নরসিংহম ও হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ
নরসিংহম ও হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ
বিশাখাপত্তনম নাকি পেটের অসুখের এক আদর্শ জায়গা।প্রত্যেকেরই নাকি কমবেশি এই অভিজ্ঞতা আছে।অতএব ব্যাগ গোছানোর সময় সবার আগে যেটা নেওয়া হয়েছিল সেটা হল জিওলিন।
সকালে বেরোনোর সময় একটা আলাদা ব্যাগে জিওলিন,দুটো জলের বোতল,দুটো ছাতা,একটা রেনকোট-এসব নিয়ে হোটেল থেকে রামকৃষ্ণ বিচের উদ্দেশে বেরোলাম।হোটেলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটি অটো আর সেখানে গভীর ভাবে নিদ্রারত এক বৃদ্ধ তেলুগু অটো চালক।ব্যাগটিকে পিছনের ডিকিতে রেখে সাতজন ঠেসাঠেসি করে বসলাম।
মিনিট দশেক বাদে রামকৃষ্ণ বিচের কালীমন্দিরের সামনে অটো এসে থামল।আমরা দীর্ঘদিন বাদে সমুদ্র দেখব বলে সাততাড়াতাড়ি অটো ভাড়া দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটছি, এমনসময় আমার খেয়াল পড়ল ব্যাগটি অটোর পিছনে ফেলে এসেছি।
এইবার আমার চিৎকারে বাকিদের খেয়াল পড়ল তারাও আমার মতই ব্যাগটির কথা বেমালুম ভুলে গেছে।এবার শুরু হল পারস্পরিক দোষারোপ।কেউ নিজের দোষ স্বীকার করবেনা।প্রত্যেকেই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।
আমাদের ঝগড়া শুনে অটোচালকরা দৌড়ে এল৷সব শুনে বলল-যদি স্ট্যান্ডের অটো হয় তাহলে তারা দেখবে,সেক্ষেত্রে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ছাতা,রেনকোট,জলের বোতল গেছে তো গেছে কিন্তু জিওলিন এখানে পাই কোথায়?
কাছের একটি ওষুধের দোকানে খোঁজ করলাম--নেই।আমাদের সমুদ্র দেখা তখন মাথায় উঠেছে।অতএব আরেকটি অটো জোগাড় করে ওষুধের দোকানে দোকানে ঘুরতে লাগলাম কিন্তু জিওলিনের হদিস পেলামনা।এখানকার মানুষ জিওলিন ব্যবহার করেনা।কোনো ডাক্তার জিওলিন প্রেসক্রাইব করেনা।আমরা অটোতে চেপে ভাইজ্যাগেের এমাথা থেকে ওমাথা চষে বেড়াতে লাগলাম একটা জিওলিন কেনার উদ্দেশে।কোনো জিনিষ না পাওয়া গেলে সেটা পাওয়ার জন্য মানুষের এক দুর্নিবার জেদ চেপে যায়।রেনকোট ও ছাতাদুটিও আমার মেয়ের খুব প্রিয় ছিল।এদিকে পারস্পরিক দোষারোপের বিরাম নেই।দু জোড়া দম্পতি এবার অতীতে কে কিরকমভাবে কাকে ডুবিয়েছে সেই ইতিহাস ব্যক্ত করে চলেছে।ঝগড়া এবার ব্যক্তিগত আক্রমনের রূপ নিয়ে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।দাম্পত্যের ভিতরের খানাখন্দ এবার ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে চাইছে।কে কতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন তার একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যানালিসিস চলছে।বাবা মায়েদের ঝগড়া দেখে বাচ্চারা মাঝে মাঝে স্টপ স্টপ অথবা কাম কাম(calm) করছে কিন্তু বড়রা তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছেনা।
অবশেষে সম্পূর্ণ বিফলমনোরথ হয়ে হেরে যাওয়া মানুষের মত হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।দরকার নেই আর সমুদ্দুর দেখে।
হেরে যাওয়া ক্লান্ত সৈনিকের মত অটো থেকে নেমে আমরা হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম।
এ কী! কে দাঁড়িয়ে!সকালের সেই বৃদ্ধ অটো চালক না!মিশকালো গায়ের রঙের কপালে তিলক কাটা নোংরা জামাপ্যান্ট পরা ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলা গুঠকা খাওয়া লাল রঙের দাঁত বের করা তেলুগু-ভাষী নরসিংহম রাজু দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঠিক আমাদের হোটেলের সামনে,হাতে আমাদের সেই বহু মূল্যবান ও বহু প্রতীক্ষিত ব্যাগটি।
আমরা এবার দুদ্দাড় করে লোভী মানুষের মত হাত পা ছুঁড়ে ছুটে গেলাম।সেই ভীষন গরীব অথচ অত্যন্ত ধনী মানুষটি আধা তেলুগু আধা হিন্দিতে যা বললেন তা হল-অনেকক্ষন অপেক্ষা করছি,দেখে নিন সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
মানুষটির মুখের অনাবিল হাসি দেখে মনে হচ্ছিল নেওয়ার আনন্দের চেয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দ বোধহয় অনেক বেশি।