দেবী
দেবী
(Image courtesy: Poster from the film "Devi", 1960, by Satyajit Ray.)
কে তুমি?
তুমি কি তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা,
ক্ষীন কটি, নিম্ননাভিঃ, লাস্যময়ী?
নাকি গৌরবর্ণা, প্রতিমা লক্ষণা, পদ্মগন্ধা,
সজলনয়না, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা
উর্বরা গাভী ? নম্র, নতশিরা?
তবে কি তুমি দশপ্রহরণধারিণী
মহিষাসুরমর্দিনী?
নাকি তুমি সর্বংসহা ধরিত্রী, অন্নপূর্ণা,
মাতৃস্তন্যদায়িনী?
যে তুমি জ্ঞানের শিখরবাসিনী,
বাণী বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী;
সেই তুমিই চরম পুরুষার্থ দাত্রী,
কমলাসনা নারায়ণী।
তুমি হতে পার সঞ্চারিনী, পল্লবিনী, লতেব;
কিংবা হতে পার জ্বলন্ত হাউইয়ের কাঠি।
হয়ত তুমি পুরুষের সেই কাঙ্ক্ষিতা
স্বপ্নসুন্দরী -
সর্বগুণান্বিতা, গৃহকর্মনিপুণা,
উচ্চশিক্ষিতা, সঙ্গিতজ্ঞা, সর্ব সম্মানে
ভূষিতা বিদুষিনী।
তুমি হতেও পার
কুসুমকোমল কমনীয় সবুজ
মখমলের মত বাগীচা,
আবার হতে পার বিনা মেঘে বজ্রপাত -
অমোঘ, দুর্নিবার ভবিতব্য - প্রলয়ঙ্করী
সৃষ্টিবিনাশিনী মহাকালী!
এ সবই তুমি হতে পার।
কিন্ত তুমি জান কি,
সবার আগে তোমায় হতে হবে নিদারুন
অসম্মানের পালঙ্কে কদর্য ক্ষমতার
অঙ্কশায়িনী?
ব্রহ্মান্ডের সকল মেধা, রূপ, রস,
সুগন্ধ, সুখস্পর্শ, সুমধুর ধ্বনির নির্যাস
তিলে তিলে আহরণ করে
হয়ে উঠেছ তুমি তিলোত্তমা - অপার্থিব!
জান কি, তোমার রূপের জ্বলন্ত শিখার
মাঝে বিশ্বসংসার হয়ে যায়
পোকা মাকড়ের মতই তুচ্ছ ? কাঠকুটো বা ছেঁড়া
কাগজের মত দাহ্য?
তাহলে
কোন অদৃশ্য অসুর শক্তির নাগপাশে
বন্দিনী তুমি, হয়ে থাক পায়ের তলায়
পিষ্ট কাদার তাল? কেন তুমি অবলা, এত বলে?
কেন হয়ে যাও প্রতি মুহূর্তে
ছিন্নভিন্ন, চূর্ণবিচূর্ণ? রক্তাক্ত হয়ে যাও
কোন দানবীয় দাঁত-নখ-থাবার কবলে?
তিলোত্তমা, কান পেতে শোনো,
>
কি বলছে আসমুদ্রহিমাচল! ওই শোনো!
গর্জে উঠেছে অনন্ত ঐশ্বর্য, বল, বীর্য,
অনন্ত জ্ঞানসম্পন্ন অন্তহীন পরমব্রহ্ম;
জ্বলে উঠেছে আরক্ত ত্র্যম্বক দৃষ্টি!
বজ্রনির্ঘোষে আদেশ হয়েছে জারি,
"হে নারী! তোমাকে হতে হবে দেবী!"
তোমাকেই হতে হবে স্ত্রীরূপিণী মায়াশক্তি,
না হলে কি করে হবে পঞ্চভূতের সৃষ্টি?
তুমি শুনতে পাচ্ছ কি? তোমাকে হতে হবে
দেবী!
সুরাসুরের সমরে তোমাকেই তুলে নিতে হবে
বিধ্বংসী অস্ত্র! তোমাকেই হতে হবে
শক্তিরূপেণ সংস্থিতা!
তোমাকে যে হতেই হবে দেবী ! না হলে,
সমগ্র সৃষ্টি যাবে রসাতলে!
একান্ন শক্তিপীঠে খন্ড খন্ড হয়ে যাবে তোমার দেহ,
প্রলয় নৃত্যের তালে তালে একেকটি
পূণ্যধামে খসে পড়বে তোমার
অংশ! পড়বে কি তার সাথে দুফোঁটা রক্ত?
অথবা এক বিন্দু অশ্রু? শুনতে পাবে কি
কেউ তোমার তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার?
মনে হয় না।
তবুও, তিলোত্তমা, জেনে রাখ,
তোমায় হতেই হবে
দেবী!
তোমার যে দেহের প্রতি জমে আছে
এই পুরুষানুক্রমিক ঘৃণা - পুঞ্জীভূত,
এই আক্রোশ - পর্বতপ্রমাণ,
এই অবহেলা - অতল,
যে নশ্বর শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয় অহরহ,
তোমার যে দেহ প্রাণ সৃজনে অপরিহার্য, অথচ
যার প্রাণের নেই কোনো মূল্যই,
তোমার সেই নির্যাতিত দেহই
গড়া হবে সহস্র পদদলিত মাটির পিন্ডে।
তোমার অপরূপ প্রতিমার কপালে, সুচারু তুলির
টানে আঁকা হবে ভুবনমোহিনী ত্রিনয়ন।
তাতে করা হবে চক্ষুদান;
তোমার মৃন্ময়ী শরীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে,
তোমার চিন্ময়ী রূপে মুগ্ধ হয়ে,
ভক্তিতে, ভালবাসায় আত্মহারা হয়ে,
এই অভিশপ্ত ছায়াঘন কালবেলায়,
স্বর্গ মর্ত পাতাল থেকে উঠবে ধ্বনি,
"যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা"!
এ তীব্র বিদ্বেষ, এ লাঞ্ছনা, এত অপমান
সয়ে, এবার বলো, তিলোত্তমা,
সত্যিই কি তুমি
হতে চাও
দেবী?