তৃষিত তিতাস (পর্ব ১)
তৃষিত তিতাস (পর্ব ১)
কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা কালো ছবি :
-------------------------------------------------
রাতের অন্ধকারে দাউ দাউ করে জ্বলছে পুলিশ Head Quarter... কিছু যুবক-যুবতী আক্রমণ করেছে সেখানে... ছিনিয়ে নিতে গেছে স্বাধীনতা... রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনিতে... কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ...
বাসুদা... সরে যান... ওরা গুলি চালাচ্ছে...
ভীমা, তুমি রত্নাকে দেখো... ওর গুলি লেগেছে...
বীরু কোথায় !!! বীরুউউউউউ....
আরে ওইইই তো... ও ওর লক্ষ্যে স্থির... পিটার গোমসকে ধরাশায়ী করছে... অনেক তাজা ভাই-বোনের প্রাণ নিয়েছে ওই গোমস... বীরুর হাতেই আজ ওর শেষদিন...
এদিকে শাড়ি পড়া একটি যুবতি ছাদে তেরঙ্গা হাতে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে বৃটিশ পতাকা দিকে... টেনে ছিঁড়ে নীচের আগুনে ফেলে দিল বৃটিশ পতাকা... ছাদে উড়ল তেরঙ্গা পতাকা... মেয়েটি salute জানালো... হঠাৎই একটা গুলি ছুটে এসে বিঁধে গেল যুবতীটির বুকে... যুবতীটির অন্তিম আর্তনাদ...
আহহহহ... বীরুউউউউউ....
যে যুবকটি বৃটিশটিকে ধরাশায়ী করছিল সে চমকে উঠে একবার পেছনে তাকায়... যুবতীটি তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছাদ থেকে লুটিয়ে নীচে পড়ছে...
সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, রুক্মিণীইইইইই....
কোমর থেকে পিস্তল বার করে সোজা বৃটিশটির মাথায় গুলি করে যুবকটি... তারপর ছোটে যুবতীটির দিকে... মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নেয় যুবকটিকে.... যুবতীটির ক্ষতস্থানে হাত রাখে যুবকটি.... কাঁপা কাঁপা রক্তমাখা নরম হাতটা শেষবারের মতো যুবকটির গাল ছোঁয়.... মুখে সকাল বেলার রোদ্দুরের মতো মিঠে হাসি, আর হাতে অন্তিম কিছু শ্বাস...
যুবতী : বীরুউউউউ....
যুবক : নাহহহ রুক্মিণী... তোমার কিছু হবে না... আমি... আমি কিছু হতে দেব না তোমার...
যুবতী : আমার... আমার সময় শেষ বীরু... আহহহ....
যুবক : নাহহহ... না... না... তুমি.... তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না... তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে...
যুবতী : পরের.... পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে... আমি... আমি ফিরব তোমার কাছে... আমি ফিরে আসব....
যুবকটি যুবতিটিকে সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরে, কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়....
যুবতী : বীইইই... বীরুউউউ.... বন্দে.... মা...
যুবক : বন্দে... মাতরম রুক... রু !!
শেষবারের মতো খুব জোরে শ্বাস নেয় যুবতীটি, তারপর ধীরে ধীরে যুবকটির গাল বেয়ে তার হাত লুটিয়ে পড়ে মাটিতে... উথলে আসা কান্না প্রাণপণে চেপে যুবকটি বুকে জড়িয়ে ধরে যুবতীটিকে.... হঠাৎই সামনে দেখে আরো এক গাড়ি সেনা নামছে.... চিৎকার করে ভীমাকে নির্দেশ দেয়,
ভীমা, সবাইকে নিয়ে পালা.... বাসুদাকে নিয়ে যা এখান থেকে...
না, যুবকটিকে পালালে হবে না... এই সেনাদের কিছু করে আটকাতে হবে... নয়তো তাদের এই দলের সবাই ধরা পড়ে যাবে.... বিশেষ করে তাদের দলনেতা 'বাসুদা' ... খুব যত্নে সে যুবতিটিকে মাটিতে শুইয়ে কিছুক্ষণ গুলির লড়াই চালিয়ে ওদের আটকে রাখার চেষ্টা করে, যাতে দলের সবাই পালাতে পারে... নাহহহ, ওরা নিরাপদ দূরত্বেই পালিয়ে গেছে... এই গুলির লড়াই-এ কয়েকটি গুলি এসে তার পেটে, বুকেও বিদ্ধ হয়েছে.... টলতে টলতে যুবতিটির কাছে এসে তাকে আবার পরম আদরে বুকে তুলে নেয়... তারপর একটা বোমায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়.... কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পুলিশ হেড কোয়ার্টার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে....
টিউলিপ হসপিটাল, Guest Room :
--------------------------------------------------
ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে উজান... সেই এক স্বপ্ন... AC-র মধ্যেও দরদর করে ঘামছে উজান... ছোটো থেকে এই স্বপ্নটা তাড়া করে বেড়ায় ওকে... কারুর মুখ পরিষ্কার দেখতে পায় না ও... খালি ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা কালো কিছু ছবি... আর ওই কিছু শব্দগুচ্ছ... বিদেশে থাকাকালীন Parapsychologist Dr. Jim Tucker-এর সাথে কথাও বলে উজান... ওনার মতে, মৃত্যুর পর আমাদের আত্মা মহাবিশ্বে সঞ্চিত থাকে... ঠাম্মি বলে, হয়তো উজানের সেই জন্মের কিছু কাজ এখনো বাকি আছে, তাই ভগবান ওকে এইভাবে পাঠিয়েছে... হয়তো সেই রাজকন্যার আসার অপেক্ষা...
বিরক্ত লাগে উজানের... মনে পড়লে সবটা পড়... এইভাবে খাপছাড়া খাপছাড়া... বিশ্বের প্রথম পাঁচজন ডক্টরদের মধ্যে অন্যতম Cardiologist Dr. Ujaan Chatterjee পেন্সিল, খাতা নিয়ে বসে পড়ে....খচখচ করে আঁকার চেষ্টা করে যুবতিটির মুখ... মানে যতটা আঁকা যায়.... ছবিটা দেখে গম্ভীর উজানও মনে মনে হেসে ফেলে... এত সুন্দর কেউ হতে পারে- ঠিক যেন ভগবানের কাছে কেউ সুন্দরতার বর্ণনা চেয়েছে, আর ভগবান তার উত্তর দিয়েছে... এত সুন্দর কেউ কি করে হতে পারে !!! আবার তার কানে বেজে ওঠে সেই পিছু ডাক-
'পরের.... পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে... আমি... আমি ফিরব তোমার কাছে... আমি ফিরে আসব.... '
মঙ্গরগঞ্জ, কালিম্পং :
--------------------------------
পাহাড়ের মিষ্টি মেয়ে হিয়া... বিদেশ থেকে MD পড়ে সবে ফিরেছে... প্রাণচাঞ্চলতা, উচ্ছ্বাসে ভরপুর... একদম পাহাড়ি নদীর মতো উচ্ছল, পাহাড়ি ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ... আর রূপ যেন ভগবান ঢেলে দিয়েছে, যেন ওকে অনেক সময় নিয়ে খুব যত্ন করে তৈরি করেছে... বড় বড় শহরে ডাক্তারি করার সুযোগ পেয়েও যায় নি... এই মঙ্গরগঞ্জ-এর গরীব মানুষগুলোর সেবা করে যায়...
হিয়ার দিন অসীম ব্যস্ততায় কেটে যায়, কিন্তু রাত প্রায় না ঘুমিয়েই কাটে... চাঁদ দেখেই রাত পার করে দেয়... কোথাও যেন একটা কত জন্মের অনন্ত অপেক্ষা... কে যেন অপেক্ষা করছে তার জন্য.... কার জন্য অপেক্ষা তার !! সারাদিন কোনোভাবে কেটে যায়... কিন্তু রাতটা যেন কাটতেই চায় না... কাকে যেন কিছু কথা দেওয়া ছিল... আর ওই পাহাড়ের ওপরের পোড়া ধ্বংসস্তূপটা... কেন টানে ওকে এত !! যেন ওখানে ওর হৃদয়ের কিছু অংশ রয়ে গেছে... ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে... আর একটা সুর যেন জন্মের ওই প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ওর প্রাণে... চাঁদের আলোয় সেই সুর ভাসিয়ে দেয় হিয়া....
আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে...
চাঁদ, ফুল, জোছনার গান আর নয়...
ওগো প্রিয় মন, খোলো বাহুডোরে...
পৃথিবী তোমারে যে চায়...
(রচনা : সলিল চৌধুরী)
প্রাণের সুর কি প্রাণে গিয়ে পৌছায় !!! ধূসর অতীত কি বর্তমানের দরজা খুলে সামনে আসবে !! ওই জন্মের প্রতিজ্ঞা কি এই জন্মে পূর্ণতা পাবে !! পুনর্মিলন হবে কি ভালোবাসার !!
(This is not a historical documentation of India's Struggle for freedom, but a work of fiction which is loosely based on events that rocked undivided India during the years 1919 to 1946...)