Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Maheshwar Maji

Drama

0.3  

Maheshwar Maji

Drama

মেঘ বৃষ্টি আলো

মেঘ বৃষ্টি আলো

32 mins
3.8K


(এক)


পর পর দুবার কলিং বেলের শব্দ পেয়ে সাধনাদেবী কিচেন থেকে ডাক দিলেন, মৌ...ও..মৌ দ্যাখ তো মা গিয়ে এই অসময়ে আবার কে এল?

মৌমিতা এই সময় মায়ের ডাকটা শুনে একটু বিরক্তই হল।তার ওঠে যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই। সবে গল্পের ক্লাইমেক্সে ঢুকেছে।নায়ক,নায়িকার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এইবার একটু মানসিক বিশ্রামের দরকার।তারপর অনেক ভেবে চিন্তে তাদেরকে আবার ফেলে আসা জীবনের প্রত্যুষে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে হবে।

এইখানে এসে একজন লেখক বা লেখিকার দায়িত্ব কয়েকগুণ বেড়ে যায়।পাঠক,পাঠিকার মনে হাজার প্রশ্নের উদয় এই জায়গা থেকেই শুরু হয়।

তাই এখান থেকে বড্ড চিন্তা করে গল্পের উত্তরণ ঘটাতে হয়।এই সময়টাই স্রষ্টা নাওয়া,খাওয়া,শোওয়া পর্যন্ত ভুলে যান।তিনি যেন সত্যিকার নায়ক,নায়িকার অভিভাবক হয়ে ওঠেন। তাই তাদের ঘরমুখো না করা পর্যন্ত মনে একদম শান্তি থাকে না।

এই সময় যদি চেয়ার ছেড়ে উঠতে হয় সত্যি সত্যিই রাগ আসে।

মৌমিতা তাই একরকম বিরক্ত হয়েই ওঠে গেল।বুকের ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে,মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলো ঘুরিয়ে বেঁধে নিয়ে দরজাটা খুলল।

একজন মাঝ বয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছেন সামনে।একটু গোল টাইপের ,উচ্চতা খুব বেশি না। দাড়ি,গোঁফ কামানো।মাথায় পাতলা চুল।জিন্স,টিশার্টের সাথে কাঁধে একটা এক্সিকিউটিভ ব্যাগ ঝোলানো।

মৌমিতাকে এক ঝলক দেখে নিয়েই লোকটি হাতদুটো জড়ো করে বলে উঠলেন,নমস্কার মৌমিতা ম্যাডাম।আমি সুখেন ভৌমিক।ফ্রম নীল ভিসন প্রোডাকশন কম্পানি।আপনার সঙ্গে দুদিন আগেই ফোনে কথা হয়েছিল।আপনি বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন।একটু স্যুটিং-এ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম বলেই আসতে পারিনি।আজ এদিক দিয়ে পেরিয়ে যেতেই আপনার কথা হঠাৎ করে খেয়াল হয়ে গেল। আপনাকে ফোন করেছিলাম।বোধ হয় ফোনটা বন্ধ আছে। তাই কোন সাড়া না পেয়ে এই দুপুর বেলায় অসময়ে বিরক্ত করতে চলে এলাম।

  মৌমিতা সাথে, সাথেই হাসি মুখে বলে উঠল, আরে না..না। সেরকম কিছু না।আসলে এই সময়টায় আমি একটু লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকি।তাই ফোনটা অফ করে রাখতে হয়।আসুন..ভেতরে ..আসুন।বসুন ওখানে।আমি এক গ্লাস জল নিয়ে আসছি।

মিনিট তিনেকের মধ্যেই মৌমিতা জল আর মিষ্টি নিয়ে হাজির হল।তা দেখে সুখেন বলে উঠলেন,আরে...কি করছেন কী ম্যাডাম!..আমি খেতে এলাম নাকি?... আমি এসেছি কাজের কথা বলতে।খাওয়া,দাওয়া অনেক পরে হবে।

মৌমিতা আপ্প্যায়নের সুরে জবাব দিল, জানি।সে হলেও আপনি আমাদের অতিথি।

----সে যাই হোক এবার আপনি বসুন।কথা আছে।

মৌমিতা নিজেকে একটু পরিপাটি করে উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

সুখেন এক ঢোক জল খেয়ে বলে উঠলেন,আমি আপনার ব্লগের অনেকগুলো গল্প মন দিয়ে পড়েছি।এবং রীতিমত অবাক হয়ে গেছি।এত সুন্দর লেখার ধরণ!...অথচ ফেসবুকে লেখালেখি করছেন?...আসলে প্রথমবার ফেসবুকে এত সুন্দর, সুন্দর গল্প পড়লাম।তাই প্রশ্নটা চলে এল।তাবলে ফেসবুক যে ফেলনা জায়গা তা কিন্তু একেবারেই নয়।সে যাই হোক আমি আপনার ব্লগ থেকে তিনটে গল্প নেওয়ার জন্য সিলেক্ট করেছি।দুটো শর্ট ফিল্ম এবং একটা বানিজ্যিক সিনেমার জন্য। তাতে আপনার কী অভিমত বলুন?

মৌমিতা যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বলে উঠল,আপনি কোন তিনটে গল্পের কথা বলছেন বলুন তো?

শর্ট ফিল্মের জন্য "হঠাৎ বসন্ত" ও "কেয়া পাতার নৌকো" আর বিগ বাজেট ফিল্মের জন্য আপনার বড় গল্প "খুশির কোলে মেঘ জমেছে" মোট তিনটে গল্প আমি নিতে চাই।

-----সে তো খুব ভাল কথা।তা...এরজন্য আমাকে কী করতে হবে?

---একটা লিখিত নক দেবেন। আপনি গল্প তিনটের স্বত্ত আমাকে বিক্রি করছেন সেই মর্মে একটা চিঠি।যাতে পরবর্তীকালে কোন ঝামেলায় না পড়তে হয়।

এবার বলুন আপনার দাবী কী?

মৌমিতা একটু ভেবে বলে উঠল,আমি একজন লেখিকা।লিখতে ভালবাসি।তাই লিখতে বসা।এ ব্যাপারে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। আপনিই বলুন কত কী দেবেন?

----সেটা কী শোভনীয় হবে?

----অবশ্যই হবে।

-----এই ধরুণ তিরিশ হাজার।যদি আগামীদিনে তেমন সাফল্য আসে।আরো কিছু বোনাস পাঠিয়ে দেব।বলুন...রাজি আছেন?

----এটা আমি ঠিক দাম হিসেবে নিতে চাই না। লেখালেখির এই আয়টুকু,আমি পুরস্কার হিসেবেই নিতে চাই।তাই আর দর,দাম করছি না। আপনি খুশি মনে যেটা ভেবেছেন।তাই দেবেন। আর হ্যাঁ... যাই বানান।লেখিকা হিসেবে আমার নামটা যেন কোনরকম বাদ না পড়ে সেটা একটু দেখবেন।

----সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না ম্যাডাম।অবশ্যই থাকবে।

তারপর সুখেন ব্যাগ থেকে পেপার এবং টাকা একসাথেই বের করে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,এটা বায়না হিসেবে দশ হাজার রাখুন।বাকিটা আপনি অফিসে এসে নিয়ে যাবেন।এটা কম্পানির ভিজিটিং কার্ড।...আর এটা হল।বন্ড পেপার।আপনি আপনার ব্যক্তব্যটি এর উপরে লিখে দিন।নিচে সাইন।

মৌমিতা সব তৈরি করে ধরিয়ে দিল।সুখেন প্রতি নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

মৌমিতা আস্তে করে দরজাটা ভাঁজ করে ছিটকানিটা তুলে দিল।তারপর হাতের টাকা কটা বুকের মধ্যে চেপে একটা দীর্ঘ নিশ্বাসে বুকটা উঁচু করে ফেলল।

দুফোঁটা জল এসে চোখের পলকদুটোকে অল্প ভিজিয়ে দিল।

এই জলটুকুতে অনেক কিছু মিশে আছে।মান,অভিমান,ভালোবাসা,ব্যর্থতা,সাফল্য এবং আনন্দ!!


(দুই)


---কী হল মৌ এসো।...এত রাত হয়ে গেল,এখনো তুমি ওখানেই বসে রইলে?..আর আমি একা,একা তোমার অপেক্ষায় গা মোড়া ভাঙছি।একবার অভাগার দিকেও চাও।সব সময় কল্প চরিত্রদের সাথে কথা নাইবা বললে!...এদিকে তোমার বাস্তবের পতিদেব যে অভাবি থেকে যাচ্ছে।সেদিকে খেয়াল রাখো?

মৌমিতা লিখতে, লিখতেই ঘাড় নিচু করে জবাব দিল,জাস্ট দু মিনিট ডিয়ার।রাগ করো না প্লিজ।শেষ করেই আমি তোমার সব বায়নার ইতি ঘটাচ্ছি।...অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় গো।

ঘড়ি দেখে লেখার অভ্যেস মৌমিতার এখন নেই।

একটা সময় ছিল যখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুকে এররাশ উত্তেজনা চাপা রেখে দু,আড়ায় ঘন্টা শক্ত বেঞ্চের উপর বসে মুখ গুঁজে লিখতে হত।

সেদিন থেকেই এই নীতির বীরুদ্ধে তার মনে একটা বিদ্রোহ জন্ম নিয়েছিল।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে।এখন সে মনের আনন্দে শুধু লিখে যায়।

তার লেখনী কথা বলতে শিখল।অগনিত মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে বসল।

একটা প্রাইভেট ইস্কুলে পড়ানোর ফাঁকে তার ফেসবুকের ব্লগটিকেও যত্ন সহকারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেল।

প্রতিদিন অসাধারণ সব গল্পের ডালি নিয়ে পাঠক, পাঠিকার সামনে হাজির হয়েছে।

সে যখন মোটামুটি তার স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেল।ঠিক সেই সময় তার বাবা একটা ভাল পাত্রের সন্ধান আনলেন।

মৌমিতার সেই মুহূর্তে বিয়ে করার একদম ইচ্ছে ছিল না।

সে আরো কিছুদিন সময় চায়।সে জানত বিয়ের পর আর সেভাবে সময় পাবে না।

এই সময় তার লেখনী একটা শিখরে উন্নিত হয়েছে।হাজার,হাজার রিডারদের গভীর প্রত্যাশা রয়েছে তার উপর।

একজন প্রকাশকও এগিয়ে এসেছেন।তার কয়েকটা গল্প একত্রিত করে একটা সংকলন বের করার জন্য।

রিডারদের কাছে বিপুলহারে সমর্থন পাচ্ছে।সংকলনটা সংগ্রহ করার।

এই সংকলনটা একবার সগৌরবে বেরিয়ে গেলেই সে একটু থিঁতু হতে পারবে।

সাহিত্যের আঙনে একটা লেখার ছাপ উঠে আসবে।

তারপর সে বিয়ে করলেও ক্ষতি নেই।সময় ধরে আস্তে,আস্তে এগিয়ে যাবে অপ্রকাশিত গল্পের দ্বিতীয় একটা সংকলনের দিকে।তখন এত তাড়া থাকবে না।

কিন্তু তার বাবা জিদ ধরে বসে রইলেন।তার কোন কথায় কানে তুলতে রাজি নন।

    অগত্যা মৌমিতাকেই একদিন পাত্রের খোঁজখবর নিয়ে তার ফোন নাম্বারটা জোগাড় করতে হল।

ইস্কুল থেকে ফেরার পথে তাকে ফোন করে পার্কে দেখা করতে বলল।

পাত্রের নাম সুকুমার অধিকারী।

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।

মৌমিতা সুকুমারকে দেখতে যাওয়ার দিনই চিনে নিয়েছিল। তাই পার্কে এক দেখাতেই চিনে ফেলল।

বরং সুকুমারই একটু দ্বিধা নিয়ে বলেছিল,আপনিই মৌ তো?

মৌমিতা কোন রকম উপসংহার ছাড়ায় বলে উঠেছিল,পাশে বসুন।কয়েকটা কথা আছে।

তারপর মৌমিতা শান্তভাবে তার সমস্ত সমস্যাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেলল।

সব শুনে সুকুমার দুহাতের তালু দিয়ে মুখটা অল্প ঘষে বলে উঠেছিল,এবার বলুন আমাকে ঠিক কী করতে হবে?

মৌমিতা শান্ত গলায় বলে উঠল,অপেক্ষা।

----কতদিন?

----কম করেও একটা বছর।

---যদি বাড়িতে না মেনে নেয়?

---আপনি অন্য মেয়ে দেখে নেবেন।

সুকুমার সেদিন তার বুকের ভেতরটা ঠিকমত দেখানোর চেষ্টা না করেই শুধু "আচ্ছা" বলে উঠে পড়েছিল।

মৌমিতার মনটাও অনেকটা হাল্কা হয়ে ছিল।

দুদিন যাওয়ার পরই খবর আসে পাত্রের বাবা দেনা-পাওনার কথাটা পাঁকা করে রাখতে চান।বিয়েটা এক বছর পরে হলেও ক্ষতি নেই।

সেই শুনে মৌমিতার রাগ চরমে ওঠে এল।

জোর গলায় তার বাবাকে বলে উঠল,একদম না বাবা।এমন কাজটি করবে না বলে দিচ্ছি।টাকা দিয়ে তোমার মেয়ের সুখ কিনতে যেও না। আমি এ বিয়ে করব না। এ বিয়ে কেন,টাকার দাবী তোলা কোন বাড়িতেয় আমি মাথায় সিঁদুর তুলে ঢুকব না। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত ।

তার বাবা অনেক বুঝিয়েও মেয়েকে সেদিন ক্ষান্ত করতে পারেননি।

বাধ্য হয়ে তখন পাত্রের বাবাকে তার মেয়ের অভিমত জানিয়েছিলেন।

ঠিক তার পরের দিনই তার ফোনটা আবার ইস্কুলের কমন রুমে নিশব্দে কেঁপে উঠেছিল।

নামটা ডিলিট করে দিলেও নাম্বারটা বেহায়া মস্তিস্ক ঠিক মনে রেখেছিল।

সুকুমারের ফোন।

একটু নিরিবিলিতে বেরিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বলে উঠল,হঠাৎ কী মনে করে?

ও প্রান্তে সুকুমার জবাব দিল,আমি ইস্কুল গেটের পাশেয় দাঁড়িয়ে আছি।পিছন ঘুরলেই দেখতে পাবেন।থাক ঘোরার দরকার নেই।

যা বলছিলাম,আপনার ছুটি হলে একবার দেখা করুন।একটা জিনিস আপনাকে দেখাতে চাই।

মৌমিতা সংক্ষেপে উত্তর দিল,ঠিক আছে।কমন রুমে ঢোকার আগে আড়চোখে পিছনের দিকে একবার তাকিয়েই ফেলল।সত্যি,সত্যিই সুকুমার দাঁড়িয়ে রয়েছে।সেই প্রথম মৌমিতার বুকে একটা ছলাৎ করে শব্দ উঠেছিল।সেটা কীসের ঢেউ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

     বাকি স্টাফদের নজর এড়িয়ে সেদিন মৌমিতা সুকুমারের পাশে হেঁটে গেছিল সামনেই বিশাল একটা দিঘীর পাড়ে।

সম্ভবত ওটা অশ্বত্থ গাছের ঘন ছায়া ছিল।তখন সবে এক ঝাঁক নতুন পাতা,সবুজ হয়ে এসেছে।সামনে টলমল দিঘী।সেখান থেকে ঠান্ডা কখনো গরম বাতাসের ঝাপটা আসছিল। অনুভূতির সেই সুখস্পর্শ তাদের দুজনকে আপন ডোরে বেঁধে ফেলতে চাইছিল।

সুকুমার অবাক ভাবে মৌমিতার দুচোখের দিকে চেয়ে ওর একটা হাত ধরে বলে উঠল,আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি মৌ।আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলেছি।আসলে পুরনো জমিদার বংশের রক্ত তো!...তাই লোভটা আজো রক্তে মিশে রয়েছে।তবে আমার দিকটাও ভেবেছে।

তাই বাবা আর কোন রকম আপত্তি করবে না।তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ নই মৌ।এটা আমি তোমাকে প্রথম দেখার দিন থেকেই টের পেয়েছি।শুধু হৃদয়ের কপাট খুলে সেই ভালবাসাটুকু তোমায় দেখাতে পারিনি।আজ আমি সেই ভালোবাসাটা তোমাকে দেখানোর জন্যই ডেকেছি।

তাকাও...তাকাও...আমার দুটো চোখের দিকে।বলো তুমি কী দেখতে পাচ্ছো মৌ?..তুমি তো একজন লেখিকা। হাজার,হাজার চরিত্রদের সাথে রোজ কত কথা বলছ! তাহলে আমার দুটি চোখের ভাষা কী তুমি পড়তে পারো না?...বলো...এই দুচোখে কী তুমি অর্থ ক্ষিদে দেখতে পাচ্ছো?...না,সত্যিকার ভালবাসার তৃষ্ণা?

মৌমিতা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি।নিজের চোখজোড়া লুকিয়ে বলে উঠেছিল,কিন্তু আমার শর্তটা তোমাকে তো আগেই জানিয়ে রেখেছি সুকুমার।

---জানি।তুমি বেকার দুশ্চিন্তা করছো মৌ।আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো।কথা দিচ্ছি তোমার লেখায় কোনরকম বিঘ্ন ঘটতে দেব না। তুমি নিশ্চিন্তভাবে তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।শুধু আমি নই, বাড়ির কেউ তোমাকে এ ব্যাপারে কোনরকম বাধা দেবে না।আমি তোমায় কথা দিলাম।এবার বলো।আর তোমার কীসের অসুবিধা?

সত্যি সত্যিই এর পর আর মৌমিতার মুখে বলার মত কোন প্রশ্ন ছিল না।

শুধু সুকুমারের তৃষ্ণিত দুটি নয়ন পানে অল্পক্ষণ চেয়ে বলে উঠেছিল,ভাল আমিও তোমায় বাসি সুকুমার ।তবে আমি তো মেয়ে।তাই সব সময় নিজের ইচ্ছের উপর জয়লাভ করতে পারি না। অনেক চাওয়া,পাওয়াকে বুকের মাঝেয় চেপে রাখতে হয়।না হলে ফোনটা আমিই আগে তোমাকে করতাম।

  তারপর সেদিন তারা উঠে এসেছিল।ক্লান্ত পাখিরা গাছের ডালে ফিরে সান্ধ মজলিশ জুড়েছিল।একটা বয়স্ক অন্ধকার গুটি,গুটি পায়ে চারিদিকটাকে ঢেকে আসছিল।

আর তারা পাশাপাশি হাতে,হাত ছুঁয়ে ফিরছিল মনের খুব কাছাকাছি একটা জায়গায় ।


(তিন)


---কে এসেছিল রে মৌ?

---একজন সিনেমা কম্পানির ডাইরেক্টর।

---ও..তাই!...সেদিন কী তোকে ইনিই ফোন করে খবরা,খবর নিচ্ছিলেন?

---একদম ঠিক ধরেছ।

---তা কী বললেন উনি?

----তিরিশ হাজার টাকায় আমার তিনটে গল্পের স্বত্ত্ব কিনতে রাজি হয়েছেন।অগ্রিম দশ হাজার টাকা দিয়ে বায়নাও করে গেলেন।

-----আমি জানতাম।তুই একদিন ঠিক জিতবি।শুধু তোকে বুঝল না তোর মনের মানুষটা রে মা।আমার দুঃখ শুধু ওইখানটাতেই।

মৌমিতা একটু ধমকের সুরেই বলে উঠল,তুমি চুপ করো তো মা।আমার ওসব পুরনো কথা বার, বার শুনতে একদম ভাল লাগে না। জাস্ট বিরক্ত ধরে গেছে।

    ওঘর থেকে তখনি একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।

সাধনাদেবী একটু হেসে বলে উঠলেন,যা গিয়ে সুধা ঢাল নবাবের মুখে,না হলে আবার ওর মেজাজ ঘুরবে না।

ঘুম ভেঙে গেছে বোধ হয়।

মৌমিতা দৌঁড়ে গেল।

গিয়েই তিন বছরের সাহেবর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,এই তো বাবা আমি।এসো সোনা।দুদু খাবে বাবা?

সাহেব কান্না থামিয়ে ওর মায়ের কোলে টুক করে উঠে এল।

মৌমিতা বুকের কাপড় সরিয়ে ছেলের হাঁ করা মুখটায় একটা স্তন ভরে দিল।

তার মাতৃ হৃদয় নেচে উঠল। সাহেবের গায়ে কয়েককটা আদুরে হামি দিয়ে সামান্য আনমোনা হয়ে পড়ল। এই সংসারে ছোট্ট সাহেব ছাড়া তার আর আপন বলতে আছেই বা কে?

তারজন্য সে অনেক যুদ্ধ করেছে।

সেদিনগুলোর কথা মনে করলে আজো বুকটা মুচড়ে ওঠে।

এক সময় চেনা,জানা মানুষগুলোও কেমন নিমেষে চেহারা পাল্টে ফেলে!!

মনে হয় সকলেই মুখোশ পরে ঘুরছে!

আসল চেহারা যে কোনটা কার সেটাই ঠিকমত বোঝা যায় না।

না হলে সুকুমারের মত একজন স্বামীরূপী প্রেমিকও এভাবে পাল্টে যায়?

তাকে চরম দুর্দিনে একা ফেলে স্বার্থপরের মত পালায়?


(চার)


বিয়ের ব্যস্ততার জন্য তিনটে দিন মৌমিতা তার রিডারদের কাছে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়েছিল।

অনেকেই কারণটা ইনবক্সে ম্যাসেজ করে জানতে চেয়ে ছিলেন।মৌমিতা কাউকে কিচ্ছুটি জানাইনি।এমন কী ক্লোজ ফ্রেন্ডদেরও অনুরোধ করেছিল।এসব ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে রিডারদেরকে যাতে জানানো না হয়।

বিয়ের একটা ছবিও মৌমিতা তার ফেসবুকে শেয়ার করেনি।

সে খুব ভাল করেই জানত।ফেসবুকের সঙ্গে তার ঠিক কী বোঝা পড়া হয়ে আছে?

সে শুধুমাত্র তার লেখাকে পাঠক, পাঠিকার মন পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্যই ফেবুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।এর সঙ্গে সে কিছুতেই নিজের ব্যক্তিগত মুহূর্তকে সামিল করতে চায় না।

তাই ঠিক তিনদিন পর আবার সে তার লেখনীর ফুল নিয়ে সকলের মন সাজাতে

বসে গেল।

নতুন ঘর,নতুন মানুষ,সর্বোপরি মনের মানুষের একান্ত সান্নিধ্য লাভের ফলে তার মনে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল।সেই অনুভূতিকে সম্বল করেই একখানা নতুন,ভিন্ন স্বাদের চিত্তাকর্ষক গল্প লিখে সেদিন পোষ্ট করেছিল। তাও মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে।

সেই গল্পটাই সম্ভবত তার সেদিন পর্যন্ত সর্ব বৃহত লাইক পেয়েছিল।প্রায় উনিশ হাজার।

মনের খুশির সাথে তার স্বপ্নের আনন্দ সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। পরম সোহাগে দুই বাহুবেষ্টনে জড়িয়ে ধরেছিল সুকুমারের লোমস বুকটাকে।ঠোঁটের উপর ঠোঁট কথা বলেছিল....রক্তের সাথে রক্ত লুকোচুরি খেলেছিল আর শরীরের সাথে শরীর মিশে গিয়ে আহ্বান জানিয়ে ছিল নতুন এক সৃষ্টিকে।

      একমাস পরেই প্রকাশকবাবু মৌমিতাকে ফোন করে তার পাবলিশিং হাউসে ডেকে পাঠালেন।সংকলনের প্রুফটা দেখে নেওয়ার জন্য।

তার শ্বশুরমশাই পরিস্কার মানা করলেন।নতুন বউকে একা,একা বাড়ির বাইরে কিছুতেই যেতে দেবেন না। তার একটা মান,সম্মান আছে সোসায়টিতে।যে কোন সময় ধিঙ্গি মেয়ের মত বাইরে পা বাড়ানো একদম চলবে না।

মৌমিতার নিজেকে অসহায় মনে হল।তার সাথে মনটাও খানিক বিদ্রোহ করে উঠল।

---আমি ক্লাবে পার্টি করতে যাচ্ছি না।যে আপনার সম্মান খোয়া যাবে!...আমি নিজের কাজেই যাচ্ছি।এবং সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।তাই আপনি মানা করলেও আমি মানতে পারছি না।

       তারপরেই মৌমিতা ভ্যানিটিটা কাঁধে ঝুলিয়ে পাতলা হিলের শব্দ তুলে দরজা টেনে বেরিয়ে পড়েছিল।

সন্ধের আগেই ফিরে এসেছিল।তাকে সেই সময় কেউ কিছু বলেননি।

মৌমিতা বাথরুমে ফ্রেস হয়ে কিচেনে ঢুকে অল্প মত উপমা বানিয়ে খেয়ে নিল।

ততক্ষণে সুকুমার অফিস থেকে ফিরে এসেছে।

সেই মুখের দিকে একবার তাকিয়েই মৌমিতা বুঝে নিয়েছিল, ব্যাপারটা নিয়ে ভালরকম কাটাচেঁড়া হয়েছে।

সেও বুকটাকে শক্ত করে নিল। সে এ বাড়ির বউ।বেতনভুক কোন বাঁদি নয়।তারও একটা নিজস্বতা আছে।

তার বুকেও একটা হৃৎপিন্ড সব সময় আওয়াজ করে।তার চোখেও কিছু স্বপ্ন আছে।বিয়ে করলেই যে সবকিছুর ইতি ঘটাতে হবে,সে মানবে না।কিছুতেই না।

     সন্ধের সময় তার শাশুড়ীমা তাকে নিচের ঘরে ডেকে পাঠালেন।

মৌমিতা গিয়ে দেখে সেখানে আগে থাকতেই সুকুমার তার বাবার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে।

তাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হল।আর কেও বসতেও বলেনি।

সুকুমার একটু ধমকের সুরেই মৌমিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,একি মৌ!...এ আমি কী শুনছি কী?...তুমি নাকি বাবার মতামতকে অগ্রাহ্য করে নিজের ইচ্ছে মত বাইরে ঘোরাফেরা করছো?...তুমি না একজন লেখিকা।হাজার,হাজার মানুষকে ভাল হওয়ার উপদেশ দাও।আজ তুমি নিজেই সংস্কার ভুলে যাচ্ছো?

মৌমিতা দাঁতে,দাঁত চেপে বলে উঠেছিল,আমি তো কোন অন্যায় করিনি।সংস্কারের নামে আমি শাস্তিটা মানতে পারব না।আমি লিখি ঠিক কথা।তা বলে আমি কোন ভগবান না। আর পাঁচটা মানুষের মত আমিও একজন মানুষ ।ইচ্ছে,অনিচ্ছে বলে আমারো একটা জিনিস আছে।

আর আমি তোমাকে এ ব্যাপারে বিয়ের আগেই কথা বলেছিলাম।তুমি কিন্তু কথা রাখবে বলেছিলে।তারপরেও বাঁধা দেওয়া কেন?

-----তুমি ভুল করছো মৌ।এসব তোমার একদম করা উচিত হয়নি।এরপর এরকম ভুল আর করো না।তোমার ইচ্ছে, অনিচ্ছে আমাকে বলো।আমি বাবাকে বোঝাব।...আর কখনো নিজের গুরুজনদের মুখের উপর উল্টো জবাব দিতে যেও না। না হলে ফলটা খারাপই হবে।ক্ষমা চেয়ে নাও বাবার পা ধরে।

মৌমিতার হাত,পা রাগে কাঁপছিল।সারা শরীরজুড়ে বিদ্রোহের একটা আগুন দাউ,দাউ করে জ্বলছিল।তবু নিজের বিবেকটাকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রাখল।চোখের জলটাকে কন্ঠেই আটকে রেখে সেদিন শ্বশুরমশাই -এর পা ছুঁয়ে বলেছিল,আমায় ক্ষমা করবেন।

উত্তরে শ্বশুরমশাই তাচ্ছিল্যের একটা হাসি টেনে বলেছিলেন,পায়ের তলার মাটিটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়।না হলে সেটা যে কোন সময় সরে যায়।দ্বিতীয়বার আমি ক্ষমা করি না। দোষিকে সাজা দিই।যাও এবারের মত তুমি ছাড়া পেয়ে গেলে।

সেদিন সারা রাত মৌমিতা অপমান আর নিজের কাছে হেরে যাওয়ার তীব্র উৎকন্ঠায় চোখের পাতা এক করতে পারেনি।

তার দীঘল দুটো চোখে কখনো নোনা ধারা কখনো বা আগুন ঠিকরে বিরুচ্ছিল।

সুকুমার সান্ত্বনার সুরে একবার শুধু বলেছিল,আরে বাবা...তুমি শুধু, শুধু মন খারাপ করছ মৌ।বাবার সামনে তোমাকে আমি বাধ্য হয়ে ধমক দিয়েছি।শুধুমাত্র বাবার সম্মান রাখার জন্য। আমি তোমায় একি রকম ভালবাসি মৌ।এসো আমার বুকে এসো।শুধু,শুধু দেরি করছ।আমার আর তর সইছে না মৌ। সারাদিন অফিসে কী কম খাটুনিটা যায়!...এসো সোনা একটু রিল্যাক্স হই।বড্ড চাগাড় দিচ্ছে।

  মৌমিতার ইচ্ছে ছিল না। তবু চোয়াল শক্ত করে সুকুমারের অবাধ্য পৌরুষের জ্বালা সেদিন সহ্য করে ছিল।

তারপর একটা পরম তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সুকুমার শরীরটা ঢিলে করে শুয়ে পড়েছিল।

জেগে ছিল শুধু মৌমিতা ।

সে আজ অনেক বড় একটা বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করল।তাই সে মনে,মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল।তাকে যেমন করেই হোক জিততেই হবে।


(পাঁচ)


মৌমিতার খুব বেশি সাজতে ইচ্ছে হয় না। তবু আজ নিজেকে অনেকদিন পর একটু গোছাল।আসলে নারীর বোধ হয় সবথেকে বড় শৃঙ্গার হল আত্মতৃপ্তি।

আজ সেই জিনিসটা মৌমিতার ভেতরে জেগে উঠেছে বলেই অল্প সাজেও অপরূপা লাগছে।

গায়ের রঙটা পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছে।দুধে,আলতা মেশানো।এক মাথা ঘন,কালো চুল।সাজানো দাঁত,বাঁশপাতার মত ঠোঁট আর মাঝারী স্বাস্থ।

এখন মাঝে,মাঝে রোদ চশ্মা পরতে হয়।তাতে ওর ব্যক্তিত্ব আরো উজ্বলভাবে প্রকাশ পায়।

হাতে একগাছি সোনার চুড়ি আর গলায় পাতলা একটা হার।পায়ে নুপূরখানা সোনার জল ধরানো।আজ একটু মেকাপ করেই বেরিয়ে ছিল।

তাই তার প্রতি আজ পুরুষের একটু বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে।

সেটা মৌমিতা নিজেও টের পাচ্ছে।বার,বার কেবিন থেকে ছেলেগুলোর চোখ ওঠা দেখে।

   মিনিট দশেক পরেই মি. ভৌমিক এসে উপস্থিত হলেন।এসেই প্রথমে মৌমিতার দিকে জোড়হাত করে বলে উঠলেন,সরি ম্যাডাম ।আপনার অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেললাম।আসুন...আসুন..ভেতরে আসুন।

তারপরেই বেয়ারার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,এই ঝন্টু যা তো গিয়ে ম্যাডামের জন্য স্পেশাল একটা আদা চা নিয়ে আয়।

  বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল এর ভেতরে এত সুন্দর একটা আরামদায়ক এবং সুসজ্জিত কক্ষ আছে।

মৌমিতা এক ঝলক তাকিয়েই বলে উঠল,খুব গোছানো অফিস!

মি. ভৌমিক দরাজভাবে হেসে বলে উঠলেন,আপনার যেমন মানুষের মন সাজাতে ভাল লাগে আমার তেমনি ঘর বা অফিস দুটোই।

বাড়িটাও এরকম।সে যাই হোক।একটা খুশির খবর হল।আপনার গল্পের উপর আমরা কাজ অলরেডি শুরু করে দিয়েছি।ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ফার্স্ট শো করব।অনেক প্রত্যাশা রয়েছে আপনাকে ঘিরে।আফটার অল সাথ দেবেন কিন্তু ।

মৌমিতা একটু লজ্জা পেল।

---কী বলছেন স্যার।আপনিই বরং আমার প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে তুলছেন।আমি তো কোনদিনও ভাবিনি,আমার এইসব গল্পগুলো কোনদিন পর্দায় সচলভাবে ফিরে আসবে।সব আপনার কৃতিত্ব।

মি. ভৌমিক চায়ের ভাড় এগিয়ে বলে উঠলেন,সেটা সময় এলেই বুঝতে পারবেন।

এমন সময় পঞ্চাশোর্দ্ধ রঙিন পা জামা,পাঞ্জাবি পরা একজন ধোপ দুরস্ত,গোলগাট্টা চেহারার মানুষ কক্ষের ভেতর নমস্কার করে ঢুকলেন।

সঙ্গে, সঙ্গে মি. ভৌমিক চেয়ার ছেড়ে ওঠে ভদ্রলোকের পা ছোঁয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,আসুন..আসুন মি. ধানুকা সাব।আমার আজ কী ভাগ্য!...আপনার মতো পরিচালকের পায়ের ধুলো পড়ল আমার মত গরীব পরিচালকের উঠোনে!!

মি. ধানুকা দাঁত না দেখিয়ে ঠোঁটটা চওড়া করে অল্প হেসে জবাব দিলেন,বসো..সুখেন..বসো।তুমি যে নিজেকে গরীব মনে করো...এটা তোমার বিনয়ী।আমরা একই পেশার মানুষ।তাই সবরকম খবর পাই।

পরক্ষণেই ভদ্রলোক চোখজোড়া মৌমিতার দিকে ঘুরিয়ে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন।

মি. ভৌমিক বুঝতে পেরে বলে উঠলেন,একজন উচ্চমানের লেখিকা।উনার গল্প থেকেই আমি আমার আগামী কাজটা করছি।

কলমের ধার আছে মানতে হবে। স্ক্রীপ্টটা তৈরি করতে খুব বেশি ঘাম ঝরাতে হয়নি।

মি.ধানুকা মৌমিতার সাথে নমস্কার বিনিময় করে বলে উঠলেন,আপনার চেহারা দেখে কোনমতেও লেখিকা বলে মনে হচ্ছে না।আপনার বোধ হয় কোথাও একটু ভুল হচ্ছে।নিজেকে পরখ করার ব্যাপারে।

আমি আপনার ভেতরে অন্য একটা প্রতিভার অঙ্কুর পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি।নিজের কোয়ালিটিকে কাগজে,কলমে শেষ করে দেবেন না।

এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড।যোগাযোগ করবেন।যদি নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করার ইচ্ছে থাকে।

তারপর মি. ভৌমিকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,শোন সুখেন...তুমি প্রযোজক খুঁজছিলে না?...চিন্তা নেই। আমি আছি।তুমি কাজ শুরু করো।ক কোটি লাগবে পরে জানিও।আজ আমার একটু তাড়া আছে।উঠি।এই খবরটুকুই দিতে এসেছিলাম।ফোনে এসব ভরসার কথা ঠিক মানায় না। কাউকে সত্যিকার সাহায্য করতে চাইলে মুখোমুখি দেখা করাটাই আমি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করি।

নমস্কার ।চলি।

আবার একবার মৌমিতার দিকে ঘুরে বলে উঠলেন,মনে করে যোগাযোগটা করবেন।

   মি. ধানুকা বেরিয়ে যেতেই সুখেন একবার ওঠে গিয়ে বাইরেটা দেখে নিয়ে পুনরায় চেয়ারে বসে পড়লেন।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৌমিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আপনি ভুল করেও ধানুকা সাবের ফাঁদে পা দেবেন না ম্যাডাম।আমরা এই জগতে অনেকদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছি।তাই কে কেমন ধরণের মানুষ,খুব ভাল করেই জানা হয়ে গেছে।

দরকার পড়লে সাহায্য চাই।উনি ব্যবসাটা আমাদের থেকে ভাল বোঝেন তাই।তাছাড়া ওনার মানি পাওয়ারের একটা জোর আছে। তাই সকলেই শ্রদ্ধা করেন।মেনে চলেন।আসলে কেউ মানুষটাকে ভেতর থেকে শ্রদ্ধা করেন না।আমিও না। আপনি যেমন লিখছেন...লিখতে থাকুন।এর আগে একদম পা বাড়াতে যাবেন না। অবশ্য কথাটা সত্যি যে আপনি খুবই সুন্দরী।আজ পর্যন্ত এত সুন্দরী লেখিকা বোধ হয় বাংলার মানুষ পাননি।তাই আপনার লেখাতেও সেটা ঝরে পড়ে।হয়ত গ্ল্যামার জগতে পা রাখলে সফলতা পাবেন।তবে অনেক কিছু হয়তো হারিয়েও যেতে পারে।

সেরকম যদি ইচ্ছে আপনার হয়।আপনি আমাকে একটা ফোন করবেন।আমি আপনাকে তৈরি করব।নিজের হাতে।আপনার সম্মানের গায়ে কোনরকম আচও লাগতে দেব না।

মৌমিতা লজ্জা পেয়ে বলে উঠল,একি বলছেন মি.ভৌমিক!...আমি আর গ্ল্যামার!...কার সাথে কাকে তুলনা করছেন?আমি তো অভিনয়ের অ টাও কোনদিন শিখিনি।তাছাড়া ও রকম বেহায়া ইচ্ছে আমার মনে কোনদিন জাগেওনি।আশা করি আর জাগবেও না।

----সেটাই ভাল।...এবার কাজের কথায় ফিরে আসি।এই নিন আপনার বাকি প্যামেন্ট।আর যোগাযোগ রাখুন।অধমকে ভুলে যাবেন না। দরকার পড়লে আবার হয়তো যেতে হবে আপনার দরজায়।ধন্যবাদ।

    মৌমিতা পার্ক স্ট্রীট্রের প্রোডাকশন হাউস থেকে বেরিয়েই হাওড়ার জন্য বাস পেয়ে গেল।

জীবনদীপের কাছে এসে বাসটা জ্যামে আটকে গেল।বাসটা ধার ঘেষে দাঁড়িয়েছে।তাই জানলার ফাঁকে মৌমিতা ব্যস্ত কোলকাতাকে দেখতে লাগল।তখনি একটা চেনা জামা হঠাৎ করে তার নজরে চলে এল।সে এটা বিগ বাজার থেকে সুকুমারের জন্য পছন্দ করে এনেছিল।এখন সে হাসি মুখে একটি মেয়ের সাথে স্টলে চা,সিগারেট খেতে,খেতে গল্প করছে।ভালই আছে হয়ত!...থাকারই কথা।তবে কী তার হিংসে হচ্ছে?...সুকুমারকে হাসিখুশি দেখে?...মৌমিতা যতই তার মনকে না না করে বোঝাক না কেন...মনকে নিজের দাসে পরিণত করবে, এমন মানুষ পৃথিবীতে নগন্য।আর সে তো একজন সামান্য মেয়েমানুষ!

মানতে না চাইলেও,এটা সত্যি ।যে মৌমিতা আজো সুকুমারকে ভালবাসে।

ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে শত আঘাত পাওয়ার পরও মনটা মাঝে,মাঝে সেই আঘাতকারী মানুষটার কাছেই ফিরে যায়।

মৌমিতা ভাবল,নতুন একখানা জুটিয়েছে বোধ হয়।শরীরের যা চাহিদা,তাতে ওর দ্বারা এতদিন উপোশ করা মোটেও সহজ কাজ নয়।যেই হোক না,তাতে তার কী আসে যায়?সে যখন তার কথা ভাবেনি তখন সেই কেন ওর ব্যাপারে এত শত ভাবতে বসেছে?একটা ছেড়ে...হাজারটা নিয়ে খেলুক না।তাতে সে কেন মাথা ঘামাবে?

তবু একবার সন্তর্পনে কালো কাঁচের আড়ালে মেয়েটির চেহারাটা ভাল করে দেখে নিল।

তার মত ওর চোখের আকৃতি এক্কেবারে নয়।সুকুমার তার এই চোখ জোড়ার গভীরে কতবার ডুব দিয়ে স্বপ্নের মণি,মুক্তো তুলে এনেছে।ঘাড়টা এই সরু। একদম বকের মত!এ সকল মেয়েকে সুকুমার কেন যে পাত্তা দেয় ভেবে পায় না। যাক গে,মরুক গে।

  ততক্ষণে বাসটাও ছেড়ে দিল।মৌমিতা আবার সিটে বসে,বসে অতীতের দিনে ফিরে গেল।


(ছয়)


মৌমিতা আর সুকুমারের মধ্যে ক্রমে,ক্রমে একটা দূরত্ব তৈরি হতে লাগল।

মৌমিতার প্রথম সংকলনটা প্রকাশ পাওয়ার সাথে,সাথেই পাঁচশো কপি ওধাও হয়ে গেছে। দ্বিতীয় সংস্করণে পড়েছে।একটা মোটা অংকের রয়্যালটি সে ইতিমধ্যেই হাতে পেয়ে গেছে।প্রকাশকবাবু দ্বিতীয় সংকলনের জন্য তৈরি হতে বলেছেন।

    এদিকে সুকুমার যেন দিন,দিন স্বার্থপরের মত আচরণ করতে শুরু করল।সে তার দেওয়া কথা থেকে মুখ ফেরাতে লাগল।

এদিকে মৌমিতাও তার লক্ষ্য থেকে এক চুল নড়তে রাজি না। তার দুচোখে অনেক স্বপ্ন।তার কলমকে সে কিছুতেই থামাতে চায় না। মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে তাকে ঘিরে।

প্রকাশকগণও নানাভাবে প্রেরণা দিতে লাগলেন।এরকম সাপোর্ট পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।সে যখন পেয়েছে।তখন হেলায় ফেলতে চায় না।

লেখার মধ্যেয় সে নিজেকে খুঁজে পায়।তাই সে কিছুতেই লেখালেখি বিসর্জণ দিতে পারবে না।

     এদিকে প্রতি রাতে সে একটু দেরি করে বিছানায় যায়।

সে রাতটার কথা মৌমিতার আর একবার মনে পড়ে গেল।

সুকুমারের শরীরে যখন মিলনের খিদে চাগাড় দেয়...তখন ও সবকিছু ভুলে যায়। প্রেমিকের মুখোশ ধরে মিলনের সুখটুকু শুধুমাত্র উপভোগ করে।

   সুকুমার বার কয়েক ডাকার পরও যখন মৌমিতাকে কাছে পেল না।তখন চুপ করে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এদিকে মৌমিতা দু মিনিটের নাম করে উঠল দেড় ঘন্টা পর।মাথার উপর ঘড়িতে তখন বারোটা পাঁচ বাজে।

জীভ কেটে লজ্জিত হয়ে পড়ল।গিয়ে দেখল,সুকুমার বাচ্চা ছেলের মত হাত,পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।মৌমিতা সুকুমারের ঘুমন্ত গালে দুটো চুমু এঁকে একপাশে করে লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়েছিল।

       তারপরের দিন থেকেই সুকুমার আমূল পাল্টে গেল।মৌমিতাকে কোনরকম ধরা,ছোঁয়াই দিত না। এমনকি রাতের সময়ও আর ডাকতো না।সেই চিন্তায় মৌমিতাও আর আগের মত লিখতে পারত না। তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যেত। তবু সুকুমারের আদর পেত না। তার শরীরেও একটা চাহিদা আছে। সেও চাইত,সুকুমারের শক্ত বুকের খাঁচায় নিজেকে গলিয়ে নিতে।এতদিন তাই করে এসেছে।সুকুমারের ভালোবাসার সেও কাঙালিনী।কিন্তু সে কথা সুকুমার শুনতে আর রাজি না।ওদিকে মৌমিতাও সেটা প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছিল না।

         তারপর হঠাৎ একদিন মৌমিতা জানতে পারল সে মা হতে চলেছে।রীতিমত দু মাসের গর্ভবতী ।খবরটা শুনেও সুকুমারের তেমন হেল,দোল হল না। তা দেখে মৌমিতা আরো বেশি অবাক হয়েছিল।নিজেকে সেই সময় বড্ড একা লাগত।তবে যাই হোক হাতে গল্প লেখার জন্য ফোনটা ছিল বলেই সে নিজেকে অনেকখানি ধরে রাখতে পেরেছিল।

বুকের জমা সমস্ত যন্ত্রণাগুলো লেখায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলত।তার সেই দুঃখে চোখের জল ফেলত বাংলার অগনিত পাঠককুল।

     ঠিক পাঁচ মাসের বেলায় একদিন সুকুমার তাকে তার বাবার ঘরে নিয়ে গেল।তার বাবা গম্ভীর গলা করে মৌমিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,তুমি হয়ত এ বাড়ির কিছু নিয়ম,কানুন সম্বন্ধে ঠিক ওয়াকিবহাল নও।তাই ডেকে পাঠালাম।

আসলে আমাদের পরিবারে প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয় তবেই তাকে গ্রহণ করা হয়।নচেৎ মেরে ফেলা হয়।প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ার পর যতগুলো মেয়ে হোক তাতে কোন অসুবিধা নেই।এখন পরীক্ষা করার যন্ত্র হয়েছে বলেই আর জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। তুমি আজকেই সুকুর সাথে ডাক্তারের চেম্বারে যাও।পেটের বাচ্চাটা পরীক্ষা করে এসো।সেই মত ব্যবস্থা নিতে হবে।

নিয়মটা শোনার পর মৌমিতার মাথাটা কিছুক্ষণ ভোঁ করে বেজে উঠেছিল।অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলে উঠেছিল,অসম্ভব ।আমি কিছুতেই পরীক্ষা করাব না। ছেলেই হোক আর মেয়ে।সন্তানটা আমার।তাই ওকে ঠিকমত পৃথিবীতে আনার দায়িত্ব একমাত্র আমারই।

তারপর গলাটাকে কঠিন করে বলেছিল,আমি আপনাদের এই জঘন্য এবং নিষ্ঠুর রীতিকে একদম মানি না।কিছুতেই না। আর জন্মের পর যদি আমার সন্তানকে হত্যা করা হয়।আমি পুলিশের সাহায্য নিতেও দ্বিধা করব না। আপনাদের সকলকে জেলের হাওয়া খাইয়ে ছাড়ব,এই বলে রাখলাম।

উত্তরে তার শ্বশুরমশাই সেদিন বলেছিলেন,আমার কথা অমান্য করলে তোমার জন্য এ বাড়িতে কোন জায়গা নেই।

তারপর জোর গলায় বলে ছিলেন,

সুকু নচ্ছাড়টাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় কর এখ্খুনি।

মৌমিতাও তখন ইস্পাত কন্ঠে বলে উঠেছিল,তার কোন দরকার হবে না মি. অবিনাশ অধিকারী।আমি নিজেই বেরিয়ে যাচ্ছি এই নরকপুরির সাম্রাজ্য ছেড়ে।

অবিনাশবাবু নিজের নামটা নিজের বউমার মুখ থেকে শুনে একেবারে থ হয়ে পড়েছিলেন।মনে হল মেয়েটি তার গালে একটা সপাটে চড় মেরে বেরিয়ে গেল।

মনের ভিতরটা ভুমিকম্পের মত টলমল করে উঠল।এতদিনের শক্ত গরীমার পাহাড়টা যেন কেউ দুহাতে ধরে দুলিয়ে দিয়ে গেল।তাই তিনি সেদিন থেকেই মূহ্যমান হয়ে পড়লেন।

   মৌমিতা ভেবেছিল হয়ত সুকুমার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু না।দিন যায়,রাত কাটে।তবু শ্বশুরবাড়ির কেউ আসে না।

তখন সে সবে ন মাসের।যে কোনদিন তার ব্যথা উঠতে পারে।এমনদিনে তার বাবা হার্ট এ্যটাকে মারা গেলেন।

কী একটা শোকের মধ্য দিয়ে সে গেছিল একমাত্র সে আর তার মা জানেন।

সেই সময় মৌমিতা প্রায় স্বপ্ন দেখত।সুকুমার তাকে দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে।ঘুমের ঘোরে মৌমিতা কতবার সেই হাত ধরতে গিয়ে জেগে উঠেছে।রাতের কালো অন্ধকারে কাউকে পায়নি দেখতে।তখন সে অনেক কাঁদত।

তবু সে ভুলেও কোনদিন শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠে দয়ার ভিক্ষা চাইতে যায়নি।

অর্থের অভাব তেমন ছিল না। তার বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন।তাই অনেকগুলো টাকা বেরিয়েছিল।তার সাথে মায়ের পেনশনটা চালু আছে।

কিন্তু তার সাহেব আজো পিতৃ পরিচয় থেকে বঞ্চিতই থেকে গেল।

আর এক বছর পর তাকে ইস্কুলে ভর্তি করতে হবে।তখন সে কী করবে?

এদিকে সে আজো বিধবা বা যুবতি কোন সাজটাই ঠিক মতো ধরতে পারেনি।আজো সেই মাথায় রোজ স্বামীর নামে এক বিন্দু সিঁদুর ঠেকায়।মাঝে,মাঝে লোকলজ্জার খাতিরে শাখা,পলাটাও হাতে গলাতে হয়।যদিও সিঁদুরটা চুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।তবু শূণ্য রাখার সাহস হয়ে ওঠে না।


(সাত)


রাত বারোটা দশ।লেখালেখি বন্ধ করে মৌমিতা বিছানায় গেল।

দুদিন হল সাহেবের শরীরটা ভাল নেই।সারাদিন ছেলেটা কেশেছে।

তুলসী পাতার রস মধু সহযোগে খাওয়ানোর পরও তেমন উপকার পাওয়া যায়নি।গতকাল সারারাত ধরে ছাড়া,ছাড়া কেশেছে।মৌমিতা লেখা বাদ দিয়ে সাহেবের বুকে তেল মালিশ করেছিল।

সকালেও একবার ভাবল,পেডিয়াট্রিককে দেখিয়ে নিয়ে আসবে।কী ভেবে আর গেল না। ভাবল,রাতটা দেখে নিয়ে সকালে তখন যাবে।

এখন সে ঘুমোচ্ছে।মৌমিতা ওকে ভাল করে শোওয়াতে গিয়ে অল্প অস্বাভাবিকত্ব আন্দাজ করল।

সাহেব ঘুম থেকে উঠছে না। ঘাড়টা লটপট করছে।যেন ওর কোন সেন্স নেই।

মৌমিতার বুকটা জোরে,জোরে বেজে উঠল।একটা আতঙ্কের কালো ছায়া তার মুখটাকে গ্রাস করে ফেলল।অস্থিরভাবে চিৎকার করে উঠল, সাহেব,সাহেব তারসাথে জোরে,জোরে ঝাঁকাতে লাগল।

সাহেবের চোখদুটো কোটরে ঢুকে গেছে।পলক ওল্টানোর সাথে,সাথে চোখদুটোও উল্টে যাচ্ছে।সাহেবকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে মৌমিতা পাগলের মত ঠুকরে উঠল...সাহেব!!

পাশের কামরা থেকে তার মা চেঁচামেচি শুনে দৌঁড়ে এলেন।

সাধনাদেবী মেয়েকে আস্বস্ত করে বলে উঠলেন, কী হল মা!...এমনভাবে কাঁদছিস কেন?

-----দেখো না মা।সাহেব আমার চোখ খুলছে না...মুখ দিয়ে কথাও বেরুচ্ছে না।

সাহেবের হাত,পা সব ভালমত পরীক্ষা করে সাধনাদেবীর বুকটা ধড়াস,ধড়াস করতে লাগল।তিনি খুব ভাল মত জানেন।এই অবস্থায় প্রথমে কী করা দরকার?

তাই মৌমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,তুই একদম ভেঙে পড়িস না মা।সাহেব আমার ঠিক হয়ে যাবে।একদম চিন্তা করিস না। কাঁদিস না মা,আমি দেখছি কী করা যায়।

তারপরেই সাধনাদেবী ওঠে এসে ক্লাবের শৈলেনকে ফোনটা লাগালেন।

ও প্রান্তে শৈলেন এখনো জেগে ক্রিকেট খেলা দেখছে।

----হ্যাঁ বলুন মাসিমা।

---একবার তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়িতে এসো তো বাবা।সাহেবের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়েছে।মনে হচ্ছে এখ্খুনি নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে হবে।

---আপনি একদম ঘাবড়াবেন না মাসিমা।আমি আসছি।

     সবকিছু ব্যবস্থা করে ওরা যখন সাহেবকে নার্সিং হোমে ভর্তি করল।তখন রাত একটা।

একজন ডাক্তার ডিউটে আওয়ারে ছিলেন।তিনি সাহেবকে পরীক্ষা করেই অক্সিজেন দিতে শুরু করলেন।

দুজন নার্সকে সবকিছু বুঝিয়ে বেরিয়ে এলেন।

সাধনাদেবী এবং মৌমিতা দুজনেই ডাক্তারের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল,বাঁচান..বাঁচান ডাক্তারবাবু ।

ডাক্তারবাবু ওদের উঠিয়ে একটু হেসে জবাব দিলেন, আপনারা অযথা ভয় পাচ্ছেন।সময় মত নিয়ে এসেছেন...এটাই অনেক।এভাবে আরো কয়েক ঘন্টা থেকে গেলে বিপদ বেড়ে যেত।সেক্ষেত্রে বাচ্চার নার্ভ সিস্টেম ডাউন হওয়ার ভয় থাকত।অ্যাবনরম্যাল হয়ে যাওয়ার চান্স থাকে বেশি।আপনাদের বাচ্চাটির সে রকম কিছু হওয়ার ভয় নেয়।বুকে কফ বসে আছে। মনে হয় দু,তিন ধরে খুব কেশেছে?

মৌমিতা চোখের জল মুছে ঘাড় নাড়ল।

----আমি জানতাম।তাই ফুসফুসে ঠিকমত অক্সিজেন যায়নি।সেইজন্যই এই অবস্থা।ওর অস্থামার একটা ক্ষীন টেনডেন্সি আছে।রক্তের নমুনা নিলে সেটা অনেকখানি বোঝা যাবে।কিসে ওর এলার্জি বেশি ।সেই মত সাবধানে রাখবেন।আপনারা এবার একটু শান্তভাবে অপেক্ষা করুন।ঘন্টা দুয়েক যাক।তারপর বাচ্চা ঠিক চাঙ্গা হয়ে উঠবে।আমি নার্স দুজনকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি।কিচ্ছু অসুবিধা হবে না।

আমার ডিউটি আওয়ার শেষ।তাই বেরিয়ে গেলাম।একটু বাদে অন্য একজন ডাক্তারবাবু আসছেন।উনি রিপোর্ট বুঝে বাকিটুকু সারিয়ে তুলবেন।আপনারা চিন্তা না করে এবার বসে পড়ুন।

             দুটোদিন যেন ঝড়ের মত গেল।সেই ঝড়ে অনেক কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। সবথেকে আগে মৌমিতার চেহারাটা।দুদিনের মধ্যেই যেন একটা বয়েসের ছাপ ফুটে উঠেছে কপালের বলিরেখায়।

চোখের নিচে কালির দাগ।ঘুম,খাওয়া কোনটাই ঠিকমত হয়নি।তবু সে তার লেখনিকে থামায়নি।

পাঠকদের কেউ জানেন না এখন তাদের প্রিয় লেখিকা কী রকম একটা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে যাচ্ছেন?

মৌমিতা এসব কথা শেয়ার করতে পছন্দ করে না।

নার্সিংহোমে সাহেবের মাথাটা কোলের উপর রেখে এক মনে লিখে গেছে সম্পর্কের ভাঙা,গড়ার খেলা।

  মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হল এই কদিনে।তার মা সবটাই জোগান দিয়েছেন।ওর হাতেও কয়েক হাজার ছিল।ওর মা নিতে চাননি।

বাড়ি আসার পর মৌমিতা চিন্তা করতে বসল।এভাবে আর চালানোটা ঠিক হবে না। তাকে পুরনো পেশায় ফিরে যেতে হবে।আগের ইস্কুলে গিয়ে একবার খোঁজ করে দেখবে।হলে ভাল।না হলে অন্য কোন ইস্কুলে তাকে জয়েন করতেই হবে।এতদিন সাহেব ছোট ছিল।

তাই তাকে একা রেখে যেতে মন চাইছিল না। আর গল্প লিখে কী এমন আয় হবে?

আজকাল সংসারে কী কম খরচ?

এত টাকা আসবে কোত্থেকে?...তারপর আবার বিপদ,আপদ আছে। এই যেমন একটা গেল।এখন কোন রকমে না হয় চলে যাচ্ছে।তার মা পেনশন পাচ্ছেন,তাই।যদি দুর্ভাগ্যবশত তার মায়ের কিছু হয়ে যায়...তখন?

চিন্তা করেই তার মাথাটা দুবার বন বন করে ঘুরে গেল।সাহেবের মুখটার দিকে তাকিয়ে সে উঠে পড়ল।

আজকেই কর্মখালি দেখে দু,এক জায়গায় বায়োডাটা জমা দিয়ে আসবে।

        ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোনটা বেজে উঠল।

ওপ্রান্তে মি.ভৌমিক ।

----গুড মর্নিং ম্যাডাম ।চিনতে পেরেছেন তো?...না আর একবার পরিচয় দেব?

মৌমিতা গলাটা ঠিক করে বলে উঠল,এত তাড়াতাড়ি ভাল মানুষগুলোকে ভোলার বদ অভ্যেস আমার নেই স্যার। বলুন কী বলছিলেন?

-----আপনার জন্য দারুণ একটা সুযোগ আছে। রাজি হয়ে দেখতে পারেন।

----আগে তো শুনি ব্যাপারটা।

-----একটা ইস্কুল সিলেবাসের নামী প্রকাশনী সংস্থা আমাকে তাদের বিজ্ঞাপন তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছেন।তারজন্য একজন সুন্দরী হাউস ওয়াইফকে আমরা খুঁজছি।স্ক্রীপ্ট সব রেডি।শুধু স্যুটিং-এর অপেক্ষা।..হঠাৎ আপনার মুখটা ভেসে এল।মাত্র আঠান্ন সেকেন্ডের পোর্টাল।দুটো লাইন হাসি মুখে আওড়ে দিলেই একটা মোটা অংকের ফীজ পেতে পারেন।

বলুন রাজি আছেন?

মৌমিতা আমতা করে বলে উঠল,কিন্তু আমি তো কখনো ওসব....

মি. ভৌমিক ওকে মাঝ পথে থামিয়ে আবার বলে উঠলেন,এত কিন্তুর কিছু নেই ম্যাডাম ।এটা কোন অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন নই।সেটা হলে আপনাকে কখনোই বিরক্ত করতাম না। আপনি শুধু হ্যাঁ করুন।বাকিটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন।

মৌমিতার মনটা অল্প খুশিই হল।এই সময় খানিকটা হলেও টাকার গন্ধ পেয়ে।

এই মুহূর্ত সেটা তার খুব জরুরীও বটে।তাই দ্বিধা ঝেড়ে বলে উঠল,কখন আসতে হবে?

----আগামীকাল সকাল নটার মধ্যেয়। আমাদের অফিসে।দুপুরে খেয়ে,দেয়ে বেরিয়ে যাবেন।আমরা আছি।একদম চিন্তা করবেন না।


(আট)


বই-এর পর পেন তারপর একটা প্রথম শাড়ির বিজ্ঞাপনে দেখা গেল মৌমিতাকে।এখন সে নিজেকে আগের মত অবহেলা করে না।

শরীরের যত্ন নেয়। নিয়মিত বিউটি পার্লারে যায়।ত্বকের পরিচর্যা করে।নিজের ঢলঢলে ব্যক্তিত্বটাকে মেরে এখন ধারালো ফলার মত একটা শৌষ্ঠব দেহের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছে।

টলিউডের অনেক নামি,দামী মানুষের সাথে মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ হয়। প্রতিদিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।তাই ফীজও বেশি হাঁকাচ্ছে।তার ইচ্ছে আছে,এবার বালি থেকে উঠে খাস কোলকাতার বুকে একটা ফ্ল্যাট কেনা।

সাহেবকে এক্সারভিসে ভর্তি করা।আর নিজেকে কাজের মধ্যে সবসময় ডুবিয়ে রাখা।

    এখন আর গল্প লেখার সময় মৌমিতা পায় না। আর ওসব ছাই,পাস লিখতেও চায় না।নাম,ডাক,প্রতিপত্তি তার এদিক দিয়ে বেশি আসছে।এবং তাড়াতাড়ি।তাহলে শুধু,শুধু নিজের সময় ব্যয় করে লাভ কী?

     এখন মাঝে,মাঝে নিজের"মেঘ বৃষ্টি আলো"র ব্লগটা খুলে ইনবক্স চেক করে।গল্প পাচ্ছেন না বলে অনেকেই রাগ দেখিয়েছেন।কেউ,কেউ শুভ কামনা জানিয়েছেন।তাকে টিভির পর্দায় দেখতে পেয়ে। অনেকেই তার এই সাফল্যে ভীষণ খুশি।

দু,একজন ঈর্ষাও প্রকাশ করেছেন।সে নাকি ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে।

মৌমিতার হাসি পেয়ে যায়।

ফ্রীতে মনোরঞ্জন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে,বাবুদের এত রাগ!!

সে একবার মনে মনে ভাবল।ব্লগটাই উড়িয়ে দেবে ।

চেপে গেল।থাক।অবসরে সময় কাটানো যাবে।

প্রকাশকদেরকে মৌমিতা নিজেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।এখন সে আর গল্প লিখছে না। অন্য কাজে ব্যস্ত আছে।

সাধনাদেবী বরং এখন মাঝে,মাঝে পেন,খাতা নিয়ে বসে পড়েন।

একটা সময় ছিল।তিনিও লিখতে ভালবাসতেন।কাজের চাপে এতদিন সব ভুলে বসেছিলেন।

মৌমিতা সেই দেখে তার মাকে বলে ওঠে,বাঃ...খুব ভালই তো লিখছ দেখছি ।লেখো...লেখো।পুজো সংখ্যায় পাঠিয়ে দিও।ওসব লেখালেখি তোমাদেরই মানাই।মোবাইলটাও ঠিকমত চালাতে শিখলে না।না হলে আমার ব্লগটা তোমার দায়িত্বে ছেড়ে দিতাম।

তার মা ঠোঁট উল্টে অভিমানী সুরে বলে উঠলেন,তোর শেখাবার ইচ্ছে কত!...সেভাবে দেখিয়ে দিলে খুব পারব।তুই কেমন নিজেকে পাল্টে ফেলেছিস!...তাহলে আমি তোর মা হয়ে এইটুকু নিজেকে বদলাতে পারব না?

খুব পারব স্মার্টফোন চালাতে।

দুদিন পর শিখেও নিলেন।এখন মাঝে,মাঝে দু,একটা অনুগল্প পোষ্ট করেন।তাতে কার কীরকম প্রতিক্রিয়া,মৌমিতার দেখার সময় নেই।

      মিঃ ধানুকার সঙ্গে ইন্দ্রপুরি স্টুডিওতে মৌমিতার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল।

মৌমিতাই প্রথম হাতটা বাড়িয়ে বলে উঠল,কনগ্র্যাচুলেশন স্যার।আয়্যাম মৌমিতা সরকার।

মিঃ ধানুকা হ্যান্ডশেক করে চোখ থেকে রঙিন চশ্মাটা খুলে সামনের মহিলাটিকে আপাদ মস্তক দেখে নিয়ে বলে উঠলেন,কোথাও যেন দেখেছি।ঠিক করতে পারছি না।

মৌমিতা এক মুখ হাসি ছড়িয়ে বলে উঠল,রাইটার মৌমিতা সরকার।মিঃ সুখেন ভৌমিকের অফিসে ।

ধানুকা স্যার উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন,ইয়েশ..ইয়েশ।মনে পড়েছে।এতদিন পর মনে হচ্ছে, নিজেকে ঠিকমত পরখ করতে পেরেছেন।

...এই গ্ল্যামার!সব তোমার বই-এর তলে এতদিন চাপা পড়ে ছিল।খুব ভাল লাগল দেখে।তা কী করছেন আজকাল?

আমার সাথে কাজ করার ইচ্ছে আছে নাকি?

মৌমিতা হেসে জবাব দিল,ফিল্মে কাজ এখনো অব্দি করিনি।এই ছোটখাটো বিজ্ঞাপন নিয়েই পড়ে আছি।অ্যাক্টিং ক্লাসে এডমিশন নিয়েছি।তাছাড়া সপ্তাহে একদিন নাচটাও শিখছি।আশা করি মাস কয়েকের মধ্যেই নিজেকে বড় পর্দার উপযোগী করে তুলব।

-----আরে মৌ সেসব তো আছেই।তুমি আমার মেয়ে বয়সী, তাই তুমি দিয়ে বলছি কিছু মনে করো না।

-----না...না।একদম না।

-----এখানে দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলাটা ঠিক হবে না। বরং চলো কোন হোটেলে বসে গল্প করা যাক।এসো আমার গাড়িতে।

         রাসবিহারীর কাছে সিগন্যালে গাড়িটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল।

ড্রাইভারের সিটে ধানুকা সাব বসে গল্প জুড়েছেন।পাশের সিটেই মৌমিতা ।ধানুকা স্যার খুব আমুদে স্বভাবের।

হো হো হাসির ফাঁকে মাঝে,মাঝে মুখটা তার দিকে নিয়ে আসছেন।

মৌমিতার ভাল লাগছে না। তবু মানা করতেও সাহস হচ্ছে না।

হয়তো না জেনেই উনি এসব করছেন।ব্যপারটা এত গুরুতর নয়।মৌমিতা সিচুয়েশনটাকে হাল্কা করার জন্য জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিল।

জানলার ফাঁক দিয়ে তাকাতেই সুকুমারের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল।সুকুমার বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হেলমেটটা খুলে রেখেছে।সেও মৌমিতাকে দেখে অল্প চমকে উঠল।এই পরিস্থিতিটা দুজনের কেউ আশা করেনি।

মৌমিতা দ্বিধায় পড়ে গেল।কাঁচটা কী তুলে দেবে?

তখনি মিঃ ধানুকা মুখটা জানলার ফাঁকে গলিয়ে এক গাল পান,মসালার থুতু ফেলে দিলেন।মৌমিতার গায়ের সাথে গা ঘেষে।

মৌমিতা কী করবে খুঁজে পাচ্ছে না। সুকুমার তাকে কী ভাবল কী জানি?...হঠাৎ সুকুমার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলে উঠল,লজ্জা করে না স্কাউন্ড্রাল!...পিকটা কার গায়ে লাগল দেখার কোন প্রয়োজনও মনে করলে না?...দোষ করলে সরি বলতে হয় সেই ভদ্রতাটুকুও শেখোনি মনে হচ্ছে?কথাটা মৌমিতার দুকানে বড্ড জ্বালা ধরাল।সুকুমার কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলল নাতো?

 ততক্ষণে গ্রীন সিগন্যাগ জ্বলে উঠেছে।

মিঃ ধানুকা মৌমিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,ওটা আমি ইচ্ছে করেই করলাম।কেন জানো মৌ?কারণ ও তোমার দিকে খারাপ চোখে চাইছিল।সহ্য হল না। তাই জবাবটা দিলাম।

ছোকরা এমন তাকাচ্ছিল...যেন তুমি ওর বিয়ে করা বউ!

...হ্যাঁ ভাল কথা।মনে পড়ল।আর ইউ ম্যারেড?

মৌমিতা এক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিল,ডিভোর্স হয়ে গেছে।

----ভেরি গুড।এটা তোমার প্রফেশন্যালের জন্য অত্যন্ত পজেটিভ।বাড়িতে হাজব্যান্ড থাকলে কাজে ফ্রিডম পেতে না।


(নয়)


মৌমিতা আজ আর একবার ধানুকা স্যারের সাথে দেখা করে এসেছে। আগামীকাল তাকে ফ্ল্যাইটে করে মুম্বই যেতে হবে।একটা হিন্দি সিরিয়ালে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।

ভাষাটা যদিও এখন তত রপ্ত হয়নি। অভিনয়টাও ঠিকমত পাঁকেনি।তবু যে এই সুযোগটা সে পেয়েছে,এটাই তারজন্য অনেক। 

দুদিন আগে মি. ধানুকা স্যার তার একটা ক্লিপ স্ক্রিনিং -এর জন্য মুম্বাই পাঠিয়েছিলেন।একজন সিরিয়াল পরিচালকের কাছে।মৌমিতার ফেসটা তাদের ভীষণরকম পছন্দ হয়েছে।তাই তড়িঘড়ি ডেকে পাঠিয়েছেন।

মৌমিতার রোলটা হবে একজন প্যারালাইসিস রুগীর। শুধুমাত্র হুইল চেয়ারে বসে থাকলেই হবে।কথা বলার দরকার হবে না।। অথচ সিরিয়ালের ওটাই নাকি মূখ্য চরিত্র।ওই মহিলাটি বিশাল এক ধনী পরিবারের বড় বউ।বিয়ের পাঁচ বছর পর হঠাৎ দুর্ঘনায় তার চলৎ শক্তি এবং বাক শক্তি লোপ পেয়ে যায়।সেখান থেকেই সিরিয়ালটা শুরু।প্রায় শ পাঁচেক পর্ব চলবে।সেইজন্য তাকে সপ্তাহে দুদিন মুম্বাই-এ থাকতে হবে।স্যুটিং চলবে।

তার ফাঁকে সেও অভিনয়টা ভালমত শিখে নিতে পারবে।

ধানুকা স্যারের স্বভাব এতটা ভাল না হলেও কাজের দিক থেকে খুব সিরিয়াস।তারজন্যই মৌমিতা এই সুযোগটা পেয়েছে।মুম্বই থেকে পরিচালক নিজে ফোন করে তাকে বার,বার আসার অনুরোধ করেছেন।ধানুকা স্যারও সাথে থাকবেন।অসুবিধা কিছু হবে না।

তবু বুকটা তার ঢাঁই,ঢাঁই বাজছে।অচেনা,অজানা শহর!...কোন বিপদ হবে না তো?অবশ্য ভয় করলে এ লাইনে সফল হওয়া যায় না।

সেটা মৌমিতা এই কয়েকমাসের অভিজ্ঞতায় ভালমত বুঝে গেছে।

       সাধনাদেবী চা কাপটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,সুকুমার এসেছিল।তোর শ্বশুরের নাকি প্রচন্ড শরীর খারাপ।মেনিয়া,টেনিয়া কী যেন হয়েছে।আবার গলায় ক্যান্সারও ধরা পড়েছে।রাতদিন নাকি তোর নাম নিয়ে চিৎকার করেন।একবার দেখা করতে চেয়েছেন।না হলে উনি মরেও শান্তি পাবেন না। আমি কিছু বলিনি।তোর ফোন নাম্বারটা চাইছিল।দিয়েছি।

মৌমিতা কথাটা শুনে একচোট হেসে বলে উঠল,এতদিনে তাহলে খেয়াল হল?

আর যদি মরে যেতাম...তাহলে কার কাছে ক্ষমা চাইতেন উনি?...কালদিন বলবে সাহেবকে দেখতে চান!..যতসব আদিখ্যেতা!...কোমরকম প্রশ্রয় দিও না মা।সোজা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবে।

মরে আছি না বেঁচে আছি তার খবর নিতে পর্যন্ত একদিন আসেনি।আজ তার বাবা চেয়েছেন বলেই একেবারে মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে দৌঁড়ে এসে গেছে!আমার,সাহেবের উপর তার যখন কোন দায়িত্বই নেই।তখন ওসব মেনে কী লাভ?

সাধনাদেবী আবার বলে উঠলেন,সুকুমার বলছিল ওকে নাকি তার বাবা মাথার শর্ত দিয়ে রেখেছিলেন।যদি তোর সঙ্গে দেখা করতে আসে,উনি সেদিনই আত্মহত্যা করতেন।তাই সে শত দুঃখেও আসতে পারেনি।

আজ তার বাবাই শর্ত ভঙ্গ করে তোকে ফিরিয়ে আনার জন্য পাগল হয়ে পড়েছেন।

মৌমিতা বলে উঠল,সব ঢং মা।ওদের ওটা একটা নতুন চাল!আমি সব বুঝি।আজ সাহেব বড় হয়েছে।বংশপ্রদীপকে কাছে পাওয়ার লোভ।তারসাথে আমারো নাম,ডাক হয়েছে।কই এতদিন তো মনে পড়ল না?আমি আর ওঘরে কোনদিন পা রাখব না।

সাধনাদেবী বলে উঠলেন,তোরা তো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে ছাড়াছাড়ি করিসনি।তাই একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই যায়।দ্যাখ মা জীবনটা অনেক বড়।তাই ছোটখাটো ভুলগুলো অগ্রাহ্য করে সম্পর্কগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কর।আমি জানি।ওরা যা অপরাধ করেছে।যেভাবে তোকে অপদস্থ করেছে।তোর কেন আমার পক্ষেও মেনে নেওয়া সম্ভব হত না। সেদিক দিয়ে তুই বেরিয়ে এসে একদম ঠিক কাজ করেছিস।

আজ আবার তারাই তো তোকে আকুলভাবে ডাকছে।তাতে অপমানটা তো এবার ওরা নিজে,নিজেই চাটছে।

-----ডাকলেই চলে যেতে হবে?এ কেমন নীতি?...আর এতদিন ধরে যে আমি এত কষ্ট সহ্য করলাম।সেই কষ্টের ভাগ কী ওরা নেবে?আমি চোখের জলে ভেসে যাওয়ার মেয়ে নই মা।আমারো দুচোখে একদিন অনেক ব্যথার অশ্রু ঝরেছিল।কেউ আসেনি মুছিয়ে দিতে।তাই ওরা পাক শাস্তি।ওপরে একজন আছেন।সবকিছু দেখছেন।তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। সব নিজের,নিজের পাপের শাস্তি পাচ্ছে।

------তাইতো বলছি মা।তুই আর একবার ভেবে দ্যাখ।যে ভুল ওরা করে আজ আফসোস করছে।সেই ভুল জেনেশুনে করাটা কি তোর যুক্তিসঙ্গত হবে?

-----আমাকে আগামীকাল মুম্বাই যেতে হবে।একজন ডাইরেক্টর ডেকে পাঠিয়েছেন।ঘুরে এসে ভেবে দেখব।তাছাড়া এখন আমার সামনে একটা উজ্বল ভবিষ্যত আছে।ওরা কী সেটা মানতে পারবে?...আমি জানি।পারবে না।তাই দ্বিতীয়বার ভাবতে বসার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

-----সেকি মা!...তুই এত বড় একটা অচেনা শহরে একা যাচ্ছিস?

----সঙ্গে ধানুকা স্যার যাচ্ছেন।একটা সিরিয়ালে লিড রোলের জন্য ডাক পড়েছে।সপ্তাহে দুদিন হয়ত ওখানে থাকতে হবে। তেমনি কাজের জন্য এদিক,ওদিক ঘুরতে হবে না।

----সে যাই বল...আমার সুবিধে মনে হচ্ছে না।যা করবি ভেবে,চিন্তে করিস।মনে রাখিস তোর জীবনের সঙ্গে সাহেব আছে জড়িয়ে।তাকে অগ্রাহ্য করাটা তোর একটা মস্ত বড় ভুল হবে।

----মা তুমি বেকার চিন্তা করছ।তাছাড়া ওর কথা ভেবেই আমি এসব করছি।

এবার ফ্ল্যাটটা যাহোক করে কিনতেই হবে।


(দশ)


হোটেলের কামরায় পৌঁছে মৌমিতা ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখল।সুকুমারের নাম্বার থেকে মোট পনেরোটা মিশ কল জমা হয়ে আছে।

প্রথম কলটা বাড়ি থেকে বেরুনোর একটু পরেই ঢুকেছিল।মৌমিতা কলটা কেটে ফোনটাকে সাইলেন্ট মুডে রেখে দিয়েছিল।

আবার ফোনে তারই কল ঢুকছে।

মৌমিতা ফোনটা ডিভানের উপর ছুঁড়ে দিল।আসুক কল।

সে তাকে কম শাস্তি ভোগায়নি।আজ দরদ একেবারে উথলে পড়ছে!

যত্তসব ন্যাকামী!!

 তাকে কামরার চাবি ধরিয়ে ধানুকা স্যার স্টুডিওতে চলে গেছেন।পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে।আগামীকাল সকালে তাকে নিয়ে যাবে।

মৌমিতা এবার তার মাকে ফোন করল।

---হ্যালো মা...আমি ঠিক মত পৌঁছে গেছি।হোটেলের রুম থেকে ফোন করছি।সাহেব কান্নাকাটি করেনি তো?

----কান্নাকাটি করেনি।তবে অনেকবার জিজ্ঞাসা করছিল।সে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি।তুই সাবধানে থাকিস।আর হ্যাঁ... সুকুমার আজ আবার এসেছিল।

ওর বাবার নাকি শেষ অবস্থা।তাই তোর পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে একবার দেখা করাতে চেয়েছিল।আমি বললাম,ও বোম্বে চলে গেছে।

-----আমাকেও অনেকবার ফোন করেছিল।বুঝুক।কষ্ট কী রঙের হয়।ওরাও আজ টের পাক।তবেই তো কাউকে আঘাত দেওয়ার আগে ভবিষ্যতে দুবার ভাববে।

     ওদিকে কলিং বেল বেজে উঠল।তাই মৌমিতা ব্যস্তভাবে বলে উঠল,আমি এখন রাখছি মা।

দরজা খুলতেই একজন একুশ,বাইশ বছরের ছেলেকে দেখতে পেল।পাতলা গড়ন।ছেলেটি বলে উঠল, রুম বয়।এই নিন ম্যাডাম জলের বোতল।আর ন্যাপকিন।দুটো জিনিস আগে দেওয়া হয়নি।দিয়ে গেলাম।

মৌমিতা অবাক হয়ে জানতে চাইল,আরে ভাই তুমি কী করে জানলে যে দিদিটি একজন বাঙালি?এসেই একদম গড়গড় করে বাঙলায় বলে যাচ্ছো যে?

মৌমিতার কথাটা শুনে ছেলেটা স্থির চোখে তার দিকে অল্পক্ষণ চাইল।তারপর একটু ভেবে বলে উঠল,আপনাকে চেনা,চেনা লাগছে।কোথায় যেন দেখেছি।

তারপর কথা ঘুরিয়ে আবার বলে উঠল,আচ্ছা আপনি আমায় হঠাত ভাই বলে কেন ডাকলেন?আপনি এত উঁচু মানুষ।আর আমি হলাম সামান্য একজন রুমবয়?

------রুমবয় হলে বুঝি ওরা মানুষ হয় না?...না ওদের কোন পরিবার নেই?...তুমি তো আমার ভাই-এর মতই।

ছেলেটা আবার মৌমিতার দিকে এক দৃষ্টিতে চাইল ।তারপর বলে উঠল,আপনার মত একজন দিদিভাই"মেঘ বৃষ্টি, আলো" ফেসবুক ব্লগে দারুণ,দারুণ গল্প লেখেন।আমি প্রত্যেকটাই পড়েছি।যতবার পড়েছি চোখ থেকে জল এসে গেছে।উনি কী আপনার কেউ আত্বীয় হন?

মৌমিতা অল্প হেসে বলে উঠল,সেই দিদিভাইটিই আমি।

সঙ্গে, সঙ্গে ছেলেটা আঁতকে উঠল।সিল খোলা জলের বোতলটা মৌমিতার মুখে ঢোকার আগেই হাতের ঝটকায় দূরে ফেলে দিল।

মৌমিতা ভয় পেয়ে বলে উঠল,একি!

ছেলেটা সন্তর্পণে দরজাটা ঠেলে আস্তে করে বলে উঠল,আপনি হয়ত জানেন না দিদিভাই।এটা একটা বাঙালি মালিকের হোটেল।আর এখানে রুম শুধু বাঙালিরাই প্রি বুকিং করে।কোলকাতা থেকে নতুন মেয়েদের,সিনেমায় কাজ দেবে বলে এখানে রাখা হয়। এই সব জলের বোতলে নানা ধরণের রাসায়ণিক মেশানো থাকে।তাদের শরীরকে উত্তেজিত করার জন্য।

আমি জেনেশুনে অনেক পাপ করেছি।অনেকটা বাধ্য হয়ে।ঘরে দু দুটো দিদির বিয়ে দিতে আছে।বাবা বেঁচে নেই।তাই এখানে এসেছি।পার্টিদের থেকে মোটা টাকার বক্সিস পাই।

আপনাকে ফাঁসানো হয়েছে দিদিভাই।তবে ভয় নেই। আমি আপনার ভাই।ঠিক সময়ে এসে গেছি।এখন আমি আপনাকে উদ্ধার করে এই নরক ছেড়ে চিরদিনের মত বিদায় নেব।

মৌমিতার মাথাটা ঘুরছে।মেঝেটা যেন চলছে।বিশ্ময় আর অজানা ভয়ে গলাটা কাঠ হয়ে গেল।

ছেলেটা বুঝতে পেরে বলে উঠল,একদম না দিদিভাই।ভয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ চেহারায় যেন না থাকে।সেভাবে নিজেকে তৈরি করুন।আর লাগেজগুলো একটাও সাথে নেবেন না।শুধুমাত্র টাকাকড়ি গুছিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ুন।একদম হোটেলের বাইরে।আমি অপেক্ষা করছি।ম্যানেজার জানতে চাইবেন।একদম আঁতশ কাঁচ নিয়ে আপনার সারা বডি চেক করবেন।আপনি বিন্দুমাত্র ঘাবড়াবেন না। বলবেন,রিচার্জ ভরতে যাচ্ছি।তারপর আমি আপনাকে কোলকাতায় পৌঁছাব।

  ছেলেটা চলে যেতেই মৌমিতা কাঁপতে,কাঁপতে ব্যাগ থেকে এ.টি.এম কার্ডটা আর নোট কটা সন্তর্পণে বুকের খাঁজে রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

এক মনে মা দূর্গার একশো আটটা নাম স্মরণ করে নিল।তাতে ভয়টা অনেক কাটল।মনে হল মা তার সাথে আছে।না হলে আজ সে অসতী হওয়ার হাত থেকে কিছুতেই মুক্তি পেত না।

   এতক্ষণে তার মনে হল সে একটা মোহের টানে এতদিন দৌঁড়ছিল!

নিজের রূপের উপর গর্ব করে আপন লেখনি সত্ত্বার গলা টিপে এক মরীচিকা নামক যশ আর প্রতিপত্তির নেশায় মাতাল হয়ে পড়েছিল।

ঠিক একই রকম নেশার বশবর্তী হয়ে একদিন তার শ্বশুরমশাইও তাকে বাড়ি থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।আজ তিনি যেমন অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হচ্ছেন।তেমনি একই রকম আগুনে পুড়ছে মৌমিতাও।

মানুষ ভুল করে বসে নিজের আত্ম অহংকার নামক দানবটাকে বাঁচানোর দায়ে।যেদিন সেই দানবের সিং দুটো কোন কারণে ভেঙে যায়। তখনি মানুষ তার প্রকৃত নিজস্বতা ফিরে পায়।মৌমিতা আজ আর একবার নিজের দিকে চাইল।

তাকে যেমন করেই হোক বাড়ি ফিরতেই হবে। নিজের বাড়ি।

 তার ভাইটি ঠিক কথায় বলেছিল।ম্যানেজারের চোখদুটো কোন আঁতশ কাঁচের থেকে কম না।

মৌমিতা অল্পও ঘাবড়াইনি।বরং ভ্রূযুগল নাচিয়ে হেসে বলে উঠল,নিজের বয়সটার কথা ভাবুন।

ঘুরে আসি তারপর না হয় বসে একটু আলাপ করব।ঠিক আছে?

ম্যানেজারের মুখটা সাপের মত বেঁকে গেছিল।

মৌমিতা সেই ফাঁকে একটা শিস তুলে নাচতে,নাচতে বেরিয়ে যায়।

         হোটেলের চৌহদ্দি পার করেই বুকের চাপা উৎকন্ঠাকে মুখের লালার সাথে বের করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।সামনেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।মনে হল ওকে বুকে জড়িয়ে একবার মনের সুখে কাঁদে।কিন্তু সে সময়টুকুও এখন ব্যয় করা চলবে না।

ছেলেটি আস্তে করে বলে উঠল।আমার পিছু,পিছু হাটতে থাকুন।কোনদিকে তাকাবেন না।

মৌমিতা তাই করল।

তারপর ছেলেটা টুক করে একটা লাল বাসে উঠে পড়ল।মৌমিতাও দৌঁড়ে হাতলটা ধরে ফেলল।

তারপর এক সময় সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ডে নেমে পড়ল।সেখানে নেমেই একটা ট্যাক্সিতে উঠল।

ছেলেটা একটাও কথা বলেনি।এদিক,ওদিক তাকায়নি।সে যেন একটা কঠোর প্রতিজ্ঞা মনের মধ্যে চেপে বসে আছে।

মৌমিতা কিছু বলতেই যাচ্ছিল।ছেলেটা আঙুলের ঈশারায় চুপ থাকতে বলল।

তারপর ছত্রপতি শিবাজি রেল স্টেশনে নেমে পড়ল।

এবার ছেলেটি প্রথম মুখ খুলল,আপনি জানেন না দিদিভাই,এটা মুম্বই।সবাই সুযোগ খুঁজে বেড়ায়।তাই বাসে বা ট্যাক্সিতে কখনো পার্সন্যাল মেটার নিয়ে কথা বলতে নেই।

আমি সাথে গেলে আপনার ভাল হত।তাতে ওদের সন্দেহ অনেক বেড়ে যাবে।ভাববে আমিই হয়তো চালাকি করে আপনাকে ভাগিয়ে দিয়েছি।তখন ওরা আজকের হাওড়াগামী ট্রেনে ওদের লোক লাগিয়ে খুঁজে বেড়াবে।তাই আজ এই পর্যন্তই।

এবার আর থাকতে না পেরে মৌমিতা সত্যি সত্যিই তার ভাইকে জড়িয়ে কেঁদে উঠল।একদম বাধভাঙা কোন নদীর মত।ঝর ঝর করে।ছেলেটার চোখেও জল এসে গেল।নিজেকে সংযত করে বলে উঠল,দিদিভাই শান্ত হন দিভাই।পাবলিক প্লেসে এভাবে কাঁদলে অনেকেই তাকাবে।

ভাই বলে একবার যখন ডেকেছেন...তখন এই সম্পর্ক আর শেষ হবে না দিদিভাই।

একটাই অনুরোধ, আপনি গল্প লেখা ছাড়বেন না। আপনাকে কাগজে,কলমেই ভাল মানাই।এই সব নোংরা লাইনে আর ভুলেও পা বাড়াবেন না।

মৌমিতা চোখ মুছে বলে উঠল,আমার আগামী গল্পে তুমিই হবে নায়ক ভাই।তোমার এই উপকার এই দিদি চিরদিন মনে রাখবে।

তোমার মত ভাই যেন প্রত্যেকটা মেয়ে পায়।

ছেলেটা চোখ মুছে ধরা গলায় বলে উঠল,আর পাপের বোঝা আমার ভারী করবেন না দিভাই।এই হাত দিয়ে অনেক পাপ কাজ করেছি।তবে আর না।অন্য কারু মা,বোনকো বিপদে ফেলে নিজের দিদিদের সুখ কিনব না দিভাই।

চললাম।বিদায়।ভাল থাকুন।সাবধানে যাবেন।

তারপরেই ছেলেটা একটা বাস ধরে উঠে পড়ল।

ট্রেন ছাড়ার এক ঘন্টা পর ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল।

মৌমিতার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল।

হয়তো জানোয়ারগুলো তার খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন করেছে।ফোনটা তার মনে করে অফ করা উচিত ছিল।হয়ত লোকেশন ট্রাক করতে পারে।

নামটা দেখে কলটা কেটে ফোনটা অফ করতে গিয়ে দেখে সুকুমারের ফোন।

মৌমিতা বুকের দুঃখগুলো গলাধ্বকরণ করে ফোনটা রিসিভ করে বলে উঠল,আমি ফিরে আসছি।পরশু সকালে হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকো।আমি নামব।

তারপরেই ফোনটা অফ করে মৌমিতা চোখদুটো মুছে অতীত সুখের দিনে ডুব দিল।


(এগার)


হাওড়ার ব্যস্ত সাবওয়ের মাঝে মৌমিতা যাচ্ছে সুকুমারের দিকে হেঁটে।সুকুমারের পরণে ধুতি আর গায়ে একটা পশমের চাদর।সদ্য পিতৃবিয়োগের শোক এখনো চেহারায় লেগে আছে।তবু মৌমিতাকে সামনে দেখে তার মুখটা উজ্বল আনন্দে ঝকমক করে উঠল।

আজ মৌমিতাও অনুশোচনার অনলে পুড়ে একদম খাঁটি হয়ে গেছে।

অতীতের সমস্ত গ্লানি আর দুঃখের অন্ধকারকে পিছনে ফেলে ছুটে আসছে তার সেই পুরনো প্রেমিকের ঘরে।

সেই চাউনি !সেই ব্যাকুলতা আজ আবার সে সুকুমারের দুচোখে ফুটে উঠতে দেখল।যেমনটি সে দেখেছিল দিঘীর পাড়ে সাক্ষাতের দিনটায়।

সুকুমারও এত বছরের দগ্ধতায় অনেক বেশি ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

আজ আর কেউ,কাউকে জড়িয়ে ধরল না। শুধু একে অপরের হাতটা শক্ত করে ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল।তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে সুকুমার নিয়ে গেল মৌমিতাকে তার বাড়িতে।এটাই মৌমিতার বাড়ি।

তার শাশুড়ি মায়ের বসনটাই শুধু সাদা নয়। আজ দেহ,মন সব কালিমামুক্ত হয়ে গেছে।

শুধু তার শ্বশুরমশাইকে ফটোতে দেখতে হল।

সাম্প্রতীক কালের ছবি বলেই হয়ত চোখদুটো বড় ঠান্ডা মনে হল।

আজ মৌমিতার সত্যি সত্যিই মনে হল,এত বছর ধরে আস্ত বাড়িটা যেন তার অপেক্ষাতেই পথ চেয়ে বসেছিল।তাই একটা নিজস্বতার গন্ধ পাচ্ছে।

সাধনাদেবীকে ফোন করে বলল,মা আমি নিজের ঘরে ফিরে এসেছি।তুমি গাড়ি করে আমার জিনিসগুলো সমেত সাহেবকে নিয়ে এসো।

সাধনাদেবী চোখের জল মুছে নাক টেনে বলে উঠলেন,গতকাল তোর পুরনো ইস্কুলের জয়েন লেটারটা এসেছে।ওটা কী সাথে নিয়ে যাব?

মৌমিতা চোখের কোনে জলটা মুছে বলে উঠল,হ্যাঁ ।

দুপুরের দিকে সুকুমার এসে বলল,মৌ তুমি আবার নতুন করে লেখা শুরু করো।অনেকদিন তোমার কোন গল্প পড়িনি।

মৌমিতা সত্যি সত্যিই লিখে ফেলল একটা গল্প।

সন্ধের সময় প্রকাশকবাবুকে ফোন করে বলল,আমি মৌমিতা বলছি আগামবাবু।এর পরের সংকলনটার জন্য তৈরি থাকুন।

আজ আবার মৌমিতা নিজের ব্লগ "মেঘ,বৃষ্টি, আলো" খুলে বসল।একটা অণুগল্প পোষ্ট করল।

মৌমিতা ভেবেছিল।হয়ত আর তেমন ফলোয়ার্স নেই।সে ভুলটাও ভেঙে গেল মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে ।

কয়েক হাজার লাইক জমা পড়ে গেল ওইটুকু সময়ে।

মৌমিতার মনে হল সত্যি সত্যিই সে এতদিন নিজের শ্রীঘরে নিজেই সাজা কাটছিল।আজ সে মুক্তি পেল।

      

-------সমাপ্ত--------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama