মহাসিন্ধুর ওপার থেকে-
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে-
মৃত্যুর সময় মানুষ কী বুঝতে পারে যে এবার তাকে সব বাঁধন কাটিয়ে চলে যেতে হবে?তার অভিনয় জীবন শেষ!এবার সে যাত্রা করবে তার নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানায়!
নাঃ,সবাই বোধহয় পারেনা।অনেকেই বিনা নোটিসে দুম করে চলে যায়।আমার বাবা কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন।বাবা এমনিতে সুস্থ সবল থাকলেও একদিন রাতে বাথরুমে যেতে গিয়ে পড়ে গেলেন।বাবা ছিলেন সংসারে সবার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া মৃদুভাষী বিনয়ী একজন মানুষ।বাবার হৃদয়ে আমাদের জন্য ছিল একসমুদ্র ভালবাসা।বাবা চাইতেন সংসারে সবাই হাসিমুখে থাকুক।তিনি পারস্পরিক ফাটলগুলোকে মেরামত করে গেছেন সারাজীবন।
বাবা সেই যে পড়ে গেলেন আর উঠলেন না।ডাক্তার বলল ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়ে বডি পার্টসগুলোকে অস্বাভাবিক দ্রুততায় নষ্ট করে দিচ্ছে।পড়ে যাওয়ার দুদিনের মাথায়
কোমায় যাওয়ার ঠিক আগে আচ্ছন্ন অবস্থায় বাবা বললেন,-'' খবরের কাগজটা দে,কাগজটা পড়া হয়নি।''
একটা কাগজ এনে দিতেই বাবা কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে রেখে দিলেন।
খানিকটা ঠাট্টার সুরেই বললাম,-''কী খবর পড়লে বাবা?''
বাবা জলভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন,-'আমার মৃত্যুর খবর'-
এর ঠিক একদিন বাদেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান।
বাবার মৃত্যু আমাকে বড় অসহায় করে দিল।এই পৃথিবীতে বাবা-ই ছিলেন আমার সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু,আমার স্বজন।বাবার কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে আমি নিজেকে উজাড় করতে পারতাম না।আমার মনে হতে লাগল আমি অনাথ হয়ে গেছি।
বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি শেষ করেই অফিসের কাজে কামরূপ এক্সপ্রেস ধরে যাচ্ছি গৌহাটি।মন তীব্র পিতৃশোকে ভারাক্রান্ত।
কুচবিহার স্টেশনে এসে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল।কি কারন জানতে পারলাম না।পেটে খিদের জ্বালায় নাভিশ্বাস উঠছে।একসময় ট্রেনের আলো নিভে গেল।ভাবলাম -যাই, বাড়ি ফিরে যাই।মনের মধ্যে কু'ডাক ডাকছে,মনে হচ্ছে কোনো বিপদে পড়ব।বহুক্ষন অপেক্ষার পর ট্রেন চলতে শুরু করল।এক তমসাঘন পথ ধরে যেন এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে।এইর
কম প্রায় তিনচার ঘন্টা চলার পর একসময় আলো দেখতে পেলাম।আলোয় আলোয় ভরে রয়েছে ফকিরাগ্রাম স্টেশন। আর ভয় নেই।ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। দেখলাম আগের ট্রেনটি একেবারে ভস্মীভুত হয়ে গেছে।অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন।অথচ এই ট্রেনটিতেই প্রতিবার আসি,এবারও টিকিট কেটেছিলাম,নেহাত বাবা মারা যাওয়ার জন্য ক্যানসেল করেছি।
এবার স্টেশনে বেশ কিছু মানুষ নেমে যেতে লাগলেন।আমি নামব না,আমাকে যেতে হবে আরো অনেকটা পথ।আমি নিস্পৃহ দৃষ্টিতে মানুষের নেমে যাওয়া দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ দেখলাম আমার বাবা ট্রেন থেকে নামছেন।নামার আগে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।যেন বিদায় নেওয়ার আগে আমাকে অভয় দিয়ে গেলেন।যেন বলে গেলেন-নিশ্চিন্তে যা,আর ভয় নেই৷যেন বলে গেলেন-চললাম রে,সাবধানে থাকিস। চমকে উঠলাম,চিৎকার করে ডেকে উঠলাম,-''বাবা!''
আমি রূদ্ধশ্বাসে ট্রেন থেকে নেমে সেই লম্বা,ফর্সা,ঋজু মানুষটির উদ্দেশ্যে প্লাটফর্ম ধরে ছুটতে লাগলাম।কিন্তু মানুষের ভিড়ে কিছুতেই তাকে ধরতে পারলাম না।আমি প্রাণপনে ছুটোছুটি করতে লাগলাম আলোআঁধারি প্লাটফর্মের এদিক থেকে ওদিক।একসময় ট্রেন ছাড়ার সিগনাল দিল।আমি হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলাম।
আকাশে তখন শুরু হয়েছে আলোর অভিষেক।
আমি কেমন যেন ধাঁধায় পড়ে গেলাম।এটা কি হ্যালুসিনেশন নাকি সত্যিই বাবা কে দেখলাম!
গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল এক অসহায় নিরুচ্চার কান্না।
আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল আমি বাবাকেই দেখেছি।বাবা আমায় বিপদ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন এতক্ষন।তারপর আমায় বিপন্মুক্ত করে পাড়ি দিলেন অনন্তযাত্রায়।
বাবা কে তারপর আর কখনও দেখতে পাইনি।তবু যখন বিপদে পড়ি,যখন দিশাহীন হয়ে পড়ি,মনে হয় আমি ঠিক এই বিপদ কে কাটিয়ে উঠবো৷আমার পাশে বাবা আছেন।
পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে দুম করে চলে যাওয়া কী অতই সহজ!
(এই অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি ঘটেছিল আমার বন্ধু শ্রী অতনু নাগ এর জীবনে।তার মুখ থেকে শুনেই গল্পটি লেখা)