Aayan Das

Inspirational

3  

Aayan Das

Inspirational

আত্মজা-

আত্মজা-

4 mins
16.6K


দরজা টা খুলতেই টুয়া স্কুলড্রেস,ব্যাগ, ওয়াটারবটল শুদ্ধ দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোমা র কোলে।মা কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে টুয়া বলল

''মা,জানতো মা,ওরা বলছিল তুমি নাকি আমার নিজের মা নও?এটা কী সত্যি মা?''

''কারা?''

''ঐ রিষিকার মা'রা''টুয়ার প্রশ্নের মধ্যে মিশে রয়েছে এক অসহায় কান্না।

সোমার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল।মাথার ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল।মনে হল পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কেউ যেন তাকে গুলি করেছে।

মুহূর্তে সামলে নিয়ে সোমা তার দশ বছরের মেয়ের গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,''-তোর কী বিশ্বাস হয় এটা?''

এবার টুয়া ও হাসতে থাকে।হেসে গড়িয়ে পড়ে মায়ের কোলে।

সোমা -রনজয় এর বিয়ের পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো সন্তান এলোনা।এসব ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারে বাড়ির বউটির ঘাড়ে সবাই দোষারোপ করে।সে-ই অপয়া।তারই শারীরিক ত্রুটি আছে।এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলনা।অথচ ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেল শারীরিক অক্ষমতাটা রনজয় এরই।তার স্পার্ম কম।অনেক চিকিৎসাতেও কোনো ফল হলনা।এদিকে নিজের অক্ষমতা জানার পর রনজয় ভুগছে ডিপ্রেশনে।সব জেনেও শাশুড়ির দোষারোপ একটুও কমেনি।আর এইভাবেই তারা দুজন ক্রমশ যেন দুরে সরে যেতে লাগল পরস্পরের থেকে।

ঠিক এইসময়ই গাইনোকোলজিষ্ট ডাঃ মিত্র নবজীবন এর ঠিকানাটা দিলেন।

বললেন,''-আপনারা দত্তক নিন।সন্তান হল সেতু।সন্তান কে জন্ম দেওয়াটা কোনো বড় ব্যাপার নয়।সন্তানের জন্ম তো আসলে দুজন নারীপুরুষের শারীরিক সম্পর্ক।কিন্তু আসল ক্রেডিট তো তাকে মানুষ করা।তাকে নিজের আদর্শে,নিজের মননে,নিজের সংস্কৃতিতে বড় করে তোলা।এটাকেই তো পরম্পরা বলে।এই বাচ্চাটিই দেখবেন আপনাদের সব ডিপ্রেশন আর অশান্তি দুর করে দেবে।''

'নবজীবন' এর পরিবেশটা ভারী সুন্দর।সোমা-রনজয় এর যে ব্যাপারটা খুব ভাল লাগলো তা হল, এখানে একগাদা শিশুকে একসঙ্গে হাজির করানো হয়না।ওদের দুজনের মুখের মিল আছে এমন একটি শিশুকেই ওরা দেখাবে।

প্রথমদিন ওদের ডিটেইলস এবং হোয়ারঅ্যাবাউটস নেওয়া হল।তারপর একটি তিনমাসের কন্যা সন্তানকে হাজির করা হল ওদের সামনে।সিষ্টার বললেন,''-ওর বায়োলজিক্যাল মাদার কিন্তু মুসলিম।খুব অভিজাত ফ্যামিলি।আপনাদের আপত্তি নেই তো?''

শিশুটি অবাক চোখে ওদের দেখছে।শিশুটির চাহনিতে অদ্ভুত একটা মায়া ছিল।সোমার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।

নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওরা ওদের সন্তানকে ঘরে নিয়ে এলো।

আর কী আশ্চর্য টুয়া বাড়িতে আসার ঠিক এক বছরের মাথায় সোমা প্রথম তার শরীরে আরেকটি শরীরের উপস্থিতি টের পেল।

সারা বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

এরপর রনজয় এর কাজের জায়গাতেও অনেকদিনের আটকে থাকা প্রোমোশন হল।ওদের স্থির বিশ্বাস হল-টুয়া ই লাকি।ও আসার পর থেকেই ....

কিছুদিনের মধ্যে ওরা ভুলেই গেল যে টুয়া ওদের অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড।সে বড্ড শান্ত ও বাধ্য।অত্যন্ত মেধাবী ও।সে ক্লাসে ফার্ষ্ট হয়।সোমা গর্বের সঙ্গে মেয়ের প্রোগ্রেস রিপোর্ট হাতে নিয়ে সবাইকে দেখায়।গর্ব করে।বরং পরে জন্মানো ছেলেটিকে নিয়েই যেন ওদের সমস্যা বেশি।

ডাঃ মিত্র বলেছিলেন,''-আপনারাই বলে দেবেন,না হলে যদি বাইরের লোকের মুখ থেকে শোনে,সি উইল বি হার্ট।আপনারা এখন থেকেই ওকে কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তটা গল্পের ছলে বলতে থাকুন।''

সোমা টুয়া কে খাওয়াতে খাওয়াতে গল্প বলে।দেবকী ও বসুদেব এর কথা বলে।কংস'র কাহিনী শোনায়।যশোদা ও নন্দর গল্প বলে।টুয়া কে খুব সচেতন ভাবেই জানানো হয় যে একজন মানুষের দুজন মা বাবা থাকতে পারে।

মাঝখানে কোনো সমস্যা হয়নি।হঠাৎ করেই ঐ রিষিকার মায়েরা...

সেই ঘটনার পর কেটে গেছে পাঁচ বছর।টুয়ার এখন পনেরো বছর বয়স।সে এখন অনেক ম্যাচিওরড।এই পাঁচ বছরে সোমা অজস্র বার তার প্রাণাধিক মেয়েকে বলতে চেয়েছে সেই নির্দয় সত্যি।কিন্তু বলতে পারেনি।একটা অজানা ভয় তার গলার কাছে এসে তাকে চেপে ধরেছে।

কিন্তু নাঃ আর না।এবার তাকে বলতেই হবে।মেয়ে বড় হয়েছে।সে বাইরে পড়তে যাচ্ছে।মেলামেশা করছে।যদি কোনোদিন বাইরে থেকে কিছু শুনে আসে?যদি প্রশ্ন করে?

কিছুতেই ঘুম আসছেনা সোমা র।মনের মধ্যে প্রবল এক উৎকন্ঠা হচ্ছে।কাল ই সেই দিন যেদিন টুয়াকে জানানো হবে তার জন্ম ইতিহাস।টুয়া জানবে তার জীবনের কঠোরতম সত্যি।সোমা একনাগাড়ে অস্থির পায়চারি করছে ঘর আর বারান্দায়।বাইরের অন্ধকার আকাশ ঢেকে গেছে অসংখ্য তারায়।আর তারই মধ্যে মধ্যমণি হয়ে রয়েছে একফালি চাঁদের কাস্তে।সোমা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।

অনেক দুরে একটানা কেঁদে চলেছে একটা কুকুর।

ঘরে নাইটল্যাম্প এর নীলাভ আলোয় অঘোরে ঘুমোচ্ছে পনেরো বছরের টুয়া।ফ্যানের হাওয়ায় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এসে পড়েছে মুখের উপর।প্রবল এক ভয় সোমা কে কাঁপিয়ে দিল।কাল সকালেই মেয়েটা জেনে যাবে যে, সে আসলে অ্যাডপ্টেড চাইল্ড।নিজের মেয়ে নয়।কাল সকালেই হয়তো সোমার শুরু হবে এক অন্য জীবনযাপন।অন্য কোনো পৃথিবীতে।অথচ রনজয় কেমন নির্বিকার।সে পাশের ঘরে ছেলেকে নিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।

বাড়িতে ডেকে আনা হয়েছে সোমার মা ও বোন কেও।যদি প্রবল এক ঝড় ওঠে!যদি সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়!সামাল দেবে কে?

এসব কথা শুনে প্রথমে সোমার মা বলেছিলেন,''-যার জরায়ু তে ভ্রুণ হিসেবে টুয়া বড় হয়েছিল মাত্র ,সে অবাঞ্ছিত বলে জন্মানোর সাথে সাথেই ওকে ত্যাগ করল,সে হবে টুয়ার আসল মা! আর তুই দিন রাত এক করে ওকে মানুষ করলি,তুই হবি ওর পালিত মা?আসল মা তো তুই ই৷''

সোমা ঘামতে থাকে।চোখে মুখে জল দেয়।আস্তে আস্তে রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফোটে।চারিদিক স্পষ্ট হয়।টুয়া পরম শান্তিতে ঘুমোতে থাকে।

বাড়ি ভর্তি লোকজন।বাবা বাজার থেকে নিয়ে এসেছে টুয়া র ফেভারিট গলদা চিংড়ি।টুয়া মাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।অগোছালো চুল।চোখের তলায় ঘন কালি।মুখে সারারাত জেগে থাকার ক্লান্তি।

টুয়া মায়ের পিঠে হাত রাখে।

''তোমার কি হয়েছে মা?''

মেয়ের স্পর্শ পেয়ে সোমা কিছুতেই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা।সে কান্না ভেজা গলায় বলে,''-আচ্ছা,ধর যদি এমন হয় যে আমি তোকে জন্ম দিইনি,তাহলে?''

বাড়ির সবাই কেমন যেন নিশ্চল হয়ে যায়।সবাই অপেক্ষা করে রয়েছে এক যুগ সন্ধিক্ষনের জন্য।যেন একটু পরেই শুরু হবে এক ভয়াল সাইক্লোন অথবা ভূমিকম্প।

টুয়া কিছুক্ষন অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ওঠে।

বলে,''-বুঝেছি বুঝেছি, আমি তোমাদের অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড তাইতো?তো হয়েছেটা কী?তুমি ই তো আমার মা নাকি!''

''তুই জানিস অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড কাকে বলে?''

''না জানার কী আছে?অন্য কেউ আমার জন্ম দিয়েছিল।তুমি আমাকে নিয়ে এসে মানুষ করেছো।এই তো?তাতে হয়েছেটা কী?তুমি এত কাঁদছো কেন?ওঃ মা,তুমি না সত্যি..''

এক বয়স্ক অভিভাবকের মত সে মা এর চোখ মুছিয়ে দিল।

ঠিক সেই সময় শোনা গেল পাগল করা ঢাকের আওয়াজ।পাড়ার মন্ডপে চলে এসেছেন মা দূর্গা।আজ মহাষষ্ঠী।

টুয়া বলল,''-মা,আজ কিন্তু সকালে পড়বনা।আমি মন্ডপে যাচ্ছি।সে দৌড়ে মন্ডপের দিকে চলে গেল।

সারা আকাশ তখন ভেসে যাচ্ছে থৈ থৈ আলোর সমুদ্রে।ওদের উঠোনটা ভরে গেছে শিউলির সৌরভে।মাইকে ভেসে আসছে দেবব্রত বিশ্বাসের ব্যারিটোন-'আলোকের এই ঝর্না ধারায় ধুইয়ে দাও..ধুইয়ে দাও...'.

#positiveindia


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational