যা হারিয়ে গেছে
যা হারিয়ে গেছে


সত্যজিৎ রায়ের নায়ক সিনেমার শেষ দৃশ্যটি মনে পড়ে?উত্তমকুমার কে ঘিরে ধরেছে ভক্তের দল অপরদিকে শর্মিলা হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ের মধ্যে।মুগ্ধ ভক্তদের মধ্যে দাঁড়িয়েও উত্তমের মুখে ঘনিয়ে উঠেছে বিষাদের ছায়া।
খুব কাঙ্খিত জিনিসের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমাদের মনে সৃষ্টি করে এক চিরন্তন বিষাদময়তা যা ফেরারি দুঃখের স্মৃতি হয়ে বারবার হানা দেয় মনের জানালায়।
তখন কলেজে পড়ি.. বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গেছিলাম মুকুটমনিপুর।চারদিকের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেল।একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কাছের একটা মেলায়।স্থানীয় আদিবাসীরা বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছে,তারই মধ্যে চলছে জুয়া খেলা।
আমাদের সঙ্গে সেই মেলা দেখতে এসেছে আমাদেরই হোটেলে ওঠা আসানসোল থেকে আসা একদঙ্গল ছেলেমেয়ে।
আমরা দলবেঁধে নাগরদোলায় উঠলাম।
আমার পাশে বসেছে সেই দলেরই একটি মেয়ে।নাগরদোলাটি উপরের দিকে উঠছে ,মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরটা যেন ভারহীন তুলোর মত হাল্কা হয়ে যাচ্ছে,উপরে ওঠার পর নাগরদোলাটি বিদ্যুৎবেগে নিচে নেমে আসছে।নাগরদোলাটি উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশে বসা মেয়েটি চিৎকার করে উঠছে,সে শক্ত করে ধরে রেখেছে আমার আঙ্গুলগুলো,মেয়েটির উষ্ণ করতল আমার শরীরে বাজাচ্ছে মধুর এক জলতরঙ্গ।তরুণীর শরীর থেকে ভেসে আসছে অপূর্ব এক সুগন্ধ।আমরা বহুক্ষন পরস্পরের আঙ্গুল স্পর্শ করে ছিলাম,ঐ ক্ষনিক সময়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক অন্য অনুরনন।
বাড়ি ফেরার সময় মেয়েটি তাদের বাড়ির ল্যান্ডফোন নম্বরটি লিখে দিয়েছিল একটি সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে।সেইসময় মোবাইল তো দুরস্থান,আমাদের বাড়িতে ল্যান্ডফোনও ছিলনা।আমাদের সারা পাড়াতে একটিই ল্যান্ডফোন,তাই আমি কোনো ফোননম্বর তাকে দিতে পারিনি।
ট্রেনে করে ফেরার সময় প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেটের প্যাকেটটা চলন্ত ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম।
ফেলে দিয়েই মনে হল- ঐ যাঃ! ওর মধ্যে তো মেয়েটির ফোন নম্বরটা ছিল কিন্তু তখন আর আফসোস করা ছাড়া গতি নেই,বিদ্যুৎবেগে ট্রেন এগিয়ে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে।
মেয়েটি চিরকালের মত হারিয়ে গেল।একটি ছোটগল্প অসাধারনভাবে শুরু হয়েও থেমে গেল মাঝপথে।
শিল্পীদি ছিল আমার প্রথম মেয়েবন্ধু।যদিও ছোটোবেলা থেকে কোএড স্কুলে পড়েছি তবুও আমার ক্লাসের কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার তেমন সখ্যতা হয়নি।শিল্পীদি আমার থেকে চারপাঁচ বছরের বড় ছিল।আমি যে বছর উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম শিল্পীদি সে বছর এমএ পরীক্ষা দিল।
এমএ পড়তে পড়তেই শিল্পীদির বিয়ে ঠিক হল এক আমেরিকা প্রবাসী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে।এদিকে বাংলায় এম এ পড়া শিল্পীদি একবর্ণ ইংরিজি বলতে পারেনা।অতএব নিরুপায় হয়ে স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে ভর্তি হওয়া।সেখানেই শিল্পীদির সাথে আমার আলাপ পরিচয় বন্ধুতা ও হৃদ্যতা।একবছর একসঙ্গে ক্লাস করার পর শিল্পীদি সেই ন্যুইয়র্ক প্রবাসী ব্রিলিয়ান্ট হ্যান্ডসাম যুবকটির হাতে হাত রেখে দমদম থেকে সোজা উড়ে গেল ন্যুইয়র্ক।
শিল্পীদি চলে যাওয়ার পর আমি কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম।আমাদের ক্লাস থাকত সপ্তাহে তিন দিন।স্যারের নির্দেশ মত আমরা রোজ বিকেলে দেখা করে নিজেদের মধ্যে জড়তা কাটানোর জন্য ইংরিজিতে কথা বলা প্র্যাকটিস করতাম।আমি সেইসময় কাঠ বেকার,শিল্পীদি টিউশানির টাকায় রোজ একটা করে আলুর চপ আর চা খাওয়াতো।
শিল্পীদি চলে যাওয়ার পর 'মিস্ করা' শব্দটির অর্থ আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারি।
যেদিন আমাদের শেষ দেখা তার সাত আট দিন বাদেই ওর বিয়ের দিন। সেদিন ও ভীষন রকমের উচ্ছল হয়ে উঠেছিল।পরেরদিনই ওর হবু বর সুদুর আমেরিকা থেকে উড়ে আসবে।শিল্পীদি কিছুতেই ওর আনন্দকে চেপে রাখতে পারছিলনা।
যাওয়ার সময় বলল-তোর ঠিকানাটা লিখে দে,ওখান থেকে চিঠি লিখব।
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে।আমি গ্র্যাজুয়েশন করছি।শিল্পীদির জন্য একটুকরো নীরব অভিমান মনের গহনে জমা হয়ে আছে।সেইসময় মোবাইল,স্মার্টফোন,ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ ছিলনা।কমিউনিকেশন বলতে চিঠি।
সেদিন একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে যাব,সকাল থেকে ব্যস্ত, হঠাৎ দেখি আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে পিয়ন।আমার নামে কোনো চিঠি সাধারনত আসেনা,যা আসে সবই বাবার নামে।
গিয়ে দেখি আমেরিকার স্ট্যাম্প লাগানো একটি এয়ারমেলে বড় বড় করে আমার নাম লেখা।খুলে দেখি শিল্পীদির চিঠি!
খুব তীব্র ভ্যাপসা গরমের মধ্যে হঠাৎ কোনো পরিযায়ী ঠান্ডা হাওয়া মনের মধ্যে যে অপরিসীম আনন্দের জন্ম দেয় আমারও ঠিক সেইরকম আনন্দ হতে লাগল,এই আনন্দের তুলনা নেই।দু পাতার সেই চিঠিটা কম করেও অন্তত পনেরো বার পড়লাম।
শিল্পীদি লিখেছে আমেরিকার কথা,ওদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের কথা,ওর নিঃসঙ্গতার কথা...লিখেছে-আমেরিকানদের জড়ানো ইংলিশ কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা,সেই কারনে বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনা..আরো লিখেছে-বিকেল হলে একা একা ব্যালকনিতে এসে বসি,ন্যুইয়র্কের আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে সুর্যাস্ত হয়,নিজেকে বন্দী মনে হয় তখন..একা বেরোতে ভয় লাগে, তোর কথা মনে পড়ে খুব..সেই বিকেলগুলো..সেই মাঠটা..হালিশহর স্টেশনের ট্রেন থেকে নেমে আসা অফিস ফেরত মানুষের ঢল..চপের দোকানটা..আমাদের ভুলভাল ইংরিজির প্রলাপ বকা..তোকে মিস করি...জানিনা,তুই আমাকে মিস করিস কিনা!
চিঠিটা আরো বার পঞ্চাশেক পড়ব বলে ভাঁজ করে মানিব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলাম।
চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দমদম স্টেশন থেকে এক ভিড়ঠাসা ট্রেনে উঠলাম।ট্রেনে তিলধারনের জায়গা নেই।সে ট্রেনে এমনই মারাত্মক অশালীন ভিড় যে আমার হাত ও পায়ের উপরও আমার কোনো নিয়ন্ত্রন রইল না।বেলঘরিয়া স্টেশনে এক লহমায় ট্রেনটা ফাঁকা হয়ে গেল।আর আমি আবিস্কার করলাম আমার মানিব্যাগটি আমার পকেটে আর নেই।
মানিব্যাগে টাকা ছিল সামান্যই কিন্তু সেখানে ছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা দামের শিল্পীদির সেই মহামূল্যবান চিঠিটি।