রকৃতি যেন কি এক আশংকায় 

মুক্ হয়ে আছে। মেঘলা আকাশ আর 

বনজ গন্ধবাহী জোলো হাওয়া সাথে, 

 বৃষ্টি ইলশেগুঁড়ি। ভয় ভয় ভাব 

সকলের মনে। তাড়াতাড়ি 

এ জায়গা যেতে হবে ছাড়ি। 

লোকসংখ্যা গুনে নিয়ে নিশ্চিন্ত নৌকার মাঝি। 

 এসেছে সকলে ফিরে নৌকার মাঝে। 

সহসা নৌকাখানা উঠল সজোরে দুলে ।

বাকরুদ্ধ সকলের নয়ন সমুখে, 

সোনালী বিদ্যুৎ এক বজ্রপাত হানে 

সুবলের শিরে। টুঁটি টিপে ধরে তার

নিয়ে চলে নৌকা থেকে দূরে। 

সুগভীর গর্জনে তার কেঁপে ওঠে বনভূমি, 

হাহাকার করে ওঠে স্তব্ধ প্রকৃতি। 


            7

সন্ধ্যার আঁধারে মিশে ছায়ার মতো, 

ফিরে আসে মউলেদের শেষ নৌকা খানি। 

বার্তা যায় গ্রামে। 

ছুটে চলে সুবলের তরুণী বধু 

বনপথ ধরে। 

হাসি থেকে তার যেন শত মুক্তো ঝরে। 

ওগো গরাণ, সুন্দরী, 

বড়ো খুশি আজ আমি। 

হাতে শাঁখা চুড়ি আর রঙিন শাড়িতে 

কত না যত্নে আজ সাজাবো নিজেকে, 

কপালেতে এঁকে নেব সিঁদুরের টিপ। 

ঘরেতে ফিরেছে আজ কতদিন পরে, 

সে আমার মনের মানুষ। 

ওগো কৃষ্ণচুড়া - 

এভাবে জ্বেলোনা মোর দেহের আগুন। 


            8

নৌকা খানি সদ্য ভিড়েছে ঘাটে। 

আলুথালু বেশে ছুটে আসে মেয়ে। 

ওই তো নেমেছে ওরা। 

কিন্তু, সে কোথায় গেল! ওগো! কোথায় তুমি! 

একী! এভাবে কি এনেছো তোমরা? 

কথা কেন বলছো না কেউ। 

সহসা বাতাস এসে বলে যায় কানে কানে, 

ওরে হতভাগী, ছেঁড়া খোঁড়া দেহ নিয়ে, 

নয়ন সম্মুখে তোর রয়েছে যে শুয়ে, 

ও যে তোর মনের মানুষ। 

সে তো নেই। আর নেই ।

বিশ্বাস করি না আমি। করিনা বিশ্বাস। 

উচ্চ কন্ঠে হতভাগী বলে ওঠে বারবার, 

সুবল আসবে ফিরে, আমি ঠিক জানি। 

বিশ্বাস করিনা আমি। 


           9

দুইদিন কেটে গেছে। ভরা সন্ধ্যায়, 

আজও আছে একাকীনি সুবলের বৌ 

তার স্বামীর প্রতীক্ষায়। 

ফিরবে তো বলেছিল। 

বলেছিল এ জীবিকা রাখবে না আর। 

অন্য কোনো জীবিকার সন্ধান পেয়ে যাবে ঠিক। 

তবে কেন ফিরলো না আজও! 

গাঢ় হয় সন্ধ্যার আঁধার। 

ফুটে ওঠে একটা দুটো তারা 

অন্ধকার আকাশের গায়ে। 

সেদিকে তাকিয়ে, সহসা কি অনুভবে 

বিপুল ক্রন্দনে, কেঁপে ওঠে তনুখানি তার। 

পাগলীনি প্রায় ধুলিপরে লুটায় তরুণী, 

ঝরে পড়ে কন্ঠ হতে করুণ আকুতি, 

হায় বনদেবী! 

ফিরায়ে দিলি না কিছু মাগো! 

সব নিলি কেড়ে! 

এবার কি করি আমি বল! বাঁচবো কি করে? 



Rate this content
Log in

Similar bengali poem from Tragedy