Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

2.1  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

বন্ধু চল...

বন্ধু চল...

9 mins
5.5K


ব্যালকনির দিকের দরজাটা খুলে দিতেই সমুদ্র থেকে একঝাঁক শীতল বাতাস এসে ঝাপটা মারলো সোমনাথ বাবুর চোখে মুখে। অদূরেই রোদে সোনার মতন চিকচিক করতে থাকা সমুদ্রটা দেখে মনটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল তাঁর। উন্মুক্ত বাহুতে হঠাৎ গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ লাগতেই তাকিয়ে দেখলেন কখন যেন ঝিমলি এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। মেয়ের মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখছিস মা কেমন সুন্দর সমুদ্র।”

উত্তর দিলো না ঝিমলি, সোমনাথ বাবুই আবার বললেন, “ওই যে দূরে কালো মতন একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে, ওটা হলো বিবেকানন্দ রক। এটা দেখতেই প্রতি বছর প্রচুর বাঙালী ছুটে আসে এই সুদূর দক্ষিণে।”

“আমরাও তো কাল লঞ্চে করে যাবো ওখানে তাই না গো?” পাশ থেকে বলে উঠলেন জয়িতা দেবী।

সায় দিলেন সোমনাথ বাবু, “হ্যাঁ যাবোই তো।”

ঝিমলি তাও নির্বিকার। সোমনাথ বাবু লক্ষ্য করলেন জয়িতা দেবীর চোখটা আবার আস্তে আস্তে ভরে উঠছে জলে, আজ মাস দুয়েক ধরে এই চোখের জল যেন আর শুকোতেই চাইছে না।

ডিং ডং…

কলিংবেলের আওয়াজটা শুনে স্বম্বিৎ ফিরল ওদের। জয়িতা দেবী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। দরজা খুলে যাকে দেখলেন তাঁকে জয়িতা দেবী চেনেন না। মুখে চাপ দাড়ির সঙ্গে মানানসই কালো ব্লেজার পরিহিত আগন্তুক পরিষ্কার বাংলায় বললেন, “নমস্কার ম্যাডাম।”

“আপনি বাঙালি?” পরিচয় জানার আগেই প্রশ্নটা আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো জয়িতা দেবীর।

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “একদম একশোভাগ। আমার নাম মৈনাক সাধুখাঁ। এই হোটেলের ম্যানেজার।”

আগন্তুকের নামটা হালকা কানে এসে লাগতেই ব্যালকনির থেকে ছিটকে বাইরের দরজার কাছে চলে এলেন সোমনাথ বাবু। যা আশঙ্কা করেছিলেন ঠিক তাই। এ তো সেই, অবিকল সেই চোখ, সেই নাক মুখ। মৈনাক সাধুখাঁও বোধহয় চমকে উঠলেন সোমনাথ বাবুকে দেখে। হবে নাই বা কেন, সবাই তো বলে সোমনাথ বাবুর মুখটা নাকি বিশেষ পাল্টাননি এতো বছরেও। মৈনাকের মুখটা খানিক পাল্টালেও ওর ওই সবজেটে চোখ দুটো সোমনাথ বাবুকে জানিয়ে দিলো এই সে। কতগুলো বছর কেটে গেছে মাঝে? কমপক্ষে বছর কুড়ি তো হবেই বোধহয়। গলার কাছটা শুকিয়ে এলো সোমনাথ বাবুর। মৈনাক বাবুর মনের অবস্থাও বুঝি একই রকম। কিন্তু এঁদের মনের খবর সম্পর্কে অজ্ঞাত জয়িতা দেবী বলে উঠলেন, “ভেতরে আসুন না, কিছু বলতে এসেছিলেন?”

“নাহ… মানে আসলে বাঙালী দেখলেই আলাপ করতে ইচ্ছে করে তাই… কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন ম্যাডাম, আসছি এখন।” কেটে কেটে কথাগুলো বলেই দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন মৈনাক বাবু। দরজা লাগিয়ে জয়িতা দেবী বললেন, “অদ্ভুত মানুষ তো! উনি এভাবে চলে গেলেন কেন!”

জয়িতা দেবীর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে খাটে ধপ করে বসে পড়লেন সোমনাথ বাবু। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে তাঁর, অথচ তাঁর তো কিছু যাওয়া আসা উচিৎ ছিলো না এতে।

স্বামীর চোখ মুখ দেখে কিছু আঁচ করে জয়িতা দেবী জিজ্ঞেস করলেন, “কিগো কি হয়েছে তোমার?”

“কই কিছু না তো।”

মুখে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও স্মৃতিকে এড়াতে পারলেন না সোমনাথ বাবু। অচিরেই স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন তিনি। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বছর কুড়ি আগের এক দৃশ্য। তখন তিনি ক্লাস টুয়েলভ। টেস্ট পরীক্ষাও হয়ে গেছে। স্কুল ফাইনালের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। এই সময়ই পড়ল তাঁদের প্রিয় স্কুলের সার্ধশত বর্ষের জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যে তিন দিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে আয়োজন করা হল বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতার। স্কুলের জন্মদিন তো আর বাদ দেওয়া যায়না, তার ওপর এটাই শেষ সুযোগও বটে। অনুষ্ঠানের আনন্দে মাতোয়ারা সোমনাথ বাবু শেষদিন যুগ্মভাবে কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু তথা হরিহর আত্মা মৈনাকের সঙ্গে। স্কুলের সেরা ছাত্র ছিলেন ওরা দুজন, সব দিনই এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ। তাই বলাই বাহুল্য দুই বন্ধু একসঙ্গে ছিনিয়ে নিলেন বিজয়ীর শিরোপা। পুরস্কার স্বরূপ দুটো পেনের সঙ্গে পেলেন একটা ট্রফি। এবারেই শুরু হল বিপত্তি। মৈনাক বাবু তাঁর মামাবাড়িতে থেকে পড়াশুনো করতেন , সেই কারণে সোমনাথ বাবু চাইলেন ট্রফিটা তাঁর বাড়িতে থাক কিন্তু মৈনাক বাবু যুক্তি দিলেন অন্য। তিনি বললেন স্কুল শেষ হলে তো এই শহর ছেড়ে চলে যাবেন তিনি তাই স্কুল জীবন থেকে পাওয়া শেষ উপহারটা রাখার অধিকার তাঁরই বেশি। এই ট্রফি তাঁকে স্কুলজীবনের স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে এই শহরটার কথাও মনে করবে। কিন্তু সোমনাথ বাবুও নাছোড়বান্দা। অতএব শুরু হলো কথা কাটাকাটি, তারপর সেই সামান্য কথা কাটাকাটি কখন যেন এক ভয়াবহ ঝগড়ার রূপ নিলো। ঝগড়ার মাঝেই সোমনাথ বাবুর হাতে ধরা ট্রফিটা আচমকা কেড়ে নিলেন মৈনাক বাবু। অপ্রস্তুতে ঘটনাটা ঘটে গেলেও সোমনাথ বাবুও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি পাল্টা ছিনিয়ে নিতে গেলেন সেটা। এভাবেই দুজনে টানাটানি করতে করতেই কখন যেন ট্রফিটা গেল হাত থেকে ছাড়া হয়ে। মাটিতে পড়ে দু’খন্ড হয়ে গেল সেটা। চমকে উঠলেন দুজনেই।

রুমের মধ্যেই ঝনঝন একটা শব্দ উঠতেই বর্তমানে ফিরে এলেন সোমনাথ বাবু। দেখলেন ঝিমলি একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। ওর হাতটা কেটে গেছে খানিকটা। সোমনাথ বাবু ছুটে গেলেন ওর দিকে। জয়িতা দেবী সঙ্গে থাকা ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে ঝিমলির হাতে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন কাটা জায়গাটায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সোমনাথ বাবু। তিনি একটি নামি বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ অফিসার আর জয়িতা দেবী ওকালতি করেন। ব্যস্ত জীবন দুজনেরই। টাকা রোজগারের নেশায় অহরহ ছুটে চলেন তাঁরা কিন্তু এই সব কিছু যার জন্য করছেন বলে এতদিন ভেবেছেন সেই ঝিমলিই যে তাঁদের অভাবে একাকিত্বে ভুগতে ভুগতে কবে যেন মানসিক রোগী হয়ে গেছে সে কথা তাঁরা টেরই পাননি। যখনকে বুঝতে পারলেন মেয়ের মধ্যেকার অসঙ্গতি তখন খানিক দেরীই হয়ে গেছে। কাউন্সিলিং চলছে ঝিমলির, তার মাঝেই সাইকোলজিস্টের পরামর্শে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন কন্যাকুমারীর এই চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুটা সময় একসাথে কাটাতে। মেয়েটা ছোটোর থেকেই একটু বেশি অন্তর্মূখী তাই স্কুলেও সেরকম বন্ধুবান্ধব নেই তার। এসময় দরকার ছিলো মা বাবার সাহচর্যের যেটার থেকেও সে বঞ্চিত হয়েছে ক্রমাগত। ঝিমলির মস্তিস্ক তাই আশেপাশে কিছু মানুষকে কল্পনা করে নেয় যারা তার বন্ধু, খেলার সঙ্গী। সেই কাল্পনিক বন্ধুর সাথেই আপন মনে গল্প করে সে, কখনও বন্ধুর কথায় খেলতে খেলতে বিপজ্জনক কিছু করে বসতে যায়। মেয়েটা যে কবে সুস্থ হবে জানেনা কেউই।

**********

গতকালই এই হোটেলে এসে ওঠা আরেক বাঙালী পরিবারের সাথে আলাপ হয়েছিল সোমনাথ বাবুদের। আজ তাঁদের সঙ্গেই জয়িতা দেবী মেয়ের সুস্থতা কামনায় গেছেন কন্যাকুমারী মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে। ঝিমলি একটা ওষুধ খাওয়ার পর ঘুমিয়েছিল তাই সোমনাথ বাবু হোটেলেই রয়ে গিয়েছেন মেয়ের কাছে। কাল মৈনাক বাবুকে দেখার পর থেকে ভীষণ অস্থির লাগছে তাঁর। সেই ঘটনার পর দুই বন্ধুর কথাবার্তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে মৈনাক বাবু শহর ছেড়েও চলে যান। এরপর আজ এতবছর কোনোদিনও দেখা হয়নি তাদের মধ্যে, কেউ কারুর খোঁজও রাখেননি। ট্রফিটা ভাঙার জন্য একে অন্যকে দোষী ঠাহরে গেছেন ক্রমাগত। আজ এতো বছর পর আবার সেই মানুষটাকে দেখে মনের মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে সোমনাথ বাবুর, মনে হচ্ছে অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে মৈনাকের হোটেলে ওঠা ঠিক হয়নি। ও যদি পুরোনো রাগ পুষে রেখে খারাপ সার্ভিস দেয় বা কোনোভাবে তাঁদের হেনস্থা করে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে! এসব কথা ভাবতে ভাবতেই আবার পরক্ষণে নিজেকে প্রবোধ দেন সোমনাথ বাবু; কি আর করতে পারে মৈনাক, ম্যানেজার হোটেলের একজন এমপ্লয়ীর বেশী কিছু নয়। তাই কোনো গন্ডগোল করলে মালিকের কাছে ওকে জবাবদিহি নিশ্চয় করতে হবে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তাঁর মনে হলো ঝিমলি তো এখন ঘুমোচ্ছে, এসময় তিনি টুক করে যদি স্নানটা করে নেন তাহলে মাথাটা খানিক ঠান্ডা হবে নিশ্চয়।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সোমনাথ বাবুর নজর গেল বিছানার দিকে, ফাঁকা সেটা। জড়ো হওয়া বেড কভারটা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। বুকটা চ্যাঁত করে উঠলো তাঁর। কোথায় গেল ঝিমলি! এক ঝলক গোটা ঘরটা দেখে নিয়ে ব্যালকনির দিকে চোখ যেতেই শরীরের রক্ত জল হয়ে এলো তাঁর। তিনি স্পষ্ট দেখলেন ঝিমলি ব্যালকনির রেলিং এর ওপর দিয়ে বাইরে একটা পা ঝুলিয়ে দিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। চিৎকার করে ব্যালকনির দিকে ছুটে গেলেন সোমনাথ বাবু কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পাখির ডানার মত দুই বাহু প্রশস্ত করে নীচে ঝাঁপ দিয়ে দিলো ঝিমলি। আর্তনাদ করে নিচের দিকে তাকালেন সোমনাথ বাবু। কিন্তু একি ঝিমলি মাটিতে পড়ার আগেই কেউ ধরে নিয়েছে ওকে। চাপ দাড়ি.... কালো ব্লেজার… মৈনাক! নাহ নিজের ছোটবেলার বন্ধুকে চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয় সোমনাথ বাবুর, ওটা মৈনাকই।

লিফট আসছিল না তাই সিঁড়ি দিয়েই উদ্ভান্ত্রের মত নীচে নামলেন সোমনাথ বাবু, তারপর তাদের রুমের ব্যালকনির দিকটা আন্দাজ করে ছুটে বেরিয়ে গেলেন বাইরে। হোটেলের কয়েকজন কর্মচারী তাঁকে ওইভাবে ছুটে বেরোতে দেখে পেছন পেছন বেরিয়ে এলেন। সোমনাথ বাবু ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেখলেন ঝিমলি শুয়ে আছে মাটিতে। আধো আধো খোলা চোখে জড়ানো গলায় সে শুধু বলল, “বাবা সোফি বলেছিল ওখান থেকে ঝাঁপ দিলে আমি পাখি হতে পারব…”

এইটুকু বলেই সংজ্ঞা হারালো ঝিমলি। সোমনাথ বাবুর মনে পড়ল ঝিমলির কাল্পনিক বন্ধুদের মধ্যে সোফি বলে একজনের কথা সে বলতো মাঝেমাঝেই। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না তাঁর। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও মৈনাক বাবুকে দেখতে পেলেন না তিনি। ভীষণ অবাক লাগল, ঝিমলিকে বাঁচিয়ে তারপর তাকে এভাবে মাটিতে শুইয়ে রেখে কোথায় গেল মৈনাক!

হোটেলের কর্মচারীদের সাহায্যে ঝিমলিকে ভেতরে এনে একজন স্থানীয় ডাক্তারকে ডাকা হলো। তিনি দেখে বললেন ভয়ের কিছু নেই, শক পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডাক্তারের কথা শুনে খানিক আশ্বস্ত হলেন সোমনাথ বাবু, কিন্তু তখনই তাঁর কানে গেল উপস্থিত সকলেই আলোচনা করছে যে কিভাবে সেকেন্ড ফ্লোর থেকে নীচে পড়েও ঝিমলির গায়ে একটা আঁচড়ও পড়ল না! গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে সোমনাথ বাবু বললেন, “আপনাদের হোটেলের ম্যানেজার কোথায়? উনিই তো আমার ঝিমলিকে বাঁচিয়েছেন।”

“আমি!” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো একটি কম বয়সী ছেলে। সোমনাথ বাবু তার অবাক হওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে বললেন, “মানে?”

ছেলেটি আগের মতোই অবাক গলায় জবাব দিলো, “আপনি তো এইমাত্র বললেন এই হোটেলের ম্যানেজার আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছে কিন্তু আমি তো কিছু করিনি।”

“কি বলছেন কি! আপনার কথা কখন বললাম? আমি তো বলছি যে ঝিমলিকে এখানের ম্যানেজার মৈনাক সাধুখাঁ বাঁচিয়েছেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

“কিন্তু এখানের ম্যানেজার তো আমিই আর আমার নাম রামেশ্বরম গোলাপাল্লী।”

“তাহলে মৈনাক…”

“স্যার যে আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছেন কি যেন নাম বললেন তাঁর?” পাশ থেকে একজন জিজ্ঞেস করে উঠলেন।

সোমনাথ বাবু দৃঢ় গলায় বললেন, “মৈনাক সাধুখাঁ।”

“আ… আপনি তাকে চিনলেন কি করে?” হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল হোটেলের আরেক কর্মচারী।

“সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। যদিও এখানে আসার আগে জানতাম না যে সে এখানের ম্যানেজার।”

“স্যার এখানের ম্যানেজার আমি রামেশ্বরম গোলাপল্লী। আর মাফ করবেন কিন্তু আমার মনে হয় আপনাকে নিশ্চয় আপনার বন্ধু ভুল তথ্য দিয়েছেন নিজের সম্বন্ধে।”

“এক মিনিট ম্যানেজার বাবু… আচ্ছা স্যার আপনি নিশ্চিত আপনি মৈনাক বাবুকেই দেখেছিলেন আপনার মেয়েকে বাঁচাতে? মানে আপনার কিছু ভুলও তো হতে পারে, আফটার অল সেকেন্ড ফ্লোরের ব্যালকনি থেকে…”

“ইম্পসিবল। আপনাদের এতো দ্বিধা দ্বন্দ্বের কারণ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। ওটা মৈনাকই ছিলো। আফটার অল হি… হি ওয়াজ মাই চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড… মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।” শেষ কথাগুলো খানিকটা স্বগোতোক্তির স্বরেই বললেন সোমনাথ বাবু।

“স্যার…” মৃদু গলায় ডাকলেন একজন।

“কি?”

“স্যার প্লিজ আপনি এই কথাটা কাউকে বলবেন না। আমাদের হোটেলের ক্ষতি হবে এতে।”

“মানে! কি বলতে চাইছেন কি আপনারা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

“স্যার মৈনাক বাবু এই হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন এ কথা সত্যি। রামেশ্বরম বাবু আসার আগে উনিই ছিলেন এখানকার ম্যানেজার।”

“ছিলেন মানে?”

“হ্যাঁ স্যার ছিলেন। মানে উনি আর এখন এই পৃথিবীতে নেই।”

“হোয়াট? আপনারা কি পাগল হয়েছেন?”

“না স্যার আমরা ঠিকই বলছি। মৈনাক বাবু খুব ভালো মানুষ ছিলেন, এই হোটেলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। কিন্তু…”

“কিন্তু কি?”

“হঠাৎ স্যারের একদিন জ্বর হয়। তারপর আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক সপ্তাহও যায়নি স্যার… প্রায় মাস সাতেক হয়ে গেল।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনাদের কথা… এ কি করে হয়! আজ আমি স্পষ্ট দেখলাম মৈনাক… আর তাছাড়া কাল তো ও নিজে আমার রুমে এসেছিল, আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করে গেল।”

“বিশ্বাস তো আমাদেরও হতো না স্যার। এর আগেও কয়েকটা বাঙালি পরিবার স্যারের মত কাউকে দেখার কথা বলেছিলেন কিন্তু ওরা যেহেতু আগে চিনতো না তাই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি আর আমরাও ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখেছি কারণ এসব কথা পাঁচকান হলে আমাদের হোটেলেরই ক্ষতি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব সত্যি কেননা আপনি তো বলছেন আপনার প্রিয় বন্ধু ছিলেন উনি।”

কোনো উত্তর না দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন সোমনাথ বাবু, সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাঁর। এরা কি সব বলছে! মৈনাক আর নেই! মৈনাক তাঁর সেই ছেলেবেলার খেলার সাথী, তাঁর প্রিয় বন্ধু… আর নেই সে!

“বাবা আমি এখানে কি করছি? এখানে এতো ভীড় কেন? কি হয়েছে?” চমকে উঠলেন সোমনাথ বাবু। কখন যেন জ্ঞান ফিরেছে ঝিমলির। ওর কি কিছুই মনে নেই কি ঘটেছে! আর ঝিমলির গলার স্বর, কথা বলার ধরণ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে না!

“মা তোর কি কিছু মনে পড়ছে না? সোফি তোকে ডেকেছিল…”

“কে সোফি?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো ঝিমলি। দ্বিতীয়বার চমকে উঠে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সোমনাথ বাবু। তবে কি ঝিমলি ঠিক হয়ে গেল! ওর গলার স্বরটাও তো আজ বহুদিন পর সেই আগের মত লাগছে যখন সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঝিমলি ঠিক হল কি করে? তবে কি মৈনাক…!

“স্যার।” মৃদু গলায় ডেকে উঠলেন একজন।

“কি?”

“একটা কথা বলবো?”

“হুমম বলুন।”

“মৈনাক স্যার মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন ওনার অস্থি যেন গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। এই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছে। আমরা তো কেউ যেতে পারিনি এখনও। আপনি যদি…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। আমার প্রিয় বন্ধুর শেষ ইচ্ছে…” কথাটা শেষ করতে পারলেন না সোমনাথ বাবু, গলাটা ধরে এলো তাঁর। ভগবানের কি অদ্ভুত খেলা! তিনি এতো ভালো একজন বন্ধু পেয়েও স্রেফ ছেলেমানুষির বশে সেই বন্ধুকে হারিয়েছিলেন আর আজ তাঁরই মেয়ে শুধু ভালো বন্ধুর অভাবে এমন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর পারলেন না নিজেকে সামলাতে, ঝিমলিকে বুকের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন সোমনাথ বাবু…

শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama