তৃষিত তিতাস (পর্ব ৪)
তৃষিত তিতাস (পর্ব ৪)
মঙ্গরগঞ্জ, উত্তরবঙ্গ :
-----------------------------
উজানও হিয়াকে নমস্কার ফিরিয়ে দেয়... হিয়া উজানের হাতে Sanitizer দেবার পর PPE এগিয়ে দেয়... পড়তেও সাহায্য করে.... একটা উদ্ভূত অনুভূতি হতে থাকে উজানের... রুক্মিণী যেন ওর আশে-পাশেই আছে... খুব... খুব... খুব কাছে...
উজান : একটা কথা জিজ্ঞেস করব !!!
হিয়া : হ্যাঁ !! করুন না...
চমকে ওঠে উজান... এ কিইইই !!! কার গলা শুনছে উজান !!! হিয়ার চোখের দিকে তাকায় উজান... সেই চোখ... এই চোখ উজান ভুলবে কি করে !!
প্রথমদিকে শুধু রায়বাহাদুরের মেয়ে বলে কম অপমান তো করে নি, চোখ একটা যন্ত্রণার ছায়া খেলে যেত শুধু... ধীরে ধীরে বহু বিপদে এই চোখদুটোই তার আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল... খালি মজা করে বলতো, দেশ স্বাধীন করা ছাড়া আমার আর একটাই ইচ্ছে- মরতে হলে তোমার কোলেই যেন আমি মরি... আর হলোও তাই... অন্তিম সময় ওর ওই চোখের জল... এই দু'চোখ ভরেই তো দেখে নিয়েছিল উজানকে...
এই চোখদুটো দেখার পর ঝাঁকে ঝাঁকে স্মৃতি ভিড় করে আসতে থাকে উজানের দিকে... এতদিন এই চোখদুটোকেই খুঁজেছে উজান, আজ তাকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না উজান.... মাথা ঘুরে টলে পড়লে হিয়া দৌড়ে এসে ধরে ফেলে উজানকে... হিয়ার আলিঙ্গনে সময় যেন থমকে যায় উজানের জন্য... সেই কবে, কত জন্ম পূর্বে যেন একদম অন্তিম মূহুর্তে এইভাবে কাছাকাছি এসেছিল তারা... ঘোর লাগা বড় বড় চোখে উজান দেখতে থাকে হিয়ার চোখ... হিয়াও অসীম বিস্মিয়ে উজানকে দেখতে থাকে কিন্তু তারপর টাল সামলাতে না পেরে উজানসমেত মাটিতে বসে পড়ে....
হিয়া : স্যার !!! আপনি ঠিক আছেন !! জল খাবেন !!
উজান : রুউউউউউ.... রুক্মিণীইইইই....
চমকে ওঠে হিয়া !!! এই ডাকটা... এই ডাকটা সে অনেকবার শুনেছে- যেন জন্মের ওপার থেকে ডাকটা আসে... মনের ভেতরটা তোলপাড় করে দিত হিয়ার- যেন কোথায় একটা অচ্ছেদ্য বন্ধন বুনন করা আছে... যেন এই একটা ডাকেরই অপেক্ষা করে আছে সে... আগে মনের ভুল ভেবে নিজেকে সামলে নিত.... কিন্তু আজ পারছে না... কেমন করে অসহায় আকুলতা নিয়ে, অন্তর উজার করা ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটা তার দিকে.... এত্ত ভালোবাসার আহ্বান হিয়া অস্বীকার করবে কি করে !!! না... না... ভুলটা হিয়ার ... এনাকে তো ডক্টর উজান চ্যাটার্জি বলেই চেনে হিয়া, বিশ্বের প্রথম পাঁচজন ডক্টরের মধ্যে অন্যতম...
উজান : তু... তু... তুমি রুক্মিণী !!! (কাঁপা কাঁপা হাত নিজের বুকের উপর রেখে) আমার... আমার রুক্মিণী !!!
হিয়া : না স্যার... আমি হিয়া...
উজান : (একটু হেসে) আমার... আমার আগের রাগগুলোর শোধ তুলছো বুঝি !!! এখনো রাগগুলো মনের ভেতর পুষে রেখেছো !! আহহহ !!! (যন্ত্রণায় মাথার রগটা চেপে ধরে)
হিয়া : Delirium !!! ওনার কি High Altitude Illness হলো !!! স্যার !! স্যার !! জল খাবেন !!!
উজান : (ধমকের সুরে) তোমার জল তুমি খাও... Idiot... 😬
হিয়া : (মনে মনে) আমি তো জলই খেতে বললাম... আর তো কিছু ভুলভাল বলি নি... শুনেছিলাম, বড় বড় ডক্টর ভীষন Moody হয়.... একে সামলাবো কি করে !! না হিয়া... এখানকার গরীব মানুষগুলোর জন্য তোকে এটা পারতেই হবে... একটা জোরে শ্বাস নে... (জোরে শ্বাস নিয়ে)... হ্যাঁ... এবার লেগে পড়....
উজান : (হাঁপাতে হাঁপাতে) কি হলো !!! রাগ হলো বুঝি!!!
হিয়া : (অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে) আমার রাগ হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করছে !!! এত কম বয়সে এত সাফল্য... পড়াশোনা করতে করতে মাথাটা কি এই বয়সেই গেছে নাকি !!!
উজান : কি হলো !!!
হিয়া : অ্যাঁ... নাহহহ... রাগ করব কেন !! আপনি জলটা খান !!! একটু ভালো লাগবে...
হিয়া উজানকে জল খাওয়ায়... হাত দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দেয়... কিন্তু দেখে উজানের জ্বর আসছে... কপালে হাত দিয়েও দেখে একবার...
উজান : কত... কতদিন পর দেখলাম তোমাকে !!
হিয়া : আপনার তো ধুম জ্বর স্যার... আপনি চলুন... ক্যাম্পে চলুন.... ঠান্ডা হাওয়াটা বোধহয় সহ্য হয় নি... জ্বরের ঘোরেই তাহলে ভুল বকছিল... আমার মতো 🤭....
উজান : রুউউউউ... আবার আমাকে ছেড়ে যাবে না বলো... আমাকে... আমাকে তো কখনো ফেরাও নি তুমি... বলো... সেদিনের মতো আমাকে একা ছেড়ে চলে যাবে না... সেদিনের তোমার বীরুর পরিণতি তো তুমি দেখো নি... তোমার সাথে সাথে তোমার বীরুও সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল... আমরা একসাথে এক আগুনে...
হিয়া : স্যার... আপনি কি বলছেন !! আমি কিছু বুঝতে পারছি না.... কোথায় আগুন !!! রুক্মিণী বোধহয় আপনার খুব কাছের কেউ, তাই না স্যার... বোধহয়... বোধহয় ভালোবাসার মানুষ... কিন্তু এই নামগুলো আমার এত চেনা লাগছে কেন !!! কেন মনে হচ্ছে কোথাও আমার সাথেও...
উজান : রুউউউউউউ....
উজান হিয়ার কোলে ঢলে পড়ে জ্ঞান হারায়... হিয়া আঁকড়ে ধরে উজানকে... ইতস্ততঃ কাঁপা কাঁপা হাতে উজানের গাল ছোঁয়... হিয়ার বুকের ভেতরটা এমন তোলপাড় হচ্ছে কেন !!! যেন খুব আপন কেউ... খুব মন দিয়ে দেখে হিয়া উজানকে... নাহহহ.. কিছু মনে পড়ছে না, কিন্তু অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠছে... চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল টুপটুপ করে উজানের গালে এসে পড়ে.... নিজের চোখের জল আর উজানের গালের মুছিয়ে নিজেকে সামলে নেয় হিয়া...
হিয়া : পেমাদা, একটা স্ট্রেচার নিয়ে এসো... স্যারকে নিয়ে যেতে হবে...
মেডিকেল ক্যাম্প :
--------------------------
পৃথা : কেমন দেখলে হিয়া !! High Altitude Illness !!
হিয়া : না পৃথাদি... oxygen intake, pulse rate ঠিকই আছে... খালি Temperature আর BP টা একটু বেশি... মনে হয়, Nerval Breakdown... কাজের খুব চাপ নিয়ে ফেলেছেন... টানাপোড়েনটা সহ্য হয় নি... ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিছু করেন না... ওনার বাবা-মা ঠিক করে খেয়াল রাখে না ওনার !!!
পৃথা : আরে বুঝিস তো... বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপার... তুই রাতে ওনার কাছে থাকবি তো !!!
হিয়া : হ্যাঁ, আমি থাকি... তুমি যাবার সময় বাবাকে একটু বলে যেও... আজ রাতে ওনার কাছে কারুর থাকার দরকার আছে... টিউলিপ থেকে মেডিকেল টিম তো কাল আসবে... উনি Lead করবেন বলে, আজ এসেছিলেন... এসেই কেমন বিপদ ঘটালেন !!! (উজানের কপালে হাত দিয়ে) আজ রাতে জ্বরটা যাতে আর না আসে, সেটা দেখতে হবে... ওষুধ দিতে হবে....
পৃথা : আচ্ছা... আমি তাহলে আসছি... সাবধানে থাকিস... কাকু তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করে রে...
(মনে মনে) তোকে এখানে একা রেখে আমারও তো যেতে ভয় করছে রে হিয়া... প্রায় প্রতি রাতে তুই অন্য মানুষ হয়ে যাস... যেন এই জগতের সাথে তোর কোনো সম্পর্কই নেই... সম্পূর্ণ অন্য জগতের একটা মানুষ... কাকু কত আগলে রাখে তোকে...
হিয়া : কি গো পৃথা দি !!!
পৃথা : কিছু না... কিছু না... চল... এলাম...
হিয়া পৃথার সাথে একটু এগোবে করে সামনে এগোতেই ওড়নায় টান পড়ে...
উজান : Please যেও না... আহহহহ... আমায় ছেড়ে যেও না... ছেড়ে যেও না Please... আহহহ... আগেরবার চলে গেলে আমাকে ছেড়ে, আর না... আর না plz... তুমি যেও না... ছেড়ে যেও না Please...
হিয়া : জ্বরের ঘোরে ভুল বকে যাচ্ছে তখন থেকে.... কাকে ভেবে বলছে কে জানে !!! নিশ্চয়ই খুব আপন কাউকে...
হিয়া উজানের মাথায় হাত বুলিয়ে জলপট্টি দিতে দিতে একটু সরতে গেলে উজান এবার হিয়ার হাত ধরে নিজের বুকের চেপে ধরে... জ্বরের ঘোরে বেশ শক্ত করেই ধরে... হিয়া এমনিতেই ভীষণ আবেগী, অনুভূতিপ্রবণ মনের মেয়ে... উজানের অন্তরের বেদনা, যন্ত্রণা, অসহায়তা সব যেন উজানের স্পর্শের মধ্যে দিয়ে হিয়ার শিরা-ধমনী বেয়ে হৃদয়কে স্পর্শ করতে থাকলো... যেন খুব চেনা একটা গানের সুর কিংবা একটা মেঠো বাঁশি সুর দূর থেকে ভেসে আসছে... ভীষণ চেনা, কিন্তু গাওয়া যাচ্ছে না... ভীষণ আপন কারুর স্পর্শ, অনুভব করা যাচ্ছে কিন্তু মনে পড়ছে না....
উজান : রুক্মিণীইইইইইইইই....
হিয়া : স্যার, আমি হিয়াআআআআ... আমাকে একটু যেতে হবে স্যার...
উজান : তুমি যাবে না- আমি জানি... যেও না রুক্মিণী... কতবার... কতবার অভিমান করে 'চলে যাব' 'চলে যাব' বলেও চলে যাও নি তুমি... আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না... তুমি... তুমি তো অন্যদের মতো নও... কথা দাও রুক্মিণী... আমাকে ছেড়ে, আবার একা করে দিয়ে যাবে না... আর হারিয়ে যাবে না...
হিয়া : জ্বরের ঘোরে আছেন, তাই এইসব কথা বলছেন... নয়তো আমি আপনার কে !! আর আমি হিয়া... আপনার রুক্মিণী নই...
হিয়া উজানের খুব কাছে সরে এসে উজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
হিয়া : ঘুমান স্যার... কাল সকালে হয়তো আপনার বলা একটা কথাও আপনার মনে থাকবে না... আমি আছি তো... সব ঠিক হয়ে যাবে... আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন... এত কথা বলবেন না.... আপনার রেস্ট-এর বড্ড দরকার যে....
হিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলে উজান আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে... রাত বাড়ে... আবার ওই পোড়ো বাড়িটা হিয়াকে আহ্বান দিয়ে ডাকতে থাকে... হিয়ার মাথাটা যন্ত্রণা করতে শুরু করে.... বদলে যেতে থাকে হিয়া, যেন এক হিয়ার মধ্যে এ এক অন্য হিয়া... এই হিয়াকে সে নিজেও চেনে না, হয়তো বা জানেও না এই হিয়ার অস্তিত্ব... মাথার যন্ত্রণায় উজানের ধরে থাকা হাতেই উজানের বুকের জামা আঁকড়ে ধরে হিয়া... হিয়া এক হাতেই ওর ডায়েরিটা বার করে লেখে,
'অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবী-দাওয়া...
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া...
মূহুর্ত যায় জন্মের মতো অন্ধ জাতিস্মর...
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃত অক্ষর...
জন্মেছি আমি আগেও, আবার মরেছি তোমারই কোলে
মুক্তি পাই নি শুধু তোমাকে আবার দেখবো বলে...'
(কলমে : শুভজিৎ দে)
নাহহহ... আর ওই পোড়ো বাড়িটার আহ্বান অস্বীকার করতে পারে না হিয়া.... টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়... এগোতে যায় অন্ধকারের দিকে... কিন্তু বাঁধা পায় উজানের ধরা হাতে... টান পড়ে দুজনের মধ্যে... জ্বরের ঘোরের মধ্যেই উজান আরো শক্ত করে টেনে ধরে হিয়ার হাত... আছড়ে পড়ে হিয়া উজানের বুকে... উজানের বুকেই জ্ঞান হারায়...