Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Drama

3  

Debdutta Banerjee

Drama

এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

6 mins
1.5K



আমার জীবনে প্রথম ভালবাসা আমার গান আর গানের স‍্যার। এ এক অন‍্য রকম ভালবাসা। মায়ের গানের গলাটা ছিল ভারী মিষ্টি। শুনেছিলাম মা এর গান শুনেই বাবা মা কে বিয়ে করেছিলেন। বাবার কথা আমার মনে নেই, খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে মামা বাড়িতে এসে মামা মামিদের দয়ায় মানুষ হচ্ছিলাম। বাবার সাথে সাথে মায়ের গানও হারিয়ে গেছিল। সব কাজের শেষে আমায় ঘুম পাড়াতে এসে কখনো কখনো মা গুনগুনিয়ে উঠতো। আর যেদিন কেউ বাড়ি থাকত না, সেদিন আমাদের বারান্দার ছোট্ট ঘরে বাবার ফটোর সামনে ধুপ জ্বালিয়ে মাকে গাইতে শুনেছি


-" দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে........"


খালি গলায় মা এর সেই গান ধুপের গন্ধে মিশে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করত। আমি অবাক হয়ে শুনতাম শুধু। মামা মামিরা থাকলে মা কখনো গাইত না।


কি ভাবে যেন আমিও গান ভালবেসে ফেলেছিলাম। মামাতো দিদিরাও গান গাইত, গান শিখাতে আসতেন একজন, সে সব আধুনিক গান, সিনেমার গান । আমার কিন্তু সে সব ভাল লাগত না। মা এর কাছ থেকে শুনে শুনে দুটো গান শিখেছিলাম, ক্লান্ত শরীরে আমায় ঘুম পাড়াতে এসে মা গাইত


-" ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু......" অথবা


"শ্রাবণের ধারার মতো পরুক ঝরে...."


আমার কচি গলায় এ গান শুনে অনেকেই মাকে বলেছিলেন আমায় গান শেখাতে। মা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে পালিয়ে যেতো। সেবার পঁচিশে বৈশাখে পাড়ার অনুষ্ঠানে আমি গেয়েছিলাম মা এর থেকে শেখা এই গান দুটো। খালি গলায় সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল আমার সে গান। গানের শেষে একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে আমায় বলেছিলেন


-"এ গান তুমি কোথায় শিখেছ ? তোমার মা বাবা কোথায় ?" কাঁচাপাকা বড় বড় চুল দাড়ি, ধুতি পাঞ্জাবি পড়া বয়স্ক লোকটাকে দেখে একটু ভয় পেয়েছিলাম। 


পাশের বাড়ির রবীন মামা এগিয়ে এসে বলেছিলেন


-" এ আমাদের অলকার মেয়ে, রিমলী। যে অলকাকে তুমি গান শেখাতে।ও তো বিধবা হয়ে ভাইদের কাছে ফিরে এসেছে।" আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম ওনাকে। তবে যে মা বলত ঐ ফটোর সাদা চুল দাড়ি ওয়ালা রবিঠাকুর মায়ের গুরুদেব!!  


উনি বলেছিলেন


-" অলকার মেয়ে!! তাই অলকার মতো গলাও পেয়েছে।" আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন


-" তুই গান শিখবি আমার কাছে ?আমি তোকে শেখাবো।"


-"মা কে জিজ্ঞেস করে বলব।" বলে একছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। উনিও পিছন পিছন এসেছিলেন। সবাই জলসায় গেছিল , ফাঁকা বাড়িতে মা সেদিন বাবার ফটোর সামনে বসে একা গাইছিল


-" আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে....." মন্ত্রমুগ্ধের মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা দুই অসম বয়সী সে গান শুনেছিলাম। গান শেষ হতেই স‍্যার মাকে ডেকে বলেছিলেন


-" তোর মেয়েটা আমায় দে অলকা, ওকে মনের মতো করে তৈরি করবো আমি।" 


মায়ের দু চোখে নেমেছিল জলের ধারা।


এরপর আমার তালিম শুরু হয়েছিল স‍্যারের কাছে। বিনা পারিশ্রমিকেই আমায় গান শেখাতেন উনি। মামাদের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করে আমি লড়াই চালিয়ে গেছিলাম। বাড়িতে মা এর একটা ভাঙ্গা হারমোনিয়াম ছিল। কিন্তু গলা সাধার পার্মিশন ছিল না। সবার অসুবিধা হতো। তাই আমার বেশির ভাগ সময় কাটতো স‍্যারের বাড়ি। অকৃতদার গান পাগল মানুষটা আমায় পিতৃ-স্নেহে ভালবাসতেন। পড়াশোনায় ফাঁকে গানই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু, আমার প্রথম ভালবাসা। আর গানের সাথেই জড়িয়ে ছিলেন আমার স‍্যার আর গুরুদেব।


অবশেষে স‍্যারের চেষ্টাতেই আমি রবীন্দ্র-ভারতীতে গান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম।গুরুদেবের হাত ছিল আমার মাথায়।ওনার গানের মাঝে আমি হারিয়ে যেতাম , আবার নিজেকে খুঁজে পেতাম। উপলব্ধি করেছিলাম আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে উনিই আছেন হৃদয় জুড়ে। 


রেডিওতে গান গাইতাম, জলসার জন্য ডাক পেতাম।সফলতার হাত ধরেই আমার জীবনে এসেছিল অনীশ। আমাকে এবং আমার গানকে ভালবেসে আপন করে নিতে চেয়েছিল। আমার হৃদয়ে ঘর বেঁধেছিল ধীরে ধীরে। ওর রঙে রাঙিয়ে উঠেছিলাম আমি। দোলা লেগেছিল প্রাণে মনে। অবশেষে স‍্যারের আর মায়ের আশীর্বাদে ওর সাথেই খেলাঘর বেঁধেছিলাম। অনীশ বদলী হয়ে গেছিল গোয়ায়। বাধ্য হয়ে আমাকেও চলে যেতে হয়েছিল। স‍্যারকে কথা দিয়েছিলাম গান কখনো ছাড়বো না। যে কোনো পরিস্থিতিতেই গান আমার সঙ্গে থাকবে। মাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। ওখানে আমার নিজের ভাড়া বাড়িতে গুরুদেবের ফটোর পাশে বাবার ফটো রেখেছিলাম সাজিয়ে। রোজ সন্ধ্যায় ধুপ জ্বালিয়ে আমরা মা আর মেয়ে গান গাইতে বসতাম। মা এতো বছর লড়াই করে ভিতর ভিতর ক্ষয়ে গেছিল। গান আর গাইতে পারতো না। একদিন ঘুমের ভিতর মা চিরবিদায় নিয়ে গানের ওপারে চলে গেছিল। মার মুখে ছড়িয়ে পরেছিল একটা স্নিগ্ধ প্রশান্তি। বোধহয় গুরুদেবের দেখা পেয়েছিল ওপারে গিয়ে।


আস্তে আস্তে আমিও সংসারে জড়িয়ে গানের থেকে দুরে চলে যাচ্ছিলাম। গোয়াতে এই বাংলা গানের কদর ছিল না তাই কথা রাখতে পারি নি। 


আমার মেয়েটির গানের প্রতি ঝোঁক ছিল জন্মগত। দাদুর পাশে গুরুদেবের ফটো দেখে দুজনকেই দাদাই ডাকতো। গোয়ায় ভাষা-গত অসুবিধায় মেয়ের পূর্ণ বিকাশ হচ্ছিল না বলে আট বছরের মেয়ে নিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম আবার শেকড়ের টানে। অনীশ চাকরী বদলে নিয়েছিল। এসেই স‍্যারের খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু উনি বাড়ি বদলে চলে গেছিলেন। পাগলের মতো খুঁজে ফিরেছিলাম ওনাকে। কিন্তু কেউ বলতে পারেনি উনি কোথায়!!


নেট থেকে খুঁজে পুরানো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে , এলাকার সব গানের স্কুল ঘুরে খুঁজে খুঁজে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। বারান্দায় বসে ছিলাম।


অপটু হাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমার মেয়ে গাইছিল


-"যার লাগি ফিরি একা একা, আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা, তারি বাঁশি, ওগো তারি বাঁশি....."


আমি চমকে উঠেছিলাম। এ গান ও কোথায় শিখল !! আমি তো কখনো শেখাই নি ওকে!!  ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম -" এ গান তুই কোথায় শিখলি ? আমি তো শেখাই নি।"


ও হাত তুলে আমায় গুরুদেবের ফটো দেখাল। -"ঐ দাদাই শিখিয়েছে।"


তিতান কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ও কি বলতে চাইছে না বুঝেই বললাম


-" এটা ওনার গান আমি জানি। তোকে কে শেখাল? আমি তো তোর সামনে গাই নি কখনো এই গান!!"


-" বললাম তো ঐ দাদাইটা শিখিয়েছে।"


ও আবার গান গাইতে শুরু করেছিল। বললাম


-" তা দাদাই এর সাথে কোথায় দেখা হল তোর?"


-" কেন পার্কের ওধারে যে মন্দিরটা ওখানেই থাকে দাদাই। আমি রোজ যাই তো। "


-" আমাকে আজ নিয়ে যাবি ?" আমি বুঝলাম কারো সাথে বন্ধুত্ব করে এসেছে ও। বাড়ির সামনেই একটা পার্ক আর মন্দির ছিল। সন্ধ্যায় ঠাকুরের গান হতো ওখানে। বিকেলে পাড়ার বাচ্চাদের সাথে তিতান খেলতে যেত ওখানে।


বিকেলে ওর হাত ধরে সেদিন মন্দিরে গেলাম। এক সাদা চুল দাড়িতে ঢাকা বৃদ্ধকে দেখিয়ে দিল মেয়ে। আপন মনে সুরের মায়াজাল বুনে চলেছেন তিনি। গলাটা আমার ভীষণ চেনা, গত দশ বছরেও পরিবর্তন হয়নি কিছুই।উনি বিভোর হয়ে গাইছিলেন


-" যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন ......"


সাদা চুল দাড়িতে সাদা আলখাল্লায় অনেকটাই গুরুদেবের মতোই লাগছিল ওনাকে। তাই তিতান গুরুদেবের ফটো দেখিয়েছিল বুঝলাম।গান শেষ হতেই গিয়ে পা জড়িয়ে ধরলাম । বললাম


-" স‍্যার, আমি রিমলী, এই আমার মেয়ে তিতান। আপনাকে গত দু মাস কত খুঁজেছি স‍্যার।" আমার দু চোখে জল।


উনি আমার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন


-" ওর গান শুনেছি। ওকে শেখা,একদিন তোর মতই বড় হবে ও।"


-"আপনি ওর দায়িত্ব নিন স‍্যার। ওকে গড়ে তুলুন।"


-"আমি গান শেখাই না আর। আজকাল এই সব গান কেউ শিখতেই চায় না। সবাই হিন্দি গান আধুনিক গান শেখে। টিভি তে নামার জন্য বাচ্চা গুলোকে কত কি শেখায়। আমার কাছে আর কেউ গান শেখে না রে। গুরুদেবের গান আজ বার্ত‍্য।" মনে হল অনেক দুঃখে কথা গুলো উগরে দিলেন উনি।


-" কিন্তু আমি ওকে গুরুদেবের গান শেখাতে চাই। বাঙ্গালী হয়ে যদি রবীন্দ্রনাথ কে না চেনে এ আমাদের লজ্জা" বললাম আমি।"আপনকে কত খুঁজেছি..."


-" ওসব গান আজ নাকি অচল। রবীন্দ্র সঙ্গীত আজ আর চলে না।কেউ আসতো না আর বিনা পয়সায় কত জনকে শিখাতে চাইতাম। তাও কেউ শিখতো না। এরপর এই মন্দির কমিটি ঠাঁই দিলো । মন্দির প্রাঙ্গণ পরিষ্কার রাখি, গাছ লাগাই আর সন্ধ্যায় গান গাই এখানে। ওরাই খেতে দেয় কদিন ধরে তোর মেয়েটা ঘুরঘুর করছে। শুনে শুনেই গান তুলে নেয় বেশ। গলাটাও ভাল।"


আমার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে। বলে উঠি


-" আর আপনাকে এভাবে থাকতে দেব না। আপনি আমার সাথে চলুন। আমার বাড়িতে থাকবেন। এ ভাবেই গুরুদক্ষিণা দিতে চাই আপনাকে। "


-"তা হয় না রে মা। প্রত্যেক কে নিজের বোঝা নিজেকে বইতে হয়। আমি এখানেই ভাল আছি। আর তোর সফলতাই ছিল আমার গুরুদক্ষিণা। গানটা ছাড়িস না। "


আবার গান ধরলেন স‍্যার


-" এই করেছ ভাল, নিঠুর হে....."


কিছুতেই আনতে পারিনি ওনাকে আমার বাড়ি।


পাড়ায় পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে আমায় গান গাইবার অনুরোধ করতে এসেছিলেন ক্লাবের কয়েকজন। আমি যে এক সময় বেতার শিল্পী ছিলাম। 


বলেছিলাম


-" যাব। তবে আমার স‍্যারকে নিয়ে যাব। আমার সাথে উনিও গাইবেন।" ওরা সানন্দে রাজি হয়েছিল।


দুদিন পর সন্ধ্যায় স‍্যারকে নিয়ে গেছিলাম ক্লাব প্রাঙ্গণে।আমার গুরুদেবের জন্মদিন, আমার অনুরোধে স‍্যার বহুদিন পর সেদিন গেয়েছিলেন


-"তুমি কেমন করে গান করো হে গুনি......"


সত্যি সবাই অবাক হয়ে শুনেছিল সেই শ্বেত শুভ্র বৃদ্ধর গান। মনে হচ্ছিল সত্যি গুরুদেব বিরাজ করছেন ওনার ভেতর। গুরুদেবের ফটোর দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল উনিও অবাক হয়েই শুনছেন। মুগ্ধতার রেশ সারা শরীরে মনে মেখে আমিও হারিয়ে গেছিলাম ঐ গানের ভিতর।সুরের পরতে পরতে ভাল লাগার ছোঁওয়ায় কোথায় যেন চলে যাচ্ছিলাম আমি। অবশেষে শেষ গান যখন আমায় গাইতে বলা হল আমি আমার গুরুদেবকে প্রণাম জানিয়ে মন প্রাণ দিয়ে গেয়ে উঠলাম


-"এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ...


-সমাপ্ত-



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama