Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Drama

5.0  

Debdutta Banerjee

Drama

অসম্ভব সম্ভব

অসম্ভব সম্ভব

7 mins
2.3K


রেল লাইনের ধারের গাছটায় ফুটে আছে থোকা থোকা লাল গোলাপ, শ্রেয়ার ভীষণ প্রিয় গোলাপ। ফাঁকা রেল লাইন ধরে ও উঠে আসে, ছিঁড়ে নেয় একটা আধফোটা গোলাপ। উঃ , দু ফোঁটা রক্ত চুনির মত জ্বল জ্বল করছে ডান হাতের তর্জনীতে। অসাবধানতায় কাঁটা বিধে গেছে। আঙ্গুলটা মুখে পুরে লাইনে বসে পড়ে শ্রেয়া। তক্ষুনি মৃত‍্যুদুতের মত ছুটে আসে ট্রেনটা। শ্রেয়া ওঠার আগেই গায়ের উপর উঠে আসে ইঞ্জিন সহ বগি গুলো। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে বসে শ্রেয়া। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর।

স্বপ্নটা গত তিনমাসে বহুবার দেখেছে শ্রেয়া। গলাটা শুকিয়ে গেছে, ট্রেনের হুইসেলটা বাজছে এখনো কানের কাছে। একটু জল খেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ও। পূব আকাশে শুরু হবে রঙের খেলা, আরব সাগরের ভেজা হাওয়ায় শরীর জুরিয়ে গেলেও মনের মধ্যে একটা অসীম শূন্যটা। যেখান থেকে উঠে আসে একটাই ছোট্ট শব্দ 'না' ।

'না'একটা ছোট্ট শব্দ, যেটাকে শ্রেয়া জীবনে কখনোই পাত্তা দেয়নি। অথচ আজ এই 'না' শব্দটাই ওর ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। সবাই বলছে সে পারবে না। অসম্ভব। কিন্তু ছোট থেকে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেই তো শ্রেয়া বেড়ে উঠেছিল। ওর জেদের কাছে সব অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠত। কিন্তু পরিস্থিতি যে এভাবে বদলে যাবে, ভগবান যে এভাবে পরীক্ষা নেবে শ্রেয়া বোঝেনি। ধীরে ধীরে পড়ার টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়ায় ও। বাঁ হাতটা দিয়ে বই খাতাগুলোর গায়ে হাত বুলায়। শেষ তিনমাসে এগুলো কেউ খুলেও দেখেনি । ড্রইং এর ইন্সট্রুমেন্ট গুলোর উপর মাকড়সা সংসার সাজিয়েছে। দেওয়ালের গায়ে ফার্স্ট সেমিস্টারে প্রথম হয়ে পুরস্কার নেওয়ার ছবিটা যেন বিদ্রূপ করছে ওর দিকে চেয়ে। গতকাল এই সেমিস্টারের ও রেজাল্ট বেরিয়েছে। এবারেও শ্রেয়ার নাম তালিকার প্রথমে। কিন্তু তা দেখে কেউ আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরেনি, ওকে অভিনন্দন জানায়নি। সবার চোখে ছিল করুণা। প্রফেসাররা ওকে বলেছিল যে ও ভালো ছাত্রী, ও অঙ্ক বা ইংরেজি অথবা যে কোনও অন্য বিষয় যেখানে ড্রইং নেই সে সব নিয়ে পড়তে পারে। বাবা বলেছেন চার্টার্ড বা এমবিএ করতে। মা ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বলেছিল সাহিত্য নিয়ে পড়েও নাম করা যায়। ও তো এক সময় ভালো লিখত, সেটাকেই বেছে নিতে।

ভাই কাল রাতে বলেছে -''দিদি তুই ইকনমিক্স পড়। ওটাই তোর জন্য বেষ্ট। "

কিন্তু শ্রেয়া যে ভেবেছিল সে একজন সফল আর্কিটেক্ট হবে, লোকের স্বপ্নের বাড়ি বানাবে তার কি হবে ? ওর ইচ্ছাটাই এভাবে চাপা পড়ে যাবে।

মাসতুতো দিদির বিয়েতে কলকাতা গেছিল ওরা। খুব আনন্দ হয়েছিল বিয়েতে। বহুদিন পর পরিবারের বাকি লোকদের সাথে একসাথে খুব ভালো সময় কাটিয়েছিল শ্রেয়া। মুম্বাইতে থেকে বাঙালি বিয়ে দেখাই হয়নি ওর। এতো নিয়ম কানুন, এতো মজা, এতো খাওয়া দাওয়া ... যেন একটা মিষ্টি স্বপ্ন। হয়তো এত বড় আঘাতটা ওর জীবনে আসবে বলেই এতো আনন্দ একসাথে এসেছিল।

জ্ঞানেশ্বরীতে যখন উঠেছিল দাদু ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ফাইনালে গোল্ড মেডেলটা চাই কিন্তু। শ্রেয়া হেসে বলেছিল -''ওটা তো আমার বাঁ হাতের কাজ।" অলক্ষ্যে বিধাতা বোধহয় তখন মুচকি হেসেছিলেন।

বাঁ হাত.... নিজের বাঁ হাতটার দিকে তাকায় শ্রেয়া। চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। একটা খাতা টেনে বাঁ হাতেই কলম তুলে নেয় ও। কাঁপা হাতে লিখতে চেষ্টা করে, কয়েকটা আঁকা বাঁকা রেখা যেন ওকে ব্যাঙ্গ করে হেসে ওঠে। এই কমজোরি কাঁপা হাতে ও ধরবে ড্রইং পেনসিল !! পয়েন্টের এক দু মিলি মিটারের ভুল ও যেখানে করা যায় না সেখানে এই একটা হাতে ও কি করে আঁকবে কঠিন কঠিন ড্রইংগুলো। ডাক্তারবাবু অবশ্য নকল হাতের কথা বলেছিলেন, প্রযুক্তির সাহায্যে আঁকাও যাবে বলেছিলেন কিন্তু শ্রেয়া যে নিজের হাতে গড়তে চেয়েছিল স্বপ্নের নীড়। তার কি হবে?

তিন মাসে এতোগুলো অস্ত্র পাচার, এতো অপারেশন কিন্তু ডান হাতটাই তো নেই। জ্ঞানেশ্বরীর আপার বার্থে শুয়ে ডান হাতেই লাইটটা নিবিয়েছিল শ্রেয়া। তারপর দু চোখের পাতা বুজেছিল নতুন স্বপ্ন দেখার আসায়। মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছিল বিয়ে বাড়িতে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো। ঘুমিয়ে গেছিল শ্রেয়া।

হঠাৎ জোরে একটা ধাক্কা, বগিটা উপরে উঠে গেছিল। ছিটকে পড়েছিল শ্রেয়া, চিৎকার, কান্না, অন্ধকার , সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল ও।

যখন জ্ঞান ফিরল ...এক ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়েছে ও, সারা শরীর ভাসছে রক্তে। চারদিকে আর্তনাদ, গ্যাস কাটারের গন্ধ, ভারি মিলিটারি বুটের শব্দ। হঠাৎ মনে হল ভাইয়ের গলা। দিদি বলে ডাকছে। ক্ষীণ স্বরে শ্রেয়া বলেছিল -'' আমি এখানে, আমায় বাঁচা।" কিন্তু এতো কোলাহলে ওর গলার স্বর পৌঁছাতে পারেনি ভাইয়ের কানে। তবু আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিল শ্রেয়া। কিন্তু পা দুটো আটকা কিছুর নিচে। আর ডান হাতটা!! কোথায় তার ডান হাত? চমকে ওঠে সে!! অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও শ্রেয়া বুঝতে পারে হাতটা নিজের দেহের সঙ্গে নেই। চিৎকারে ফেটে পড়ে সে, আর্তনাদ করে ওঠে, "আমি বাঁচতে চাই''। কেউ এগিয়ে আসে না। শ্রেয়ার দু গাল বেয়ে রক্তের ধারা ধুয়ে নেমে আসে লবণ জল। আস্তে আস্তে শরীরটা টেনে হিচড়ে বার করতে চায় ও। কিন্তু ওর চারপাশে মৃতদেহের স্তুপ। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে অবসন্ন হয়ে আসা শরীরে শ্রেয়ার মনে হয় পূব আকাশ লাল হচ্ছে। একটা নতুন দিনে শুরু হচ্ছে। তাকে বাঁচতে হবে।

সুবেদার বিক্রম বিশাল শেষ বারের মত ঘেঁটে দেখছিলেন ধ্বংসস্তূপ। এই দুটো কামরায় প্রাণের চিহ্ন নেই, যে কয়জন ছিটকে বাইরে পড়েছিল বেঁচে গেছে। কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখন শুধু কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আর থেঁতলে যাওয়া দেহাবশেষ, যাদের আলাদা করাই যাচ্ছে না আর। তবুও শেষ বার ঘুরে দেখছিলেন তিনি এই মৃত্যুপুরী। হঠাৎ একটা রক্তাক্ত হাত আঁকড়ে ধরেছিল ওঁর ডান পা। মুহূর্তের জন্য ভয়ে কেঁপে উঠেছিলেন তিনি!! এত মৃতদেহের মধ্যে, একটা হাত এভাবে...!! পোড় খাওয়া সুবেদার ভালো করে তাকিয়ে দেখেন প্রাণের স্পন্দন রয়েছে ঐ হাতে। ওঁর ডাকে এগিয়ে আসে দলের ছেলেরা, একটা সদ্য যুবতি মেয়ে.... ঈশ, ডান হাতটাই নেই। ততক্ষণে আবার জ্ঞান হারিয়েছে শ্রেয়া।

প্রথম তো বাঁচার আশাই ছিল না। ধীরে ধীরে সেই আশার আলো জ্বলে ওঠে, যম ও হার মানে ওর জেদের কাছে। কিন্তু নতুন জীবনের সঙ্গে সঙ্গে একটা শূন্যটা গ্ৰাস করে শ্রেয়ার জীবন। সবার চোখে করুণা, সবার মুখে -'ও আর পারবে না।' এই না টা গত তিনবারে ও সবচেয়ে বেশি শুনেছে। ডান হাত ছাড়া জীবনে নাকি কিছুই হবে না। পড়াশোনায় ইতি টানতে হবে।

ডাক্তার ভটরা বলেছিলেন লাইন বদলে নিতে। যে সব লাইনে ড্রইং নেই তাতে চলে যেতে। নতুন করে বাঁচতে।

-''মা, আমি আর তোর মা ও তো কলেজে পড়াই, আমাদের দেখ। তুই এমন চুপ করে থাকিস না। একটা দুর্ঘটনা তোর হাত কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু তোকে তো ফিরে পেয়েছি। কত লোক সেদিন স্বজন হারা হয়েছে বল তো ? মায়ের বুক থেকে সন্তান হারিয়ে গেছে। মাথার সিঁদুর মুছে গেছে, কত ভাইকে হারিয়েছে বোনেরা, কত বৃদ্ধ বৃদ্ধার শেষ আশা নিভে গেছে। তোর তো শুধু একটা স্বপ্ন হারিয়ে গেছে। কিন্তু ওটাই তো একমাত্র পথ নয়। পথ আরও আছে, তুই ঠিক কর কি নিয়ে পড়বি। ''

চোখের জল শ্রেয়ার আগেই শুকিয়ে গেছিল। ও শুধু চেয়ে থাকে বাড়ির পাশের রাস্তায়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা স্কুল যাচ্ছে, ওদের দু চোখে কত রঙিন স্বপ্ন। কত বৃদ্ধ বৃদ্ধা পার্কে জগিং করছে নিজেদের ফিট রাখার জন্য। ও ধারের ফুটপাতে বাসা বেঁধেছে একটা ভিখারি পরিবার, পুরুষটার দুটো হাত নেই। ভিক্ষা করে সারাদিন। কি অসহায়!! মহিলাটা বাচ্চা কোলে কাজে যায়। পাশেই একটা বহুতলের কাজ চলছে, লেবারের কাজ করে বোধহয়।

সেদিন সকালে শ্রেয়া দেখছিল মহিলাটা নেই। লোকটা পায়ের সাহায্যে স্টোভ জ্বালিয়ে দুধ গরম করে বাচ্চাকে খাওয়াল। নিজে পা দিয়েই রুটি বেলল, ভাজল। পা দিয়ে বোতল খুলে জল খেল। একটু পরেই মহিলা ফিরল । লোকটা লাল চা করে দিল। বিদ্যুতের ঝিলিক দেয় শ্রেয়ার মাথায়। একটা অশিক্ষিত লোক দুই হাত হারিয়ে বেঁচে রয়েছে, জীবন যুদ্ধে টিকে রয়েছে তবে একটা হাত নিয়ে ও কেন পিছিয়ে পড়বে!! হঠাৎ একদিন ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনা ওকে হারিয়ে দেবে!!

শুরু হয় নতুন করে চেষ্টা, এক হাতেই ঝেড়ে পুছে নেয় বইয়ের টেবিল। ড্রাফটিং বোর্ডটা বিছিয়ে নেয় বিছানায়, টি স্কেল টা লাগিয়ে পা দিয়ে চেপে ধরে, সেট স্কয়ার টা বসিয়ে বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে, পেনসিলটা মুখে তুলে নেয়। পায়ের সাহায্যে আঁকতে থাকে নতুন করে, হয় না, বেঁকে যায়। কিন্তু শ্রেয়া হারতে শেখেনি। মেজারিং টেপ টা পা দিয়ে চেপে মাপ নেয় আবার। হয়নি, নতুন কাগজ লাগায় আবার।চেস্টা চলতেই থাকে।ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ কেটে যায়। বাবা মা ভাই হার মানে ওর কাছে, অসম্ভব জেদ ওর। সেই অসম্ভব জেদের বশেই ও সম্ভব করবে ওর স্বপ্ন। অটোক‍্যাডে অবশ্য অনেক সহজ হয়ে ওঠে ওর কাজ। কয়েকদিন প্র্যাকটিসের পর ও ছোটে কলেজে। প্রফেসার রয় নিজের প্রিয় ছাত্রীটিকে দেখে চোখের জল লুকান। বলেন -''কি নিয়ে পড়বে কিছু ভাবলে ? আমি বলছি ইকনমিক্স পড়ো। ''

-''আমি ভেবে নিয়েছি সার, আজ থেকেই ক্লাস জয়েন করবো। '' উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শ্রেয়ার চোখ মুখ।

-''গুড, তা কোন কলেজে ভর্তি হলে?''

-''সার, এখানেই, ফাইনাল ইয়ারের পড়া শুরু করবো আজ থেকেই... বেশ কয়েকটা ক্লাস মিস হলেও আমি পারবো সার।''

প্রফেসর রয় আকাশ থেকে পড়লেন। আর্কিটেকচারে ডান হাতটাই আসল অস্ত্র। সেটা হারিয়ে কি মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেলো ? কি বলছে ও !!

-''সার আমি পারবো। আমি পারবো কমপ্লিট করতে, একটা হাত রয়েছে এখনো। ''

শ্রেয়ার জেদের কাছে সেদিন হার মেনেছিল সবাই। এক হাতেই ও শুরু করেছিল নতুন করে পড়াশোনা। রাতের পর রাত জেগে ও প্র্যাকটিস করেছে বাঁ হাতে আঁকা। নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করে না ও। মানসিক ভাবে ও সুস্থ সবল।

ওর জেদ দেখে বন্ধু আর প্রফেসররা মিলে ওর জন্য আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি নকল হাত আনিয়েছিল। কিন্তু তাতে ও আরাম পায়নি কাজ করে। এর চেয়ে বাঁ হাত ও দুই পায়ে ও বেশি সাবলীল। অবশেষে শেষ হল ওর ফাইনাল সেমিস্টার। শুধু প্রযুক্তি নয় হাতের ও পায়ের সাহায্যে আঁকা ড্রইং ও করেছে খুব যত্ন নিয়ে। বন্ধুরা অবাক হয়েছে ওর জেদ দেখে।

রেজাল্টে এসেছিল ওর পুরস্কার, আবার গোল্ড মেডেল। বাঁ হাতেই ছিনিয়ে নিয়েছিল ও সেরার সেরা সম্মান।

আজ শ্রেয়াকে সারা বিশ্ব চেনে, ও আজ নিজের কলেজেই প্রফেসর, সারা বিশ্বে পড়িয়ে বেড়ায় শ্রেয়া। ও সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে অসম্ভব বলে কিছু হয় না।সব সম্ভব। একটা দুর্ঘটনা 'না' করে দিতে পারে না কারোর এগিয়ে চলাকে। পথ যতই বন্ধুর হোক জেদ আর একাগ্ৰতা জয় আনবেই। শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে নিজের ওপর।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama