Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sayandipa সায়নদীপা

Drama Inspirational Tragedy

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama Inspirational Tragedy

কোকুন

কোকুন

28 mins
16.8K


“ওই তো রিকি ফিরে গেছে…”

স্কুল থেকে ফিরে বাইরের গেটটা লাগাতে লাগাতে ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা মামিমার কথা গুলো কানে এলো রিকিয়ার; বুঝতে পারল নিশ্চয় তাকে নিয়েই কোনো আলোচনা চলছে এবং সেটা ভালো না মন্দ আলোচনা এই দোলাচল নিয়ে ঘরের ভেতর পা রাখল সে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই প্রথম যার দিকে চোখ পড়ল তাঁকে রিকিয়া চেনেনা। পরনে ডার্ক ব্লু ব্লেজার, ব্লেজারের ফাঁক গলে উঁকি দেওয়া দামি হাত ঘড়ি আর চোখে থাকা একটা বেশ সুন্দর ডিজাইনের রিমলেস চশমা আগন্তুক ভদ্রলোকের সমূহ বিত্তের জানান দিচ্ছে। ছোটবেলার থেকেই চশমা নিত্য সঙ্গী হওয়ার দরুন চশমার ব্যাপারে রিকিয়া একটু বেশিই আবেগপ্রবণ, আর তাই না চাইতেও বারবার তাকিয়ে ফেলছে ভদ্রলোকের চশমাটার দিকে।

ভদ্রলোকের ঠিক বিপরীত দিকের কাউচটাতে বসে আছেন মামু। সেখান থেকেই রিকিয়ার হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে মামু বললেন, “মিঃ সেনগুপ্ত, এই হচ্ছে আমার একমাত্র ভাগ্নি রিকিয়া।”

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের জন্য রিকিয়ার দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে বললেন, “হাই…আয়্যাম শ্রীনিবাস সেনগুপ্তা, নাইস টু মিট ইউ।”

নিজের বাবার বয়েসী একটা লোককে সাধারণত প্রথম সাক্ষাতে প্রণাম করতে শিখেছে রিকিয়া; তাই ভদ্রলোকের বাড়ানো হাতটা দেখে একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল সে, কোনোমতে মনের দ্বন্দকে পাশ কাটিয়ে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো, “আমি রিকিয়া। রিকিয়া সোম।”

এরপর হঠাৎ করেই ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা নীরবতা নেমে এলো, কেউ কোনো কথা বলছেনা। একেবারে পিনড্রপ সাইলেন্স। এই সুযোগে রিকিয়া রুমে উপস্থিত সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল; দিদানের মুখ দেখে সে বেশ বুঝতে পারছে ভদ্রলোককে প্রণাম না করার জন্য দিদান রিকিয়ার ওপর বেশ চটে আছেন। তবে দিদান ছাড়া ঘরের বাকি সবার মুখের অভিব্যক্তি প্রায় একই রকম, এই হঠাৎ নিস্তব্ধতা সবাইকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।

অবশেষে মিঃ সেনগুপ্তই নীরবতা ভেঙে বললেন, “রিকিয়া যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও নিশ্চয় টায়ার্ড আছো…”

উফফ… রিকিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসে নিজের ঘরে। পোশাক পরিবর্তন করে উঠে আসে ছাদে। চুপচাপ বসে দেখতে থাকে ঘরে ফিরতে চাওয়া পাখির ঝাঁককে। ভদ্রলোক না যাওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য সঠিক জায়গা।

“কি রে পড়ছিস?”

মামুর গলা শুনে খাতার ওপর থেকে মুখ তুললো রিকিয়া। মামু দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন আর হাতে দুধের গ্লাস। রিকিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়। হ্যাঁ, এই সময় একগ্লাস দুধ তার জন্য বরাদ্দ ঠিকই কিন্তু সেটা বেশিরভাগ সময়ই আসে মা বা মামিমার হাত দিয়ে, কদাচিৎ দিদানও আনেন কিন্তু মামু! কক্ষনো না। রিকিয়া মনে মনে আন্দাজ করতে পারল আজ নিশ্চয় কোনো বিশেষ ব্যাপার আছে এবং সেটা গুরুতরও বটে। তবুও মনের ভাবনাটাকে মনেই চেপে রেখে মুখে শুষ্ক হাসি টেনে উত্তর দেয়,

“হ্যাঁ… এই যে কেমিস্ট্রির রিয়াকশন গুলো বড্ড গোলমেলে লাগে, কিছুতেই মাথায় ঢোকে না।”

“ধুরর, এ আবার কোনো সমস্যা নাকি! ঠিক করে বুঝে নিলেই হলো।”

“আমার হয়না যে!”

“আচ্ছা দুধ টা খেয়ে নে আগে, দেখছি তারপর।”

রিকিয়ার দুধ খাওয়া হয়ে যেতেই মামু ওর খাতা টেনে নিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন; কিন্তু মামুর চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো রিকিয়ার। অথচ অস্বস্তির কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ও। প্রায় আধ ঘন্টা পর মামু পেনের ঢাকনা লাগিয়ে বললেন,

“আজ এগুলোই থাক, কাল বাকি দেখা যাবে।”

“আচ্ছা। ঠিক আছে।”

“রিকি!”

“হ্যাঁ মামু?”

“তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।”

“হ্যাঁ বলো না।”

“জানিনা তুই কথাটা কিভাবে নিবি… তাই ঠিক বলতে…”

“কি এমন কথা মামু যে তুমি এতো ইতস্তত করছো?”

“বলছি… বলতে তো হবেই আজ না হলে কাল…”

শেষ কথাগুলো খানিকটা স্বগতোক্তির স্বরে বললেন মামু। রিকিয়ার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল।

“কি হলো মামু?”

“মা তোর মনে আছে আজ কতবছর তোর মা তোকে নিয়ে একা?”

রিকিয়া যেন জোরে একটা ধাক্কা খেল; ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসছে মামুর প্রশ্নের উত্তরটা ভাবতে গিয়ে। জবাব দিতে পারলোনা ও, চুপ করে থাকল। তাই বোধহয় মামুই আবার বলতে শুরু করলেন,

“তুই তখন মাত্র সাত বছরের ছিলি। আর তারপর আরও বছর সাতেক কেটে গেছে।”

“হুম।”

“কখনো চেয়ে দেখেছিস নিজের মায়ের মুখটার দিকে। ভাব তো এই দীর্ঘ সাত বছর তোকে একা হাতে সামলাচ্ছে, তোর পড়াশোনা থেকে শুরু করে সব দিক… আমরা থাকলেও কতটুকুই বা করতে পারি বল! তাছাড়া আমার রোজগার তো জানিস… তোর দাদাভাইয়ের কলেজের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি… আর তাছাড়া তোর মায়েরও কি ভালো লাগে বাপের বাড়িতে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে!”

শেষের কথাগুলো রিকিয়ার গায়ে ছ্যাঁকার মতো লাগে; মামুর মুখের ওপর কিছু অপ্রিয় কথা বলতে না ইচ্ছে হলেও বলে ফেলে,

“এসব আমায় কেন বলছ মামু? মা তো জব করে আর সংসার খরচে কন্ট্রিবিউটও করে। আমার পড়া থেকে শুরু করে সব এক্সপেন্সই তো মাই চালায়। তাও এসব বলছ কেন?”

“তুই আমায় ভুল বুঝেছিস রিকি, আমি এরকম বলতে চাইনি।”

“তুমি কি বলতে চেয়েছ আমি জানিনা মামু কিন্তু এখন আমিও বড় হয়েছি আমারও তো শুনতে খারাপ লাগে এসব।”

“রিকি মা আমার… তুই আমাকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছিস … দোষটা হয়তো আমারই। এক বলতে এসে আরেক কথা বলছি। শান্ত হ, তারপর শোন যে কথাটা বলবো।”

“কি?”

“মিঃ সেনগুপ্ত…”

“হুম...”

“মিঃ সেনগুপ্ত… মানে… রিকি… ওনার স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন…”

“হ্যাঁ, তো?”

“উনি তোর মাকে…”

মামুর অসম্পূর্ণ কথাটা নিজের কল্পনাতেই সম্পূর্ণ করে ফেলতে পারে রিকিয়া আর সে কথাটা ভেবেই কেমন স্তম্ভিত হয়ে যায়, কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেনা সে কিন্তু তার হাতের মুঠো হঠাৎ করেই শক্ত হয়।

“রিকি, মিঃ সেনগুপ্ত তোর মা কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। তোর মাকে দেখে ওনার খুব পছন্দ হয়ে গেছে, এমনিতেই সাধারণ বাঙ্গালী ঘরোয়া মেয়ে চাইছিলেন উনি। তারপর তোর মা তো… উনি খুব বড় ব্যবসায়ী। দিল্লিতে থাকেন। তোদের জীবনটাই পাল্টে যাবে দেখিস মা…”

আগের মতোই নিরুত্তর থাকে রিকিয়া, ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে। মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে নেয়; চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসতে চায়। মা সুন্দরী ও জানে। রিকিয়া মায়ের মতো দেখতে না হয়ে বাবার মতো হয়েছে বলে কতো লোককে কতো রকম কথা বলতে শুনেছে ও। কিন্তু আজ...

“রিকি, মা আমার, শোন না… আমি জানি এটা তোর পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কঠিন কিন্তু নিজের মায়ের কথাটা একবার ভাব। তুই আর কয়েক বছর পর বিয়ে করে নিজের সংসারে যখন ব্যস্ত হয়ে যাবি তখন তোর মা একলা কি করে জীবনটা কাটাবে ভাব একবার! সব তোর একটা হ্যাঁ বা না এর ওপর নির্ভর করছে। আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জোর করবোনা, শুধু এটুকু বলবো যাই সিদ্ধান্ত নে তোর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিস। সারা জীবন অনেক স্বার্থ ত্যাগ করেছে তোর জন্য। ভেবে দেখ। আসছি আমি।”

মামু চলে যায়… মামুর চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিকিয়া।

স্যাক্রিফাইস! হ্যাঁ মা নিশ্চয় তার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে, কিন্তু রিকি কি কিছুই করেনি মায়ের জন্য? ও যে মায়ের জন্য নিজের সব থেকে প্রিয় জিনিসটা হারিয়েছে সেটা কি কিছুই না? আর সবাই কি করে ধরেই নিচ্ছে যে ইন ফিউচার রিকি মাকে দেখবে না! ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে ভবিষ্যতে কি করবে এত সহজে বুঝে নিলো সবাই!

“রিকি তুমি মামুকে কি বলেছ?”

“মানে?”

“তুমি মামুর সাথে কোন সাহসে ওরম রুড বিহেভ করেছ? আমি তোমায় এই শিক্ষা দিয়েছি! গুরুজনদের সাথে কেমন ভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছো বুঝি?”

রিকিয়া সহসা উঠে গিয়ে মায়ের হাতটা ধরে ফেলে, “সরি মা। কাল মামুকেও সরি বলবো। আসলে মামু কিসব বলছিলো তাই মাথা ঠিক রাখতে পারিনি…”

মা হঠাৎই রিকিয়ার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়; রিকিয়ার বুকে যেন আবার একটা ধাক্কা লাগে সজোরে। অজান্তেই বেড কভারটা হাতে মুঠো করে ধরে অস্ফুটে বলে,

“মা… তুমি… সত্যি? তুমি নিজে কি চাও?”

“জানিনা আমি। সবাই বলছে তো…”

“তুমি কি চাও মা?”

“আমি একটু শান্তি চাই… একটু ভালোভাবে বাঁচতে চাই…”

আর কথা বাড়ায়না রিকিয়া। পাশ বালিশটা টেনে শুয়ে পড়ে।

সুবিশাল খাটে নরম গদিতে শুয়েও আজকাল ঘুম আসতে চায়না রিকিয়ার। চারিদিকে কেমন যেন নতুন নতুন গন্ধ। ছোটবেলা থেকে রাতের বেলা মায়ের কোল ঘেঁষে মায়ের গায়ের গন্ধ মেখে ঘুমনোই তার অভ্যেস। এখন সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একই ছাদের নিচে থেকে নিজের মাকেও কেমন যেন অচেনা মনে হয়।

হ্যাঁ, মা আর মিঃ সেনগুপ্তার বিয়েটা শেষমেশ হয়েই গেছে। রিকিয়ার সম্মতি নিয়েই হয়েছে। মামিমার রোজগার তাগাদা, দিদানের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, মায়ের অচেনা রূপ আর মামুর গম্ভীর মুখ… নাহ বিয়েতে অসম্মতি জানিয়ে নিজের পরিবারের লোকদের অসন্তুষ্ট করতে চায়নি সে। আর রিকিয়ার প্রিয় প্রকাশ স্যারও যখন বললেন রিকিয়ার আপত্তি করা উচিত না তখন আপত্তি করার আর প্রশ্নই ওঠে নি।

একমাস হলো ওরা এখন দিল্লিতে। রিকিয়া নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, ছোটো একটা শহরের বাংলা মিডিয়ামে পড়া রিকিয়ার হঠাৎ করে রাজধানী শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়ে কেমন দিন কাটাচ্ছে তা জানার ফুরসৎ নেই এখানে কারুর। মা মিঃ সেনগুপ্তার কোম্পানিতে কি যেন একটা পদে যোগ দিয়েছেন, ব্যস্ত থাকেন ভীষণ। এখানে আসার আগে একদিন মিঃ সেনগুপ্তাকে আঙ্কল বলে ডেকেছিল বলে মামিমা আর দিদানের সে কি রাগ! মায়েরও মুখ ছিল গম্ভীর। মামিমা বললেন বাবা বলে ডাকতে; মিঃ সেনগুপ্তা এখন রিকিয়ার নতুন বাবা। অবাক হয় রিকিয়া, বাবাও তবে নতুন-পুরোনো হয়! নাহ, বাবা বলে ডাকতে পারেনি ও, বাবা ডাকটা সেই মানুষটার জন্যই না হয় তোলা থাক। বরং রাহুল আর রোমির মতো রিকিও মিঃ সেনগুপ্তাকে ড্যাড বলতে শিখে নিয়েছে। এটাই ভালো।

শ্রীনিবাস সেনগুপ্তর দুই সন্তান, রাহুল ও রোমি। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থী রাহুলের জীবনযাত্রা দেখে প্রায়শঃ শিহরিত হয় রিকিয়া। লেট নাইট পার্টি, ড্রিংক, স্মোক এসব যেন রাহুলের শিরায় শিরায় মিশে। খড়্গপুরের মতো শহরের বুকে বসে খাঁটি বাঙালী পরিবারে বড় হওয়া রিকিয়ার কাছে এ জীবনযাত্রা ছিল কল্পনাতীত। দাদাভাইকে দেখতো কোনোদিনও টিউশন থেকে ফিরতে রাত ন’টা বেজে গেছে দেখলেই মামু পায়ে পায়ে রাস্তার মোড় অবধি এগিয়ে যেতো। আর সেখানে রাহুল! প্রত্যেকদিন কত রাতে বাড়ি ঢোকে, মাঝে মাঝে কাজের লোকেদের কেউ একটু আপত্তি করলে শোনা যায় তার নেশাতুর গলার গালিগালাজ। ঘুম আসেনা রিকিয়ার, তাই রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দেওয়া এই শব্দ গুলো অতি সহজেই ওর কানে ঢোকে। মাঝে মাঝে অবাক হয় ও, আচ্ছা মিঃ সেনগুপ্তা কি কিছুই জানেননা এসব নাকি বড় বড় শহরের এমনটাই দস্তুর! এই কি তবে বড় শহরের আধুনিকতা! রোমি রিকিয়ার থেকে বছর খানেকের ছোটো হবে। তার সম্বন্ধে এখনো বিশেষ কোনো ধারণা করে উঠতে পারেনি রিকিয়া কারণ তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো রকম সাক্ষাতের সুযোগ খুব কমই হয়। রোমিকে দেখলে মাঝে মাঝে রিকিয়ার সেই আগেকার দিনের অন্তঃপুরচারিণী রাজকন্যের মতো মনে হয়, যে থাকতো সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে আর তাই তাকে ঘিরে লোকের কৌতূহলের অন্ত থাকতো না। এখানে অবশ্য অন্য লোকেদের কথা রিকিয়া জানেনা কিন্তু তার কাছে রোমি অবশ্যই এক কৌতূহলের জিনিস। মায়ের বিয়ের আগে যখন শুনেছিল মিঃ সেনগুপ্তার ছেলেমেয়ের কথা তখন মনে মনে কল্পনা করেছিল যে একটা অচেনা অজানা শহরে এসে দুটো বন্ধু পাবে অন্তত। কিন্তু নাহ, কল্পনা আর বাস্তব তো কোনোদিনও এক হয়না। রিকিয়ার সাথে তাই রাহুল আর রোমির কোনো বন্ধুত্ব তো গড়েই ওঠেনি, বরং ওরা দুজন যেন নিজেদের সামনে এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলে রেখেছে যাকে ভেদ করা রিকিয়ার পক্ষে অসম্ভব। আর তাছাড়া সেদিন রাত্রের ঘটনার পর তো সে দেওয়াল ভেদ করার ইচ্ছেটা রিকিয়ারও চলে গেছে।

সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। রোজগার মতোই ঘুম ধরছিলোনা রিকিয়ার তাই ও বেরিয়ে এসেছিল ব্যালকনিতে। জোৎস্না যেন ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই ছোটোবেলায় যখন বাবা ওকে কোলে বসিয়ে চাঁদের বুড়ির সুতো কাটার গল্প শোনাতেন। প্রত্যেক পূর্ণিমার দিনে রিকিয়া বড় বড় চোখে চেয়ে দেখতো চাঁদের গায়ের কালো কালো দাগ গুলোকে আর বোঝার চেষ্টা করতো ওখানে চাঁদের বুড়ির ঘরটা ঠিক কোনখানে। তারপর বাবার কোলে চড়ে বায়না জুড়ত আবার চাঁদের বুড়ির গল্প শোনার আর বাবাও একটুও বিরক্ত না হয়ে আবার শুরু করতেন সেই পুরোনো গল্প। চশমার মধ্য দিয়ে আজ ওই বড় গোল চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রিকিয়া হঠাৎ যেন দেখতে পাচ্ছিলো বাবাকে আর বাবার কোলে বসা ছোট্ট রিকিয়াকেও।

কল্পনার জগতে ভেসে যাচ্ছিল সে কিন্তু হঠাৎ করেই কোথা থেকে ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার এক বিভৎস শব্দ ভেসে এলো কানে। রিকিয়া বুঝতে পারলো শব্দটা এসেছে রোমির ঘর থেকে। মনে একটা আশঙ্কা নিয়ে রিকিয়া নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ছিলো কিন্তু দেখলো করিডোর ফাঁকা, একটা কোনো জনপ্রাণী নেই। আশ্চর্য! কেউ কি শুনতে পায়নি ওই বিভৎস আওয়াজ! যাই হোক, যতই কোনো সম্পর্ক না থাক তাও রিকিয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল রোমির রুমের দিকে আর তখনই শুনতে পেয়েছিল সেই কথোপকথন-

“সিস, প্লিজ মেডিসিন লাগা লে।”

“নো।”

“ডোন্ট বিহেভ লাইক এ ফুল… ইতনা ব্লিডিং হো রাহা হ্যা হাত মে…”

“হাঁ… ব্লিডিং তো হো রাহা হ্যা পর হাত মে নেহি, হার্ট মে।”

“ইউ ইমোশনাল ফুল… বি প্র্যাকটিক্যাল… বি প্র্যাকটিক্যাল।”

“আই কান্ট… আই কান্ট টলারেট দ্যাট বিচ… এন্ড দ্য ডটার অফ বিচ…”

“হোয়াট ডু ইউ থিংক...আই লাইক দেম?”

“হুহ…”

“হোয়াই আর ইউ ওভার রিয়াকটিং? ওয়াজ ইট আনএক্সপেক্টেড? নট এট অল। মুঝে তো ইয়ে সোচ কে হয়রানি হোতি হ্যা কি শুভ কাম মে উনহোনে পাঁচ সাল দের কিউ করদি?”

“মিঃ সেনগুপ্তা…”

“হুম… দেখনা অব ও বিচ এন্ড দ্য ডটার অব বিচ ক্যায়সে হামে হাটাকে পুরি প্রপার্টি কা পসেশন লেঙ্গে। স্মল টাউন লেডিস…. আই নো দেম ওয়েল…”

রিকিয়ার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিলো… এগুলো এদের মুখের ভাষা! আর রিকিয়াদের কি ভাবে ওরা! রিকিয়ারা ভিখিরি নাকি যে ওদের বাবার সব কিছু দখল নিতে চাইবে!

একরাশ তীব্র ঘৃণা নিয়ে সেদিন নিজের ঘরে ফিরে এসেছিল রিকিয়া আর সেই সাথে ওদের সাথে বন্ধুত্ব করার শেষ ইচ্ছেটাকেও সেদিন গলা টিপে মেরে ফেলেছিলো। সেদিন থেকে ঘৃণাটা আর একতরফা হয়ে থেকে থেমে থাকেনি, দু তরফেই সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। রাহুল আর রোমির মতো রিকিয়াও নিজের চারপাশে তুলে ফেলেছিলো এক স্বচ্ছ দেওয়াল যাকে ভেদ করার সাধ্য কারুর নেই।

“মা তোমার সাথে কথা আছে কিছু, সময় হবে তোমার?”

“এভাবে বলছিস কেন রিকি! সময় হবে মানে!”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে উত্তরটা সাজিয়ে নেয় রিকিয়া তারপর মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলে, “না মানে এখন তো অনেক চাপ তোমার তাই…”

রিকিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা বলেন, “তোর জন্য আমি সবসময় ফ্রি। বল কি বলছিস?”

মায়ের কথাটা কেমন যেন প্রহসনের সংলাপ বলে মনে হয় রিকিয়ার; হাসি পেয়ে যায় ওর। নিজের মনের অবস্থাটা বুঝতে না দিয়ে বলে, “মা আমি মামাবাড়ি যাবো। মন খারাপ করছে ওখানের জন্য।”

“রিকি! এখন কি করে যাবে! তোমার স্কুল আছে আর তাছাড়া… এটা দিল্লি, এখান থেকে যখন তখন চাইলেই যাওয়া যায়না।”

রিকিয়া কোনো কিছু বলার আগেই দরজার বাইরে থেকে ভেসে আসে একটা কন্ঠস্বর, “রিকিয়ার কি এমন চাই যেটা তার ড্যাড দিতে পারবেনা?”

ঘরে ঢুকলেন মিঃ সেনগুপ্ত, মুখে একগাল হাসি, চোখে রিকিয়ার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন। রিকিয়াকে উত্তরটা দিতে হলো না, মাই বললেন, “ও বলছে মামাবাড়ি যাবে।”

মিঃ সেনগুপ্তর মুখটা ক্ষনিকের জন্য কেমন থমথমে হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ করে হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “বেটা তোমার কিছু চাই আর সেটা তোমার ড্যাড দিতে পারবে না এটা হতেই পারে না। আমার স্যাটারডে কলকাতা যাওয়ার কথা ছিলো কাজে, তো সেটা নাহয় আমরা পরশুই চলে যাই। তোমাকে তোমার মামাবাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আমি কলকাতায় ফিরে এসে কাজ সারবো, এগেইন তোমাকে নিয়ে ব্যাক টু দিল্লি।”

রিকিয়ার চোখ মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো; এই প্রথম মিঃ সেনগুপ্তকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর আসন থেকে সরিয়ে অন্য কিছু মনে হলো। উচ্ছাসে বলে উঠলো, “থ্যাংক ইউ… থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“রিকি তুই! আরে মিঃ সেনগুপ্ত আপনি।”

মামিমার উচ্ছসিত গলা, “মা দেখুন কে এসেছে।”

আদর আপ্যায়নের পর্ব মিটতেই মিঃ সেনগুপ্ত আবার চললেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। রিকি রয়ে গেল মামাবাড়িতে। সেই পুরোনো বিছানায় শুয়ে বহুদিন পর আরাম করে ঘুমোলো ও। এই ঘুমটার সত্যি দরকার ছিলো। পরের দিন ও গেলো ওর পুরোনো স্কুলে; প্রাণ ভরে দেখলো স্কুলটাকে। দেখা করলো দিদিমনিদের সাথে, বন্ধুদের সাথে। ওর প্রিয় বন্ধু সামিয়াকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ দুজনে কাঁদলো খুব। ভিডিও চ্যাটে প্রায়ই কথা হয় দুজনের কিন্তু তাও সামনা সামনি সাক্ষাতের অনুভূতিটা কি আর যন্ত্র এনে দিতে পারে! স্কুল থেকে বেরিয়ে রিকিয়া গেল প্রকাশ স্যারের বাড়ি। অনেক কথা হলো স্যারের সাথে কিন্তু ভুলেও ওর মানসিক অবস্থার কথা স্যারকে বললো না রিকিয়া। স্যার ওকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন, সব কিছু জানলে স্যার হয়তো শুধু শুধু কষ্ট পাবেন।

সারাদিনের ক্লান্তি অতি সহজেই রিকিয়ার চোখে ঘুম হয়ে নেমে এলো রাতে। মাঝ রাত্রিরে রিকিয়া হঠাৎ স্বপ্নে দেখতে পেলো বাবাকে। ও দেখলো ওদের সেই পুরোনো বাড়িটার প্যাসেজের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ও আর ওর মা, ওপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ওর বাবা। প্যাসেজটা ভয়ঙ্কর রকমের অন্ধকার কিন্তু হঠাৎ করে বাবার পেছন দিকে একটা দরজা খুলে গেলো। তার থেকে একটা তীব্র আলো এসে ধাঁধিয়ে দিলো রিকিয়ার চোখ। কিচ্ছুক্ষণের জন্য কিছুই দেখতে পেলো না ও। তারপর চোখটা একটু সয়ে যেতে দেখলো বাবা কেমন যেন ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছেন পেছন দিকে ওই আলোটার মধ্যে… রিকিয়া ছুটে যেতে চাইলো বাবার কাছে কিন্তু মা ওর হাতটা টেনে ধরলেন। তারপর কোথা থেকে যেন মিঃ সেনগুপ্ত এসে হাসতে লাগলেন হাঃ হাঃ করে… রিকিয়া চিৎকার করে উঠলো, “বাবা!”

ঘুমটা ভেঙে গেলো ওর। দরদর করে ঘাম দিচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেলো ও। মাথাটা কেমন ভারী লাগছে। আবার শুয়ে পড়লো রিকিয়া। চোখ বন্ধ করে স্বপ্নটা ভুলে ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলো।

সকালে মুখের রোদের ছটা লাগতেই ঘুমটা ভাঙলো রিকিয়ার। চোখ খুলে দেখলো দিদান এসে দাঁড়িয়ে আছে জানলার ধারে, পর্দার একটা কোণ তখনও হাতের মুঠোয় ধরা। রিকিয়াকে জাগতে দেখে একগাল হাসি নিয়ে ওর পাশে এসে বসেন দিদান। তারপর ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেন, “শুভ জন্মদিন দিদিভাই।”

“দিদান তোমার মনে ছিলো!” উচ্ছসিত গলায় প্রশ্ন করে রিকিয়া।

“আমার আদরের দিদিভাইয়ের জন্মদিন কি আমি ভুলতে পারি!”

“ওহ দিদান। আই লাভ ইউ।” আনন্দে দিদানের গালে একটা চুমু খায় রিকিয়া।

“হ্যাপি বার্থডে রিকি সোনা।” মামিমা এসে ঢোকেন ঘরে।

“থ্যাংক ইউ মামীমা।”

“উমম ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। আজ আমরা দারুন মজা করে রিকির জন্মদিন সেলিব্রেট করবো।”

“হ্যাঁ ওই জন্যই তো বাবুকে সাত সকালে বাজার পাঠালাম। ভালো দেখে চিংড়ি মাছ আনতে বলেছি। আমার দিদিভাইয়ের প্রিয় চিংড়ির মালাইকারি রাঁধবো দুপুরে।”

“কিন্তু দিদান আমি তো বাড়িতে লাঞ্চ করবো না আজ! ভুলে গেলে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিকিয়া।

মুহূর্তে দিদান আর মামিমার মুখটা কালো হয়ে যায়। মামিমা বলেন, “তবে কোথায় লাঞ্চ করবে?”

“প্রত্যেকবছর যেখানে করি।”

“কিন্তু দিদিভাই প্রত্যেক বছরের সাথে এ বছরটা যে অনেক আলাদা। তোমার নতুন জীবন শুরু হয়েছে, অতীতকে ভুলে যাও।” দিদানের গলার স্বর সহসাই কড়া হয়ে উঠলো।

“দিদান! আমি আজকের দিনটার জন্যই সেই সুদূর দিল্লি থেকে এখানে ছুটে এসেছি।”

“আসা উচিৎ হয়নি রিকিয়া। আজকের দিনটা তোমার নিজের পরিবারের সাথে কাটানো উচিৎ ছিলো।”

“মামীমা তোমরা কি তাহলে আমার পরিবার নও?”

“আমি কি বলতে চেয়েছি সেটা তুই ভালো করেই জানিস রিকি। আর আমরা যদি তোর পরিবার হই তাহলে আমাদের সাথে সেলিব্রেট কর আজকের দিনটা। তোর মামা তোর জন্য সক্কাল সক্কাল বাজারে গেলেন তোর প্রিয় জিনিস গুলো আনতে, আর তুই বলছিস বাড়িতে লাঞ্চ করবি না?”

“লক্ষ্মী মামীমা আমার রাগ করেনা। আমি ডিনারে তোমাদের রান্না সব ভালোমন্দ খাবো। রাত্রে তোমাদের সাথে সেলিব্রেট করি? এখন প্লিজ যেতে দাও। প্লিজ, আমাকে যেতেই হবে।”

মামীমা বা দিদান কেউ কোনো সাড়া দেয়না রিকিয়ার অনুরোধের। তাই রিকিয়া কাতর গলায় আবার বলে ওঠে, “কেন এরকম করছো? তোমরা তো সবই জানো!”

“দিদিভাই একটা কথা ছিলো।”

“কি দিদান?”

“দিদিভাই…”

দিদানকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয়না মামিমা, ইশারায় দিদানকে চুপ করতে বলে রিকিয়াকে বলেন, “ঠিক আছে তুই যা।”

রিকিয়া আনন্দে জড়িয়ে ধরে মামিমাকে।

“হাই মুকেশ আঙ্কল!”

“আরেহ রিকিয়া বেটি যে! কেমন আছো?”

“আমি ভালো আছি আঙ্কল, আপনি?”

“হামি ভি ঠিক আছি।”

“আচ্ছা আঙ্কল। আমার জন্য কোন টেবিলটা বুক আছে এবার?”

“তুমার জন্য! রিকি বেটা আজ কি তুমার বাডডে?”

“হ্যাঁ।” মুকেশ আংকেলের অভিব্যক্তি দেখে একটু অবাক হয় রিকিয়া, “কেন কি হয়েছে আঙ্কল?”

“বেটা এবার তো কোনো বুকিং হয়নি তুমাদের?”

“বুকিং হয়নি!” রিকিয়ার মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

“নাহ… আচ্ছা বেটা আমি বলি কি তুমি এখানেই ওয়েট কোরো। হতে পারে সে বিজি ছিলো খুব তাই প্রি বুকিং করাতে পারেনি।”

“হুম… হতে পারে… আচ্ছা আমি অপেক্ষা করছি।” মুখে কথা গুলো বললেও মনে সংশয় রয়েই যায়।

একটা ফাঁকা টেবিল দেখে বসে পড়ে রিকিয়া। ওর মনের মধ্যে চলতে থাকে ঝড়। কোনোবার তো এরকম হয়না, তবে এবার কেন হলো! একজন ওয়েটার এসে আচমকাই রিকিয়ার সামনে রেখে দেয় ওর প্রিয় পেস্ট্রির প্লেট আর জুসের গ্লাস। চমকে ওঠে রিকিয়া, ওর মনের মধ্যে বয়ে যায় একটা আনন্দের হিল্লোল। চোখের কোণটাও যেন খানিক আর্দ্র হয়, মুখে একগাল হাসি নিয়ে ঘুরে তাকায় ও। কিন্তু কোথায় সে! কেউ তো নেই! মুহূর্তের মধ্যে মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায় ওর, আশেপাশে তাকিয়ে ইতিউতি খুঁজতে থাকে তাকে। কিন্তু নাহ সে তো নেই।

ওয়েটার জিজ্ঞেস করে, “ম্যাম আপ ঠিক হো না?”

গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না রিকিয়ার, মাথাটা শুধু ওপর নিচে নেড়ে সম্মতি জানায়। ওয়েটারটাই আবার বলে, “হামারে স্যার নে আপকে লিয়ে ইয়ে ভেজা হ্যা। উনকি তরফ সে ইয়ে ট্রিট আপকে লিয়ে।”

রিকিয়া তাকায় মুকেশ আঙ্কলের দিকে। কোনো এক কাস্টমারের সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কিসব কথা বলছিলেন উনি, রিকিয়ার দিকে চোখ পড়তেই থাম্বস আপ দেখালেন।

“ম্যাম আজ আপকা বার্থডে হ্যা?” ওয়েটার জিজ্ঞেস করে।

“হুম।”

“হ্যাপি বার্থডে ম্যাম।” পান খাওয়া লালচে দাঁত গুলো বের করে শুভেচ্ছা জানায় লোকটা।

রিকিয়া ধন্যবাদ জানানোর চেষ্টা করে কিন্তু ওর গলার স্বর কেমন যেন জড়িয়ে যায়। সে কি তবে আসবে না! সে কি ভুলে গেলো তার পরিকে!

টলোমলো পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসে রিকিয়া। বেলা দুটো বেজে গেছে। নাহ সে আর আসবেনা রিকিয়া জানে। ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে জলে। এ অবস্থায় কিভাবে বাড়ি ফিরবে ও নিজেই জানেনা। মাথার ওপর সূর্যের ঝলকানিতে ওর চোখ যেন ধাঁধিয়ে আসে। লাভ নেই জেনেও নিজের মোবাইলটা তুলে একবার স্ক্রিনটাতে চোখ রাখে রিকিয়া। নাহ কিচ্ছু নেই, সব শূন্য। সে তো মোবাইল ব্যবহার করে না। মামিমা ইতিমধ্যে একবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন রিকিয়ার।

অটোতে ওঠার আগে শেষবারের মতো একবার ঘুরে তাকায় “চিলিজ” রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। এই রেস্টুরেন্টটাতেই আজ সাত বছর ধরে তার জন্মদিন পালন করে তার বাবা। “চিলিজ” এর মালিক মুকেশ ভাটিয়া বাবার স্কুলের বন্ধু। বাবা প্রত্যেক বছর রিকিয়ার জন্মদিনের আগে থাকতেই মুকেশ আঙ্কলকে ফোন করে সারাদিনের জন্য বুক করে রাখতেন একটা টেবিল, দিয়ে রাখতেন খাবারের অর্ডারও। সব খাবার হত রিকিয়ার পছন্দের। এখান থেকে বেরিয়ে ওরা যেতো কোনো পার্কে, সেখান থেকে কোনো একটা সিনেমা দেখে ডিনার সেরে ওকে মামাবাড়িতে দিয়ে আসতেন বাবা। নিজে কোনোদিনও ঢুকতেননা ভেতরে। কোর্ট অর্ডার দিয়েছিল মাসে একবার দেখা করার, কিন্তু মায়ের জিদে সেটা অলিখিত ভাবে হয়ে যায় বছরে একদিন। মায়ের যুক্তি ছিলো প্রত্যেক মাসে দেখা করলে রিকিয়ার কষ্ট বাড়বে, মন চঞ্চল হয়ে থাকবে, বাস্তবটাকে মেনে নিতে পারবে না। রিকিয়া ছোটো ছিলো, মা বাবার যুক্তি তর্ক বোঝার ক্ষমতা ওর ছিলো না। মাঝে মাঝে এখন ওর মনে হয় বাবা কেন মায়ের জেদ মেনে নিয়েছিলেন তখন! আর এখনই বা বাবা কেন মোবাইল ব্যবহার করেন না! কেন রিকিয়ার সাথে কথা বলেন না সারাবছর!

বাড়ির দরজায় অবশেষে যখন পা রাখে রিকিয়া তখন ওর শরীর জুড়ে হাজার মাইল পথ চলার ক্লান্তি, গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। হঠাৎ করে নাকে এসে ধাক্কা দেয় চিংড়ির মালাইকারীর গন্ধ। ডাইনিং টেবিলে থরে থরে সাজিয়ে রাখা ভালো মন্দ সব খাবার। রিকিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তবে কি মামিমা আর দিদা জানতেন যে বাবা আসবেন না; রিকিয়াকে ফিরে আসতে হবে সম্পূর্ণ একলা?

মৃদুমন্দ একটা মিউজিক চলছে হলটাতে। কেক কাটার পর্ব মিটতেই এখন সবাই ড্রিংক বা ডেজার্ট নিয়ে ছোটছোটো দল করে গল্পে মত্ত। কেউ বা হয়তো ব্যস্ত ব্যবসায়িক আলোচনায়। শ্রীনিবাস সেনগুপ্ত আর ওনার স্ত্রী বিভাবরী সেনগুপ্ত এক ভদ্রলোকের সাথে কিছু আলোচনায় মশগুল। ওদের থেকে অনেক দূরে একটা টেবিলের কোণে বসে থাকা রিকিয়ার কানে এসে পৌঁছায় না সে আলোচনার টুকরো। যাকে ঘিরে এত আনন্দ আয়োজন তার মুখ জুড়ে যে শুধুই আঁধার - সেদিকে নজর পড়ে না কারুর। নিজের জন্মদিনের পার্টিতে নিজেকেই সব চেয়ে বেশি অপাঙতেয় মনে হয় রিকিয়ার। এমন জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি তার জন্য হওয়া তো দূরের কথা এমন পার্টি রিকিয়া কোনোদিনও চোখেই দেখেনি। তার ওপর এটা আবার ছিলো সারপ্রাইজ পার্টি, এই পার্টিতে থ্রো করার প্ল্যান ছিল বলেই নাকি মা বা মিঃ সেনগুপ্ত কেউই রিকিয়াকে ওর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাননি। কিন্তু এতো আড়ম্বর, এতো আয়োজন কি রিকিয়া কোনোদিনও চেয়েছিল? এত দামি দামি গিফট কি কোনোদিনও ওর আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিলো? ও তো চেয়েছিল সামান্যই তবে কেন এতো এলাহী আয়োজন, এতো নামী দামি উপহারের ভিড়ে সেই সামান্য টুকুই কেউ এনে দিতে পারলো না ওকে! নাকি ওর চাওয়াটা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল? আর সেই মানুষটা… সে কি করে ভুলে গেল ওকে।

চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে রিকিয়ার, কোনোরকমে সামলাচ্ছে ও নিজেকে। ইচ্ছে করছে ছুট্টে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাউহাউ করে কাঁদে। কিন্তু উপায় নেই। সহসাই রিকিয়ার নজর চলে যায় হলের একপ্রান্তে যেখানে একটা রিভলভিং টুলের ওপর বসে রাহুল গোটা হলটায় চোখ ঘোরাচ্ছে, আর আপন মনেই হেসে চলছে। যথারীতি ওর হাতে ধরা মদের গ্লাস। রিকিয়া অবাক হয়ে যায়, ওর জন্মদিনের পার্টিতে এসেছে রাহুল! কিন্তু কেন?

একটা গ্লাস মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে রাহুল তুলে নেয় আরেকটা গ্লাস। মিঃ সেনগুপ্ত কি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না? নাকি এটাই ওদের ট্রেন্ড! কোনো কারণ ছিলো না তাও রিকিয়া উঠে যায় রাহুলের কাছে, ওর পাশের টুলটাতে বসে পড়ে। ওকে দেখে রাহুল প্রথমে একটু অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকায় তারপর একটা বাঁকা হাসি হেসে বলে, “ওহ হোয়াট আ সারপ্রাইজ! লুক দ্য বার্থডে গাল ইজ হেয়ার। ওহ মাই গড! হাউ লাকি আই এম…”

রাহুলের গলায় শ্লেষ স্পষ্ট। ওর মুখ থেকে ভেসে আসা মদের গন্ধে গাটা গুলিয়ে ওঠে রিকিয়ার। ও বুঝতে পারে অল্প অল্প নেশা হয়েছে ছেলেটার। রাহুল এবার ওর মুখটা রিকিয়ার আরও কাছে এনে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট হেয়ার?”

রিকিয়া জানেনা ও কেন উঠে এলো এই ছেলেটার কাছে, কেনই বা ওকে বাধা দিতে যাবে ও! তাও বলে ওঠে, “এত ড্রিংক কোরোনা, স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ।”

“হাঃ হাঃ হাঃ ডমিনেশন, ইউ ওয়ান্ট টু ডমিনেট… ইউ ওয়ান্ট টু ডমিনেট রাহুল সেনগুপ্তা… লুক রোমি… লুক এট দিস গার্ল...আই টোল্ড ইউ না? … ওহ রোমি ইজ নট হেয়ার… হোয়্যার ইজ রোমি?” নিজের মনেই বিড়বিড় করে যাচ্ছিল রাহুল, নেশা চড়ছে ওর।

“দাদা, তোমাকে ডমিনেট করার কোনো ইচ্ছে বা উদ্দ্যেশ্য আমার নেই। আমি শুধু সাবধান করতে চাই তোমায়, এই বয়েসে এতো ড্রিংক করলে তোমার শরীর ভেঙে পড়বে!”

“হোয়াট ডিড ইউ সে?” অনুসন্ধিৎসু গলায় জিজ্ঞেস করে রাহুল।

“শরীর ভেঙে পড়বে…” হতভম্ভ হয়ে জবাব দেয় রিকিয়া।

“নো… বিফোর ইট।”

“আমি তোমাকে ডমিনেট করতে চাই না…”

“নো… নো… নো… বিফোর দিস...”

“দাদা!”

“ইয়াহ… আমি তোমার দাদা টাদা নই। আমি শুধু রোমির দাদা… আমি আর কারুর কিছু নই…”

“তুমি এতো ভালো বাংলা বলো!”

“হুম… আমার ঠাম্মি শিখিয়েছিলেন, মমও ভালো বাংলা গান গাইতো। টেগোরস সংস… হার ফেভারিট…”

“তোমার মা কে খুব মিস করো তাই না?”

“মম… আমাদের একলা রেখে চলে গেল… ঠাম্মিও…”

“আন্টি কি করে মারা গেলেন?”

“ক্যানসার… লাংসে…”

“তোমার মম যে রোগে প্রাণ হারালেন তুমি সেই রোগটাই নিজের শরীরে আনার তোড়জোড় করছো!”

“ইয়াহ… ইন্টেলিজেন্ট ইউ আর…”

“তোমার কিছু হলে রোমির কি হবে?”

নড়েচড়ে বসে রাহুল, বোঝা যায় এই দিকটা সে কোনোদিনও ভেবে দেখেনি। রিকিয়া এতদিনে এটুকু বুঝেছে যে রাহুল আর যেমনই হোক রোমিকে ভীষণ ভালোবাসে, সে ভালোবাসায় খাদ নেই কোনো। বিড়বিড় করে কিসব যেন বলতে থাকে রাহুল নিজের মনে। তারপর হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে ওঠে, “তোমার ড্যাড কিভাবে মারা গেলেন?”

“আমার বাবা বেঁচে আছেন...আমার বাবা কেন মারা যেতে যাবেন!” রাহুলের প্রশ্নে আঁতকে উঠে একটু জোরেই কথা গুলো বলে ফেলে রিকিয়া। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোকজন অবাক হয়ে তাকায় ওদের দিকে। রিকিয়া অপ্রস্তুতে পড়ে যায়। রাহুল আস্তে করে বলে, “সরি… আই থট…”

“ইউ আর রং।”

“হুম… ডিভোর্স। কতো বড়ো ছিলে তুমি?”

“সাত।”

“হুমম। দেখা হয় তোমার ড্যাডের সাথে?”

আর নিজেকে সামলাতে পারেনা রিকিয়া, বহুক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা কষ্টটা এবার হুড়মুড় করে ওর চোখ দিয়ে ঝরে পড়তে থাকে। রাহুল নিজের হাতটা রাখে রিকিয়ার হাতে। রিকিয়া মুখ তুলে তাকায় রাহুলের দিকে। ওপরে লাগানো একটা নীলচে আলো এসে রাহুলের মুখে পড়ে ওকে কেমন যেন মায়াময় করে তুলেছিল। রিকিয়া তাকিয়ে থাকে রাহুলের চোখের দিকে। সে মদ খেয়ে নেশা করা ছেলেটাকে আজ কেমন যেন দেবদুতের মতো লাগছে, কিচ্ছুক্ষণ আগেও তো এমনটা লাগেনি!

আস্তে আস্তে আশেপাশের কোলাহল যেন স্তিমিত হতে থাকে রিকিয়ার কানে, একটা কোনো মৃদু যান্ত্রিক শব্দ ওর কানে একটানা বাজতে থাকে। নেশা ধরে যায় রিকিয়ার। আশেপাশের উজ্জ্বল আলো গুলোও যেন একটার পর একটা নিভতে থাকে, শুধু মাথার ওপর জ্বলে রয়ে যায় সেই নীল আলোটা। মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে রিকিয়া। ও জানেনা রাহুল ওর কথা শুনছে কিনা, তাও বলতে শুরু করে ওর সব কথা। এতবছর ধরে যেসব কথাগুলো ওর বুকে জমতে জমতে একটা শক্ত পাথরের পাহাড় তৈরি করেছিল সেই পাহাড়ের বুক চিরে হঠাৎ করেই আজ একটা ঝর্ণা নামে।

একের পর এক রিকিয়া বলে যেতে থাকে ওর জীবনের গল্প, কিছুটা অভিজ্ঞতা, কিছুটা শোনা। মা বাবার ভালোবেসে বিয়ে… বাবার ট্রেকিং এর শখ… ওদের সময় না দেওয়া… মা বাবার মধ্যে অশান্তি… কথা বন্ধ হওয়া… উভয় পক্ষেরই মধ্যস্থতায় অনীহা… দু পক্ষের লড়াই… জেতার মরিয়া প্রচেষ্টা… অতঃপর বিচ্ছেদ… সাত বছরের শিশুটাকে নিয়ে টানাটানি… এক্ষেত্রে একপক্ষের জয়… বিজয়ী পক্ষের চাপানো অলিখিত সন্ধি… হাজারটা দ্বন্দ্ব, বুকের মধ্যে তিলেতিলে জমিয়ে রাখা কষ্ট নিয়ে সেই সাত বছরের শিশুটার পনেরো বছরে পদার্পণ… তারপর সেই ধাক্কা… জীবনের সব থেকে প্রিয় মানুষটার কথা না রাখা…

রিকিয়া জানেনা রাহুল শুনছে কিনা তাও ও বলে যেতে থাকে একেরপর এক… সবকিছু।

সকালে দরজায় কেউ কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙে রিকিয়ার। দরজা খুলে অবাক হয়ে যায় ও। বিপরীত দিকে রাহুল দাঁড়িয়ে।

সে বলে, “একটা জায়গা যাবে আমার সাথে?”

কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না রিকিয়া। মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব এসে খোঁচা দিতে থাকে।

“কোথায় যাবো?”

“তোমার ড্যাড ট্রেকিং করতো বলেছিলে না?”

“হ্যাঁ, কেন?” বাবার উল্লেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে রিকিয়া।

“কোলকাতায় থাকেন তো?”

“হ্যাঁ।”

“ওকে লিশন, তুমি যেতে চাও কিনা জানিনা তবে আমার এক বন্ধু আছে সিদ্ধার্থ। ও বেঙ্গলি। ওর আঙ্কল কোলকাতায় থাকেন, ওনারও হবি ট্রেকিং। সো আই থিংক অজয় আঙ্কল তোমার ড্যাডকে চিনলেও চিনতে পারেন। আর অজয় আঙ্কল কালই এসেছেন সিদ্ধার্থদের বাড়ি। সো তোমার ড্যাডকে যদি ট্রেস করতে চাও… লুক কোনো গ্যারান্টি নেই, জাস্ট একটা ওয়াইল্ড গেস। সো ইফ ইউ ওয়ান্ট…”

একটা ঢোঁক গেলে রিকিয়া। রাহুলের সাথে বেরোনোটা নিরাপদ হবে কিনা ভেবে পায়না সে, আবার বাবার খোঁজ পাওয়ার এই সুযোগটাও মিস করতে ইচ্ছে করেনা। সেদিন চিলিজ থেকে মামাবাড়িতে ফেরার পর রিকিয়া এটুকু ভালো করে বুঝে গিয়েছিল যে তার বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে বাবার কোনো খোঁজ পাবেনা কোনোদিনই। ওরা মনে প্রানে চাইছেন রিকিয়া যেন ওর বাবার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যায়। তাই আজ দ্বিধাগ্রস্ত মনেই রাহুলকে সম্মতি জানায় রিকিয়া। এই সাতসকালে বেরিয়ে পড়ে দুজনে। বেরোবার সময় দেখে গেটের কাছে থাকা সিকিউরিটি গার্ড দুটো নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে ব্যস্ত। রাহুল ওদের দেখে বিড়বিড় করে বলে, “ভালোই হয়েছে ঘুমোচ্ছে, নয়তো হাজারটা প্রশ্ন করতো। সব ড্যাডের জন্য।”

রিকিয়া শুনে যায় কথা গুলো, প্রত্যুত্তর দেয়না। ওর মনে যেন এখন হাতুড়ি পিটছে কেউ।

প্রায় দেড় ঘন্টা লাগে সিদ্ধার্থদের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে। ফ্ল্যাটের ভেতরটায় ঢুকতেই রিকিয়ার মনে হয় যেন একটুকরো বাংলা এসে জুড়ে বসেছে এই চার দেওয়ালের মাঝে। এতো সকালে ওদের দেখে সাময়িক অবাক হলেও সিদ্ধার্থর মা আর ঠাকুমা আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি রাখেন না। ওনাদের আন্তরিকতার ছোঁয়ায় নিজের সব কষ্ট, সব অভিমান পাশে সরিয়ে রেখে রিকিয়ার মনে তৈরি হয়ে যায় এক ভালোবাসার আবেশ। ও বুঝতে পারে দিল্লিতে থেকেও এই মানুষগুলো নিজের স্বকীয়তাকে একেবারে বিসর্জন দিয়ে দেননি। সিদ্ধার্থকে দেখেও অবাক হয় রিকিয়া, ঠিক যেন রাহুলের বিপরীত, একটা নিপাট মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী ছেলে। কে জানে হয়তো রাহুলের মা ঠাকুমা বেঁচে থাকলে ওরও এতোটা অধঃপতন হতো না! তবে ছেলেটা যে আদপে খারাপ নয় তা আজকের ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে রিকিয়ার কাছে।

“হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান, কেমন আছো?” প্রশ্নটা করতে করতে যে মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালো বাবার মতো তাঁরও পেটানো শরীর দেখে রিকিয়া আন্দাজ করে নিলো ইনিই তবে সিদ্ধার্থর কাকু, অজয় বাবু। রিকিয়ার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তবে এই সেই মানুষ যে পারে তাকে তার বাবার খোঁজ এনে দিতে!

“আমি ভালো আছি আঙ্কল, আপনি কেমন আছেন।”

“আমিও ঠিকঠাক আছি। আরে ইয়াং লেডি, তোমায় তো ঠিক চিনলাম না?” ভদ্রলোকের নজর রিকিয়ার দিকে।

রিকিয়া কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই রাহুল বলে উঠলো, “ও রিকিয়া, আমার ফ্রেন্ড।”

মনে মনে হাসলো রিকিয়া। ও রাহুলকে দাদা বলে সম্বোধন করলেও রাহুল যে ওকে বোন বলে মেনে নিতে পারেনি তা স্পষ্ট হয়ে গেল ওর জবাবে। কিন্তু তাহলে রাহুল কেন করছে এসব! রিকিয়ার জন্য করুণা মাত্র!

রাহুল, সিদ্ধার্থ আর অজয়বাবু এরপর গল্পে মাতেন। স্পোর্টস থেকে শুরু করে পলিটিক্স কিছুই বাদ যায়না ওদের আলোচনায়, শুধু রিকিয়ার প্রসঙ্গটাই আর ওঠে না। থাকতে থাকতে কেমন যেন অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলো রিকিয়া। যতবার অজয় বাবুর দিকে তাকাচ্ছে ততবার ওর ইনটুইশন বলছে পারলে এই মানুষটাই পারবে ওকে ওর বাবার হদিশ এনে দিতে।

“এই দেখছিস এটাকে বলে কোকুন।” দুটো বাচ্চা এসে দাঁড়িয়েছে রিকিয়াদের কাছে। ওদের মুখের মধ্যে অসম্ভব মিল বলে দিচ্ছে বাচ্চা দুটো যমজ। সিদ্ধার্থ পরিচয় দেয় ওদের, “আমার দাদার দুই ছেলে।”

বাচ্চা দুটো রিকিয়াদের দিকে তাকিয়ে আবার মন দেয় নিজেদের আলোচনায়। দ্বিতীয় বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করে, “কোকুন কি?”

“এমা… তুই এতাও দানিস না!”

“না তো, কি লে?”

“কোকুনে ক্যাটপিলা থাকে। তারপর সেটা বাতাফ্লাই হয়ে দায়।” বিজ্ঞের মতো জানায় প্রথম বাচ্চাটি।

দ্বিতীয় বাচ্চাটা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “ও ও ও ও…”

ওদের কথা শুনে হেসে ফেলে রিকিয়া। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি একটা শুঁয়োপোকার গুটি। ও নিজের মনেই হেসে বলে, রাজধানী শহরের বুকেও তবে ঘরের দেওয়ালে গুটি বাঁধে শুঁয়োপোকা!

“আঙ্কল আপনি আকাশ সোম বলে কাউকে চেনেন? কলকাতাতেই থাকেন, আপনার মতো ট্রেকিং করা ওনার হবি…” খোশগল্পের মাঝে এমন হঠাৎ করে রাহুল প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় যে অন্য সকলের সাথে রিকিয়াও চমকে ওঠে।

অজয় বাবুর মুখটা মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। উনি কিছুটা অবাক হয়েই রাহুলকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি ওকে চিনলে কি করে?”

“সব বলবো আঙ্কল, আগে বলুন আপনি চেনেন কিনা!”

“চিনি… মানে চিনতাম। বছর দুয়েকের আলাপেই খুব কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো আমার।”

“চিনতাম…মানে! আপনার সাথে আর যোগাযোগ নেই?” কেমন একটা শঙ্কা মেশানো গলায় প্রশ্ন করে রিকিয়া।

রিকিয়ার গলার স্বরে পরিবর্তনটা বোধহয় অজয় বাবুর নজরে আসেনা, মাথাটা নিচু করে নেন তিনি। তারপর কেমন একটা ঘোর লাগা গলায় বলেন,

“বছর সাত আট আগে স্ত্রী এর সাথে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো। কেন হয়েছিলো সে কারণ অবশ্য জানা নেই আমার তবে ওদের একটা মেয়ে ছিলো। তার কাস্টাডি পায় ওর স্ত্রী। বছরে একটা দিন মেয়ের সাথে কাটানোর সুযোগ পেতো, মেয়ের জন্মদিনে। দুবছরের আলাপে দেখেছিলাম ওই দিনটার জন্য কেমন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো লোকটা। মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসতো, আদর করে ডাকতো ‘পরি’ বলে। কিন্তু…”

“কিন্তু কি?” রিকিয়ার প্রশ্ন।

“এ বছর…” গলা ধরে আসে অজয় বাবুর, “এবছর ওর শ্বাশুড়ি হঠাৎ করে একদিন ফোন করে বলে যে ওর বউ নাকি বিয়ে করছে আবার। মেয়েটাকে নিয়ে বিয়ের পর অন্য কোন স্টেটে চলে যাবে। ওর শ্বাশুড়ি এও বলেন মেয়েটার জীবন থেকে ও যেন সরে যায়, নয়তো মেয়েটা নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে পারবে না।”

“দিদান!” অস্ফুটে বলে ওঠে রিকিয়া, ওর গলা বুজে আসে। শেষমেষ দিদান এমনটা করতে পারলো! আর বাবা! তিনিই বা কেন কোন প্রতিবাদ করলেন না!

“আকাশ চাইলেই কোনো স্টেপ নিতে পারতো, কিন্তু লোকটা…” গলার স্বরটা ভারী হয়ে এলো অজয় বাবুর, “ফোনটা পাওয়ার পর খুব ভেঙে পড়েছিলো। আমরা সবাই তখন ক্লাবে ছিলাম যখন ওর ফোনটা আসে। ফোনটা রেখে খুব ভেঙে পড়েছিলো! খুব কনফিউসড ছিলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘অজয় দা আমার সাথে দেখা করলে আমার পরির ক্ষতি হবে!’ আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি, সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম শুধু…”

“তারপর?” জিজ্ঞেস করে সিদ্ধার্থ।

“সেদিনই ফেরার সময়… অন্যমনস্ক ছিলো তো খুব… বাইকটা কন্ট্রোল করতে পারেনি…”

ওই দীর্ঘদেহী অজয় বাবুর শরীরটা কেঁপে উঠলো সহসা। পাহাড়ের বুকে নিজের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়া মানুষটার ভেতরটা যে কতটা নরম হতে পারে তার প্রমান দিয়ে দিল ওঁর দু চোখ থেকে ঝরে পড়া দুটো জলের রেখা।

অজয় সরকারের কথা গুলো এতক্ষন মন দিয়ে শুনে যাচ্ছিল রাহুল। কাল সন্ধ্যের পার্টির পর থেকে ওর বারবার করে মনে হচ্ছিল এই উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটা হয়তো আদপে এতোটাও খারাপ না, সেও হয়তো পরিস্থিতির স্বীকার ওদেরই মতো। তাই রাহুল ভেবেছিল ওদের মা তো কোনোদিনও ফিরবেনা, যদি এই মেয়েটা ওর বাবাকে ফিরে পায় তাহলে সেই ভালো। এখানে এসে অজয় আংকেলের কাছে মেয়েটার বাবার খবর আছে জেনে আশায় বুক বেঁধেছিলো রাহুল, কিন্তু এই শেষটা শোনার জন্য বোধহয় রাহুলসহ প্রস্তুত ছিলো না কেউই।

রাহুলের হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে কান্না পেয়ে গেল; চোখের সামনে ভেসে উঠলো নববধূর সাজে সজ্জিত খাটের ওপর শোয়ানো ওর মায়ের নিথর দেহের ছবিটা। নিজের মনেই কাকে যেন ও জিজ্ঞেস করে উঠলো, “কেন?”

রাহুলের চোখ চলে গেল রিকিয়ার দিকে। তিরতির করে কাঁপছে সে। রাহুল ডেকে উঠলো, “রিকিয়া…”

রাহুলের ডাকে কিনা কে জানে একবার খুব জোরে কেঁপে উঠলো রিকিয়ার শরীরটা তারপর দুদিকে জোরে জোরে মাথা নেড়ে চিৎকার করে, “না না,” বলতে বলতে এক ছুটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েটা, ওর ধাক্কায় কাঁচের সেন্টার টেবিলটা উল্টে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। কাঁচের একটা টুকরো এসে বিদ্ধ করলো রাহুলের পা, চলকে পড়লো রক্ত। ভ্রূক্ষেপ করলো না রাহুল… ছুটলো রিকিয়ার পেছন পেছন…

মেন রাস্তার ওপর ক্যাঁচ করে একটা গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ... তারপরেই শুরু হলো লোকেজনের ছোটাছুটি, চিৎকার চেঁচামেচি… রাস্তায় পড়ে থাকা দেহটা থেকে চারিপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো রক্ত…

১০

“আপ মে সে কিসিনে নেহি দেখা ও কাঁহা গেয়ী?”

“নেহি মেমসাহাব। ম্যায় জব রিকিয়া মেম সাহাব কে কামরে মে গ্যায়ি ও নেহি থি। ম্যায়নে সোচা কে টয়লেট মে হোগি পর…”

“কোথায় গেল আমার মেয়েটা! এখানে তো কিচ্ছু চেনেনা, ফোনও ধরছে না। হে ভগবান…”

উত্তেজনায় বিভাবরী ভুলে গেলেন এখানের যারা কাজ করে তারা বাংলা বোঝে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তে, বড্ড একলা লাগছিলো। এখানে আসার পর কোম্পানির কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে রিকিয়াকে সেভাবে সময়ই দিতে পারেননি। নিজের উন্নত কেরিয়ারের হাতছানিতে ভুলেই গিয়েছিলেন অন্য সব কথা। আজ সকাল থেকে মেয়েটাকে না পেয়ে এখন মরমে মরে যাচ্ছেন তিনি। তিনি ছাড়া মেয়েটার তো আর কেউ ছিলো না। আকাশ তো বছরে ওই একটাদিন এসেই তার দায়িত্ব সেরে দিতো। কিন্তু তাও মেয়েটা যেন সারাবছর মুখিয়ে থাকতো ওই একটা দিনের জন্য। সারা বছর তো ঠিক করে বোধহয় হাসতও না। আচ্ছা তিনি যে এতো কষ্ট করে সারাবছর মেয়েটাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে যেতেন তার কি কোনো মূল্য ছিল না! আকাশই কি রিকিয়ার কাছে সব কিছু ছিলো? নাকি মেয়েটা তাঁকেও ভালোবাসতো গভীরভাবে। এখানে এসে তাঁকে কাছে না পেয়েই কি মেয়েটা অভিমান করে চলে গেল কোথায়!

ডুকরে কেঁদে উঠলেন বিভাবরী। মোবাইলটা তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন তাঁর প্রাক্তন স্বামী আকাশের নম্বরটা। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল, আকাশ ধরলো না। রিকিয়া জানেই না তার বাবাও মোবাইল ইউজ করে। ওকে বলা হয়েছে ওর বাবা ফোন ব্যবহার করে না। আচ্ছা বিভাবরী তো এত শর্ত চাপিয়ে গেছেন আকাশের ওপর তাও আকাশ কোনদিনও প্রতিবাদ করেনি কেন! মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছে। কেন? শুধুই কি রিকিয়ার ভালো হবে ভেবে! আকাশ কি কোনোদিন তাঁকে ভালোবাসেনি? তিনিও কি ভালবাসেননি ওই লোকটাকে? শুধু মনোমালিন্য আর কথাকাটাকাটি কি সব ভালোবাসা শেষ করে দিয়েছিলো! বিচ্ছেদটা আটকানোর কি কোনো উপায় ছিলো না? তিনি কি পারতেন না আর একটু সহনশীল হতে? আকাশ কি পারতোনা নিজের শখটাকে একটু দমন করে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করতে? তাঁরা আলাদা না হলে আর কিছু হোক না হোক তাঁদের মেয়েটা হয়তো এতটা ইন্ট্রোভার্ট, এতটা একগুঁয়ে হতো না। মেয়েটা হয়তো প্রাণ খুলে হাসতে শিখত।

“তুমি যাকে ভালোবাসো স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো…” মুঠোফোনের ঝংকার শুনে চোখ মুছলেন বিভাবরী দেবী। মায়ের ফোন।

“হ্যালো।”

“কি রে তোর গলাটা এমন লাগছে কেন?”

“কিছু না। আচ্ছা মা আকাশের সাথে এবার রিকির দেখা হয়েছিলো?” কান্না ভেজা গলায় অকারণেই প্রশ্নটা করে ফেললেন বিভাবরী।

“বিভু তোকে একটা কথা বলা হয়নি… একটা খারাপ খবর ছিল।” ঢোঁক গিলে কথাটা বললেন বিভাবরীর মা।

“কি?”

“বিভু আকাশ আর নেই রে। তোরা দিল্লি যাওয়ার পরে পরেই একদিন বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ওর এক কলিগ ফোন করে খবরটা জানায়। তুই তোর নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলিস ওই সময় তাই আর এই অশুভ খবরটা দিইনি। শোন না দিদিভাইকে আমরা কিছু জানায়নি, শুধু শুধু কষ্ট পাবে বলে। ও ভেবেছে আকাশ কোনোকারণে আসেনি ওর সাথে দেখা করতে, খুব অভিমান হয়েছে ওর আকাশের ওপরে।

হ্যালো বিভু শুনছিস? হ্যালো… হ্যালো…”

হাত থেকে ফোনটা ফসকে নীচে পড়ে যায় বিভাবরীর। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারেননা, গলার কাছে শক্ত কিছু একটা যেন আটকে যায়।

আকাশ… আকাশ… যে মানুষটাকে একদিন ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন তার সাথে… যে মানুষটার সাথে হাত ধরে দিনের পর দিন পাড়ি জমিয়েছিলেন কতো নির্জন পথে… যে মানুষটার বুকে মাথা রেখে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন কত সূর্যোদয়… সূর্যাস্ত… যে মানুষটা তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার, রিকিয়া… সেই মানুষটা আর নেই!

আকাশ… আকাশ… রিকি… রিকি....

১১

বীভৎস এক্সিডেন্টের দৃশ্যটা দেখে সহসাই থমকে দাঁড়ায় রিকিয়া। ওর বুকের ওঠা নামা আরও বেড়ে যায়। রিকিয়াকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে রাহুলেরও গতি শ্লথ হয়। ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাঁচ বছর আগেকার একটা দৃশ্য। মায়ের মৃতদেহের সামনে তখন লোকজনের ভিড়, সবার মুখে সান্ত্বনা বাক্য… কোনোটা সহজাত আবার কোনোটা বা কৃত্রিম। এরই মাঝে কোনো এক কাজের লোক হাত ধরে ওই ঘরে নিয়ে আসে রাহুলের ছোট্ট বোনটাকে। সাত বছরের মনটা পারেনি এই দৃশ্যটা সহ্য করতে… ছুট লাগিয়ে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল ছোট্ট শরীরটা। রাজধানী শহরের ব্যস্ত রাস্তা… রক্তে ভেসে গিয়েছিলো চারিপাশ… প্রায় সাত আট মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর বাড়ি এসেছিল রোমি, সঙ্গী ছিল একটা কৃত্রিম পা।

সেদিন রাহুল পারেনি ওর বোনটাকে রক্ষা করতে কিন্তু আজ আর না… দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে হাত রাখে রিকিয়ার কাঁধে। দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে পেছন ফিরে তাকায় রিকিয়া, অবাক হয়ে চেয়ে থাকে রাহুলের মুখের দিকে। রাহুল বলে, “কষ্ট পাসনা বোন, আমি তো আছি, তোর দাদা…সব ঠিক করে দেব আমি…” রাহুলের গলার স্বরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, সেই সাথে যেন এক পরম আশ্বাসের অনুভূতি।

রাহুলের বুকে মাথা রাখে রিকিয়া, দুহাত দিয়ে রিকিয়াকে ঘিরে ধরে রাহুল। রোমির অদৃশ্য দেহটা সুদ্ধ ওদের দুজনের দেহটাকে ঘিরে তৈরি করে ফেলে একটা কোকুন; যার থেকে একদিন সব কাঁটা ঝরিয়ে প্রজাপতি ডানা ঠিক মিলবেই...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama