একা এবং কয়েকজন
একা এবং কয়েকজন


একটা শিরশিরে ভাললাগা চৈতালী র কপাল থেকে নেমে এসে স্তনবৃন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল।সুমন্ত হোয়াটসঅ্যাপে লিখে পাঠিয়েছে-
আকাশ যেখানে সবুজ মেঘের খামে,বর্ষার চিঠি পাঠায় তোমার নামে/সেইখানে হবে দেখা,তোমার সঙ্গে একা-
চৈতালী জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।রাতের অবগুন্ঠন ত্যাগ করে সাদা চাদর গায়ে জানলার পাশে উবু হয়ে বসে রয়েছে শীতকাল।এইসময় টা দিনের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র।চৈতালীর আর ঘুমোতে ইচ্ছে করছেনা।সে মোবাইলে সরোদ চালিয়ে দিল,শুনতে লাগল ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের আহিরভৈরোঁ রাগ।
চৈতালী একজন কবি।সে একটি সরকারি চাকরি করে ঠিকই কিন্তু তার বেঁচে থাকা কবিতাকে অবলম্বন করে।দু বছর আগে তার বিয়েটা যখন ভেঙে যায় তখন সে চুড়ান্ত হতাশ হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল কবিতায়।সে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেয়েছিল।আজ অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন ও ই পাবলিকেশনে চৈতালীর কবিতা বেশ সম্মানের সঙ্গে গৃহীত হয়।এবার সে বই বের করার কথা ভাবছে।এখন প্রকাশনীর সুদীপ সেন এর সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটাকে ফাইনাল করতে হবে।
বছর চল্লিশের সুদীপ সেনের ফরসা রঙে, কালো ফ্রেমের চশমায়,নিখুঁত ভাবে ছাঁটা গোঁফে ও ঢেউ খেলানো চুলে একটা সম্ভ্রান্ত অভিজাত ভদ্রলোক মার্কা ব্যাপার থাকা সত্ত্বেও লোকটার সামনে একা যেতে চৈতালীর একটা আলগা অস্বস্তি হয়।
সুদীপ সেন চৈতালী কে দেখলে যেন মোমের মত গলে যেতে থাকে।
চৈতালীর মনে হল বাবানের মা অসুস্থ না থাকলে বাবান কে নিয়ে যাওয়া যেত।
প্লিজ কাম.আপনার জন্যই ওয়েট করছি.আমাদের একটা মিটিং আছে আজ.আমাকে আবার প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে জানেনতো.
কাল রাতে 'দিনকালে' বেরোনো আপনার কবিতাটা পড়ছিলাম.'নীল নির্জনে'.কবিতাটা মন কে এমনভাবে ছুঁয়ে গেল.এমনই ধাক্কা দিল..সারারাত আর ভাল করে ঘুমই এলোনা-..যাই বলুন প্রেমের কবিতায় ছন্দের একটা বড় ভূমিকা আছে.আর.আপনার মধ্যে একটা ছন্দময় মন আছে-
-থ্যাঙ্ক ইউ সুদীপ দা-আমার কিন্তু আপনার কাছে একটা আবদার আছে..মানে এ লাইনে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে তো সেভাবে চিনিনা..তাই আপনার কাছেই .
প্লিইজ বলুন-
সুদীপ টেবিলের উল্টোদিক থেকে উঠে এসে চৈতালী র পাশে দাঁড়ালো-
বলুন-
আমার পঞ্চাশটা কবিতা নিয়ে একটা বই বের করব ভাবছি..আপনার এখন প্রকাশনী থেকে-
সুদীপ একদৃষ্টে খানিকক্ষন তাকিয়ে রইল চৈতালী র দিকে...সেই দৃষ্টিতে রয়েছে এক অপার মুগ্ধতা-
সুদীপ নিজের ডানহাতের করতল চৈতালীর চিবুকের সামনে মেলে ধরল.তারপর খানিকটা পজ নিয়ে অস্ফুটে বলল--------দিন
চৈতালী র বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল-
কী চাইছে সুদীপ?সে তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে হাত সরিয়ে নিল-
তারপর ভয়ে ভয়ে বলল-কি দেবো?
সুদীপ এবার হাসতে হাসতে বলল-আপনার কবিতাগুলো দিন..পড়ে দেখি..তারপর তো সিলেকসন-আপনার কথা আমি কী ফেলতে পারি!
-মানে ..কবিতাগুলোতো সবকটা এখন নেই..আমি...
-আমারও এখন সময় নেই..আপনি কাল দুপুরে আমার বেহালার ফ্ল্যাটে একবার আসুন..কবিতাগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে একটা দীর্ঘ আলোচনা দরকার.ওখানে কেউ ডিসটার্ব করবেনা-
বাবান চৈতালীর ক্লাসমেট ছিল।বাবানের মধ্যে একটা চোদ্দ পনেরো বছরের কিশোর এখনও লুকিয়ে আছে।মাঝখানে অনেকদিন বাবানের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিলনা,তারপর ফেসবুকের মাধ্যমে আবারও বন্ধুতা দৃঢ় হয়েছে।বাবানের মধ্যে এমন একটা সহজ ব্যাপার আছে যে ওর কাছে মনের সবকথা নিঃশঙ্কোচে বলা যায়।বাবান এমন একজন পুরুষ যার সঙ্গে চৈতালীর এক নির্মল ইনোসেন্ট হৃদ্যতা আছে,যে সম্পর্কের মধ্যে প্রেমের বা শরীরের আঁশটে গন্ধ নেই।বাবান দরকারে অদরকারে চৈতালীকে সাহায্য করে,সঙ্গ দেয়।বাবানের প্রতি চৈতালীর একটা কৃতজ্ঞতা আছে।
"ইচ্ছে করে কোলে মার্কেট বা গড়িয়াহাট থেকে কতগুলো ডাঁসা ডাঁসা পুরুষ কিনি/পুরুষগুলোকে ধীরে ধীরে নগ্ন করি একের পর এক/ ওদের তছনছ করার পর সপাটে এক লাথি কষিয়ে বলি-যাঃ শালা!"
কবি তন্দ্রা দে চৈতালীর মুখের দিকে তাকালেন-কেমন হয়েছে?
তন্দ্রা একজন সিনিয়র নারীবাদী কবি।তার প্রতিটি লেখাতে ঝরে পড়ে তীব্র পুরুষ বিদ্বেষ।
তন্দ্রা বললেন-কী জানিস,পুরুষরা দিনের পর দিন আমাদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করেছে,তাই একটা প্রতিশোধ নিতে না পারলে আমার শান্তি হয়না।আমি পুরুষকে পণ্য হিসেবে দেখতে চাই।
তুই তো আমারই মত ডিভোর্সি..একা থাকিস..আমারই মত কোনো পিছুটান নেই..চল্ আজ রাতে তোকে একটা ছেলে কিনে দি..এনজয় কর-
চৈতালীর অত শরীরের নেশা নেই।সে বলল-না বাবা, ভয় লাগে-
তন্দ্রার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই কিন্তু এখনও তার শরীরের নেশা যায়নি।তন্দ্রা ইন্টারনেট ঘেঁটে আঠাশ বছরের একটি হ্যান্ডসাম ছেলেকে রাতের জন্য ভাড়া করলেন।
তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন-
তুই সত্যিই একা থাকিস?
-হুম
-কিন্তু এইসময় তো একা থাকবার কথা নয়...তোর কত জন পুরুষবন্ধু?..আই মিন অ্যাডমায়ারার?
চৈতালী লজ্জা পেয়ে গেল।সে তার গোপন ভাললাগার কথা চট করে কাউকে বলেনা।কিন্তু সব কথা বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখতে রাখতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে,একটা মানুষ নেই যার কাছে সব কথা বলা যায়।সে ফিসফিস করে বলল-
-একজন আছে.কবিতা লেখে.আমার সঙ্গে কবিতা নিয়ে কথা হয়.গল্প হয়.আমাকে ইন্সপায়ার করে.আমাদের মনের মিল হয়.কিন্তু ও ম্যারেড..যা করে সবটাই বাড়িতে লুকিয়ে.
আরেকজন আছে. অ্যাডমায়ার করে.একটা বিগ হাউজের পাবলিশার.একটু এজেড.আমার একটা কবিতার বই পাবলিশ করবে বলেছে..আমাকে কালকে ওর ফ্ল্যাটে ডেকেছে.দুপুরে.একা-
আর আমার এক ছোটোবেলার বন্ধু আছে..জাষ্ট বন্ধু..ওর কাছে আমি সব কথা শেয়ার করতে পারি..সঅঅব..ওর সঙ্গ আমাকে নিশ্চিন্ত করে..আমাদের দুজনের কারো কাছেই কারো কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই-
তন্দ্রা সিগারেটটা অ্যাষ্ট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বললেন-প্রথম দুটো লোককে আমি খুব ভাল চিনি কিন্তু শেষের ছেলেটাকে ঠিক চিনতে পারলামনা..আমার জীবনে এমন কেউ আসেনি,এই ছেলেটাকে আরো একটু ভাল করে চেন্-
তবে মনে রাখিস যার কাছে তুই কিছু প্রত্যাশা করিসনা সেই তোর আসল সুহৃদ-
চৈতালী ফিরে এসেছে নিজের ফ্ল্যাটে।বাইরে নেমে এসেছে শীতের ক্লান্ত বিকেল।সে বাবান কে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।এখন আর বাবানের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভাললাগছেনা।এইসময় সুমন্ত কে পেতে ইচ্ছে করছে।সুমন্তর মধ্যে এমন একটা উত্তাপ আছে যা বাবানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়না।
চৈতালী সুমন্ত কে ফোন করল-
-ব্যস্ত?
-কেন
-প্লিজ একবার এসো..তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে.. খুউব-
-না.আজ হবেনা.বাচ্চাটার শরীরটা.এখন রাখছি-
চৈতালীর সমস্ত শরীর জুড়ে হঠাৎ এক তীব্র রাগ হল।কোনো দুঃখ বা অভিমান নয় শুধুই এক তীব্র রাগ।অন্য কারো উপর নয় ,শুধুমাত্র নিজের উপর।
চৈতালীর মনে হল ভালবাসা শব্দটা আসলে একটা চার অক্ষরের গালাগালি ছাড়া আর কিচ্ছুনা।আসলে পুরুষ আর নারীর মধ্যে কখনও ভালবাসা হয়না।কোনো একজন মানুষ কেও তার সবটা নিয়ে ভালবাসা যায়না।মানুষ আসলে নিজেকে ছাড়া কখনও কাউকে ভালবাসেনা।
মানুষ আসলে একা একা সারাজীবন শুধু নিজের সঙ্গে প্রেম করে যায়..বাথরুমের আয়নায় যে নগ্ন শরীরটাকে সে রোজ দেখে প্রেম আসলে তারই সঙ্গে..কয়েকজন আসে শুধু সেই প্রেম কে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।
#love