সমকামিতা ভালোবাসার
সমকামিতা ভালোবাসার
রাত 1:00am আচমকা একটা ফোন কল, একটু অবাক হলাম! এত রাতে আবার কে ফোন করলো। কেউ তো করে না, একটা সময় একজন করতো। সে...না...তো! ফোনটা না ধরেই বুকের ভেতরটা কেমন একটা করছে, তার কথা শুধু মনে পড়ছিল, মনে হচ্ছে হয়তো সে ফোনটা করেছে। কিন্তু কেন! হঠাৎ 2 বছর পর তার আমার কথা মনে পড়লো!
ফোনটা অনেক্ষন দিয়ে বেজে যাচ্ছে... এবার হয়তো না ধরলে কেটে যাবে, ফোনটা ধরলাম।
-- হ্যালো...হ্যালো...
-- হুম (খুবচেনা গলা আমার সন্দেহ ঠিক ছিল)
-- শুনতে পারছিস আমি নীল...
-- বল কী হয়েছে কী দরকার!
-- কেমন আছিস?
-- যেমন রেখেছিস।
-- মনে পড়ে এখন?
-- ভুলিনি তো কখনো।
-- রাগ করেছিস?
-- রাগ করার আছে কী!
-- তাহলে এটা...
-- সবটাই অভিমান।
-- বাড়ির সবাই কেমন আছে?
-- সবাই সবার মতো।
-- আর তুই?
-- নিজের মতো।
-- বদলে গেছিস অনেক!
-- চেষ্টা করছি বদলানোর।
-- সেই দিনগুলোর কথা মনে
পড়ে?
-- সবটাই এখন অতীত।
-- দেখা করবি একদিন?
-- সময় নেই।
-- চেষ্টা কর সময় বার করার...
-- ইচ্ছে নেই।
-- এত অভিমান কেন ?
-- এটাতো সামান্য মাত্র।
-- আরো আছে?
-- হয় তো।
-- তোকে বড্ড ভালোবাসি!
-- ও আচ্ছা...
-- বিয়ে করবি আমায়?
-- তা এখন আর সম্ভব না।
-- কেন বলা যাবে কী ?
-- আমি এখন অন্য কারুর।
-- তবে তুই তো আমায়
ভালোবাসিস?
-- কে বললো এই সব।
-- এখন আমি প্রিয় না?
-- আমি নিজে নিজের কাছে প্রিয়।
-- আর ভালোবাসিস না?
-- হুম, বাসি তো নিজেকে।
-- আর আমি?
-- হারিয়ে গেছিস অতল সমুদ্রে।
-- এতটা অভিমান জমানো?
-- রাখলাম
[রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে]
(...হঠাৎ দেখা)
ফোনটা নিজেই রেখে দিলাম, অযথা কথায় কথা বাড়ছিল আবার সেই আগের মতো, যা আমি আর চাই না মনে করতে। ফোন রাখলেও আমার মন চাইছিল কথা বলতে কিন্তু আমি তা আর হতে দিলাম না, অনবরত চোখ থেকে জল ঝরছে নিস্তব্ধতার আড়াল বেয়ে। ফিরে গেলাম আজ থেকে প্রায় ২ বছর আগের ঘটনায়...
আমি রক্তিম মনস্তত্ত্ববিদ্যাতে অনার্স 2nd year, আমি প্রেমে পড়েছি নীলাদ্রির ওরফে নীলের, সেও আমাকে ভালোবাসে। last year, মাঝে মধ্যে কলেজে আসে নীল, সময় অসময় কথা বলা ঘুরতে যাওয়া আমাদের প্রায়ই চলত। আমাদের এই প্রেমটা আর পাঁচজনের মতো সাধারন না। আমি শারীরিক গঠনে একজন পুরুষ আর মানসিক দিক থেকে নারীসত্তা কাজ করে আমার মধ্যে, আমি মেয়েদের মত সাজতে ভালোবাসি, একটা সুন্দর প্রেম করতে চাই ভালোবাসা দিয়ে প্রেমিককে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। আর পাঁচজনের মতো আমি সাধারন না। আমি মেয়েদের মতো সাজলে লোকে নানা কথা বলে বিভিন্ন মানুষ আমাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে ছক্কা, হিজরা, হাফ লেডিস, বৃহন্নলা প্রভৃতি। সবটাই সহ্য করে আমি পাহাড়ের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, আর নিজেকে আটকাতে পারছিনা এতগুলো বছর ধরে শুধুই নিজের সাথে লড়াই করছি। একটা সময় নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে তাই একা থাকতেই বেশি পছন্দ করি।
হঠাৎ একদিন নীল আসলো আমার কাছে আলাপ করতে। আমাদের বন্ধুত্ব হল আলাপ হলো, বন্ধুত্বটা কখন প্রেমে পরিণতি পেয়েছে আমরা বুঝিনি, ও আমার খুব খেয়াল রাখতো ঠিক এক প্রেমিক যেমন তার প্রেমিকার খেয়াল রাখে। আমি ধীরে ধীরে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি নীলকে আমার প্রেমিকের আসনে বসাতে শুরু করি। ও এতে আপত্তি করেনি সবটা বুঝে আমার পাশে থেকেছে।
আমরা দুজন বিয়ে করবো ঠিক করেছিলাম, আমার ভয় ছিল এই সমাজ তো মেনে নেবেনা আমাদেরকে কোনোদিন, একটা পুরুষের সাথে একটা পুরুষের বিয়ে! নীল বাড়িতে আমার কথা বলেছে...তারা সকলে আমাকে মেনে নিয়েছে বললো। নীলকে বললাম আমি তোদের বাড়িতে গিয়ে তোর পরিবারের সাথে দেখা করতে চাই, নীল রাজি হলো না বলল বিয়ের পর দুজনে একসাথে যাবো ওনারা অনেক দূরে থাকে। ১৪ -ই বৈশাখ আমাদের বিয়ে, এক ছোটো কালীমন্দিরে আমরা বিয়ে করবো। বিয়ের দিন আমি গিয়ে অপেক্ষা করছি নীলের, সেই দিন আমি পুরো বিয়ের কনের মতো সেজেছিলাম সকলে বলছে আমায় খুব সুন্দর লাগছে। একা একা সেই মন্দিরে অপেক্ষা করছি নীলকে ফোনেও পাচ্ছিনা। আমি আমাদের ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করছিলাম আমরা দুজন একটা সন্তান দত্তক নিয়েছি তাকে মানুষ করছি, তাকে নিয়েই সময় চলে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় আমার কল্পনা ভাঙতে একটা ফোন আসলো। কে একজন বলছে নীলের বিয়ে হয়ে গেছে রাইয়ের সাথে, রাই আমার কলেজের খুব ভালো বন্ধু, নীলেরও খুব ভালো বন্ধু। ওকে নিজের বোনের মতো দেখত আর ভালোবাসতো, আমাকে এইটাই বলেছে এতগুলো বছর তার মানে!
এটা শোনার পর আমি অবাক, একদিকে খুব খুশিও হচ্ছিলো আর খুব কষ্টও, আমার দেখা স্বপ্নটা হারিয়ে গেল এই ভাবে। পরবর্তীতে জানতে পারলাম রাইও নীলকে খুব ভালোবাসে, এতদিন আমার সাথে সবটাই অভিনয় ছিল! আমাকে বিয়ে করলে নীল কোনোদিন সুখী হতো না।
যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে...
এই কথা মাথায় রেখে আমি পরিবারের থেকে দূরে চলে যাই একটা আশ্রমে যেখানে আমাদের মতো অনেক মানুষ আছে, একটা অনাথ শিশুকে মানুষ করি যার নাম রনি রক্তিম এর 'র' আর নীলাদ্রির 'ন'। তার বাবা এবং মা হওয়ার চেষ্টা করি তাকে নিয়ে আমার দিন বেশ চলছে। হঠাৎ এই ফোন এসে আমাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যা আর কোনোদিন সম্ভব না, নীল এখনো আমাকে ভালোবাসে এই কথাটা কতটা সত্যি বা মিথ্যে তা আমার জানা নেই, তবে আমিও নীলকে ভালোবাসি। সে আমাকে কেন মিথ্যে বললো জানিনা, আর জানার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। আমার দিক থেকে তার প্রতি ভালোবাসাটা সত্যি ছিল, আর তার দিক থেকে সবটাই ধোঁয়াশা। আজ সে আমার প্রাক্তন। ইচ্ছা থাকলেও প্রাক্তনের কাছে যাওয়া যায় না, প্রিয় বন্ধুর সংসার তো আমি আর ভেঙ্গে দিতে পারি না, আমার সংসার নাই বা হলো, তা বলে ওদের জীবন নষ্ট করবোনা। এইভাবে আর বেঁচে থাকতে পারছি না। সময় আর এই সমাজের কাছে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিনা। আমরা আইনি খাতায় স্থান পেলেও সমাজে পাইনি। বাংলা ভাষার বইতে বা চাকরির পরীক্ষায় আবেদনপত্রে স্ত্রী ও পুরুষলিঙ্গ বাদেও আরেকটি লিঙ্গ আছে, 'ক্লীবলিঙ্গ' এইটাই হয়তো আমাদের মত মানুষের পরিচয়। কেন এই সমাজ আমাদের মেনে নেয় না? আমরাও তোমাদের মত মানুষ, তবে কেন আমাদের ভালোবাসা নেই! সমাজের প্রতিটি দোরগোড়ায় আমাদের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। এটাই কি আমাদের পরিচয়!
আমাদের মতো মানুষদের কোনো পরিচয় নেই,
আমাদের ভালোবাসা নেই, বন্ধুও নেই কেউ
আমাদের ভালোবাসতে পারে না এই সমাজ
আমাদের কোনোদিন মানতে পারে না
আর ভবিষ্যতেও পারবে না
আমরা কেবল বেঁচে থাকি মানুষের একটা উদাহরণ হয়ে সমাজের বুকে। তাই আজ বিদায় নিলাম প্রাক্তন তুমি ভালো থেকো। সবটা আমার স্বপ্ন ও কল্পনা ছিল...
তুমি ভালো থেকো প্রাক্তন... তুমি ভালো থেকো।
আমাদের সম্পর্কটা হয় তো এমন ছিল...
"ওরে নির্বোধ ওটা অন্য পৃথিবী,আর তোর বড্ড দেরি হয়ে গেছে।।(অন্য বসন্ত)"
একটা নাম না জানা
ভালোবাসার গল্প...
প্রথমে বন্ধুত্ব, ভালোলাগা
থেকে, তারপর না বলা
ভালোবাসায় পূর্ণতা পাওয়া।
নিজের করে পাবে না জেনেও
সঙ্গ চাইতো দিনের শেষে দুজনে।
বন্ধুত্বের হাত ধরতো,
ভরসা হত একে-অপরের।
ব্যস্ততার ফাঁকে আড়াল
খুঁজতো, মনের গভীরে।
না চাইতেও পেয়েছিল-
মনের মতো মানুষের সঙ্গ।
যা অন্যের...তার ওপর নিজের
অধিকার জন্মাবে না কোনদিন।
ভালোবাসা ছিল তাই হয়তো
অভিমানটাও ছিল,
তবে এই নাম না জানা
ভালোবাসার কোনো
অধিকার ছিল না।
ওই ভালোবাসা ওই পৃথিবীটা অন্যের,
তোর বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
তোর ভালোবাসার কথা
অপ্রকাশিত রয়ে গেল।
তবে ভালোবাসাটা দুজনের
অসম্পূর্ণতায় ঘেরা।